শানজিদ অর্ণব
গত শতকের সত্তরের দশক ঠিক আর দশটা দশকের মতো ছিল না। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিল। রাইফেল, রেডবুক দিকে দিকে মুক্তি আনছে— এই ছিল আহ্বান। তবে পশ্চিম বাংলার নকশালবাড়ি গ্রামে যা শুরু হয়েছিল, তার তুলনা মেলা ভার! ১৯৬৭ সালের ২৫ মে নকশালবাড়ি জেলায় কৃষকরা সংগঠিত হয়ে ভূস্বামী আর তাদের ভাড়াটে গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বারুদ যেন দিয়াশলাইয়ের আগুন পেল, দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে এ কমিউনিস্ট আন্দোলন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের এমন চেহারা এ উপমহাদেশে আগে কখনো দেখা যায়নি। আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) আর নায়কের নাম চারু মজুমদার। আন্দোলনের মতাদর্শ ছিল মাও সে তুংয়ের চিন্তাধারা। চীনের পিকিং রেডিও নকশালবাড়ির উত্থানকে ঘোষণা করল ‘ভারতের আকাশে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’। আর নকশালদের আহ্বান ছিল ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন’। এ আহ্বান সফল হয়নি, দেয়ালে লেখাও মুছে গেছে বহু আগেই কিন্তু নকশাল আন্দোলনের স্মৃতি, রাজনীতি কিংবা ইতিহাস কোনোটাই এতটুকু বিস্মৃত হয়নি।
দিনক্ষণের হিসাবে এ বছর নকশাল আন্দোলনের ৫০তম বার্ষিকী। নকশাল আন্দোলন কারো কাছে ছিল বিপ্লবের যাত্রা, কারো কাছে সন্ত্রাস। যে যেভাবেই মূল্যায়ন করুন না কেন, সে সময়কে মুছে দেয়া অসম্ভব। হাজার হাজার তরুণ নিজের সার্টিফিকেট পুড়িয়ে দিয়ে, নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমে পড়েছিল। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাওয়ের তত্ত্ব বাস্তবায়ন করতে শহরের নিরাপদ গৃহ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা তখন গ্রামে কৃষকের পর্ণকুটিরে হাজির। বাদ যায়নি বিভাগের সেরা ফল করা ছাত্রটিও। নকশাল আন্দোলন একদিকে যেমন ভারতের রাজনৈতিক জীবনকে আলোড়িত করেছিল, তেমনি নাড়া দিয়েছিল সংস্কৃতি, সাহিত্যের জগেকও। এ আন্দোলন কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে অনেক কালজয়ী উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা, গান। এক্ষেত্রে ভারতের আরো অনেক ভাষার চেয়ে বাংলা ভাষার সৃষ্টিই মনে হয় অধিকতর সমৃদ্ধ। হবেইবা না কেন? নকশালবাড়ির জন্ম তো বাংলাতেই। মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা তো কালজয়ী সাহিত্য, যা অন্য অনেক ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।
২৫ মে নকশালবাড়িতে সংঘর্ষের দিনই দিলীপ বাগচি রাজবংশীদের আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত কবিতায় জানিয়ে দিলেন নকশালবাড়ির আগমনী বার্তা, তার প্রেক্ষাপট, তার প্রতিজ্ঞা—
“ও নকশাল নকশাল নকশালবাড়ির মা
ও মা তোর বুগত্ অকেতা ঝরে
তোর খুনত্ আঙ্গা নিশান লঘ্যা
বাংলার চাষী জয়ধ্বনি করে।।
… ও মা তোর বুগত্ অকেতা ঝরে
সেই অকেতা হইতে জন্ম নিবে
জঙ্গাল সাঁওতাল বাংলার ঘরে ঘরে…”
অর্থাত্ শুরুর দিন থেকেই নকশালবাড়ির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগোলো বাংলা কবিতা। কবিরা একদিকে যেমন শব্দে আগুন জ্বালিয়েছেন, তেমনি মাঠের লড়াইয়েও শামিল হয়েছিলেন। কবিরা খুন হয়েছেন, কারাগারে গিয়েছেন, নির্যাতন সয়েছেন। নকশাল আন্দোলনের কবিতায় স্থান পেয়েছে সরাসরি রাজনৈতিক আহ্বান, মতবাদ, সশস্ত্র সংগ্রাম, কৃষক সংগ্রামের গাথা। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে দুর্গা মজুমদার সশস্ত্র বিপ্লবের মন্ত্র তুলে ধরেছেন তার ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ কবিতায়। কবিতা যেন লড়াইয়ে নামার সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক! সারা জীবন ধূম উদ্গীরণের চেয়ে অন্তত একবারের জন্য হলেও জ্বলে ওঠবার আহ্বান।
“নতজানু হয়ে তিলে তিলে ক্ষয়ে বাঁচবার নাম
আমি রাখলাম
মরণের স্তব—
খুনের বদলে খুন না ঝরিয়ে মরবার নাম
আমি রাখলাম
শ্মশানের শব!
মারার তাগিদে আড়ালে গা-ঢেকে বাঁচবার নাম
আমি রাখলাম
সংগ্রামী গৌরব—
মরণের মুখে থুথু ছুড়ে দিয়ে মরবার নাম
আমি রাখলাম
সশস্ত্র বিপ্লব!!
