স্মরণে শ্রদ্ধায় মননে সাধক নীলোৎপল সাধ্য । শিল্পী অদিত্য বসু
“যাব না গো যাব না রে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায় রব আপন কোণে,”
কবি গুরুর এই দুটি গানের লাইন গত ১৮ই মার্চ ২০২০ সালে সত্যিই খুব ভাবিয়ে তুলে ছিল, যেদিন ‘সহজ মানুষ’ নামক আলেস থেকে প্রচারিত লাইভ অনুষ্ঠানটির ৩৩৫ তম পর্বে শ্রদ্ধেয় নীলোৎপল সাধ্যের স্মরণাঞ্জলি অনুষ্ঠান আমাদের প্রিয় আবৃত্তিকার, লেখক, গবেষক, সঞ্চালক শ্রদ্ধেয় রবি শংকর মৈত্রীদা আয়োজন করেছিলেন। একটানা সাড়ে তিন ঘন্টার লাইভ অনুষ্ঠানটিতে বিভিন্ন শিল্পী ওনাকে নিয়ে ওনার সাংগীতিক অবদান নিয়ে বেশ কিছু তথ্য সমৃদ্ধ আলচনার সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে ওনার সহধর্মিনী ঝর্ণা বৌদির আলাপচারিতা ও ওনার কন্ঠের বে শ কিছু গানের ভিডিও শোনা – লাইভ অনুষ্ঠানটিতে ছিল নিঃসীম ব্যকুলতা এবং মন পাগল করা এক অসীম আকুতি (একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি ), আমি সত্যি কোন লাইভ অনুষ্ঠান একটানা এতক্ষণ শুনি না – কিন্তু সেদি ন এই অনুষ্ঠানটির প্রতি এক অমোঘ টান অনুভব করলাম একমাত্র গুণী শি ল্পী সংগীতের পরিব্রাজক শ্রদ্ধে য় নীলোৎপল সাধ্যের অফুরন্ত ভান্ডার দেখে , শুনে।
কিযে পেলাম সেই স্মরণানুষ্ঠান থেকে দাঁড়ি পাল্লায় তার নাই বা হিসে ব করলাম, কিন্তু একটা কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমরা এখনো – না, না, দাদা আপনি কোথাও যাননি – আপনি এখনো বাংলাদেশের দুর্গম-দূরবর্তী জেলায় জেলায় অনেক নবীন-নবীনাদের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী ও সুর পৌঁছে দিয়ে চলেছেন সংগীতে র একনিষ্ঠ পরিব্রাজক হিসেবে।
আপাতদৃষ্টিতে যার সাথে আমার কোন আলাপ নেই, দেখিনি কোনদিন, কিছুই জানি না তাঁর সম্বন্ধে – ১৮ই মার্চের আগে যার কন্ঠ আমার কাছে অচেনা – তাঁকে নিয়ে আমার এত লেখার সাহস! কিন্তু শুধুই সাহস নয়, এই মানষুটিকে নিয়ে এপার বাংলায় বসে কিছু লেখার ইচ্ছে জন্মাল অকপটে , মনের কোণের আড়ালে বেশ কিছু কথা কেন জানি না উঁকি মারতে শুরু করলো- অসম্ভব মনের তাগিদ অনভুব করলাম -অবশেষে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কলম ধরলাম, আশায়- অপেক্ষায় রইলাম পাঠককুল একবার পড়ে দেখবেন হয়ত কোন কর্মের অবসরে।
নীলোৎপল সাধ্য ছিলেন একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, দক্ষ সংগঠক, প্রকৌশলী এবং প্রশিক্ষক, জন্মগ্রহণ করে ছিলেন ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত ধোবাউড়া গ্রামে । পিতা জ্ঞানেন্দ্রনাথ সাধ্য ছিলেন তবলার এক সাধক আর কাকা সুনীল সাধ্য ছিলেন সংগীতসাধক। তাই সুষ্ঠ সাংগীতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা মানুষটির ৫ বছর বয়স থেকেই সুরের প্রতি আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার। অচিরেই কাকার ছত্রছায়ায় শুরু হল তাঁর সংগীতের হাতেখড়ি পর্বটি।
কোনভাবেই তাঁর সংগীতশিক্ষা ও তবলা শিক্ষায় ভাটা পড়েনি সেই শৈশব কাল থেকেই – তাই তো পাঁচ বছর বয়সেই সংগীত বিষয়ে প্রথম পুরষ্কার লাভ গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়াকালীন। এতো কম আনন্দের খবর নয় তাঁর সংগীত জীবনের শুরুতেই। শুধু তাই নয়, ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে জ্যাঠামশাইয়ের প্রিয় অভ্যাস ছিল রেডিও শোনা-সেই সুবাদে আকাশবাণী আয়োজিত পঙ্কজ মল্লিকের সংগীত শিক্ষার আসর তাঁর বাল্য বয়সে কম উজ্জীবিত করেনি তাঁকে, যেখানেই খেলে বেড়াত না কেন, বালক নীলু ছুটে চলে আসত। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল তাঁর চিরবন্ধু, চিরনির্ভর ও চিরশান্তির একমাত্র আশ্রয়স্থল। ফলস্বরূপ একাধিক গুনী মানুষের সংস্পর্শে আসা এবং ক্রমাগত তালিম প্রাপ্তি ঘটতে থাকে।
১৯৮১ সালে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের ময়মনসিংহ শাখার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সময় সংগীতগুরু ওয়াহিদুল হকের নজরে পড়েন এবং পর্যায়ক্রমে এক অন্যতম শিষ্য হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে তাঁর ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে ওঠেন এবং নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায়ের গুণে ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে সংগীত প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। এমন কি, ১৯৮১ সালে প্রখ্যাত গুণী শিল্পী শ্রী শৈলজারঞ্জন মজমুদার বাংলাদেশে আসেন, সেইখানে ও নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও অধ্যাবসায়ের গুণে অচিরেই নীলোৎপল সাধ্য অন্যতম একটি আসন অধিকার করে নেয়। ওয়াহিদুল হক ছিলেন তাঁর একাধারে সংগীতগুরু ও কর্মগুরু। ওয়াহিদুল হকের প্রবাহমান ধারাকে তাঁর একনিষ্ঠ শিষ্য নীলোৎপল সাধ্য পরম্পরা অনসুারে যুগোপযোগী শিষ্য তৈরি করে বেড়িয়েছেন – দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে – যার জীবনে কোন নাম-যশ-অর্থ কোনটিরই আকাঙ্ক্ষা ছিল না। সবাই বলত ওয়াহিদুল ভাই আর নীলোৎপল সাধ্য এক অপূর্ব মানিক জোড়। ওয়াহিদুল ভাইয়ের মহাপ্রয়াণের পর নীলোৎপল সাধ্য এই গুরুদায়িত্ব একা নিজের করে নিয়ে ছিলেন। এরকম জেলা উপজেলা মিলিয়ে একনিষ্ঠভাবে সংগীত শিক্ষাদান এবং নবীন প্রজন্মের কন্ঠে সুরের বিচার ওনার মত আবেগ তাড়িত হয়ে কাউকে করতে দেখা যায়নি। এই ‘পদ্মফুলটি’ চিরকালিনঃ স্বার্থভাবে একাধারে তাঁর কর্ম করে গেছেন। তিনি সব সময় বলতেন একটা কথা- “রবীন্দ্রনাথের গান আমার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, সমস্ত গ্লানি ও মলিনতা থেকে দূরে রাখে; আমার জীবনের সকল শুভকর্মের নির্দেশিকা”।
একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি তিনি কত বড় সংগীত সাধক ছিলেন যে ১৯৮১ সাল থেকে ২০১৮ অবধি শুধু রবীন্দ্রচর্চায় ১০০০ থেকে ১২০০ কর্মশালা জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ আয়োজিত মনের তাগিদে, প্রাণের তাগিদে করে বেড়িয়েছেন – তাই প্রত্যেকটা মানুষের আকুন্ঠ ভালবাসায়, প্রাণের আবেগে হৃদয়ের মণি কোঠায় তাঁর নামটি এখনো জ্বলজ্বল করে ভাসছে। তিনি সবসময় মনে প্রাণে চাইতেন আর বলতেন প্রকাশ্যে- “গুরুদেবের গড়া শান্তি নিকেতনে যে পরিবেশে শিক্ষাদান করা হত, আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি সেই পরিবেশে আমাদের দেশেও (বাংলাদেশ) শুদ্ধভাবে রবীন্দ্রনাথের গানকে যেন শেখানো হয়।”
কর্মজীবনের ক্ষেত্রে ও টি.এন্ড.টি. বোর্ডে কর্মরত অবস্থায় যখন যেখানে দরকার ছুটে গেছেন এবং বাহবা কুড়িয়েছেন। তিনি বেশ কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিষয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে, শিল্পী ও প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ওয়াহিদুল হকেরই গড়া ‘আনন্দধ্বনি’ সংগঠনের সাথে এবং ছায়ানট সংগীত শিক্ষায়নের সাথে, সংগীতে যে মন ছিল তাঁর অগাধ পান্ডিত্য, তেমনি ছিল তাঁর অতুলনীয় জ্ঞানভান্ডার। শুধু রবীন্দ্রসংগীত নয়, বাংলা পুরাতনী গান এর জগতে ও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ- কখনো চয়নে থাকত তাঁর দাশরথী রায়-কমলাকান্ত-গিরিশ চন্দ্র ঘোষ; আবার কখনো অতুলপ্রসাদ সেন- রজনীকান্ত- দ্বিজেন্দ্রগীতি- ব্রহ্মসংগীত এমন কি উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ও মনমোহন চক্রবর্তীর গান। কি বিচিত্র সুষমায় সুসজ্জি ত তাঁর জ্ঞানে র ভান্ডার।
২০১৬ সালে সাধক নীলোৎপল সাধ্য কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন এই সংগীতের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে দিনের পুরো সময় আত্মত্যাগী হয়ে যাবেন, ঠিক সেই সময় শারীরিক ভাবে অসুস্থতায় তাঁকে হার মানতেই হয়েছিল। কিন্তু খানিক সুস্থ হয়ে তি নি আবার শিক্ষাদানে ব্রতী হন। কিন্তু কি ছুঁতেই মারণ রোগে র হাত থেকে নিজে কে বাঁচাতে পারলেন না। অবশেষে ১৭ই মার্চ ২০২০ সালে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন, রোগের কাছে পরাজয় হলে ও জনগনের মননে, হৃদয়ে তিনি চিরকাল অজেয় হয়ে থাকবেন, আছেনও।
কিন্তু প্রশ্ন একটাই মনে বারবার উদ্বেক করে – সব কিছু ছেড়ে এই মোহময় কর্মকান্ডের জগত ছেড়ে-ঝর্না দিদিভাই আর মিষ্টি মেয়েকে ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি আপনার ওই পারে চলে যাওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল ‘দাদা’?
আপনার চির পরিচিত ঘরটাকে তো আপনারই যত্ন করে রাখার কথা ছিল –
– ‘আমার এ ঘর বহু যতন করে
ধুতে হবে মছুতে হবে মোরে’
না না দাদা, আপনি কোথাও যাননি – একনিষ্ঠ শিল্পী ও সাধকের মৃত্যু নেই বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস! আপনি আমার মত অগনিত সংগীতপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে চিরকালের মত একটি আসন লাভ করেছেন এবং সারাজীবন থাকবেন শ্রদ্ধাবনত –প্রণম্য – গুণী মানুষ হিসেবেই। রইল আমার প্রণাম আপনারই চরণে , শেষে আবারও বলি কবি গুরুর কথায় –
– ” তুমি যে চে য়ে আছো আকাশ ভরে
নিশি দিন অনিমেষে দেখছ মোরে ।”
