Categories
ঐশ্বর্য্যময় এক কল্পবিজ্ঞান সংকলন ‘অঙ্কিটের বুদবুদ’
আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট


“শ্রুত্বা গ্রামান্তরে অহং ভালো বটে সিরিনী সত্যনারায়ণস্য
গত্বা তারাতিহর্ষাদাটখানি বাতাসা পাইলামবশেষে
রাত্রৌ তীব্রান্ধকারে চোখে কিছু দেখিনা ঘা গুঁতা খাই কপালে
ভুক্ত্বা খেদান্বিতো হং ফিরে আসি বাড়িতে বৌ বলে কে রে কিলা রে “
সিন্নি লোভী বটকৃষ্টর গ্রামান্তরে গিয়ে আটখানি বাতাসা লাভ ও অন্ধকারে বাড়ি ফিরে গৃহিনীর চোর সন্দেহে তাড়না। এই অর্ধপক্ব শ্লোক নাকি এক কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর অংশ! (স্পয়েলার হয়ে যাবে বলে গল্পটা বলছিনা।) কয়েক বছর আগে এক শারদ সংখ্যায় পড়ে হেসে হেসে অস্থির হয়েছিলাম, আর যে নির্মল আনন্দ পেরেছিলাম তার সঙ্গে তুলনীয় কেবল ঘনাদা কাহিনীর রামভুজের ‘কি হৈল বাবু মাগুর মাছের ঝোল খাইবেন না’ এবং ‘ মাগুর মাছের ঝোল খাবো আমি!’ প্রসঙ্গ। ভালো কল্পবিজ্ঞানকে কিন্তু উৎকৃষ্ট সাহিত্য হতে হবে। তা না হলে কল্পবিজ্ঞান পড়ে এক প্রজন্মের বেড়ে ওঠার আশা বৃথা! যশোধরা যশস্বী কবি, তাঁর গদ্যের হাত মারকাটারি রকমের ভালো। কল্পবিজ্ঞান লেখক পিতার বিজ্ঞানমনস্কতায় যুক্ত হয়েছে তাঁর নিজের পাঠ ও প্রতিভা। ‘অঙ্কিটের বুদবুদ’ বইটির উন্মোচনের সময় উপস্থিত ছিলাম না বলে মনে যে ঈষৎ দু:খ ( মিশ্রিত ঈর্ষাও) ছিল , একদিন ঝলমলে বাতাসের মতো বইটি লেখক এসে উপহার দেওয়ায় মন ভালো হয়ে গেল। নানা পত্র পত্রিকায় লেখা গল্পগুলির মধ্যে লিখনশৈলী আর বিষয় বৈচিত্র্যের মহাভোজ। ‘কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে আমার আশ্চর্য সম্পর্কগুলো প্রসঙ্গে ‘ নামের ভূমিকায় যশোধারা লিখেছেন ” যে কবিতা লেখে তার কল্পনা শক্তিই আরও একটু ছড়িয়ে গেলে কল্পবিজ্ঞানের মহল্লায় বিস্তার পায়। পণ্যায়িত দুনিয়ার যন্ত্রায়িত প্রাণহীন জীবনের ওপরে টিপ্পনি দেওয়ার পাশাপাশি আমার কলমে কল্পবিজ্ঞান অস্বাভাবিক কিছু না বরং খুবই প্রাঞ্জল , অর্গানিক।”এই কথাগুলো সত্যি তো অবশ্যই কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতার সঙ্গে কল্পনা ও সাহিত্য মেলানোর ক্ষমতা সবার থাকেনা। হয়তো আমি নিজে কল্প বিজ্ঞান লিখিনি বলে আমার মনে এর রহস্য পুরোপুরি উন্মোচিত নয়। ‘জানালা’ বলে একটি গল্প আছে সংকলনে। ‘নৈয়ায়িক বটকৃষ্ট ‘ যিনি লিখতে পারেন, তিনিই লেখেন ‘জানালার’ মত গভীর এক মনস্তাত্বিক গল্প যা মানব সভ্যতার ক্রূরতাকে চ্যালেঞ্জ করে, স্মৃতিহীন অস্তিত্ব থেকে নীরজার বেরিয়ে আসার গ্রহণ প্রতিজ্ঞার মধ্যে দিয়ে। কেবল কল্প বিজ্ঞান নয, গল্পটি এক অসামান্য উচ্চতায় পৌঁছেছে মুক্তিকামী মানুষের আত্ম অন্বেষণে ।যশোধরার ভাবনা চিন্তা বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন গল্পে নানা মাত্রা পায়। রোবোদের মানুষ সদৃশ আচরণ, তাদের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ আবার মানুষের আবেগ নিয়ে তাদের ফিরে আসা সবই এই কল্প অভিযানের নানা দিক।’ হরিহর বাবু ও সেই রোবো’ র মত নির্মল হাসির গল্প কিন্তু শেষ কথা নয় — ‘মাঠের আড্ডা’ র মত এত মন ভোলানো, মন কেমন করানো, একে বারে ছোটদের জন্য এক মায়া ভরা গল্প — হারানো শৈশবের জন্য কতখানি মায়া থাকলে লেখা সম্ভব হয়! গল্পগুলি ভাবায়, ভোলায়, চিন্তাশক্তিকে বাড়িয়ে দেয়, আর মনে আনে ভালো সাহিত্য পাঠের অনাবিল আনন্দ। সূর্যশেখরের ধাঁধা গল্পটি অন্যরকম। যতটা বিজ্ঞান কল্পনা , তার চেয়ে বেশি বিজ্ঞান সাধনা নিয়ে দূরে চলে যাওয়া এক মানুষের নিজের কালে , নিজের মানুষের কাছে ফেরার চেষ্টা।
ছ’টি অনুবাদ গল্প এই সংকলনে রেখে পাঠকের খুব উপকার করেছেন যশোধরা। এগুলি একসঙ্গে পাওয়া এক সৌভাগ্য। তাছাড়া, যশোধরার অনুবাদ গল্পগুলিকে মৌলিক গল্পের স্তরে নিয়ে গেছে। সি এল মূর এর ‘দ্য ব্রাইট ইলিউশন’ এর অনুবাদ ‘উজ্জ্বল বিভ্রম’ গল্পটি যেমন। উপন্যাসোপম দীর্ঘ কাহিনীটি যেন এক ত্রিমাত্রিক জগতের মধ্যে দিয়ে যাত্রার চলচ্ছবি। অনুবাদ কাজ হিসেবে অসামান্য আবার সাহিত্যের দর্শন হিসেবেও।
এক সর্ব নিয়ন্ত্রক ঈশ্বরের জগতে, দীক্ষণ অলৌকিক বিচরণের মধ্যে প্রেমে আকৃষ্ট হয় এক নারীর, যার রূপ মানুষীর নয়, বরং এক সরীসৃপ জাতীয় কিছুর, কিন্তু দীক্ষণ চলে যাচ্ছে রূপ থেকে অরূপে—-তখন এসে দাঁড়ান সেই ভিন্নলোকের ঈশ্বর। একটু উদ্ধৃত করি—
“ এই প্রেম, যা তাদের যুক্ত করেছে, দুটি এত বিজাতীয় ভিন্ন অস্তিত্ব কে, তা তাদের জীবন শেষ হবার সঙ্গেই নিবে যেতে পারেনা। এ অনেক মহান, অনেক চমৎকার, ঢের ঢের বেশি শক্তিশালী ।ওর(দীক্ষণের) মধ্যে আর কোনও অনিশ্চিতি বোধ ছিলনা, ভয় ছিলনা, আশা শুধু ওকে তীব্র ভাবে উত্তেজিত বিচলিত করছিল। পরে কী আছে? ওপারে? কোনও বিশাল অস্তিত্ব? কোনও নক্ষত্রগামী অভিযাত্রা? অস্থির অধৈর্য হয়ে সে মৃত্যুর কিনারে অপেক্ষা করতে লাগল।”
মহাবিশ্বের বিশালতম মানচিত্রটি প্রকাশ হওয়ার প্রায় এক সময়ে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে ‘অঙ্কিটের বুদবুদ’ এর মত এক বিস্ময়কর বই। কালোত্তর সভ্যতা, পৃথিবী -উত্তর বিশ্বলোক কে নিয়ে এই আমাদের উৎসবের সময়!
অঙ্কিটের বুদবুদ
যশোধরা রায়চৌধুরী
কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস
মূল্য: ৩৫০ টাকা

অনিতা চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায়, ১৯৫৬ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর। খুব ছোটবেলা থেকে লেখা লিখি আরম্ভ। ১৯৬৯ তে প্রথম কবিতা প্রকাশ সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত সন্দেশ পত্রিকায়। ১৯৮০ র দশক থেকে কবিতার পাশাপাশি গদ্য লিখছেন। বিমল করের উৎসাহে ছোট গল্প ও উপন্যাস লেখা। সাহিত্যর সব ধারায় অনায়াস বিচরণ। ১৯৮২ তে পদার্থ বিজ্ঞান ও কারিগরি র বিশিষ্ট গবেষক ও আই এ এস অফিসার সতীশ অগ্নিহোত্রীর সঙ্গে বিবাহ।
কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছোটদের জন্য লেখা,প্রবন্ধ ও অনুবাদ মিলিয়ে ৫০ টির মত বই লিখেছেন। বহু গল্প ও চারটি উপন্যাস ইংরেজীতে অনুবাদ হয়েছে।ইংরাজী গল্প সংকলন সেভেনটিন এর জন্য The Cross word Economist Book Award পেয়েছেন ২০১২ তে। গল্পমেলা পুরস্কার, শরৎ পুরস্কার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, সোমেন চন্দ পুরস্কার, গজেন্দ্র মিত্র পুরস্কার , প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার ছাড়াও সম্মানিত হয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণ পদকে। উল্লেখ যোগ্য বই: মহুলডিহার দিন, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, আকিম নিরুদ্দেশ, ছোটদের গল্প সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ, মহানদী, মহাকান্তার, কাস্তে, রোদ বাতাসের পথ ইত্যাদি।১৯৮০ তে আই এ এস এ যোগ দিয়ে ৩৭ বছর দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। ভারত সরকারের সচিব পদমর্যাদায় থাকা কালীন অবসর। অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখায় উঠে আসে বাংলা ও তার বাইরের ভারতবর্ষ।প্রান্তিক মানুষের অনুচ্চারিত কন্ঠস্বর ও হৃদয়ে ধরে রাখা দেশের সন্ধানে লেখক প্রায়ই বেরিয়ে পড়েন পথে, গ্রাম গঞ্জে।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “চন্দন গাছ”, “বৃষ্টি আসবে”, “সাজোয়া বাহিনী যায়” প্রভৃতি। তাঁর একটি মূল্যাবান গ্রন্থ হল “কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা”। শিশুসাহিত্য রচনায় তাঁর সহজ বিচরণ। শিশুদের জন্য লিখেছেন বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস।
তাঁর রচনা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে ৷ তিনি বহু পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন।
কবিতা সংকলন
- চন্দন গাছ (১৯৮৭)
- বৃষ্টি আসবে (১৯৯২)
- সাঁজোয়া বাহিনী যায় ( ১৯৯৫)
- নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৬)
- ব্রেল (২০০২)
- কৃতাঞ্জলী মেঘ (২০০৮)
- কবিতা সমগ্র (২০০৯)
- মালিম হার্বার (২০১৫)
- আয়না মাতৃসমা ( ২০১৬)
- শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৯)[২]
উপন্যাস
- মহুলডিহার দিন (১৯৯৬)[৩]
- যারা ভালোবেসেছিল ( ১৯৯৮, নতুন সোপান সংস্করণ ২০১৯)[৪]
- অকালবোধন (২০০৩)
- অলীক জীবন (২০০৬)
- সুখবাসী (২০০৯)
- আয়নায় মানুষ নেই (২০১৩)
- মহানদী (২০১৫)[৫]
- উপন্যাস সমগ্র ( ২০১৮)
- কাস্তে ( ২০১৯)[৬]
- লবণাক্ত (২০২০)[৭]
- মহাকান্তার (২০২১)[৮]
গল্প সংকলন
- চন্দন রেখা ( ১৯৯৩)
- প্রতিক্ষণ গল্প সংকলন ( ১৯৯৭)
- তরণী (২০০০)
- অতলস্পর্শ (২০০৬)[৯]
- শ্রেষ্ঠ গল্প (২০০৩, বর্ধিত ২০১৮)
- পঞ্চাশটি গল্প (২০১২)
- দশটি গল্প (২০০৯)
- ভালোবাসার গল্প (২০১৮)[১০]
- সেরা পঞ্চাশটি গল্প (২০১৮)[১১]
- পঞ্চাশটি গল্প (২০১৯)[১২]
শিশু-কিশোর সাহিত্য
- আকিম ও পরীকন্যে (১৯৯৩)
- আকিম ও দ্বীপের মানুষ, আকিম নিরুদ্দেশ, রতন মাস্টারের পাঠশালা, বন্দী রাজকুমার ( ২০০৪)
- জয়রামের সিন্দুক ( ১৯৯৩)
- এবু গোগো (২০০৯)
- ছোটোদের গল্প সমগ্র (২০১২)
- ছোটোদের গল্পমেলা (২০২০)[১৩]
প্রবন্ধ সংকলন
- কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা (২০০১)[১৪]
- উন্নয়ন ও প্রান্তিক মানুষ (২০০৭)
- দেশের ভিতর দেশ ( ২০১৩)
- এই আঁধারে কে জাগে ( ২০২১) [১৫]
- রোদ বাতাসের পথ ()[১৬]
- Involuntary Displacement in Dam Projects edited by A.B. Ota & Anita Agnihotri ; foreword by Michael Cernea. Prachi Prakashan, 1996. আইএসবিএন ৮১৮৫৮২৪০৩৭
অনূদিত বই
- দোজ হু হ্যাড নোওন লাভ ( ইংরেজি ভাষায় ‘যারা ভালোবেসেছিল’ উপন্যাসের অনুবাদ ) (২০০০) [১৭]
- ফরেস্ট ইন্টারল্যুড্স্ (২০০১)[১৮]
- ডাগার ই মহুলডিহা (সুইডিশ ভাষায় ‘মহুলডিহার দিন’ উপন্যাসের অনুবাদ ) (২০০৬ )[১৯]
- দ্য অ্যাওয়েকেনিং ( ইংরেজি ভাষায় ‘অকালবোধন’ উপন্যাসের অনুবাদ )(২০০৯) [২০]
- সাবোটাজ (২০১৩) [২১]
- সেভেন্টিন (২০১৫) (ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গল্প সংকলন) [২২]
- মহুলডিহা ডেজ (২০১৮) [২৩]
- আ ডে ইন দ্য লাইফ অফ মঙ্গল তরম (২০২০)(ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গল্প সংকলন) [২৪]
- দ্য সিক্ল্ (২০২১) ( ইংরেজি ভাষায় ‘কাস্তে’ উপন্যাসের অনুবাদ ) [২৫]
- মহানদী (২০২১) ( ইংরেজি ভাষায় ‘মহানদী’ উপন্যাসের অনুবাদ ) [২৬]