এ কবিতা লেখার ঠিক ছ’মাস পর দুর্গা মজুমদার মহাভারতের রূপকে তার কবিতায় জানান দিলেন নকশালবাড়ির আগমনের। ১৯৬৭ সালের ১১ জুন লেখা সেই কবিতার নাম ‘গাণ্ডীবে টঙ্কারে দিল’।
“…তারপর একদিন সমুদ্রের তপ্ত স্রোতে বাষ্পের নিয়মে
আকাশের পূর্বকোণে লাল মেঘ জমে…
কৌরবেরা হতবাক, দালালেরা বস্ফািরিত নেত্র
গোগৃহের রণক্ষেত্র—
বিরাট কালের অজ্ঞাতবাসের বৃহন্নলা বেশ ছাড়ি
গাণ্ডীবে টঙ্কার দিল নকশালবাড়ী।”
এর পর কয়েক বছর নকশাল আন্দোলন ধনী, ভূস্বামীদের, পুলিশের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠল। সাধারণ ঘরের তরুণরা ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে পড়লেন পার্টির সশস্ত্র আন্দোলনে। নকশাল আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সাধারণ মানুষের বিপ্লবী রূপান্তর। মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা যে বিপ্লবের জননী, সে গল্প এবার সত্য হয়ে দেখা দিল। দান-খয়রাত নয়, রাষ্ট্রে নিজের অধিকার নিয়ে মানুষের বাঁচতে চাওয়ার দাবি উঠেছিল। আর এ চেতনা মূর্ত হলো ১৯৭৪ সালে স্বপন চক্রবর্তীর লেখা ‘আমাদের গল্প’ কবিতায়—
“আমরা সাহায্য চাইনি
কারণ আমরা বদল চেয়েছি।
চেয়েছি ক্ষিদের মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধে
একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।
…কোনদিনই আমরা কমিউনিস্ট হতে চাইনি।
এখন সময়
মানুষের জন্যে আমাদের মানুষের মত হতে শেখাচ্ছে।
আমরা চাইনি ইজ্জত খুইয়ে ঘাড় হেঁট করে পেট ভরাতে।
আমরা বদল চেয়েছি
চেয়েছি ক্ষিদের যন্ত্রণার বিরুদ্ধে
একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।”
নকশাল আন্দোলনে কৃষকের জমি আর অধিকার আদায়ের স্বপ্ন বিধৃত হয়েছে দীপক আচার্যের ‘নক্শাল কোন সাল ইতিহাসে আনলে’ গানে—
“নক্শাল কি মশাল আশমানে জ্বলছে,
কিষাণের ক্ষোভে আজ হিমালয় টলছে,
অনেক দিনের পুরোনো সে জিজ্ঞাসা-
মিটবে কি কভু চাষীর জমির আশা?
লড়াইয়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তর উত্তাল-
নক্শাল, নক্শাল, নক্শাল, নক্শাল!”
নকশাল আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন গ্রামের গরিব, ভূমিহীন কৃষকরা। তাদের শতবছরের বঞ্চনার ক্ষোভে আগুন জ্বালিয়েছিল নকশালবাড়ি। এ আন্দোলনে যুক্ত বাংলা কিংবা বিহারের কৃষকরাও ছোট ছোট কবিতা রচনা করেছিলেন। বিহারের নীচু বর্ণের কৃষক ভিখারি রাম হিন্দি ভাষায় রচনা করেছিলেন এমন এক কবিতা –
‘দিনগুলো বন্ধ্যা,
খাওয়ার জন্য একটু ছাতু নেই ঘরে,
মাথার ওপর নেই কুঁড়েঘরের আশ্রয়ও।
আমাদের পায়ে জুতো নেই,
দিনগুলো বন্ধ্যা।’
নকশাল আন্দোলনে যুক্ত চারজন তরুণ কবি খুন হয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে, জেলখানায় বন্দি অবস্থায়। এদের মধ্যে আছেন কবি দ্রোণাচার্য ঘোষ, তিমিরবরণ সিংহ, অমিয় চট্টোপাধ্যায় ও মুরারি মুখোপাধ্যায়। তিমিরবরণ সিংহ ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নকশাল আন্দোলনে গ্রামে গিয়েছিলেন কৃষকদের সংগঠিত করতে। ১৯৭১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বহরমপুর জেলে নিহত হয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে। অমিয় চট্টোপাধ্যায় বেহালা পৌরসভার কাউন্সিলর হয়েছিলেন। নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পুরুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে পার্টির কাজ শুরু করেন। গ্রামে কাজ করতেন ‘সাগর’ ছদ্মনামে। গ্রেফতার হয়ে ঠিকানা হয় জেলখানা এবং জেলের অভ্যন্তরেই তাকে হত্যা করা হয়।
কৃষকদের সরাসরি বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে মুরারি তার কবিতায় লিখেছিলেন—
‘হে কৃষক বিদ্রোহ কর
ঘোরতর বিদ্রোহ
তা’না হলে ঘুচিবে না
তোমাদের এই দুগ্রহ।’
নকশাল আন্দোলন দমাতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জবাবে পাল্টা জবাব দেয়ার প্রত্যয়ে তরুণ কবি মুরারি মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘কলকাতা বদলা নিতে জানে’। কবিতা কি চিঠি— সবখানেই মুরারি ছিলেন সমাজ বদলের আকাঙ্ক্ষায় অস্থির। ‘কলকাতা বদলা নিতে জানে’ যেন সে সময়ের এক জীবন্ত দলিল। যুগের ক্রোধ যেন মুরারির কলমে ভাষা পেল। মুরারি বলছেন তার বন্ধু কাজল আর সমীরের রক্ত কলকাতাকে আরো উত্তাল করেছে; ভোটের রাজনীতিকে বিদায় দিয়ে রক্তাত্ত সংগ্রাম, প্রতিশোধের কথা বলেছেন। শহরের বাবুদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। আহ্বান জানিয়েছেন বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার। আর শেষমেশ উচ্চারণ করেছেন নকশালবাদীদের নেতা চীনা বিপ্লবের নেতা মাও সে তুংয়ের নাম—
‘পূর্ব দিগন্তে রক্ত সূর্য মাও সে তুঙ
টুটল আঁধার, কোটি সেনানীর ভাঙলো ঘুম
আজ এই দিনে যোদ্ধার বেশে তোমায় পেলাম
কৃষকের কলকাতা লাল সেলাম।’
জেল থেকে মাকে লেখা মুরারির চিঠি যুগযুগান্তের বিপ্লবী তরুণের স্মারক। শ্রেণীবৈষম্য ভরা সমাজ যত দিন থাকবে, মুরারির চিঠিও তত দিন প্রাসঙ্গিক। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের কোনো বিপ্লবীর চিঠি তালাশ করলে সেখানেও পাওয়া যাবে মুরারির কথার প্রতিধ্বনি। মুরারি জেল থেকে মাকে লিখছেন, ‘যে সমাজে বড়লোক আরও বড়লোক হয় আর গরীবের কুঁড়ে ঘরে মাঝরাতে বৃষ্টির জলে ঘুম ভেঙে যায়, দেয়ালের মাটি ধসে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের বুকে, সত্যি করে বলতো মা, সে সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার কোন অর্থ আছে?’ অন্য একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘ওরা আমাদের জেলে পুরেছে, হত্যা করছে, আরও অনেক কিছু করার কুমতলব আঁটছে, কিন্তু মূর্খ ওরা। তুমিও বলো হাত দিয়ে সূর্যের আলো ঠেকানো যায়?’ জেলে বসেও মুরারির তেজ আর পার্টি আর বিপ্লবের ওপর আস্থা এতটুকু কমেনি, চিঠিতে আরো লিখেছেন— ‘আমরা জিতেছি, আমরা জিতবো, আমরা শত্রুর ঘুম কেড়ে নিতে পেরেছি। হত্যা করার একচেটিয়ে অধিকার আমরা ওদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। এতদিন জোতদাররা কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করেছে, আজ আমাদের পার্টির পরিচালনায় কৃষকরাই ওদের জমি থেকে উচ্ছেদ করছে, ওরা পালিয়ে যাচ্ছে, শহরে।’ গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার মৃত্যুর আগে এক মুহূর্তের জন্যও মুরারির চোখ থেকে মুছে যায়নি। মুরারিকে ১৯৭১ সালে হাজারীবাগ সেন্ট্রাল জেলে হত্যা করা হয়।
নকশাল আন্দোলনে যুক্ত তরুণদের দমাতে চালানো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিষয়টি অজানা নয়। তুলে নিয়ে হত্যা করা, কারাগারে খুন, গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে পিটিয়ে হত্যা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। রাষ্ট্রের সেই দানবীয় চেহারাও কবিদের কবিতায় মূর্ত হয়েছে। কবি কৃষ্ণ ধর লিখেছেন ‘একদিন সত্তর দশকে’ শিরোনামের কবিতা—
“শিকারকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে
অন্ধকারে মিলিয়ে যায় জল্লাদের গাড়ি
শহরের দেয়ালে দেয়ালে পরদিন দেখা যায় তারই কথা
সে নিদারুণ তৃষ্ণায় একবার জল চেয়েছিল
যে যন্ত্রণায় নীল হয়ে একবার ডেকেছিল মাকে
তবু স্বপ্নকে অক্ষত রেখেই সে
বধ্যভূমিতে গিয়েছিল
একদিন সত্তর দশকে।”
রাষ্ট্রীয় দমনের একটি ভয়ানক রূপ ছিল কম্বিং অপারেশন। কোনো একটি এলাকা ঘিরে ফেলে নির্বিবাদ গ্রেফতার, খুন, নির্যাতন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ সালে পশ্চিম বাংলায় চলেছিল এ কম্বিং অপারেশন। এ অপারেশনের স্বরূপ উন্মোচন করে সমীর রায় লিখেছেন ‘নরমুণ্ড শিকারীরা পোস্টার সেঁটেছে’—
“আমি ভুলিনি, আমি ভুলিনি, আমি ভুলিনি
আমার গলার উপর পা রেখে, আমার মুখের রক্ত দিয়ে
নরমুণ্ড শিকারীরা কলকাতা শহরে পোস্টার সেঁটেছে-
‘বাঁচুন, বাঁচতে দিন, হিংস্রতা বর্জন করুন’।”
নকশাল আন্দোলনের কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, বিপ্লবের আহ্বান, রাজনৈতিক স্লোগান, পরিস্থিতির সরল বিবরণ। তাই সব কবিতা মানোত্তীর্ণ হতে পেরেছে এমনটা বলার সুযোগ নেই। নির্মল ঘোষ তার নকশালবাদী আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য গ্রন্থে লিখেছেন, ‘অনস্বীকার্য, নকশালপন্থী কাব্যচর্চায় আঙ্গিকের চেয়ে বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর এর ফলে বক্তব্যে বহুক্ষেত্রেই আবেগের প্রাধান্য দেখা গেল, যা শেষপর্যন্ত পাঠক মানসকে প্রায়শ প্রভাবিত বা প্রাণিত করতে সমর্থ হয়নি।’ তবে কবিতার শৈল্পিক মানের এ বিতর্কে অর্জুন গোস্বামী নকশালবাদী কবিতার পক্ষেই রায় দিয়েছেন, ‘এটা সত্তরের দশক। এই দশক প্রত্যক্ষ করেছে শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিতশ্রেণীর লড়াই। এই দশকেই প্রমাণিত হয়েছে যে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রকে উপরে উপরে যতই শক্তিশালী বলে মনে হোক না কেন আসলে তারা হলো কাগুজে বাঘ। স্বভাবতই এই দশকের মানুষের সচেতনতা অনেক বেশি। আমরা এমন কোন কবিতা পড়তে চাই না যাতে আছে হতাশা, আছে যন্ত্রণার গোঙানি। আমরা এমন কবিতা পড়তে চাই যাতে ধরা পড়বে শোষণের আসল স্বরূপ, যে কবিতা পড়ে অনুপ্রেরণা পাবেন লক্ষ লক্ষ খেটে খাওয়া মানুষ এবং যে কবিতা প্রকৃতই হবে শোষিতশ্রেণীর সংগ্রামী হাতিয়ার। আমাদের মধ্যে অনেকে বলেন কবিতা হলো এমন একটা জিনিস যা ঠিক স্লোগান নয়। আমাদের বক্তব্য হলো কবিতার বিষয় ও কবিতার আঙ্গিক এই দুটোর মধ্যে আগে বিষয়, পরে আঙ্গিক। বক্তব্যকে সাধারণের উপযোগী করে বলার জন্য কবিতা যদি কারুর কাছে স্লোগান বলে মনে হয় তবে সেই স্লোগানই হলো সত্তরের দশকের শ্রেষ্ঠ কবিতা।’
নকশাল আন্দোলনে সময়ে কবিতা শুধু বাংলা ভাষাতেই লেখা হয়নি বরং এ আন্দোলনের প্রভাবে আরো কয়েকটি ভাষার কবিরা। তেলেগু ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি চেরাবান্দা রাজু এমনই একজন। সক্রিয়ভাবে নকশাল তথা মাওবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আজীবন। কারাবাস, রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ভোগ করেছেন। ১৯৭২ সালে নকশাল আন্দোলন যখন রাষ্ট্রীয় দমনে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, সে সময় তিনি লিখেছিলেন—
আমি উত্তাল ঢেউ ডিঙিয়ে
তীরে পৌঁছতে চেষ্টা করেছিলাম…
নৌকা সামনে এগিয়েছে,
কিন্তু সেই ঢেউ উপহাসের হাসি হেসে আমাকে বলেছে:
‘তুমি কী পাগল?
আমরা বয়ে চলছি
আমাদের হাজারটা চোখ আছে,
তুমি কীভাবে আমাদের পেছনে ফেলবে?’
আমি ফিরে গেলাম…
আজ,
নৌকার হালটা আর আমার হাতে নেই,
আজ আমিই বরং তার হাতের পুতুল।
তেলেগু কবিদের মধ্যে সুব্বারাও পাণিগ্রাহীও কবিতা লিখেছেন। মালয়লাম ভাষার কবি সচ্চিদানন্দন, শঙ্কর পিল্লা, অট্টর রবি ভার্মা রচনা করেন নকশালবাদী কবিতা। হিন্দি ভাষায়ও রচিত হয় কবিতা। হিন্দি কবিদের মধ্যে লিখেছেন— উগরাসেন সিং, হরিহর দিভেদী, ধুমল, গোরাখ পাণ্ডে প্রমুখ।
কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্পেও ধরা রয়েছে নকশাল আন্দোলন। কিছু রচিত হয়েছে আন্দোলন চলাকালে আবার কিছু পরবর্তীকালেও। গল্পগুলোয় রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও তরুণদের দুঃসাহসী রাজনীতির বিবরণ পাওয়া যায়। মহাশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী গল্পটি দিয়ে শুরু করা যাক। আদিবাসীরা বেশ ভালোভাবেই যুক্ত হয়েছিলেন নকশাল আন্দোলনে। আর আদিবাসীদের সংগ্রাম বাংলা ভাষায় মহাশ্বেতা দেবীর চেয়ে ভালো আর কেই বা লিখতে পেরেছেন! ঝাড়খন্ডের সাঁওতাল মেয়ে দ্রৌপদী পুলিশের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সাতাশ বছরের দোপিদকে গ্রেফতারে সহায়তার জন্য নগদ একশ টাকা পুরস্কারও ঘোষিত হয়েছে। ঝাড়খানি জঙ্গলে সর্বাত্মক অপারেশন চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় দ্রৌপদিকে। এর পর তার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। গণধর্ষণের পর বিক্ষত দেহে ফেলে রাখা হয় তাকে। কিন্তু তাতেও তো মাথা নোয়ায় না দোপিদ। জ্ঞান ফিরে দোপিদ যখন সব বুঝতে পারে, তখন নিজের কাপড় নিজেই ছিঁড়ে ফেলে। সামরিক কর্তা নির্দেশ দেন দোপিদকে কাপড় পরাতে। দোপিদ তখন বলে ওঠে, “কাপড় কী হবে, কাপড়? লেংটা করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে? মরদ তু?
চারদিকে চেয়ে দ্রৌপদী রক্তমাখা থুথু ফেলতে সেনানায়কের সাদা বুশ শার্টটা বেছে নেয় এবং সেখানে থুথু ফেলে বলে, হেথা কেও পুরুষ নাই যে লাজ করব। কাপড় মোরে পরাতে দিব না। …দ্রৌপদী দুই মর্দিত স্তনে সেনানায়ককে ঠেলতে থাকে এবং এই প্রথম সেনানায়ক নিরস্ত্র টার্গেটের সামনে দাঁড়াতে ভয় পান, ভীষণ ভয়।”
দীপংকর চক্রবর্তীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী গল্পটি নকশাল রাজনীতির চিত্রায়ন। সে সময়ের রাজনীতির তাত্ত্বিক লড়াই, ঝোঁক সবই ধরা রয়েছে এ গল্পে। পুলিশের হাতে বুলু নামের এক তরুণ কর্মীর মৃত্যু খবরে কলকাতা ছুটে আসেন এক পরিচিত সিদ্ধার্থ। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সিদ্ধার্থ যে দেয়াল লেখাগুলো দেখতে থাকেন, তা দিয়ে লেখক আমাদের চোখের সামনে সে সময়ের রাজনীতিকে জীবন্ত করে তোলেন। কোথাও লেখা, ‘ভোট বয়কট করে নয়, ভোটের মাধ্যমেই আপনার রায় দিন।’ তার পাশেই নকশালদের লেখা, ‘তেইশ বছর ভোট দিয়ে আপনি কী পেয়েছেন? ভোট নয়, সশস্ত্র কৃষিবিপ্লবই মুক্তির পথ।’ শেষের এ দেয়াল লেখা দেখতে দেখতে সিদ্ধার্থ বুঝলেন এটিই বুলুদের পার্টির পোস্টার, তবে অন্য সবার পোস্টার অক্ষত থাকলেও বুলুদেরটার ওপর আলকাতরা মারা হয়েছে। আরো একটি স্লোগান দীপংকর তুলে ধরেছেন, যা সে সময় পশ্চিম বাংলার রুশ ও চীনপন্থী নকশালদের মধ্যে তীব্র মতাদর্শিক বৈপরীত্যকে প্রকাশ করেছে— ‘জ্যোতিবাবুর বাড়ি তিন তলা— ওপরে ভাড়া, নীচে ভাড়া, সি. আর. পি দিচ্ছে পাহারা— জ্যোতিবাবু সর্বহারা!’ লেখক বুলুদের বলেছেন সূর্যসেনের উত্তরসূরি। বুলুর বাবা সন্তোষবাবু সিদ্ধার্থকে বলেন, ‘জানো সিদ্ধার্থ, যৌবনে আমিও বন্দুক হাতে লড়েছি চট্টগ্রামে, মাস্টারদার পাশে-দাঁড়িয়ে। আজ এই সব বুলু মন্টুদের দেখে গর্বে বুক ফুলে ওঠে, চোখে জল আসে। বিনয়-বাদল-দীনেশ আর বাঘা যতীনরা মরেন নি, এদের মধ্যে আমি দেখতে পাই তাঁদের, দেখতে পাই মাস্টারদা-লোকনাথ আর টেগরাকে।’ সন্তোষবাবু নিজে নির্বাচনপন্থীদের দলের কর্মী। কিন্তু বুলুদের আত্মত্যাগ তাকে ধাক্কা দেয়, নিজের পার্টির বিপ্লবী পরিচয় নিয়ে তার মনে সন্দেহ তৈরি হয়, ‘বুলুর মৃত্যু আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমরা আবার বিপ্লবী! এরা কী জন্য লড়ছে বলো তো? কী আছে এদের সামনে? এদের তো পাবার কিছু নেই! কিন্তু দেবার জন্য আছে- জীবন! সবার মুক্তির জন্য এরা জীবন উত্সর্গ করছে।’ বুলুদের বাসা থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে সিদ্ধার্থ দেখলেন একটি বাসের গায়ে মাও সে তুংয়ের ছোট একটা ছবি লাগানো। মূলত এ ঘটনা পাঠককে দেখিয়ে লেখক তার গল্পকে একটি নিরেট সরল রাজনৈতিক করে তুললেন। লেখক এবার সিদ্ধার্থের অনুভূতির বয়ানের সমর্থন জানালেন নকশাল আন্দোলনকে, “প্রচণ্ড আবেগে ও বিস্ময়ে আপ্লুত হয়ে পড়ল সিদ্ধার্থ। মাও সে তুংয়ের ছবিটার ওপর ক্রমান্বয়ে ভেসে উঠতে লাগল বুলু-রন্টু-বিচ্ছুদের মুখগুলো। ছবিটার তলায় খুদে খুদে অক্ষরে লেখা: ‘বলো, হাতদিয়ে রোখা যায় কি সূর্যের কিরণ? হত্যা করে রোখা যায় কি বিপ্লব?’ আপন মনেই মাথা নাড়ল সিদ্ধার্থ। না রোখা যায় না। ওরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।” দীপংকর চক্রবর্তী এ গল্প লিখেছেন সেই উত্তাল সময়ে, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনীক পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল।
দীপংকর চক্রবর্তীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী গল্পটি ছোটগল্পের শিল্পমান সেভাবে অর্জন করতে পারেনি। গল্পটি নেহাতই রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে উপস্থাপন হয়েছে। তবে আন্দোলন চলাকালে উত্তাল সময়ে লেখক-সাহিত্যিকদের লেখাগুলো হয়তো এমন হওয়াটাই অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। অর্থাত্ সাহিত্যের শিল্পমানের চেয়ে বক্তব্য, আবেগের প্রকাশই ছিল মুখ্য। নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত আরো অসংখ্য ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে— হাসান আজিজুল হকের আমরা অপেক্ষা করছি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পলাতক ও অনুসরণকারী, বিমল করের নিগ্রহ, সমরেশ বসুর শহিদের মা, দেবেশ রায়ের কয়েদখানা, সুবিমল মিশ্রের মাংস বিনিময় হল, নবারুণ ভট্টাচার্যের খোঁচড়, জয়া মিত্রের স্বজন বিজন, বশীর আলহেলালের মোকাবিলা প্রভৃতি।
