| 29 নভেম্বর 2024
Categories
জীবন যাপন নারী

বাঙালি জনজীবনে অলংকার

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

অমর সিংহ রচিত সংস্কৃত অভিধান মতে ‘অলম’ শব্দ থেকে অলংকার শব্দের উদ্ভব বলে পণ্ডিতেরা ধারণা করেন। অলম শব্দের অর্থ ভূষণ। প্রাচীণ বাঙালি রমণীরা কর্ণে কর্ণকুণ্ডন, কর্ণাঙ্গরীয়, আঙ্গুরীয়ক গলায় কন্ঠহার, হাতে বলয়, খেউর, কটিদেশে মেখলা, পায়ে মল পরতেন। শঙ্খ বলয়ের ব্যবহার শুধু বিবাহিতা নারীরাই করতেন। একাধিক হার গলায় দিতেন নারীরা এবং অনেক সময় পশ্চিম দেশীয় স্ত্রীলোকের ন্যায় হাতে অনেকগুলি চুড়ি, বালা পড়তেন। ধনী রমণীরা সোনা-রূপা ছাড়াও মনি-মুক্তার আভরণ ব্যবহার করতেন (রমেশচন্দ্র মজুমদার)। যেমন মুক্তাখচিত হার যা মহানীল রক্তাক্ষ মালা নামে পরিচিত। এছাড়াও মূল্যবান পাথরের গুটিকার ও হীরক খচিত বিভিন্ন অলংকার, রত্ন খচিত ঘুঙুর, মরকত, নীলকান্তমণি প্রভৃতি রত্নিদি ব্যবহারের কথা জানা যায়। এ ধরনের অলংকরণ প্রসাধনে পটিয়সী ছিলেন সাধারণত রাজ পরিবারের নারীরা। মধ্যবিত্ত গরীব গৃহস্থ নারীদের এই মূল্যবান গহনা ব্যবহার করতে দেখা যেত না। তারা শঙ্খ বলয়, পুষ্প পত্রের মালা ও কর্ণাভরণ পরিধান করে সুসজ্জিত হতেন।

সমসাময়িক সাহিত্য ও প্রত্নবস্তুর সাক্ষ্য হতে প্রমাণিত হয়, প্রাচীন বাঙালি নারী ও পুরুষ এমন কতকগুলি অলংকার ব্যবহার করতেন যা উভয় ক্ষেত্রেই একই রকম। কর্ণকুণ্ডণ, অঙ্গুরীয়ক, কণ্ঠহার, বলয়, খেউড়,  মেখলা ইত্যাদি নর-নারী নির্বিশেষে ব্যবহার করতেন । বিজয় সেনের নৈহাটি লিপি এবং দেওপাড়া প্রশস্তি থেকে পূর্ব উলি­খিত মহানীলরক্তাক্ষমালা এবং মুক্তাখচিত হারের কথা জানা যায়। এমনকি রাজবাড়ির ভৃত্যের স্ত্রীরাও নাকি হার, কর্ণাঙ্গুরি, মালা, মল এবং সুবর্ণবলয় ইত্যাদি পড়তেন। মূল্যবান পাথরের তৈরি ফুলও ব্যবহার করতেন। নৈহাটি লিপি থেকে একথাও জানা যায় যে, মুক্তাখচিত হার পড়তেন রাজপরিবারের মেয়েরা। রামচরিতে আছে, হীরকখচিত নানা সুন্দর অলঙ্কার ও রতœখচিত নানা ঘুঙুরের কথা, মুক্তা মরকত, নীলকান্তমনি, চুনী প্রভৃতি রত্নদি ব্যবহারের কথা। আর সোনারূপার গহনা তো ছিলোই। বলা বাহুলা, এইসব অলংকরণ বিলাস ছিলো সাধারণ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র গৃহস্থদের নাগালের বাইরে; বড়জোড় শঙ্খবলয়, কচি তালপাতার কর্ণাভরণ এবং ফুলের শালাতেই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো। দেওপাড়া প্রশস্তিতে কবি উমাপতিধর বলছেন, পল­ীবাসী নির্ধন ব্রহ্মরমণীরা রাজার কৃপায় নগরে এসে বহুবিত্তশালী হলেও তারা মুক্তা ও কার্পাস বীজ, মরকত ও শাকপাতায় রূপা ও লাউফুলের রত্ন ও পাকা ডালিমের বীজে, সোনা ও কুমড়া  ফুলের পার্থক্য যে কি তা জানতেন না। ভরতমুনি তার নাট্য শাস্ত্রে (আনুমানিক তৃতীয় শতক) বলছেন, “গৌরীনামলক প্রায় সশিখাপাশবেণিকম” অর্থাৎ গৌরীয় নারীদের মাথায় কুঞ্চিত কেশ এবং তাদের চুলের বেণীর শেষাংশ থাকতো শিখার মতো মুক্ত।

মুসলিম শাসনামলের অলংকার সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যে দেখা যায় যে, স্ত্রীলোকেরা সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ ও মূল্যবান অলঙ্কারাদি খুব ভালোবাসতেন। তারা নানারকম শাড়ি কিংবা ঘাঘরা এবং রেশমী জামা বা সুতী কাপড় পরিধান করতেন। সম্পদশালী ধনী পরিবারের মেয়েরা গলার হার, মুক্তা ও হীরার কর্ণকুণ্ডণ, অনন্তবালা, বলয় ও মূল্যবান পাথর বসানো সোনার আংটি ইত্যাদিতে সজ্জিত হতেন। তারা কোমরে কিংকিনী নামক আরও একটি অলংকার পরতেন এবং পায়ে নুপুর বা পাঁইজর পরতেন (ইউসুফ জুলেখা, রসুল বিজয়, লায়লী মজনু)। সেকালের মেয়েদের মধ্যে নানা প্রকারের প্রসাধন দ্রব্য ব্যবহার প্রচলন ছিলো। তারা চুলের খোঁপা বাঁধতেন এবং অঞ্জন দিয়ে চোখ কালো করে তুলতেন। তারা সিঁদুর দিয়ে কপালের অগ্রভাগে রক্তিমাভ করে তুলতেন এবং জাফরান (কুমকুম) দিয়ে ঠোট রক্তগোলাপী করতেন। মেহেদী মেখে তারা হাতের নখ রঙিন করতেন। তারা কপালে চন্দনের ফোঁটা দিতেন এবং গলায় পুষ্পের মালা ব্যবহার করতেন (লায়লী মজনু, ইউসুফ জোলেখা, রসুল বিজয়)। সাধারণ ঘরের স্ত্রীলোকেরা প্রধানত শাড়ি বা ঘাঘরা এবং চোলী পরিধান করতেন। কানের দুল এবং নখ তাদের অলংকৃত ছিলো। পোশাক-পরিচ্ছদ এবং অলংকারের উলে­খ স্থানীয় লোকসঙ্গীতেও পাওয়া যায় (পূর্ববঙ্গগীতিকা)। তারা নানারকম রৌপ্য অলংকারও ব্যবহার করতেন। র‌্যালফ ফিচ লিখেছেন, মেয়েলোকেরা বহু রূপার গহনা তাদের গলায় ও বাহুতে পরিধান করতেন। তারা পায়ে রূপা ও তামার এবং হাতির দাঁতের আংটি বহুল পরিমাণে ব্যবহার করতেন। অলংকার বা ভূষণ দেহের চারুত্বও কমনীয়তা আনে। অতীতের বহু অলংকার এখনো বাংলার নারীকুল ব্যবহার করেন। এই সকল অলংকারের মধ্যে নারী সমাজের মনোজাগতিকতার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। অলংকারগুলোর মধ্যে রয়েছে সিঁথিতে টিকলি, সিঁথি পাটি, গলার হার, হাঁসুলি, দুল, মাকড়ি, বালা, চুড়ি, মল, বিছা, নথ, কাঁকন, বাজু, মাদুলি, মুকুট, রূপার কাঁটা, ঝাপটা, কানবালা, ঝুমকা, লকেট, খাড়–, বাকখাড়–, বিছা, মানতাসা, তোড়া, বাউটি, টায়রা, দড়ি বিছা, তারা বিছা, সর্পবিছা, সূর্যবিছা, বেনীর অলংকার ইত্যাদি।

এসব অলংকারের অধিকাংশই সোনা এবং রূপার তৈরি। কিছু রয়েছে সোনা অথবা রূপার শস্যদানা, নিমফল, বৈচিফল, কড়ি ইত্যাদি। অলংকারগুলো নারীদের ব্যবহার্য হলেও এগুলো তৈরি করেন পুরুষেরা। স্বর্ণকার শ্রেণীর পেশাই অলংকার তৈরি করা। সোনা, রূপা ও চাঁদির পাশাপাশি অন্যান্য ধাতুর তৈরি অলংকারও ব্যবহার করা হয়। আজকাল সাধারণ নারীরা যে সকল অলংকার ব্যবহার করেন তা মূলত ইমিটেশন। আধুনিক নাম সিটিগোল্ড। অবশ্য নিরাপত্তার স্বার্থে আধুনিক শিক্ষিত সচেতন, রুচিশীল মহিলাদের রূপা এবং ইমিটেশন গহনার প্রতি অত্যধিক আগ্রহী হতে দেখা যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত