| 27 জানুয়ারি 2025
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত কবিতা

অনুবাদ কবিতা: নীলিম কুমার’র কবিতা । অনুবাদক: বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

একজন কালো চামড়ার নারী

 

একটি কালো চামড়ার নারী

 তার কালো চামড়ার নিচে শুয়ে থাকে গভীর একটি সাগর,

 কিন্তু শান্ত ঢেউ। কেউ বুঝতে পারে না

 

 পৃথিবীটা তার কাছ থেকে সবকিছু আদায় করে

 ঝাড়ু হাতে শুরু হয় তার সকালবেলা।

 সূর্য তাকে নমস্কার করে

প্রতি নমস্কার করার মতো তার সময় নেই

 

 ছোট্ট একটি তারা বিছানা থেকে

 কাঁদতে কাঁদতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে

 তার কালো চামড়ার নিচে ভরে থাকে দুধ

 তারাটিকে খাওয়ানোর জন্য তার সময় নেই।

 কারও ওপরে রাগ করলেও তার নেই ক্ষোভ

ঢেউগুলি শান্ত

 

অথচ

 পৃথিবীর সমস্ত দিয়াশলাইর ভেতরে

সেই কালো চামড়ার নারী

 পৃথিবী যখন চায় তাকে জ্বালায়,

 যখন চায় নেভায় …

 

পৃথিবী যা চায় তাই দিতে হয় তাকে

 বুকের উনুনে সেঁকে

 দুঃখের কড়াইতে ভেজে

 নিজেরই স্বপ্ন  পুড়ে পুড়ে

 খাওয়ায় পৃথিবীকে।

নিজেকে বেড়ে দেয় ভাতের থালে

একজন কালো চামড়ার রাঁধুনি –পৃথিবীটা

 তাকে জালে ফেলে।

 তার কালো চামড়ার নিচে শুয়ে থাকে

 একটি গভীর সাগর, শান্ত ঢেউ

 কেউ বুঝতেও পারে না

 

 সে যদি একদিন রান্নাঘরে না ঢোকে

পৃথিবীটা সেদিন ক্ষুধার্ত থাকবে,

 সে যদি একদিন পৃথিবীকে জল ঢেলে না দেয়

 জগতটা সেদিন তৃষ্ণায় মরবে,

 সে যদি ফুলে জল না দেয়

 পৃথিবীর বাগান গুলি মরে যাবে ,

সে যদি মেঘের গান না গায়

 পৃথিবীতে বৃষ্টি হয় না,

 সে না ডাকলে  রোদ আসে না।

সে না ডাকলে বাতাস আসে না।

তাই ভোরবেলা দরজা খুলেই সে

 সবাইকে ডাকে

 ডানা ঝাপটে ঝাপটে পাখিগুলি আগেই আসে…

 

পৃথিবীর গ্রামে গ্রামে আছে

 পৃথিবীর শহরের শহরে আছে সেই মেয়েটি

 কালো চামড়ার নারী,

যার ঠোঁটে থাকে পৃথিবীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার মতো

ঘুম পাড়ানি গানের অরণ্য

 

একজন কালো চামড়ার নারী

সে তার কালো চামড়ার নিচে বড়ো আলগোছে

 একটা কলসে ঢুকিয়ে রেখেছে

 ছোট্ট এক টুকরো আকাশ।.

 এই ভেবে যে— যদি কখনও

 শেষ হয়ে যায় পৃথিবীর ওপরের আকাশ,

 তখন তাকেই যে পেড়ে দিতে হবে

সেই আকাশটা…

 

 

 

নিঃসঙ্গতা বিষয়ক

 

মানুষ যেভাবে কখনও অকারণে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে

ঠিক সেভাবে একটি প্রজাপতিও কখনও অকারনে

নিঃসঙ্গ হয়। একটি পাখিও সেভাবে নিঃসঙ্গ হয়।

সেভাবে নিঃসঙ্গ হয় জঙ্গলের কোনো জন্তু।

এমনকি অরণ্যের অজস্র গাছের মধ্যে একটি গাছও

নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে কখনও।

একটি ক্ষুদ্র পিঁপড়া, মানুষের মতো সেও  কখনও

নিঃসঙ্গ হয়ে কোনো একটি কোণে নীরবে অপেক্ষা করে থাকে।

 

মানুষ নিঃসঙ্গ হওয়ার মতো

নদীও কখনও নিঃসঙ্গ হয়। নিজের বুকে

খেলতে থাকা মাছগুলিকে কখনও নদীটির  নিজেরই ভালো লাগে না।

বয়ে যেতে ইচ্ছা করে না, অথচ বয়ে যেতে হয়।

সাগরকেও তো সব সময় নিঃসঙ্গ বলেই মনে হয়।যেভাবে

চাঁদ নিঃসঙ্গ। সূর্য নিঃসঙ্গ।

তারাগুলির মাঝখানে কোনো একটি তারা নিশ্চিতভাবেই

নিঃসঙ্গ

 

নিঃসঙ্গ হওয়াটা এক ধরনের সৌন্দর্যই।

এটা কেবল মানুষের জন্যই নয়।

কে কখন কেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে

তা জানাটা সম্ভব নয়। বহুক্ষেত্রে

এর কোনো কারণই থাকে না।

বিশ্বাস হয়না, কিন্তু একটি শপিংমলও নিঃসঙ্গ

হয়ে পড়তে পারে। একটি স্কুল নিঃসঙ্গ

হয়ে পড়তে পারে। একটি পার্ক ,একটি গম্বুজ,

একটি চিমনি, একটি লাইটপোস্ট ,একটি বাস

একটি সাইকেল নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তে পারে।

কে ভাবতে পারে যে লোহায় নির্মিত

পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী যন্ত্র চালিত রেল গাড়িটাও

যে মানুষের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে কখনও?