নকশাল আন্দোলন নিয়ে রচিত হয়েছে উপন্যাসও। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাসের মধ্যে আছে— স্বর্ণ মিত্রের গ্রামে চলো (১৯৭২), মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা (১৯৭৩) ও অপারেশন? বসাই টুডু (১৯৭৮), শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শ্যাওলা (১৯৭৭), শৈবাল মিত্রের অজ্ঞাতবাস (১৯৮০), জয়া মিত্রের হন্যমান, সমরেশ মজুমদারের কালবেলা প্রভৃতি।
স্বর্ণ মিত্রের গ্রামে চলো উপন্যাসটি নকশাল আন্দোলনে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের অংশ নেয়ার বিবরণ। প্রেসিডেন্সির ছাত্র অনিরুদ্ধ বাগচী ওরফে রঘুর নকশাল হয়ে গ্রামে কৃষক সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার কাহিনী। নকশাল আন্দোলনে প্রেসিডেন্সির ছাত্রদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। স্বর্ণ মিত্র তার উপন্যাসে সেই ছবিটা দেখাতে চেয়েছেন, ‘…ভয়ঙ্করভাবে বদলে গেল কলেজের ইতিহাস। কলারের শেষ বোতাম আঁটা মেদিনীপুরের সেই লাজুক বোকা ছেলেটার পেছনেও আজ গোয়েন্দা পুলিশের কড়া নজর। …যে ছেলেটি মায়ের হাতের টিফিন বার করতে সংকোচ বোধ করতো, লজ্জা বোধ করতো তার সেই বহু দূরের কুঁড়ে চালাটির পরিচয় দিতে, আজ সেই ছেলেটিও বুক ফুলিয়ে চলে, মাথা উঁচু করে গরিব বংশের পরিচয় দেয়। কলেজে ঘুরে ঘুরে ছাত্রদের সংগঠিত করে। …প্রেসিডেন্সি কলেজের এমন যুগান্তকারী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো সারা বাংলাদেশে। ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্রের দল নানা কলেজ থেকে বেরিয়ে এলো মধ্যবিত্ত জীবনের মায়া কাটিয়ে। কমরেড অচিন্ত্যর নেতৃত্বে তারা দল বেঁধে রওনা দিলো গোপীবল্লভপুর, ডেবড়া, বহরাগোড়া-বাংলা বিহার উড়িষ্যা সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামে। সেই বিপ্লবী স্রোতেরই একটি বিন্দু রঘু।’ পুরো উপন্যাসে একজন শহুরে তরুণ গ্রামের এই কষ্টকর সংগ্রামে কীভাবে অংশ নিয়েছিলেন, তার বিবরণ পাওয়া যায়। উঠে এসেছে কৃষকদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। মাঝে মাঝেই এসেছে পরিস্থিতি অনুযায়ী মাও সে তুংয়ের উক্তি।
নকশাল আন্দোলন নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস বোধহয় মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা। অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান ব্রতী নকশাল আন্দোলনে জড়ায়, তারপর একদিন খুন হয়ে যায়। ‘সেই ব্রতী। মুক্তির দশকে এক হাজার তিরাশি জনের মৃত্যুর পরে চুরাশি নম্বরে ওর নাম।’ ব্রতীর মা সুজাতার জবানিতে উঠে আসে তার প্রাণপ্রিয় সন্তানের গল্প। ব্রতীর থেতলানো মরদেহ ছুঁয়ে দেখেন সুজাতা। সেই দশকে খুন হয়ে যাওয়া অসংখ্য ব্রতীর মায়েদের যন্ত্রণা ধারণ করেছেন সুজাতা। ব্রতীর বাবা দিব্যনাথ নকশালদের ঘৃণা করেন। এমনকি ছেলের মুখাগ্নি পর্যন্ত করেননি। মধ্যবিত্ত পরিবারের নানা ভণ্ডামিও উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। ব্রতীর অপরাধ? মহাশ্বেতা দেবী লিখছেন, ‘অপরাধের মধ্যে ব্রতী এই সমাজে, এই ব্যবস্থায় বিশ্বাস হারিয়েছিল।’ ব্রতীর ঘর সার্চ করে পুলিশ উদ্ধার করে নকশালদের স্লোগানের খসড়া। সত্তরের দশকের অতি পরিচিত সব স্লোগান। ব্রতীর প্রেমিকা নন্দিনী পুলিশি হেফাজতে প্রায় অন্ধ হয়ে যায়, দীর্ঘদিন সলিটারি সেলে থেকে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
গল্প, কবিতা, উপন্যাসের বাইরে নকশাল আন্দোলন নাটক, গান, সিনেমাসহ আরো অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব রেখেছিল। সেসব নিয়ে যথেষ্ট আলোচনার সুযোগ এ লেখায় হচ্ছে না। তবে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নামের পথপ্রদর্শক বাংলা ব্যান্ডটির কথা সামান্য উল্লেখ করতে চাই। ব্যান্ডটির মূল উদ্যোক্তা বলা যায় গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে। মনিদা নামে পরিচিত গৌতম ছাত্রজীবনেই নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে গৌতম গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন, সইতে হয়েছে নির্যাতন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রশাসনের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়তে হয়েছিল তাকে। তারপর ১৯৭৬ সালে জন্ম নেয় কিংবদন্তি বাংলা ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’।
নকশাল আন্দোলনের একটি বিতর্কিত অধ্যায় ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গান্ধী, বিদ্যাসাগর প্রমুখের মূর্তি ভাংচুর। মূলত ১৯৭০-৭১ সালে কলকাতা শহর ও সংলগ্ন অঞ্চলে এ ভাংচুরের কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছিল। নকশালপন্থীদের মূল্যায়নে সে সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ঔপনিবেশিক আর গান্ধী, বিদ্যাসাগররা শাসকদের সহায়ক। তাই সমাজ বদলাতে এসবের উচ্ছেদ ঘটাতে হবে। শশাঙ্ক লিখেছেন, ‘কৃষকের বিপ্লবী লড়াইয়ের অনুপ্রেরণায় পেটি বুর্জোয়া পরিবার থেকে আগত যুবকদের প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষা পদ্ধতির প্রতি আক্রমণ অসামান্য ও অকল্পনীয়। যতদূর জানি, পৃথিবীর কোন দেশের বিপ্লবের ইতিহাসে এর কোন নজীর নেই। পেটি বুর্জোয়া যুবক ও ছাত্ররাই এই প্রতিক্রিয়াশীল উপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার শিকার এবং তাঁরা যুবক বলেই এর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক বিপ্লবী পতাকা তুলে ধরেছেন।’ তবে এ ভাংচুরের ঘটনা খোদ পার্টিতে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। সেদিকে নজর দেয়ার আগে এ অ্যাকশনের পেছনের প্রেক্ষাপটটি নিয়ে সামান্য কথা হতে পারে। বিভিন্ন মত আছে কিন্তু একটি মত বেশ আলোচিত, সেটি হচ্ছে আন্দোলনের প্রাথমিক অধ্যায়ের সমাপ্তি। নকশাল আন্দোলন শুরু হতেই শহরের উচ্চশিক্ষিত তরুণরা গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করার উদ্দেশ্যে গাঁয়ের গরিব কৃষকদের সংগঠিত করতে যান। কিন্তু গ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জোরদার অভিযান শুরু হওয়ায় অনেক তরুণ শহরে ফিরে আসতে বাধ্য হন। নির্মল ঘোষ নগরে ফিরে আসা তরুণদের প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘শহরে আত্মগোপন করাও ছিল তাঁদের কাছে গ্রামের তুলনায় সহজ। তদুপরি শহরে পার্টির নির্দিষ্ট কার্যক্রম তাঁদের বিপ্লবী রোমান্টিকতাকে প্রয়োগের যথেষ্ট সুযোগ দেয়নি। তাই অধৈর্য হয়ে, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের কার্যক্রম স্থির করে নিলেন এবং গান্ধীর মূর্তি ভাঙার প্রয়াস, আমেরিকান ও সোভিয়েত সাহিত্যের বহ্নিউত্সব ইত্যাদি কার্যাবলীকে তাদের কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করেন। এদের প্রাথমিক আক্রমণের লক্ষ্য ছিল আমেরিকা পরিচালিত শিক্ষাসংস্থাগুলি, যা অচিরেই পরিবর্তিত হয়েছিল সমস্ত শিক্ষায়তনের প্রতি আক্রমণে। সাধারণভাবে এরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হঠাত্ উপস্থিত হয়ে অফিসঘর তছনছ করেন, জাতীয় নেতাদের ছবি ভেঙেচুরে, পুলিশ আসবার আগেই স্থানত্যাগ করতেন।’ যহোক, চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত এ ভাংচুরে পূর্ণ সমর্থন জানালেন। কিন্তু পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোর সদস্য সুশীতল রায়চৌধুরী ছদ্মনামে একটি বিবৃতি প্রচার করে এ মূর্তি ভাঙা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলার বিরোধিতা করেন। তার বক্তব্য ছিল, যে বিপ্লবী রাজনীতির জন্য গান্ধী ও গান্ধীবাদ বাধাস্বরূপ, তাই তার মূর্তি ভাঙা যেতে পারে কিন্তু বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরের রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর প্রমুখ বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের মূর্তিভাঙা অনুচিত। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্কারের জন্য অবশ্যই আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র নষ্ট করা বা আসবাবপত্র ভাঙা বা প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরি নষ্ট করা অনুচিত। বলাই বাহুল্য, চারু মজুমদার এ মতকে পাত্তা দেননি। বরং তিনি বলেছেন, ‘যদি গভীর ঘৃণায় ছাত্রেরা আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাংচুর করে, তবে সে কাজে কোন বিপ্লবীরই বাধা দেয়া উচিত না।’
বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে সরোজ দত্ত বলেছিলেন, “বিদ্যাসাগরের দেড়শ বছর পূর্ণ হওয়ার ঘটনাকে মওকা হিসেবে গ্রহণ করে আজ বিদ্যাসাগরের পূজায় কেন এত আড়ম্বর হচ্ছে? ব্যারাকপুরে যখন মঙ্গল পাঁড়ের ফাঁসি হয় এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ সারা বাংলায় জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর কি তখন তার কলেজকে এই বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনানিবাসে পরিণত হতে দেয়নি? ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাঁড়ে যখন ফাঁসিতে উঠেছিল বিদ্যাসাগর কি তখন সংস্কৃত কলেজে বসে ব্রিটিশের জয়গান করে ‘বাংলার ইতিহাস’ রচনা করেনি? তাইতো আজ ছেলেরা গান্ধী ও বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গছে মঙ্গল পাঁড়ের মূর্তি গড়ার জন্য।”
নারায়ণ সান্যালের বিবরণীতে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার এক অজানা কথা উঠে আসে। “কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর-মশায়ের মর্মরমূর্তির যেদিন মুণ্ডচ্ছেদ হয় তার মাসখানেকের মধ্যে সিপিএম (এম. এল) দলের এক নেতৃত্বস্থানীয় ছাত্রনেতার সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হয়েছিল! ঘটনাচক্রে সে আমার নিকট আত্মীয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কট্টর নকশাল। আমার পেচকপ্রতিম বিরস মুখখানা দেখে সে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, ‘বিশ্বাস কর ছোটকাকু! মূর্তিটা যে ভেঙ্গেছে তাকে আমি চিনি। গত বছর হায়ার সেকেন্ডারিতে সে বাংলায় লেটার পেয়েছে। ওর সেই বাংলা প্রশ্নপত্রে প্রবন্ধ এসেছিল তোমার প্রিয় দেশবরেণ্য নেতা। ও লিখেছিল বিদ্যাসাগরের উপর।’
আমি জানতে চেয়েছিলুম, ‘তাহলে ও বিদ্যাসাগরের মূর্তিটা ভাঙল কেন?’ ‘…বিদ্যাসাগরের মূর্তি তো সে ভাঙেনি। ভেঙেছে একটা ফেটিশ! ষড়যন্ত্রী মশাইরা যে ফেটিশের গলায় প্রতিবছর ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর একটা করে গাঁথা ফুলের মালা দুলিয়ে দিয়ে বলেন, আগামীবার ভোটটা আমায় দেবেন কাইন্ডলি! দুঃখ কর না কাকু। সর্বহারার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হলে বিদ্যাসাগরের মূর্তি আবার বসাব’।”
সহায়ক গ্রন্থাবলি ঃ
নকশালবাদী আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য, নির্মল ঘোষ
নকশাল আন্দোলনের গল্প, সম্পাদনা: বিজিত ঘোষ
নকশালবাড়ি : তিরিশ বছর আগে এবং পরে, আজিজুল হক
মননে সৃজনে নকশালবাড়ী, সম্পাদক: প্রদীপ বসু
এবং অন্যকথা ষাণ্মাসিকের নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫০ বছর শীর্ষক সংখ্যা; সম্পাদক: বিশ্বজিত্ ঘোষ, জলধি হালদার
Thema Book of Naxalite Poetry, Sumanta Banerjee
কৃতজ্ঞতা: বণিকবার্তা