| 8 মে 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প এই দিনে গল্প সাহিত্য

একজন মাননীয় প্রাক্তন মন্ত্রীর মৃত্যু

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

আজ ২৭ অক্টোবর গল্পকার নাওয়াল আল সাদাবি’র শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত মিশরীয় লেখক নাওয়াল আল সাদাবির গল্প  “The Death of His Excellency, The Ex-Minister” এর অনুবাদ করেছেন নাহার তৃণা ‘একজন প্রাক্তন মাননীয় মন্ত্রীর মৃত্যু’ শিরোনামে। গল্পটিকে একেবারে হুবহু আক্ষরিক অনুবাদ বলা যাবে না হয়ত।


ছোটবেলায় যেভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে সেভাবে আরেকটা বার আমার মাথার উপর তোমার হাতটা রাখো না মা। তুমি ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কে আছে আমার। দীর্ঘ কুড়িটা বছর তোমার খোঁজ খবর রাখতে ব্যর্থ এই সন্তানের প্রতি তুমি কখনও অভিযোগের আঙুলটা পর্যন্ত তোলোনি। তবে তুমিই একমাত্র ব্যক্তি নও মা, যার কাছ থেকেই আমি শুধু দূরে থেকেছি, কর্মব্যস্ততার ঘোরে আমি এতটাই ডুবে ছিলাম যে নিজের চারপাশের পৃথিবী, এমন কী নিজের দিকেও ঠিক মতো তাকানোর ফুরসত মেলেনি আমার। স্ত্রী বা ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গও যোগ্য দাম পায়নি। নিজের কন্যা সন্তানের জন্যও আমার কোনো সময় বরাদ্দ ছিলো না। কাজের ব্যস্ততা নিয়ে বাইরে যাবার সময় আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বটিকে এক ঝলক দেখে নিয়েছি হয়ত, তাও শুধু গলার টাইটা ঠিকঠাক বাঁধা হলো কিনা, কিংবা স্যুটের সাথে মানানসই শার্টটা পরেছি কিনা সেটা যাচাইয়ের ছুতোয়।

আমার কখনও মনে হয়নি মা, তুমি তোমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করো আমিও সেই পৃথিবীটাতেই বাস করছি। মরে না গিয়েও অন্য একটা জগতে চলে যাওয়া কী আদৌও সম্ভব কারো পক্ষে? ফলাও করে ছাপানো পত্রিকার শ্রদ্ধাঞ্জলি ছাড়াই আমি মরে গেলাম, সেটা হয় নাকি? কেননা, আমার মতো মহান মন্ত্রীরা যখন মৃত্যবরণ করেন তাদের শোকে দেশব্যাপী শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রকাশ পাওয়াটাই রীতি। সেসব রীতি রেওয়াজ ছাড়াই আমি মরে যাবো, তাও কী হয়! একটা আড়ম্বরময় শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সারি সারি শোকাতুর মানুষের উপস্হিতি ঘটবে তবেই না সেটা মানানসই হবে। সে অনুষ্ঠানে উপস্হিতদের প্রথম সারির মাঝখানটাতে রাষ্ট্রের প্রধান ক্ষমতাশালী পুরুষটিরও উপস্হিতি ঘটবে, অনুষ্ঠানের জন্য মানানসই শোকের কালো পোশাক, কালো টাই আর কান্না লুকানোর জন্য তার চোখে থাকবে কালো চশমা। এধরনের দৃশ্যগুলো আমার মধ্যেও ঘোরগ্রস্হ একটা আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে, যে মৃত্যুর পর আমিও নিথর শরীরে দামী কফিনে শুয়ে থাকবো আর শোকগ্রস্হ লোকজন আমার দেহটা সশ্রদ্ধায় কাঁধে তুলে নেবে। তবে মনকে কখনও এ প্রশ্নটা করতে সাহস পাইনি, মেকি শোকের মাতম বিনা নিখাদ সমবেদনা পাওয়ার মতো কোনো নজির কী আদৌ আমি রেখেছি!

তোমাদের পৃথিবী থেকে আজ আমি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি মা! আর এই বাস্তবতা আমার শরীর-মনের পক্ষে বহন করাটাও একটা ভারী বোঝার মতো। কাজের ক্লান্তিতে কখনও কখনও আমার যখন শরীর ভেঙে পড়তে চায়, আশ্চর্যজনকভাবে মন তখনও তৎপর হয়ে কাজের চিন্তায় ডুবে থাকে। অন্যদিকে, মাঝে মধ্যে মনটা কেমন যেন বিগড়ে যায়। কোনো কাজে সে আর তখন শরীরের সঙ্গ দিতে চায় না, অথচ শরীরটার তখন শতেক কাজের ব্যস্ততায় ছুটোছুটিতে ব্যস্ত থাকার সময়, ব্যস্ততায় তাকে তখন অফিসে ছুটতে হয়, সভা বা সম্মেলনে সভাপতিত্ব করা, বিমান বন্দরে অতিথিদের সাদর অভ্যর্থনা জানানো, পার্টিতে অংশ নেয়া অথবা উচ্চ পর্যায়ের মিশনে বিদেশ ভ্রমণে ছুটে মরতে হয়, অথচ মন দূরেই থাকে সঙ্গ দেয় না।

এই ব্যাপারটা আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করে, যখন দেখি আমার শরীর মনের সচেতন যুগলবন্দী ছাড়াই সব কিছু করে যাচ্ছে। এরকম ঘটনা আমাকে বেকায়দায় ফেলে, বিশেষ করে সেইসব পরিস্হিতিতে আমি অতিমাত্রায় উদ্বিগ্নবোধ করি, যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় আমার উপস্হিতিই শুধু নয় একই সাথে প্রয়োজন হয় আমার অখণ্ড মনোযোগেরও। কিন্তু মন তো সেসময় সঙ্গ দিতে নারাজ। আমার কাছে কেবলমাত্র মহামান্য প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিসমৃদ্ধ সভাটিই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।  যখন থেকে আমি সরকারি উচ্চপদস্হ হিসেবে কাজ শুরু করেছি, তখন থেকেই অন্যের অধীনে কাজ করার ব্যাপারে আমার ব্যাপক বিতৃষ্ণা ছিলো। তবে আমার উর্ধ্বতনদের প্রতি জন্ম নেয়া তীব্র বিদ্বেষ লুকানোর ব্যাপারে আমি ভীষণ তুখোড় ছিলাম বলতে পারো। সেসব লুকানো বিদ্বেষই হয়ত আমি আমার রাগের প্রকাশ হিসেবে নিজের অধস্হন কর্মচারি আর বাড়িতে স্ত্রীর উপর ঢেলে দিতাম, যেমনটা আমার বাবা ঢালতেন তোমার উপর।

কর্মক্ষেত্রে উর্ধ্বতনদের সামনে আমি কখনই নিজের উষ্মা প্রকাশ করিনি, সে সাধারণ পর্যায়ের কর্মকর্তা হোক কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান হোক। সাধারণত চেয়ারে বসে থাকলেও আমার শরীর ও মন সর্তক অবস্হায় নিজের দক্ষতার প্রতি যথেষ্ট যত্নবান থাকতো। সর্বক্ষণ একটা ভয় আমাকে তাড়া করে ফিরতো হয়ত তিনি আমাকে কোন প্রশ্ন করবেন আর আমি তার উত্তরটা দিতে ব্যর্থ হবো। যদিও উত্তরটা আমার জানা, কিন্তু তবুও কেমন এক ভয়ে নিরন্তর আমি ভীত থাকতাম, মরিয়া হতাম যথার্থ উত্তরের জন্য, ভয় হতো নিজের জানা উত্তরটা হয়তবা অপরিহার্য উত্তর নাও হতে পারে।

আমাদের রাজনীতির প্রথম শিক্ষাটি হলো এখানে সঠিক উত্তরটি তেমন প্রয়োজনীয় নয়, বরং প্রয়োজনীয় উত্তরটিই সবসময় সঠিক বলে বিবেচিত হয়। একজন মন্ত্রী হিসেবে যে কোনো অশুদ্ধ তথ্যের স্তুপ থেকে সত্যের নির্ঝাস খুঁজে বের করার জন্য আমাকে আপাদমস্তক সতর্ক থাকতে হতো।

এটা খুব কঠিন কাজ ছিলো। আমি কোনো সভায় অংশ নিলে আমার বামহাতকে কোলের উপর অনড় অবস্থানে রেখে ডানহাতকে টেবিলে কাগজের উপর রাখতাম। আমাকে যে কোনো দৈবাৎ নড়াচড়া, অদৃশ্য মাথা নড়া, হাতের আঙুলের গোপন ইশারা কিংবা নীচের ঠোঁটের সামান্যতম কুঞ্চন অথবা নাক, চোখ, মুখের মাংসপেশীর সুক্ষ্ণ পরিবর্তন ইত্যাদির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হতো। আমি যে কোনো বেচাল ঘটনা আগ থেকে বুঝে ফেলতাম। আমার বুদ্ধিবৃত্তি এত প্রখর ছিলো যে আমি দ্রুততম উপায়ে যে কোনো ঘটনার উৎসমুখ সনাক্ত করতে পারতাম। আমার সেরা দিনগুলোতে আমার চোখ-কান শিকারি বাঘের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষিপ্র ছিলো। ঠোঁটের ওঠানামা দেখেই বুঝে ফেলতাম কোন শব্দটি উচ্চারিত হতে যাচ্ছে।

চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে আমার শরীর মন আত্মা সবকিছু যেন একসুতোয় গেঁথে একটি সংবেদনশীল স্নায়ুতন্ত্রে পরিণত হতো। উন্মুক্ত রাডারের মতো এরা পরস্পরের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়তো। আমার মস্তিষ্ক, বাহু, বক্ষদেশ এবং উদর এমনভাবে কাঁপতো যেন এর ভেতর দিয়ে নিরন্তর বৈদ্যুতিক প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। যখনই আমি মহামান্য প্রেসিডেন্টের পাশে দাঁড়াবার সুযোগ পেতাম তখন আমার ডানহাত এমনভাবে থরথর করে কাঁপতে থাকতো যে বাম হাত দিয়ে ধরে রেখেও সামাল দেয়া যেত না। আমার দুই হাত বুক কিংবা পেটের উপর কোনাকুনি ভাঁজ করে রাখতাম। বসে বা দাঁড়িয়ে যাই থাকি না কেন আমার দুই পা পরস্পরের সাথে এমনভাবে সেঁটে থাকতো যেন আমি এক লজ্জাবতী কুমারী।

প্রেসিডেন্টের পাশে দাঁড়ানো একটি ছবি আছে আমার। আমাদের উপর যখন ক্যামেরার লাইট পড়েছিল আমি চেষ্টা করছিলাম আমার ওই কিম্ভুত ভঙ্গিটা পরিবর্তন করতে। চেষ্টা করলাম আমার ডানহাতকে বাম হাতের কাছ থেকে মুক্ত করে আনতে, এক পা থেকে অন্য পায়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে চাইলাম, কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। আমার দুহাতই কেমন যেন অনড় অবশ হয়ে পড়ে রইল। যখন ওই ছবিটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় আমি এতই  বিব্রতবোধ করি যে পরিবারের কাছ থেকে সেটা লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করি, বিশেষ করে আমার কন্যা। সে অন্যান্য উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার মাঝে আমার ছবির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলছিল, ‘এটা তো বাবার ছবি নয়, মা!”

একজন ক্ষমতাধর মন্ত্রীর গর্বিত স্ত্রী হিসেবে তার মা বলছিল, ‘এটা তোমার বাবা, মহামান্য মন্ত্রী প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রেসিডেন্টের পাশে।’

সেদিনের মতো জীবনে কখনো অতটা বিব্রতবোধ করিনি আমার কন্যার সামনে। তাঁর শিশুর সারল্যমাখা চোখের সামনে আমার সমস্ত গোপন রহস্য যেন ফাঁস হয়ে পড়লো। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে কোনো কোনো শিশুর ভেতর একটা অতীন্দ্রিয় শক্তি বাস করে। আমি আমার কন্যার চোখের দিকে তাকাতেও ভয় পাচ্ছিলাম। কেমন স্থির অপলক একটা দৃষ্টি, আর দশটা সাধারণ শিশু তার বাবার দিকে যেভাবে তাকায় তার চেয়ে বেশ আলাদা সে দৃষ্টি। এমনকি সে যদি চরম দুর্নীতিবাজ এবং শয়তান প্রকৃতির লোকও হয় তবু একজন বাবা তো বাবাই। তারপরও আমার কন্যার চাহনির সামনে নিজের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে পড়ার ভয়ে আমি দারুণভাবে আতঙ্কিত ছিলাম।

 

আমার বাবা ছিলেন একজন পুরোদস্তুর মাগীবাজ, মদপ্য এবং জুয়াড়ি। অথচ সেই লোক ছিলো তোমার কাছে দেবতা সমতুল্য, ঠিক বলছি মা? এবং তুমি তোমার ছেলেকেও সিংহ শাবক হিসেবে ভাবতে ভালোবাসতে,  আশা করতে ছেলেও অবশেষে তার বাবার মতো কালেদিনে সিংহ পুরুষ হয়ে উঠবে। আমি সিংহ-ই হয়েছি, মা। বাড়ি এবং কর্মক্ষেত্র দু’জায়গাতেই আমি ছিলাম চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারী। আমার অধস্হনেরা আমার প্রতি যতবেশি বাধ্য এবং নতজানু হতো, নিজের প্রতি মুগ্ধতা আর ভালোবাসার মাত্রা ততই চড়চড় করে বেড়ে যেত। আমার কর্তৃত্বে থাকা  পুরুষ কিংবা মহিলা কেউই আমার বিরুদ্ধে টু শব্দটা করার সাহস করেনি, গোটা জীবনে এমনটাই হয়ে এসেছে আমার সাথে।

শুধু একজন ব্যতিক্রম ছাড়া। বিপ্লব শুরুর এক বা দুমাস আগে ব্যতিক্রমী সেই তরুণীটি আমার অফিসে আসে।

মেয়েটা এসেই আমার এতদিনের ভারসাম্যটা নষ্ট করে দিলো। এমন নয় যে সে আমার মতের বিরুদ্ধে ছিলো বা একজন কর্মহীন কুড়ি একুশ বছরের তরুণী সে, যে নিজের হতাশা আর ক্ষোভ ঝাড়ার জোশে একজন মাননীয় মন্ত্রীর সামনে নিজের সব কথা বলার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। বরং সেটা তার জন্য ছিলো তাচ্ছিল্যপূর্ণ বিষয়, যে সাহসে সে একজন নারী হয়েও পুরুষের বিরুদ্ধে গলা তোলার সাহস দেখিয়েছে, এমন কী আমার সম্মানজনক পদমর্যাদাকে পর্যন্ত তোয়াক্কা করার বিনয়টুকুও অগ্রাহ্য করতে পেরেছে। না, সত্যি বলছি, মেয়েটির ভয়শূন্য ভাবভঙ্গি আমাকে অকপটভাবে বিস্মিত হতে বাধ্য করেছিল, কারণ সেই প্রথম কেউ একজন একদম দ্বিধা-জড়তাহীন ভাবে সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলেছিল। এই প্রথম কারো এমন চাঁছাছোলা দৃষ্টির সামনে নিজেকে পড়তে হয়েছিল। একজন ভদ্রলোকও ওরকম চাহনী দেবার আগে দশবার ভাববে, সেখানে একজন নারীর এমন আচরণ! 

সত্যি আমি দারুণ কৌতূহলী হয়েছিলাম বটে, আবার ভীষণ এক ক্ষোভে তরুণীটির উপর নয় নিজের উপরই দারুণভাবে বিরক্তবোধ করছিলাম। বিষয়টার শেষ দেখার একটা উদগ্র ইচ্ছা আমাকে কেমন রাগিয়ে দিয়েছিল। জেদ ধরেই পরেরদিন মেয়েটিকে সাক্ষাত দেবার জন্য নিজের মূল্যবান কিছু সময় বরাদ্দ করলাম। এরপর তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের ডেস্কে বসে   টেলিফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

মেয়েটা নিতান্তই একটা ভাঙা কুলো বৈ কিস্যু নয়, এমনটা ভাবতে তাকে বাধ্য করতে চাইলাম আমি। এমন কি তাকে উত্যাক্ত করার ইচ্ছাতে রসিকতা পর্যন্ত শুরু করলাম, নিজেও হাসলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, মেয়েটা বিন্দুমাত্র রাগ দেখালো না। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সে সারা ঘরময় স্বাচ্ছন্দ্য ভঙ্গিতে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো, যেন সে ঘরে আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে বুঝি নিজের বাড়িতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। দেয়ালে ঝুলানো পেইন্টিংসগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল সে। তারপর একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপ মাখা গলায় বলে উঠলো “এটা কী পপি ফুল?”

আমার দিকে সে ঘুরে দাঁড়ানোর আগে আমি তীক্ষ্ণভাবে তাকে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। তার সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন আমার মাথার খুলি ভেদ করে চলে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি বুঝি সেখানে একদম বিবস্ত্র হয়ে বসে আছি। তখন আমার সেই কিম্ভূত ছবিটা দেখে কন্যার প্রতিক্রিয়াটা মনে পড়লো। তার ভাবভঙ্গি আমাকে ক্রমশ ক্রোধাক্রান্ত করে তোলে। ভদ্রতার পলেস্তরা খসে পড়লো আমার। তার চোখের সামনে হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে বলে উঠি, “কি মনে করো তুমি নিজেকে? কে তুমি? তুমি যেই হও তাতে কিস্যু যায় আসে না। তুমি একতাল মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিস্যু নও। একজন নগন্য নারী তুমি। শুধুমাত্র বিছানায়, পুরুষের শরীরের নীচেই তোমার জায়গা।” যে কোনো সাধারণ নারী এমন কথা শুনে মরমে মরেই যেত। কিন্তু মেয়েটি  লজ্জাও পেলো না, অস্বস্তিতে  একবারের জন্য চোখের পলকও ফেললো না।

সরকারি সম্মানজনক পদটা খোয়ানো আমার কাছে আসলে সবচে’ দুঃখজনক বিষয় ছিলো না, সেটি কীভাবে হারিয়েছি সেটাই আমার কাছে সবচে’ দুঃখজনক বিষয়।

সেই অভিশপ্ত সকালে পত্রিকা খুলে সদ্য নিযুক্ত মন্ত্রীসভার সদস্যদের তালিকায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নিজের নামটা দেখতে না পেয়ে নিজেকে কেমন অপদস্হ, আর শূন্য যে মনে হয়েছিল মা! হঠাৎই আমি কেমন বাতিল হয়ে গেলাম, আমার নাম যেন মুছে ফেলা হলো সব জায়গা থেকে, আর কোথাও আমার অস্তিত্বের কোনো চিহ্ন থাকলো না। আমার যে ফোনটি দিনরাত বিরামহীন ভাবে বেজে যেত, সেটাও হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেলো। এখন আমি পরিত্যাক্ত একজন। আমি এটা হাড়েহাড়ে টের পেলাম, মন্ত্রীত্ব থাকাকালে অবিরাম আসতে থাকা ফোন কলগুলো তা যত ফালতুই হোক না কেন, সেগুলো আসলে আমি উপভোগই করতাম; তাতে তখন বিরক্তির ভাব দেখালেও আদৌও আমি সেভাবে বিরক্ত হতাম না; বরং মনের খুব গভীরে সেটা নিয়ে নিজেকে চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভেবে আত্মতৃপ্তি হতো। যে কারণে এখন ফোনটার হঠাৎ থেমে যাওয়া আমাকে ভীষণভাবে পীড়িত করছে। আসলে আমি ওতেও আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম, যেমন আমি সুরা, নারী, ক্ষমতা আর সম্পদের প্রতি আমি আসক্ত ছিলাম। পুরুষ হিসেবে যাবতীয় আনন্দ-ব্যসন কী ঈশ্বর কেবল মাত্র আমাদের জন্যই নিধারিত করেননি? সেই অধিকারেই উন্মত্তের মতো পুরুষের জন্য মনোনীত যাবতীয় আনন্দ খাবলে খাওয়ার নেশায় কম হন্য হয়নি, কিন্তু দশঘাটের জল খেয়েও নিজেকে কখনও পূর্ণ মনে হয়নি। এমনকি চল্লিশ জায়গার চল্লিশ নারীতে মত্ত থেকেও সব কেমন শূন্য মনে হয়েছে।

স্বীকার করছি মা, বড় মামুলি কারণে ঐশ্বরিক দানের অপচয় করেছি আমি। সেই দুর্ভাগ্যজনক অভিশপ্ত দিনটাতে প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে ক্যাবিনেট মিটিং এ বসেছিলাম। আমি নিশ্চিত যে আমি চেয়ারেই বসে আছি কিন্তু একই সাথে অনুভব করছিলাম আমি যেন ওখানে নেই। আমি কিছুতেই আলোচনায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। বোঝার চেষ্টা করছিলাম আমি সবসময় যেভাবে এখানে বসি সেভাবেই বসেছি কিন্তু কোথাও যেন কিছু একটা নেই। অনবরত ভেবেই যাচ্ছিলাম, এই সভাকক্ষে বসে থাকা মানুষটি কী আমিই নাকি সে অন্য কেউ? এই দুজনের মধ্যে কে তবে সত্যিকার আমি? এবং তখন আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আমার সকল দ্বিধাদ্বন্দের মূলে রয়েছে ওই প্রতিবাদী, বৈপ্লবিক মনোভাবের তরুণীটি, যখন থেকে তার প্রতি আমার দৃষ্টি পড়েছে তারপর থেকে আমি কিছুতেই তার কথা না ভেবে পারছিনা।

এমন নয় যে তরুণীটি অনিন্দ্য সুন্দরী, তবুও সে কি বিস্ময়কর দক্ষতায় ব্যাপারটা ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল, পৌরষের যে দাপুটে বিশ্বাস আজীবন তাবৎ পুরুষ আঁকড়ে থাকতে ভালোবাসে, আমার সে বিশ্বাস সে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে যেন। মহামান্য প্রেসিডেন্টের সংকেত পাওয়ার অপেক্ষায় আমার ডানহাত কাগজের উপর অনুগতের মত কলমটা ধরে ছিলো। কিন্তু আমার বামহাতের নড়াচড়া নজরে পড়ে যায় তার। তিনি আমার দিকে চোখ ফেরান এবং আমার উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। প্রশ্নটার সঠিক এবং অপরিহার্য দুটো উত্তরই আমার জানা ছিলো, কিন্তু কোনো উত্তর দেয়া হয়ে ওঠেনা, ভয় আমাকে ভীষণভাবে ঘিরে ধরে।

এখন আর মনে নেই তখন সে উত্তরটা আসলে কে দিয়েছিল। যখন মাননীয় প্রেসিডেন্ট আমার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন, তখন আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। কাঁপনটা আমার জ্বরতপ্ত শরীরের কারণে কিংবা বিপ্লবী তরুণীটির প্রতি আমার অতিমাত্রার আচ্ছন্নতার কারণেও হতে পারে। আসলে আমার মন তখন পুরোমাত্রায় বিক্ষিপ্ত। আলোচনা সভায় আমি পাথরের মূর্তির মতো অনড় বসে ছিলাম।     মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমাকে লক্ষ্য করছিলেন, তাঁর সুতীব্র দৃষ্টি যেন আমাকে মরণের হিম শীতল গভীরতায় ছুঁয়ে গেলো। তিনি আমাকে দ্বিতীয় প্রশ্নটা করলেন, সেটা ছিলো বেশ সহজ আর স্বতসিদ্ধ।

মাগো, মহামান্য প্রেসিডেন্টের প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা যে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো সেটা আমি কী করে ভুলে গেলাম?  আর সে উত্তরটাই আমাকে অবধারিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো। আমি দুঃখ করছি না মা, বরং পারলৌকিক মুক্তি ও শান্তি উদযাপন করতে যাচ্ছি। আমার বুক থেকে বিশাল একটা পাথর যেন নেমে গেলো। আমি এই পৃথিবীকে সানন্দে চিরবিদায় জানাচ্ছি।

এই শান্ত সমাহিত বিদায়ের ক্ষণটিতেও টেলিফোনের অকস্মাৎ থেমে যাওয়ার বিষয়টি আমাকে নিরন্তর পুড়িয়ে মারছে, আর সে কারণে এখনও আমি আমার টেলিফোনটি পাশে রেখেছি। মৃত্যুর আগে একবুক তৃষ্ণা নিয়ে আমি অপেক্ষায় আছি, শেষবারের মতো কেউ একজন আমাকে ফোন করুক, ফোনের ওপাশ থেকে অন্তত একবার কেউ বলে উঠুক, “হ্যালো, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়!”

 

মূল গল্প: ‘The Death of His Excellency, The Ex-Minister’ Nawal El Saadawi

লেখক পরিচিতি:

জন্মসূত্রে মিশরীয় নাওয়াল আল সাদাবি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক ও ঔপন্যাসিক। নারী অধিকার এবং সম্মান আদায় আন্দোলনের একনিষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে তিনি মিশর ও মিশরের বাইরে সুপরিচিত। ইসলামে নারীর অবস্হান নিয়ে তিনি প্রচুর লেখালেখি করেন। বহু মুসলিম রাষ্ট্রে প্রচলিত নারীর যৌনাঙ্গ ব্যবচ্ছেদের নিষ্ঠুর প্রথাটি নিয়েও তাঁর কলম যথেষ্ট সোচ্চার। আরব বিশ্বে তিনি ‘সিমন দ্য বোভোয়া’ নামে পরিচিত।  ১৯৩১ সালের ২৭ অক্টোবর, কায়রোর ছোট্ট গ্রাম কাফর তাহলাতে নাওয়াল আল সাদাবির জন্ম। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ডায়েরি অফ অ্যা চাইল্ড কল্ড সাউদ’ লিখে তিনি সাহিত্যবিশ্বকে নিজের সাহসী আগমনের বার্তা জানান দেন। তাঁর কলম ৮৭ বছর বয়সে আজও সমান তেজি। এ বিষয়ে তাঁর সোজাসাপ্টা বক্তব্য, “আমি বয়সের সাথে আরও উগ্র হয়ে উঠছি। আমি লক্ষ্য করেছি যে লেখকরা যখন বৃদ্ধ হন, তারা অনেকবেশি নমনীয় হয়ে ওঠেন। তবে আমি এর বিপরীত। বয়স যেন আমাকে আরও ক্রুদ্ধ করে তুলেছে।”

ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী নাওয়াল আল সাদাবি’র লেখালেখি এবং পেশাগত কর্মজীবন নারীদের রাজনৈতিক ও যৌন অধিকারের জন্য নিবেদিত। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসেবে বরাবরই তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজের আপত্তি কিংবা বক্তব্য জোড়ালোভাবে জানান দিয়েছেন। এ কারণে বার বার তাঁকে ক্ষমতাশালীদের চক্ষুশূল হতে হয়, কারাবরণও ভোগ করতে হয়েছে। জেলে বসে তিনি জেলকর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁকে সরবরাহ করা পেনসিল দিয়ে টয়লেট পেপাররোলে লিখেন তাঁর জেল অভিজ্ঞতার বিবরণ “মেমোরিজ ফ্রম দ্য ও’ম্যান্স প্রিজন”। ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক মতামতের বিপক্ষে দাঁড়ানোর জন্য তাঁকে দেশ ত্যাগেও বাধ্য করা হয়েছিল। তবুও তাঁর কলম নতজানু হতে শেখেনি। নাওয়াল আল সাদাবি প্রচুর লেখালেখি করেছেন, এ পর্যন্ত তিনি ৫০টি উপন্যাস এবং অসংখ্য ছোটগল্প রচনা করেছেন। তাঁর লেখালেখির বিষয়বস্তু বৈশ্বিক ক্ষেত্রে নারী, বিশেষত মুসলিম সমাজ বা মিশরীয় প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্হান। ১৯৭২ সালে তাঁর গবেষণালব্ধ উল্লেখযোগ্য নন ফিকশন “ও’ম্যান এণ্ড সেক্স” প্রকাশিত হয়। নাওয়াল আল সাদাবির উল্লেখযোগ্য ফিকশন বইগুলো হলো, “ও’ম্যান এট জিরো পয়েন্ট”,”গড ডাইজ বাই দ্য নাইল”, “দ্য হিডেন ফেস অফ ইভ”,“দ্য ফল অফ দ্য ইমাম”, “দ্য সার্কেলিং সঙ” ইত্যাদি। ৩০টিও বেশি ভাষায় তাঁর বই অনুদিত হয়েছে।

2 thoughts on “একজন মাননীয় প্রাক্তন মন্ত্রীর মৃত্যু

  1. গল্পের ভাষা সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। ভাষান্তরিত হওয়ার কারণে কোথাও হোঁচট খেতে হল না। গল্পের আগে ও পরে সংযোজিত অংশটুকু না- থাকলে অনুবাদ-সাহিত্য বলে মনে হত না। অনুভবের তীব্রতা বজায় থেকেছে। মূল গল্পের বহুমাত্রিক পরিমণ্ডল অনুবাদেও মনকে নাড়া দেয়। মূল গল্পের লেখিকার সাহসী লেখনীর সাথে আরো পরিচয় ঘটবে,এই আশা রাখি।

    1. দারুণ ভাবে অনুপ্রাণিত হবার মতো মন্তব্য! ভবিষ্যতে এই লেখকের আরো গল্প অনুবাদের চেষ্টা থাকবে।
      গল্পপাঠ এবং সহৃদয় মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত