| 19 মার্চ 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

নতুন আন্তর্জাতিকের সময় এখনই

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

কাথরিন ইয়াকুবসদত্তির

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

 

 

 

 

 

 

 

 

 

[মহামারীর সূচনা হয় সাধারণভাবেই, নতুন কোন রোগের শারীরিক সংক্রমণের মাধ্যমে। প্রাথমিক ধকল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর দিয়ে গেলেও ক্রমশ: তার প্রভাব পড়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। কোভিড মহামারীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিশ্বব্যাপী মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র এখন স্পষ্ট।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের সকল প্রগতিশীলদের এক কাতারে শামিল হওয়ার আহবান জানিয়েছেন আইসল্যান্ডের প্রধান মন্ত্রী কাথরিন ইয়াকুবসদত্তির। তিনি আইসল্যান্ডের লেফট গ্রিন মুভমেন্ট দলের প্রধান এবং ‘প্রোগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনালে’র কাউন্সিল সদস্য। মে মাসের ১১ তারিখে ‘প্রোগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনালে‘র ওয়েবসাইটে এই বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়।]

 

২০০৮ সালের আর্থিক ধ্বসের প্রাক্কালে যারা বিশ্বের বিত্তশালী ব্যক্তিদের সুরক্ষা দিয়েছিল তাদের নীরব মন্ত্র ছিল, ” কখনো সঙ্কট-কালীন সুযোগের অপচয় করবেন না” (Never let a good crisis go to waste)।

যখন পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ প্রাণঘাতী মহামারীর কারণে সৃষ্ট গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করছে তখন প্রবচন নয়, বরং সতর্ক বার্তা হিসাবেই এই কথাটি মনে পড়লো। জরুরি অবস্থা কার্যকর এবং স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করার এই অবস্থায় আমাদের ‘সঙ্কট’-কালীন’ সময়ের সুফল লাভের বিষয়ে সজাগ হওয়া বেশি দরকার।   

ইতোমধ্যেই মহামারীর অজুহাতে সংসদের ক্ষমতা হ্রাস করার এবং অধ্যাদেশের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনার  উদ্যোগ দৃশ্যমান। রাজপথে ভারী অস্ত্রসহ পুলিশ ও সেনা মোতায়েন, আইন ভঙ্গের কারণে গ্রেপ্তারের হুমকি এবং মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতার প্রয়োগ এরই বহিঃপ্রকাশ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য প্রণীত আইন এবং রাষ্ট্রীয় নজরদারী বাড়ানোর জন্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে নাগরিক স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন। মহামারীর এই সময়ে সরকার জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ও সামাজিক শক্তিসমূহের সমাবেশ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই সকল কার্যক্রম কিভাবে করা হচ্ছে তা খেয়াল করা; এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এর ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিভিন্ন সরকার আপদকালীন যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা কি সংকট উত্তরণের সাথে সাথেই তুলে নেয়া হবে নাকি তা “রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও নাগরিক অধিকারে”র এবং সরকারে “নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভা”র ভারসাম্যকে স্থায়ীভাবে ধ্বংস করে দেবে।

অতীতের অভিজ্ঞতা যদি দিক নির্দেশক হয়, তাহলে আমাদের অবশ্যই জাতীয়তাবাদী পশ্চাৎপদতার খপ্পরে পড়তে হবে। ডানপন্থী কর্তৃত্বপরায়ণ ও জনতুষ্টিবাদী শক্তি অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ব্যবহারের সুযোগ খুঁজবে। এর সাথে যুক্ত হবে কোভিড ১৯ সাথে ‘অন্য’ (আগন্তুক/ অচেনা, বিদেশি, বহিঃশত্রু) অভিধা যোগ করে নতুন বৈষম্যমূলক শাসন চাপিয়ে দেয়ার জন্য জাতি-রাষ্ট্রের ”পুনঃ সীমানা-নির্ধারণে”র বা “পুনঃ অঞ্চলভুক্ত করার” দাবী। প্রকৃত অর্থে বহুজাতিক সংকট নিরসনে এই ধরণের জাতীয়তাবাদী প্রচেষ্টা আন্তঃরাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিভেদকে কেবলমাত্র গভীরই করবে। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী উলরিখ বেক অভিহিত “ঝুঁকিপূর্ণ সমাজ”-, যার সাথে যুক্ত মহামারী, জলবায়ু পরিবর্তন, পারমাণবিক দুর্ঘটনা ইত্যাদি-, বিশ্বায়নের যুগের এই পৃথিবীতে কোন সার্বভৌম সীমারেখা ও সীমান্তকে সমীহ করে না। এ জাতীয় ঝুঁকিগুলি “গণতান্ত্রিক” এই অর্থে যে তা সামগ্রিকভাবে পুরো মানবজাতিকে মোকাবেলা করতে হয়, এমনকি কিছুটা অসমভাবে হলেও।

মহামারীর ফলে, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং “সামাজিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা”র সামর্থ্যের ঘাটতির কারণে গরীব দেশগুলোকে ধনী দেশগুলোর তুলনায় দীর্ঘমেয়াদী ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিশ্বায়ণের এই পৃথিবীর দক্ষিণে এর ফলাফল দাঁড়াবে আন্দোলনের স্বাধীনতায় অধিকতর নিষেধাজ্ঞা, একই সাথে রপ্তানি বাজারের সংকোচন ও আর্থিক সম্পদে সীমিত সুযোগ। বিশ্বায়ণের এই পৃথিবীর উত্তরে প্রাণহানির ক্ষেত্রে কিছু দেশ ইতোমধ্যে শ্রেণি এবং জাতি ভিত্তিক পার্থক্য প্রত্যক্ষ করছে কারণ অপেক্ষাকৃত বিত্তবানরা কর্মস্থল ও বাসগৃহে ‘সামাজিক-সঙ্গ’ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছে। অন্য কথায়, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ”সামাজিক ঝুঁকিসমূহ”কে সবচেয়ে অরক্ষিত রাষ্ট্র ও সমাজে স্থানান্তরের অপচেষ্টা রুখে দেয়া এই লড়াইয়ের অংশ। মহামারী অন্ততঃ একটা বিষয় স্পষ্ট করেছে মানব জাতির অস্তিত্বের শঙ্কা সর্বজনীন – জাতীয় সার্বভৌম অঞ্চলের মোড়কে কোন “কল্পিত সমাজে” সীমাবদ্ধ নয়।

চলমান সংকট ইতোমধ্যে অনেক ক্ষতিকর রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ইন্ধন যোগাচ্ছে। অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন শ্রেণিভুক্তির মাধ্যমে গর্ভাবস্থা অবসানের অধিকারকে খর্ব করার চেষ্টাসহ সেক্সিস্ট নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। বিনামূল্যে সরবরাহের কারণে সহিংস পর্নোগ্রাফির চাহিদা বেড়েছে। মহামারীর সময়ে নেয়া আইসোলেশনের কারণে পারিবারিক সহিংসতা বহুগুণ বেড়েছে, একই সময়ে পুলিশ ও ‘শিশু সুরক্ষা সেবা’য় অভিযোগ হঠাৎ বেশ হ্রাস পেয়েছে। ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরুতে বর্ণবাদ ও বিদেশীভীতির (xenophobia)  প্রকোপ দৃশ্যত বৃদ্ধি পেয়েছিল মূলতঃ এশীয় বংশোদ্ভুতদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া ও অন্যান্য চরম কর্মসূচী বিশ্বব্যাপী সকল অভিবাসী, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের প্রাপ্য সুরক্ষা আরও নাজুক হয়ে প্রকৃত অর্থে হুমকিতে পরিণত হয়েছে। বহিরাগতদের বাদ দেয়ার সদা সক্রিয় জাতীয়তাবাদী প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ”বৈষম্যহীনতাসহ কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ভিত্তিক” আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনসমূহকে সমর্থন যোগানো এখন আরো বেশি জরুরি।

এই সংকট আমাদের গণতন্ত্রকে কী করবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সকল দেশ সুফল না পেলেও অনেক দেশেই সরকারের নেয়া কঠোর পদক্ষেপ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ কমিয়েছে এবং এর ফলে মহামারীজনিত ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যু হ্রাস পেয়েছে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গণতন্ত্রী রাজনীতিবিদরা দুর্যোগ মোকাবেলার দায়িত্ব ক্রমশঃ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের হাতে অর্পণ করেছে, আবার তা নিয়ে রাজনৈতিক চালের চেষ্টাও আছে। অবশ্যই কঠিন জিজ্ঞাসা হচ্ছে এই পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ কতদূর যেতে পারবে যেখানে বিশেষজ্ঞরা মানুষকে ‘গৃহে অন্তরীণ’ ও ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার’ নির্দেশনা দিচ্ছে আর অন্যদিকে  ব্যবসায়ীরা কায়েমী স্বার্থে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করছে। তবে কোভিড প্রাদুর্ভাব আবারো প্রমাণ করলো, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও শক্তিশালী জনকল্যাণমুখী  ব্যবস্থা কেবলমাত্র সামাজিক ন্যায় বিচারেরই নয়, একটি কার্যকর সমাজ পরিচালনারও অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। যদিও এই উপলব্ধি বৈষম্যমূলক জাতীয়তাবাদী ধারণার সমর্থনে ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভাইরাস বিষয়ে ভুল তথ্যের অপপ্রচার রোধ করতে পারেনি।

এই দুর্যোগকে ব্যবহার করে কর্তৃত্বপরায়ণ ও জনতুষ্টিবাদী ডানপন্থীদের পশ্চাৎপদ কর্মসূচী এগিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে, জরুরি অবস্থার এই সময়ে আমাদের দ্রুতই দুনিয়া জুড়ে প্রগতিশীল শক্তির মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক সংহতি জোরদার করা দরকার।

একটি প্রগতিশীল ‘আন্তর্জাতিক’, অতি প্রয়োজনীয় সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষে আন্দোলন তৈরি, নীতি নির্ধারণ ও ভাব বিনিময়ের প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করবে। এই কারণেই আইসল্যান্ডিক লেফট গ্রিন মুভমেন্টের অংশগ্রহণ।

যদি লড়াই করার – ইতিহাস তৈরি করার কোন সময় হয়ে থাকে তা এখনই।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

One thought on “নতুন আন্তর্জাতিকের সময় এখনই

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত