বাংলা বর্ষপঞ্জি : নতুন ও পুরাতন নিয়ম

Reading Time: 3 minutes

 

 

এক.
বাংলা বছর হচ্ছে সৌর-বছর ৷ আমাদের আছে ( ছিল) সূর্যের আবর্তনের নিয়মে গড়া বৈচিত্র্যপূর্ণ এক সমৃদ্ধ সৌর-পঞ্জিকা; যেখানে প্রকৃতির ভোরেই ঠিক ঠিক পঞ্জিকার দিন শুরু হয় ৷ কোন মাসে কত দিন- সে প্রশ্নেও এ পঞ্জিকা খ্রিষ্টপঞ্জির ‘থার্টি ডেজ হ্যাভ সেপ্টেম্বর’-এর মতো কোনো ছড়া-ছক মেনে চলে না ৷ চলে প্রকৃতির ব্যাকরণে, মহাবিশ্বের খেয়ালে ৷ খ্রিষ্টীয় ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অধীনস্থ বাংলা একাডেমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে একটি কমিটি করে এই অসাধারণ বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলা সনকে অদ্ভুত ছকে ফেলে হাস্যকরভাবে সরল করে ফেলে ৷

দুই.
বৈচিত্র্যপূর্ণ সনাতন সৌর-পঞ্জিকাকে বদলে গড়া বাংলা একাডেমির নতুন বঙ্গাব্দের অদ্ভুত ছক :
বছরের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ থেকে ভাদ্র) হবে ৩১ দিনের এবং বাকি সাত মাস (আশ্বিন থেকে চৈত্র) সাধারণভাবে ৩০ দিনের বলে গণ্য করা হবে।
প্রতি চতুর্থ বছরে (অধিবর্ষে) একটি অতিরিক্ত দিন থাকবে ৷ খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকার ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝে পড়ায় ফাল্গুন মাসেই ওই অতিরিক্ত দিনটি যোগ হবে ৷
খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকার দাসত্ব করে ২৯ দিনের ফেব্রুয়ারিতে পড়া ফাল্গুনটাই হবে ৩১ দিনের ৷ অর্থাৎ গ্রেগরিয় লিপ ইয়ারের দেখাদেখিই চলবে বাংলা অধিবর্ষ ৷ সূর্যোদয়ে নয়; পশ্চিমের নিয়মে বাংলা পঞ্জিকাতেও মধ্যরাতে (রাত ১২টা ০১) দিন শুরু হবে ।

তিন.
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বের সেই কমিটি বৈচিত্র্যপূর্ণ সনাতন সৌর-পঞ্জিকাকে সংস্কারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে- “বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনের অযৌক্তিক কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে”৷ কমিটির প্রস্তাবনা অনুযায়ী ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অধিনস্থ বাংলা একাডেমি বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিন এবং শেষের সাত মাস ৩০ দিন ধরে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করে ৷ পাকিস্তান আমলে গঠিত সেই ছকে-বাঁধা বাংলা পঞ্জিকার চর্চা কিন্তু শুরু হয় স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেই ৷ স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ওই অদ্ভুত প্রকৃতিবিরুদ্ধ পঞ্জিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর হয়; আর আমরা পেয়ে যাই জোড়ায় জোড়ায় পহেলা বৈশাখ, এগারোই জৈষ্ঠ্য বাইশে শ্রাবণ, পৌষ পার্বণ, চৈত্র সংক্রান্তি ।

চার.
বাংলা বর্ষপঞ্জির ব্যবহার কেবল রাষ্ট্রীয়ভাবে দিন গণনা আর পহেলা বৈশাখের মতো জাতীয় উৎসব উদযাপনের মধ্যে সীমিত নয়; এর সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির নানা পার্বণ, লোকাচার আর উৎসবের ঐতিহ্য ৷ ক্ষণ-গণনাকে সরল করার যুক্তি দেখিয়ে একটি নিছক প্রাতিষ্ঠানিক/ রাষ্ট্রীয় সংস্কার তাই প্রতিষ্ঠানবিরোধী বাঙালির লোক-জীবনের আচার-বিশ্বাসকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি ৷ পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, চৈত্র সংক্রান্তির মতো আয়োজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে সংশোধিত পঞ্জিকা অনুসরণ করলেও, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির সাথে যুক্ত নানা লোকাচার পালনের ক্ষেত্রে আবহমান প্রথা অনুযায়ী এখনো সেই সনাতন পঞ্জিকাকেই মেনে চলেন এদেশের মুসলমান-হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের ও নৃগোষ্ঠীর অসংখ্য মানুষ ৷ তাছাড়া পার্শ্ববর্তী ভূখণ্ডের বাঙালি জনগোষ্ঠীও যথারীতি ওই সনাতন পঞ্জিকাই ব্যবহার করে চলেছেন ৷

পাঁচ.
স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কারের ছকে বাঁধা নতুন পঞ্জিকা চালু হলে, একই সাথে দু-দুটি পৃথক পঞ্জিকার অস্তিত্বের ফলে বাঙালির বৈশাখ-ফাল্গুন বরণ, বিভিন্ন লোকাচার পালনের পাশাপাশি বাংলা মাসের বিভিন্ন বিশেষ দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রেও নানা বিভ্রান্তি দেখা দিতে শুরু করে ৷ হাস্যকরভাবে পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গে আলাদা আলাদা দিনে পালিত হতে দেখা যায় রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর মতো আয়োজন।

ছয়.

১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদুল্লাহ্ কমিটির সুপারিশক্রমে সংস্কারকৃত বর্ষপঞ্জি চালুর পরে ভিন্ন ভিন্নভাবে দুই দফা এর সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রথমবার ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাস্কফোর্স “চৈত্রের পরিবর্তে ফাল্গগুনকে অধিবর্ষের মাস নির্ধারন”-সহ ২০ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে তারপরেও থেকে যাওয়া অসঙ্গতি দূর করা এবং জাতীয় দিবসগুলোকে মূলানূগ করার উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের নেতৃত্বে গঠিত আরেকটি কমিটি “বছরের প্রথম ৬ মাসকে (বৈশাখ-আশ্বিন) ৩১ দিন, কার্তিক-মাঘ ও চৈত্র মাসকে ৩০দিন এবং ফাল্গুনকে ২৯ দিন ধরা’-সহ কিছু সুপারিশ পেশ করে। ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমির সভায় সেই সুপারিশগুলো গৃহীত হলেও আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতায় তা আর বাস্তবায়ন করা হয়ে ওঠেনি।

সাত.
আমরা যারা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, মরে-পচে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই আমাদের ভালোবাসার বাংলাকে; তাদের প্রায় সবাই দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মিলনের, ঐক্যের গুরুত্বকে উপলব্ধি করতে পারি ৷ মুখে ঐক্যের কথা বলে দুই বাংলা একই বর্ষপঞ্জিকে দুই রকম করে ব্যবহার করলে সাংস্কৃতিক মিলন কেবল ধারণাতেই সীমিত থাকবে বলেই মনে হয় ৷ অভিন্ন বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা ও চর্চার স্বার্থে, আদিবাসীসহ বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির বাংলা পঞ্জিকাশ্রিত লোকাচারকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, বাঙালির দিন গণনার এই বিভ্রান্তির অবসান ঘটাতে আমাদের তাই মূল পঞ্জিকাকে ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই ৷

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>