 

আপনারা হয়তো

এখন আমাকে প্রশ্ন করবেন যে–

এই নির্জীব বস্তু এবং যন্ত্রগুলি

কীভাবে ‘নিঃসঙ্গতা’ অনুভব করবে?

সেটাইতো—

নির্জীব বস্তু আর যন্ত্রগুলির ভেতরে

প্রাণ সঞ্চার করাই কি কবিদের কাজ নয়!

 

 

বয়স

 

পাহাড় আমার চেয়ে বয়সে বড়ো,

আমি পাহাড়কে প্রণাম করি।

নদী আমার চেয়ে  বয়সে বড়ো,

আমি নদীকে প্রণাম করি।

পাথরগুলি আমার চেয়ে বয়সে বড়ো,

আমি পাথর কি প্রণাম করি।

অরণ্য আমার চেয়ে বয়সে বড়ো

আমি অরণ্যকে প্রণাম করি।

আকাশ আমার চেয়ে বয়সে বড়ো,

আমি আকাশকে প্রণাম করি।

সূর্য আমার চেয়ে  বয়সে বড়ো,

চাঁদ এবং তারা আমার চেয়ে বয়সে বড়ো,

আমি সূর্য- চাঁদ- তারাকে প্রণাম করি।

 

দাদু শিখিয়েছিলেন

বয়সে বড়োদের প্রণাম করতে হয়।

বাবা শিখিয়েছিলেন

বয়সে বড়োদের প্রণাম করতে হয়।

শিক্ষক শিখিয়েছিলেন

বয়সে বড়োদের প্রণাম করতে হয়।

আমিও আমার মেয়েকে শিখিয়েছিলাম

বয়সে বড়োদের প্রণাম  করতে হয়।

আজ আমি যখন

একটি নতুন বাড়ি বানানোর নেশায়

আমার পিতার জন্মের আগেই

দাদু তৈরি করা বাড়িটা ভেঙ্গে দিলাম,

আমার মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল–

বাবা, এই বাড়িটা

তোমার চেয়ে বয়সে ছোটো ছিল নাকি?

 

 

 

আমি নিজের পেছন পেছন যাই

 

আমি নিজেকে অনুসরণ করি।

আমি যে নিজেকে অনুসরণ করি এই কথাটা

সে বুঝতে পারে, আর আমাকে ছেড়ে

দ্রুত এগিয়ে যায়।

আঁকাবাঁকা ভাবে যায়, যাতে

আধা রাস্তায় আমি থেমে যাই।

তথাপি

আমি নিজেকে অনুসরণ করা ছাড়িনি।

সে আমাকে সূঁচলো পাথরগুলির ওপর দিয়ে নিয়ে গেছে,

খাড়া পাহাড়ের ওপর দিয়ে নিয়ে গেছে,

কাঁটাগুলির ওপর দিয়ে নিয়ে গেছে…

আমার পায়ের অবস্থা খারাপ!

রক্তাক্ত আমার দু পায়ের পাতা

প্রতি পদক্ষেপে আমার রক্ত…

তথাপি

আমি নিজেকে অনুসরণ করি।

কারণ তাকে বাঁচাবার জন্য

আর কেউ তো নেই

আমি ছাড়া!

 

 

 

সর্বহারা ঈশ্বর

 

অরণ্যটির মাঝখানে

ছোটো একটি মন্দিরে

এতদিন সুখেই ছিলেন ঈশ্বর

 

মাঝেমধ্যে তার কাছে কেউ যেত বহুদিন পরে

দেখেছিল- শুকিয়ে যাওয়া লাল জবা ফুল,

নিভে যাওয়া প্রদীপ, শুকনো সলতে এবং

জ্বলে শেষ হওয়া ধূপের কাঠি গুলির মধ্যেও

ঈশ্বরের কোনো অসন্তোষ ছিল না

 

কিন্তু গতরাতের ঝড় বৃষ্টিতে

মন্দিরটা ভেঙে ঈশ্বরের গায়ে পড়ল।

মাটির ঈশ্বরের দুটো পা ভাঙল ,

গলা থেকে ছিটকে গেল মাথাটা,

হাত দুটো ছিঁড়ে গেল!

নিজের শরীরটা হারিয়ে

সর্বহারা হয়ে পড়ল ঈশ্বর

 

কিন্তু

ঈশ্বরের একটা কথাই আমার ভালো লাগে যে

সর্বহারা হয়ে পড়লেও

মানুষকে আশীর্বাদ দেওয়া থেকে ঈশ্বর বিরত হয় না!

 

দেখুন_

আমাদের ঈশ্বরের হাত দুটি

ছিঁড়ে পড়ে থাকলেও

আশীর্বাদ দেওয়ার ভঙ্গিতেই ছিঁড়েছিল

 

   

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত