গল্পকার ,প্রবন্ধকার , বাচিকশিল্পী ও চিত্রগ্রাহক জয়ন্ত সরকারের প্রয়াণে ইরাবতী পরিবার শোকাহত। ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁকে স্মরণ করে যে লেখাটি প্রকাশ করা হলো তা শারদীয়া কবিতা উৎসবে প্রকাশিত।
ভারতীয় চিন্তায় শক্তির এক প্রকাশ নারীতে, যার মধ্যে আছে সৃষ্টির ক্ষমতা। প্রজননের ক্ষমতা তাঁকে দিয়েছে দেবীত্ব; তিনি মানবকূলে মাতৃদেবী। মানুষের উপকারী যে-কোনও সৃষ্টিরও (শস্য, উদ্ভিদ প্রভৃতি) তিনি অধিষ্ঠাত্রী দেবী। অন্যদিকে অশুভ শক্তির বিনাশে তিনি পারদর্শিনী, শত্রুদলনের সমরে নিপুণা। আবার পুরুষের কর্মশক্তিকে জাগরিত ও উৎসাহিত করার ক্ষমতার অধিকারিণীরূপে পুরুষ দেবতার স্ত্রী তাঁর শক্তি। শাক্ত পদাবলীতে দেবী মূলত দুটি ধারায় অর্চিতা। একদিকে তিনি উমা, অন্যদিকে তিনি শ্যামা। উমাকে কেন্দ্র করে আগমনী-বিজয়া ইত্যাদি অংশ রচিত। এই উমা – পার্বতী, দক্ষকন্যা সতী, দুর্গা, চন্ডিকা ইত্যাদি নানা নামে অভিহিতা। উমা কখনও ‘অতসী কুসুমবর্ণাভা দীপ্তিতে মঙ্গলময়ী মাতৃমূর্তিতে বিরাজমানা’; আবার কখনও বা ‘নবীন হেমকান্তিতে স্নেহের দুলালী আদরিণী কন্যা।’ দুর্গা দুর্গতিনাশিনী বা দনুজদলনী কিন্তু উমা প্রথমে কন্যারূপে, পরে মাতৃরূপে আবির্ভূতা। শাক্ত পদাবলীর বিভিন্ন পর্যায় আছে – বাল্যলীলা, আগমনী, বিজয়া, মা কি ও কেমন, ভক্তের আকুতি ইত্যাদি।
‘বাল্যলীলা’র পদে চঞ্চলা বালিকা উমার আবদার ও অভিমান এবং মেনকা – গিরিরাজের বাৎসল্যের চিত্র প্রকাশিত। উমার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য মাতা মেনকার অন্তহীন উৎকণ্ঠাই ‘আগমনী’ গানের বিষয়বস্তু; আর কন্যা-বিচ্ছেদজনিত দিগন্তপ্লাবী মর্মন্তুদ হাহাকারের অনবদ্য কাব্য রূপায়ণ হল ‘বিজয়া।’
কিছু কবিতা / গানের সাহায্যে এইসব বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক্ –
(ক) পর্যায়: বাল্যলীলা
যে মহাশক্তি জগতের আধারভূতা তিনি গিরিরাজ হিমালয় ও তাঁর পত্নী মেনকার সুকঠিন তপস্যার প্রীত হয়ে লীলাচ্ছলে মেনকার কন্যারূপে মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছেন। জগজ্জননীকে এইভাবে কন্যারূপে কল্পনা করে তাঁর অনন্ত লীলামাধুরী বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন শাক্ত কবি। যে পদগুলিতে মহামায়ার বাল্যলীলা বর্ণিত হয়েছে সেগুলিই বাল্যলীলার পদরূপে পরিচিত। কবি, সাধক রামপ্রসাদ সেনের একটি গানে আছে –
গিরিবর, আর আমি পারিনে হে, প্রবোধ দিতে উমারে ।
উমা কেঁদে করে অভিমান, নাহি করে স্তন্যপান
নাহি খায় ক্ষীর ননী সবে ।।
অতি অবশেষ নিশি, গগনে উদয় শশী,
বলে উমা, ধরে দে উহারে।
কাঁদিয়া ফুলালে আঁখি, মলিন ও মুখ দেখি,
মায়ে ইহা সহিতে কি পারে ?
আয় আয় মা বলি, ধরিয়ে কর-অঙ্গুলি,
যেতে চায় না জানি কোথারে ।
আমি কহিলাম তায়, চাঁদ কি রে ধরা যায়,
ভূষণ ফেলিয়ে মোরে মারে ।।
উঠে বসে গিরিবর, করি বহু সমাদর
গৌরীরে লইয়া কোলে করে।
সানন্দে কহিছে হাসি, ধর মা, এই লও শশী,
মুকুর লইয়া দিল করে ।।
মুকুরে হেরিয়া মুখ, উপজিল মহাসুখ,
বিনিন্দিত কোটি শশধরে ।
শ্রীরামপ্রসাদ কয়, পূণ্য পুঞ্জচয়,
জগত-জননী যার ঘরে ।
কহিতে কহিতে কথা, সুনিদ্রিতা জগন্মাতা
শোয়াইল পালঙ্ক-উপরে ।।
এই পদটিতে মেনকার জবানীতে উমার বায়না, আবদারের কথা প্রকাশিত হয়েছে।
আবার, রাধিকাপ্রসন্নের লেখা একটি পদে পাই –
আর জাগাস্ নে মা জয়া, অবোধ অভয়া,
কত করে’ উমা এই ঘুমাল ।
মা জাগিলে একবার, ঘুম পাড়ানো ভার –
মায়ের চঞ্চল স্বভাব আছে চিরকাল ।
কাল উমা আমার এল সন্ধ্যাকালে,
কি জানি কি রূপে ছিলে বিল্বমূলে,
বিল্বমূলে স্থিতি করিয়ে পার্বতী
জাগিয়ে যামিনী পোহাল ।
উপরোধ উমা এড়াতে না পেরে,
সারাদিন বেড়ায় প্রতি ঘরে ঘরে ;
সন্ধ্যা বেলা অবশ হ’ল ঘুমের ঘোরে –
মায়ের মুখের পান মুখে রহিল ।
উমার সঙ্গে জয়া যদি করবি খেলা,
খেল্বি গো জয়া জাগিয়ে মঙ্গলা,
দ্বিজ রাধিকা বলে, উমা না জাগিলে,
জগতে কে জাগিবে বল ।।
-এই পদটিতে উমার প্রতি মেনকার স্নেহের প্রকাশ যেন চিরকালীন মাতৃমহিমার প্রকাশ। কন্যার প্রতি স্নেহ-মায়া-মমতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরালভাবে কবি জগজ্জননী উমার পূজা-মাহাত্ম্যের কথাও বলেছেন।
এইভাবে শাক্ত পদাবলীর বাল্যলীলা পর্যায়ে দেবচরিত্রের মানবায়নের সঙ্গে সঙ্গে উমার ঐশ্বর্য রূপও আভাসিত হয়েছে।
(খ) পর্যায়: আগমনী
আগমনী শাক্ত পদাবলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যপর্যায়। মাতৃগৃহে কন্যাকে আনার জন্য মায়ের আকুলতা-ব্যাকুলতা, স্বপ্নদর্শন, স্বামীর প্রতি কাতর অনুনয়, কন্যার দুর্ভাগ্যের সম্ভাব্য চিন্তায় অকারণ উদ্বেগ, স্বামীর কৈলাস যাত্রা, পিতৃগৃহে আগমনের আগে শঙ্করের কাছে উমার বিদায় প্রার্থনা, মাতা ও কন্যার প্রথম সাক্ষাৎ, মানাভিমান, আনন্দোল্লাস- এই সবই আগমনী পর্যায়ের পরস্পর সন্নিবিষ্ট দৃশ্যাবলীর মতো। আগমনী পর্যায়ের পদগুলির দুটি স্তবক। প্রথমটিকে পূর্ব-আগমনী এবং পরেরটিকে উত্তর-আগমনী বলা যায়। প্রথম পর্যায়ে দেখা যায়, শরৎ ঋতুর আবির্ভাবে মেনকার সন্তানবৎসলতার উৎকণ্ঠার সূচনা; পরের পর্যায়ে পাই মাতা ও কন্যার অশ্রুবিগলিত মিলন দৃশ্য। প্রকৃতপক্ষে, আগমনী-বিজয়ার গানগুলি বাঙালি সমাজের ছবি। বাঙালি কবি তাঁর নিজস্ব ভাবনায় উমা, মেনকা, গিরিরাজ, ভোলানাথের ছবি এঁকেছেন। চরিত্রগুলি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পৌরাণিক সত্তা হারিয়ে বাঙালির একান্ত পরিচিত চরিত্ররূপে আমাদের আনন্দ-বেদনার অংশীদার হয়ে গেছে। আসলে আগমনী-বিজয়ার গানে মেনকা আর উমার মধ্যে বাঙালি আবিষ্কার করেছে নিজেদের ঘরের মা আর মেয়েকে। চার-পাঁচটি উদাহরণ দিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা যেতে পারে। কবি গোবিন্দ চৌধুরী লিখেছেন –
গিরি, গৌরী আমার এল কৈ ?
ঐ যে সবাই এসে, দাঁড়িয়েছে হেসে,
(শুধু) সুধামুখী আমার উমা নেই ।
সুনীল আকাশে ঐ শশী দেখি,
কৈ গিরি, আমার কৈ শশিমুখী ?
শেফালিকা এল উমার বর্ণ মাখি
বল বল, আমার কোথা বর্ণময়ী ?
নির্ঝরিণীর জল, হ’ল নিরমল,
ঐ এল হেসে শান্ত শতদল,
শতদলবাসিনী কোথায় আমার বল?
(ওরা) তেমনি চেয়ে আছে –
কেবল তারা নেই ।
শরতের বায়ু যখন লাগে গায়,
উদার স্পর্শ নাই, প্রাণ রাখা দায়
যাও যাও গিরি, আনগে উমায়,
উমা ছেড়ে আমি কেমন ক’রে রই ।।
–আলোচ্য পদে উমার আবির্ভাবকে প্রকৃতির পটভুমিকায় স্থাপন করা হয়েছে। প্রকৃতির চারিদিকে যখন উমার আভাস তখন উমাকে অমূর্ত তত্ত্বমাত্ররূপে কৈলাসে শিবঅঙ্গে বিলীন হয়ে থাকলে চলবে না। সুন্দর সৃষ্টির মাঝখানে উমাকে সৌন্দর্যের মাধুর্যের বাস্তব প্রতিমূর্তিরূপে প্রকাশিত হতে হবে।
আবার –
গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না ।
বলে বল্বে লোকে মন্দ, কারো কথা শুন্বো না ।
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়, উমা নেবার কথা কয় –
এবার মায়ে-ঝিয়ে কর্বো ঝগড়া, জামাই বলে মান্বো না ।
দ্বিজ রামপ্রসাদ কয়, এ দুঃখ কি প্রাণে সয়,
শিব শ্মশানে মশানে ফিরে, ঘরের ভাবনা ভাবে না ।।
আগমনী পর্যায়ের এই গানে বাঙালি মায়ের চিরকালীন বাসনা যেন ব্যক্ত হয়েছে। পদটিতে বাংলাদেশের সামাজিক জীবনের প্রতিফলনও লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া কন্যার জন্য মাতার ব্যাকুলতার ভাবটিও এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
আগমনী পর্যায়ের বেশ কিছু গানে / পদে উক্ত বাসনা পরিলক্ষিত হয়।
প্রাণের কন্যা উমার মঙ্গল সংবাদ না পেয়ে বিচলিতাচিত্তা মেনকা হিমালয়ের বিরুদ্ধে অনুযোগ করেন –
বল গিরি, এ দেহে কি প্রাণ রহে আর,
মঙ্গলার না পেয়ে মঙ্গল সমাচার ।
দিবানিশি শোকে সারা, না হেরিয়া প্রাণ-তারা,
বৃথা এই আঁখি-তারা, সব অন্ধকার।
খেদে ভেদ হয় মর্ম্ম সকলই অসার।
তুমি তো অচল পতি, বল কি হইবে গতি,
ভিক্ষা করে ভগবতী কুমারী আমার ।
বাঁচি বল কার বলে, দুঃখানলে মন জ্বলে,
ডুবিল জলধি জলে প্রাণের কুমার ।
ত্রিজগতে নাহি আনো, একমাত্র সেই কন্যে,
না ভাব তাহার জন্যে তুমি একবার ।। (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
সাধারণ মর্ত্য জননীর মতো মেনকা, কন্যা উমাকে রাত্রে স্বপ্নে দর্শন করেন, উমার কথা বলতে বলতে নয়নদুটি অশ্রুধারায় সিক্ত হয়, অন্তর বেদনায় দীর্ণ হয়।
কুস্বপন দেখেছি গিরি, উমা আমার শ্মশানবাসী,
অসিত বরণা উমা, মুখে অট্ট অট্ট হাসি ।
এলোকেশী বিবসনা, উমা আমার শবাসনা,
ঘোরাননা ত্রিনয়না, ভালে শোভে বাল শশী ।।……. (গিরিশচন্দ্র ঘোষ)
উমা সাধারণ বাঙালি মেয়েদের মতো পিতার গৃহে যাবার জন্য স্বামীর অনুমতি প্রার্থনা করেন, তিনদিন পরে যে ফিরে আসবেন পতির কাছে সে কথা জানাতেও ভোলেন-না। শিব-ও সাধারণ স্বামীর মতই উমাকে পিতৃগৃহে যাবার অনুমতি দেন। কবি ঈশ্বর গুপ্ত পদ সৃষ্টি করেছেন শিবের জবানীতে,
জনক-ভবনে যাবে, ভাবনা কি তার ?
আমি তব সঙ্গে যাব, কেন ভাব আর ।
আহা আহা, মরি মরি, বদন বিরস করি,
প্রাণাধিকে প্রাণেশ্বরি, কেঁদো নাকো আর ।
হৃদয়েশি, অহরহ আমার হৃদয়ে রহ,
নিদয়-হৃদয় কহ, কি দোষ আমার ।
যখন যে অনুমতি কর তুমি ভগবতি,
কখনো কি করি আমি অন্যথা তাহার ?
সকলি তোমারি ছায়া, তুমি নিজে মহামায়া,
তোমার বিচিত্র মায়া, বুঝে ওঠা ভার ।। …..
গিরিরাজ হিমালয় উমাকে এনে মেনকার হাতে সমর্পণ করে বলছেন,
গিরিরাণি, এই নাও তোমার উমারে,
ধর ধর হরের জীবন-ধন ।
কত না মিনতি করি, তুষিয়ে ত্রিশূলধারী, প্রাণ-উমা আনিলাম নিজ-পুরে ।
দেখো, মনে রেখ ভয়, সামান্য তনয়া নয়, যাঁরে সেবে বিষ্ণু হরে ।
ও রাঙ্গা চরণ-দুটি, হৃদে রাখেন ধূর্জটি, তিলার্দ্ধ বিচ্ছেদ নাহি করে ।। (কমলাকান্ত ভট্টাচার্য)
কিন্তু উমা গিরিপুরে উপস্থিত হলেও মাতা মেনকা দশভূজা, অসুরদলনী উমাকে দেখে ঘাবড়ে যান! তার প্রাণের উমার পরিবর্তে রণরঙ্গিনী উমাকে দর্শন করেন। দ্বিভূজা, চন্দ্রমুখী, অতি শান্ত, সুধারাশিতে পূর্ণ তাঁর উমাশশী এ’তো নয়!! গিরিরাজ-কে বলেন,
গিরি, কার কণ্ঠহার আনিলে গিরি-পুরে?
এ তো সে উমা নয় – ভয়ঙ্করী হে, দশভূজা মেয়ে ।
উমা কোন্ কালে ত্রিশূলে অসুরে সংহারে ।
হায়, আমার সেই বিমলা, অতি শান্তশীলা,
রণ-বেশে কেন আসবে ঘরে ! (রসিকচন্দ্র রায়)
কন্যা পিতৃগৃহে এসেছে। সাধারণ বাঙালি মাতার মতোই মেনকারও জানার ইচ্ছা উমা পতিগৃহে কেমন আছে বা জামাই কেমন!!
ও মা, কেমন করে পরের ঘরে,
ছিলি উমা বল মা তাই ।
কত লোকে কত বলে, শুনে ভেবে মরে যাই
মা’র প্রাণে কি ধৈর্য্য ধরে,
জামাই নাকি ভিক্ষা করে !
এবার নিতে এলে, বলবো – ‘হরে
উমা আমার ঘরে নাই’ ।। (গিরিশচন্দ্র ঘোষ)
উপরের পদটিতেও আমরা দেবী মহিমার পরিবর্তে বাঙালি জননীর বিরহ ব্যাকুলতাই মুখ্য দেখতে পাই।
আবার মেনকার পরিবর্তে উমার মনোবেদনা, মাতার প্রতি অভিমান খুঁজে পাই এই পদটিতে –
তুমি তো মা ছিলে ভুলে,
আমি পাগল নিয়ে সারা হই ।
হাসে কাঁদে সদাই ভোলা, জানে না মা আমা বই ।
ভাং খেয়ে মা সদাই আছে
থাকতে হয় মা কাছে কাছে
ভাল মন্দ হয় গো পাছে, সদাই মনে ভাবি ওই ।। (গিরিশচন্দ্র ঘোষ)
সাধারণ বাঙালি ঘরে দেখা যায় বিবাহের পর পিতৃগৃহের প্রতি কন্যার আকর্ষণ দিন দিন কমে আসে। কন্যা স্বামীর গৃহে সন্তানাদি ও সংসারের বিভিন্ন কাজকর্মে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, পিতৃগৃহে সময় অতিবাহিত করার অবকাশ পায়-না। তাছাড়া নববধূ সুলভ ভীতিও পিতৃগৃহে আসার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কয়েক বছর পরে দেখা যায় নিজের সংসার ফেলে রেখে পিতৃগৃহে বেশিদিন থাকতেও চায় না, পতিগৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য নানা ছলনারও হয়তো আশ্রয় গ্রহণ করে। উমা-ও তার ব্যতিক্রম নয় –
এসেছিস মা – থাক্ না উমা দিন-কত ।
হয়েছিস্ ডাগর-ডোগর, কিসের এখন ভয় এত ?
বলিস্ যদি আনি মা, জামাই,
সকালে লোক কৈলাসে পাঠাই,
সবাই মিলে করবো যতন, যোগাব তার মন-মত ।
খল কপট তো নাইক তার মনে,
যে ডাকে, সে ফেরে তারা সনে,
মান-অভিমান তার মনে নাই, কুচুটে তো তুই যত ।
এখন বুঝি ঘর চিনেছিস, তাই হয়েছি পর,
কেঁদে কেঁদে ভাসিয়ে দিতিস্ নিতে এলে হর ।
সঁপে দিচ্ছি পরের হাতে, জোর আমার তো নাই তত ।। (গিরিশচন্দ্র ঘোষ)
পদটি মহাকবি গিরিশচন্দ্রের ভক্তচিত্তের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। তিনি ঐশ্বরিক চরিত্র তিনটিকে মানবীয় রসে প্রোজ্জ্বল করে তুলেছেন। পদটি মূলত মাতা মেনকার জবানীতে রচিত; উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক নয়। মা-মেয়ের সম্পর্ক এখানে অতি ঘরোয়া। সাধারণ ঘরের পরিচিত মাতৃজাতির চরিত্র গিরিশচন্দ্রের নিপুণ লেখনী প্রভাবে এখানে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিবাহের পরবর্তীকালে কন্যার উপর মাতার আর কোন জোর থাকেনা। বাঙালি জননীর পক্ষে এই নির্মম করুণ সত্যটি কাব্যে উপস্থিত করার ফলে পদটি জীবন্ত ও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে।
উপরিল্লিখিত পদ্গুলি থেকে বোঝা যায়, ‘আগমনী’ অংশে বাংলাদেশের অতি পরিচিত পারিবারিক আলেখ্যই মূলত চিত্রিত হয়েছে। গার্হস্থ্যভাব প্রধান হওয়ার জন্য মহাদেব, উমা, হিমালয়, মেনকা সব চরিত্রই মানবিক গুণে সমৃদ্ধ। সাধারণ গৃহস্থ ঘরের পত্নী ও কন্যারূপে মহামায়ার চরিত্রটি অলৌকিকত্ব ও দৈবীমহিমা বিবর্জিত হয়ে একান্ত পরিচিত বস্তুজগতের মানবী হয়ে উঠেছে।
(গ): বিজয়া
“দেখিতে দেখিতে নবমী-নিশীথ আসিয়া পড়িল, এই রজনী প্রভাতেই বিদায়লগ্ন, হিমালয় অন্ধকার করিয়া উমা অন্তর্ধান করিবে। তাই এই রজনীকে বিলম্বিত করিবার জন্য মায়ের সে কি আকুল মিনতি, সকরুণ প্রার্থনা! এখনও গৃহে স্বর্ণদীপের আলো কিন্তু রাত্রি প্রভাতেই সে সব অন্ধকার হইয়া যাইবে….।” মাতৃহৃদয়ের কন্যাবিশ্লেষজনিত আর্তি পৃথিবীর করুণতম বেদনার স্মারক। শরৎ সপ্তমীর দিনে সমস্ত বঙ্গভূমির ভিখারী-বধূকন্যা মাতৃগৃহে আগমন করে এবং বিজয়ার দিনে সেই ভিখারী ঘরের অন্নপূর্ণা যখন স্বামীগৃহে যায় তখন সমস্ত বাংলাদেশের চোখ যেন অশ্রুপূর্ণ হয়ে ওঠে। পদকর্তারা লিখেছেন,
রজনী, জননী, তুমি পোহায়ো না ধরি পায়,
তুমি না সদয় হ’লে উমা মোরে ছেড়ে যায় ।
সপ্তমী অষ্টমী গেল, নিষ্ঠুর নবমী এল,
শঙ্করী যাইবে কাল, ছাড়িয়ে দুখিনী মায় ।
তুমি হ’লে অবসান, আমি হ’ব গতপ্রাণ ,
বিজয়া-গরল-পান করিয়ে ত্যজিব প্রাণ ।। (অজ্ঞাত)
মাতা মেনকার করুণ আর্তি –
শুনগো রজনী, করি মিনতি তোমারে
অচলা হও আজকের তরে, অচলারে দয়া ক’রে ।
সাধে কি নিষেধে দাসী, তুমি অস্তে গেলে নিশি,
অস্তে যাবে উমাশশী, হিমালয় আঁধার ক’রে ।
বল্বো তোমায় যামিনী, তুমি ত অন্তর্যামিনী,
অন্তরের ব্যথা আপনি, সকলি জান অন্তরে ।।
নিঠুর নবমী নিশি আসে, মায়ের নয়ন জলে ভাসে। মাতৃহৃদয়ের অনন্ত বেদনার রূপকার শাক্তপদকর্তাগণ নবমী রজনীর চিত্রাঙ্কনে নিজেদের হৃদয় থেকেও রক্ত ঝরিয়েছেন –
ওরে নবমী-নিশি, না হইও রে অবসান ।
শুনেছি দারুণ তুমি, না রাখ সতের মান ।।
খলের প্রধান যত কে আছে তোমার মত –
আপনি হইয়ে যত, বধ রে পরেরি প্রাণ ।।
প্রফুল্ল কুমুদবরে সুচন্দন লয়ে করে,
কৃতাঞ্জলি হৈয়ে তোমার চরণে করিব দান ।
মোরে হৈয়ে শুভোদয়, নাশ দিনমণি-ভয়,
যেন না সহিতে হয় রে শিবের বচন-বাণ ।।
হেরিয়ে তনয়া-মুখ, পাসরিলাম সব দুখ,
আজি সে কেমন সুখ হতেছে স্বপন-জ্ঞান ।
কমলাকান্তের বাণী শুন ওগো গিরিরাণি !
লুকায়ে রাখ না মা’রে হৃদয়ে দিয়ে স্থান ।। (কমলাকান্ত ভট্টাচার্য)
কিন্তু সব আশার, সব কামনার সমাপ্তি ঘটিয়ে দশমী প্রভাতের আবির্ভাব হয় – মেনকাকেও বাস্তব সত্য মেনে নিতে হয়। দশমী প্রভাতে মাতা মেনকার মনোবেদনা ব্যক্ত হয়েছে নিম্নলিখিত পদে যেখানে মেনকার মাতৃরূপ বিকশিত, দৈব ভাবনার বিন্দুমাত্র প্রকাশ নেই —
কি হলো, নবমী নিশি হৈলো অবসান গো ।
বিশাল ডমরু ঘন ঘন বাজে, শুনি ধ্বনি বিদরে প্রাণ গো ।।
কি কহিব মনে দুঃখ, গৌরী পানে চেয়ে দেখ –
মায়ের মলিন হয়েছে অতি ও বিধু বয়ান ।।
ভিখারী ত্রিশূলধারী, যা চাহে, তা দিতে পারি ;
বরঞ্চ জীবন চাহে, তাহা করি দান ।
কে জানে কেমন মত, না শুনে গো হিতাহিত;
আমি ভাবিয়ে ভবের রীত হয়েছি পাষাণী গো ।।
পরাণ থাকিতে কায়, গৌরী কি পাঠানো যায়;
মিছে আকিঞ্চন কেন করে ত্রিলোচন !
কমলাকান্তের লৈয়ে, কহ হরে বুঝাইয়ে –
হর, আপনি রাখিলে রহে আপনার মান গো ।। (কমলাকান্ত ভট্টাচার্য)
শাক্ত পদাবলীর লীলা পর্যায়ের অন্তর্গত বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়ার গানগুলিতে বাংলাদে শের অতি পরিচিত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ভক্ত-ভগবানের মিলন-সঞ্জাত যে প্রেম তাঁর অভিব্যক্তির নাম লীলা। ভক্ত-ভগবানের মধুর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে বাল্যলীলা-আগমনী-বিজয়ার গানে। মানবীয় রসসিঞ্চিত এই লোকায়ত জীবনকাহিনী বিভিন্ন পদকর্তার রচনায় অপরূপ রূপ পরিগ্রহ করেছে। পারিবারিক চরিত্রগুলির মধ্যে মাতা মেনকার চরিত্রই বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়ারগীতিনাট্যের প্রধান চরিত্র। কন্যাসন্তানের জন্য জননীর হৃদয়ক্ষরিত অশ্রান্ত অশ্রুধারায় আগমনী ও বিজয়ার পদাবলী অভিষিক্ত। গানগুলি অতলান্ত মাতৃস্নেহের পরিপূর্ণ আলেখ্য। বালিকা কন্যাকে পতিগৃহে পাঠিয়ে জননীর যে দুশ্চিন্তা, তাকে কাছে পাবার যে দুর্বার আগ্রহ, কাছে পেয়ে মিলনের যে আনন্দ-তন্ময়তা, আবার বিদায় মুহূর্তের যে মর্মস্পর্শী অশ্রুকাতরতা তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে শাক্ত পদাবলীর লীলা অংশ করুণ মধুর। বিভিন্ন ছোটখাটো পারিবারিক চিত্রের সমাহারে আগমনী-বিজয়ার পদগুলি বাঙালি পাঠকের কাছে বিশেষ আকর্ষণরূপে পরিগণিত হয়েছে। এগুলি বাঙালির পারিবারিক জীবনের মর্মসঙ্গীত। উৎসব-মুখর দিনগুলির পরে বিজয়ার প্রভাতে সমস্ত বন্ধন, সমস্ত আর্তিকে দলিত-মথিত করে নৃত্যরত শঙ্করের ডম্বরু বেজে উঠেছে। উমা কৈলাসে প্রত্যাবর্তনরতা। মেনকার ব্যাকুল আর্তিতে রণিত হয়েছে বিচ্ছেদকাতরা ধরণীর অনন্ত ক্রন্দন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার ঘরে আজ রাত্রি শেষ হইতে না হইতে সানাই বাজিতেছে। সে বাঁশি যেন আমার বুকের পঞ্জরে হাড়ের মধ্য হইতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বাজিয়া উঠিতেছে। কারণ ভৈরবিণী রাগিণীতে আমার আসন্ন বিচ্ছেদ ব্যথাকে শরতের রৌদ্রের সহিত সমস্ত বিশ্বজগৎময় ব্যাপ্ত করিয়া দিতেছে ।” কিন্তু বিরহের মধ্যেও তো থাকে আগমনের সূচনা। রবি ঠাকুরের কথা দিয়েই শেষ করি – “তাই ধরার আঙিনায় আগমনী গানের অন্ত নাই। যে লইয়া যায় সেই আবার ফিরাইয়া আনে। তাই সকল উৎসবের মধ্যে বড় উৎসব এই হারাইয়া ফিরিয়া পাওয়ার উৎসব ।”