আজ ২০ নভেম্বর কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক পাপড়ি রহমানের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
তখনও আমি তাকে ভালো করে দেখি নাই। শুধু তার পেন্সিল-টর্চের মতো সরু অথচ তীক্ষè আলোর চোখ দুটো দেখেছিলাম। যদিও তখন মধ্যাহ্নের উদোম-রোদ্দুর, বনভূমির ভেতর আলো-ছায়ার রহস্যময় খেলা… তবুও তাকে আমি স্পষ্টতই দেখি নাই। ফলত তার চোখের আলোর তীব্রতা শরীর আড়াল করে ফেলছিল বলেই আমি ওই দেখা-না-দেখার বিভ্রান্তিতে দুলছিলাম। বাবুর অবস্থাও আমার মতো কিনা আমি তা-ও বুঝতে পারছিলাম না। বাবুকে জিজ্ঞেস করতে আমার ভয় ও লজ্জা দুটাই কাজ করছিল। কারণ আমার দেখাটা যদি সত্যিই চোখের বিভ্রম হয়, বাবু তা নিয়ে এতটাই কটাক্ষ ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে যে, আমি একেবারে মরমে মরে যাব। বাবুর স্বভাব মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত করে এক ধরনের আনন্দ নেওয়া। এটা যারা করে তারা নিজেদের ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সকে ঢাকার জন্যই করে থাকে। যেন অন্যেরা তার লিমিটেশনের দিকে আর আঙুল না-তোলে। আমি এইগুলো যে বুঝি না, তা নয়। আমি সবই বুঝে ইগনোর করে চলি… এতকিছু ধরলে জীবনের কঠিন পথটা আরও বেশি কঠিনতর হয়ে পড়ে বলে। এত ধরলে প্রেমের অনুভূতিটা একেবারে মাঠে মারা যায়!
আমি যাকে দেখছি তার কথা বাবুকে বলব বলব করেও বলে উঠতে পারছিলাম না।
বললেই বাবু ধাম করে বলে বসবে…
বয়স হলে মানুষ খামাখাই কতকিছু যে দেখে!
হুম, বয়স আমার হয়েছে, সেটা সত্যি। তবে সেই বয়স এতটা ধোঁয়াটে হয়ে উঠে নাই, যাতে করে আস্ত একটা বন্যপ্রাণীকে আমি ভুলভাল দেখতে শুরু করব! আমার কাছে মনে হলো একটা রয়েল-বেঙ্গল-টাইগার ঠোঁট বাঁকিয়ে তার বাম চোখটা দুষ্টুমির ছলে বন্ধ করে আমাকে একটা উইঙ্ক করল! কিন্তু রয়েল বেঙ্গলের এই আজগুবি চিন্তাটা আমাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই হলো। যদিও চৌদিকে নিবিড়-জলাজংলা, আপনজালা অজস্র বৃক্ষরাজির জড়াজড়ি করে রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে থাকার মনোরম দৃশ্য! জলাজংলা হলেও এই রকম ফিকে-বনভূমিতে বাঘের উপস্থিতি চিন্তাও করা যায় না।
খুব ভোর-ভোর আমি আর বাবু বাস ধরে এইখানে এসেছি। দেখা-সাক্ষাৎ কম হয় বিধায় স্পেশাল কিছু মুহূর্ত উদযাপনের জন্য আমাদের এই জঙ্গলবিহার। চলার পথে বাস একবার বিরতি দিলে বাবু নেমে গিয়ে ধূমশলাকা টেনে এসেছে। বাবুর নেমে যাওয়ার সুযোগে আমি সামান্য ঝিমাতে শুরু করেছিলাম। ফজরের আজানের সময় ভালো করে জলটল ঢেলে গোছল করার পরেও আমি ঝিমুচ্ছিলাম। ঘুমের তীব্র ক্লান্তি আমাকে বারংবার ঝিমুনির ভেতর ঠেলে দিচ্ছিল। হঠাৎ বাবুর কথায় আমার ঝিমুনির ওপর দিয়ে কিছু পাখপাখালি উড়ে গেল। আমি সেই পাখসাটে ঘুমচোখের পাপড়ি মেলে দেখি…
বাবুর হাতে দুইকাপ ধূমায়িত মিনি-সাইজের কফি!
গরমকফি দেখে আমি একেবারে আহ্লাদিত হয়ে উঠলাম। আরে! এমন জায়গায় কফি? ভাবাই যায় না।
টিস্যুপেপারে পেঁচিয়ে রাখা একটা মিনিকফি বাবু আমার দিকে এগিয়ে দেয় প্রায় নিঃশব্দে। এ রকম ক্ষণগুলোতে বাবু কোনোদিনই কথা বলে না। সে কাউকে চমকে দিয়েই দূরে সরে যায়। যেমন করে মেঘমন্দ্রিত আকাশে বিজলী চমকায়… সে আলোতে পৃথিবী দৃশ্যমান হয় কি হয় না তার তোয়াক্কা না-করেই বিজলী চলে যায় ফের মেঘের রাজ্যে।
কফির কাপ হাতে তুলে দেওয়ার পর আমি চেষ্টা করেও বাবুর মুখের রেখা পড়তে পারছিলাম না। শীতের প্রকোপ এতটাই বেশি যে, বাবু একটা কানমাথাগলা-ঢাকা টুপি পরে আছে। আর তাকে ঠিক এস্কিমোদের মতো দেখাচ্ছে।
কফির কাপে আমি ঠোঁট ডুবিয়েই চনমনে বোধ করি।
বাহ! অত্যন্ত ভালো টেস্ট!
নিবিড়জঙ্গলে যাত্রা পথে এ রকম স্বাদু-কফি! আমি সত্যিই চিন্তাও করতে পারি নাই!
আমি এবার সামান্য জোরে বাবুকে শুনিয়েই বলি…
বাহ, সত্যি ভালো টেস্ট!
এটা বলতে বলতেই আমার দুই চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসে। আমার সহসা মনে পড়ে যায়… ইতোপূর্বে আমাকে কেউ এত যত্ন করে কফিরকাপ হাতে তুলে দেয় নাই। কোনো ভ্রমণে তো নয়ই। সামান্য এক কাপ কফি দেখে আমার চোখ উপচে জল নামে কেন? ধুর, ফালতু-রকম ইমোশনাল আমি!
আমি কী অনেক ঠকে ও ঠেকে, গর্তে পড়ে পা ভেঙে শিখি নাই… কারও হাতের যত্নের কফির চাইতে জীবনের ডিজায়ার আরও ব্যাপক। জীবন তো অন্তহীন লোভের-আধার। ফলে জীবন যে কতকিছুই চায়! যেমন আরাম-আয়েশের চিন্তাহীন নির্ভার-দিনরাত্রি আর উঁচু স্তরের সামাজিক মর্যাদার ব্যাপকতার কাছে এই ধূমায়িত কফির মূল্য একেবারে কানাকড়ির মতোই। তাও কিনা আমি এই সামান্য কফির-প্রেমের জন্য নিজেকে একেবারে ক্ষয় করে দিতেও রাজি আছি? নিজের ফালতু-ইমোশন নিয়ে আমি বরাবরই বিপাকে পড়ি। যেমন এখনও পড়লাম। আমার চোখ উপচে পড়া অশ্রুমঞ্জরি চশমার প্রোগ্রেসিভ কাচে আড়াল করে ফেললাম। চশমা পরার এই এক সুবিধাÑমানুষের অনুভবের সমস্ত কিছুই সে আড়াল করে ফেলে! যাবতীয় দুঃখবেদনাসহ সুখের ছবিগুলোও চশমা বেশ কায়দা করে লুকাতে জানে।
বাস আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে গেলে একটা অটোতে উঠে পড়ি আমরা। বিকট শব্দ করতে করতে অটো আমাদের একেবারে ঝড়ের বেগে উড়িয়ে নিয়ে চলে। আমরা যে কটেজ বুকিং দিয়েছি তার নাম ‘ইকো-কটেজ’। পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা এক আদিম ও নির্জনতার ডেরা। আমি রুমের তালা খোলার আগেই বাবুকে দেখি টিলার ঢাল বেয়ে অনেকটা নিচে নেমে গেছে সে! দেখে আমি একেবারে হা হা করে উঠি…
অ্যাই অ্যাই কই যাচ্ছ?
ততক্ষণে বাবু আমার চাইতে অন্তত বিশফুট নিচে নেমে গেছে।
আমি টিলার খাড়াই বেয়ে নামতে নামতে দুই-একবার পা পিছলাই। আর তখুনিই আমি তাকে দেখতে পাইÑ বাবুর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে… একটা জলজ্যান্ত বাঘরোল! আমি তাকে রয়েল-বেঙ্গল-টাইগার ভেবে যখন চীৎকার করব ভাবছি, তখনই সে আমাকে তার বাম চোখের ওপরের পাতা বুঁজে ফেলে উইঙ্ক করে!
নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে তার দিকে তাকালে আমার বাঘের বিভ্রম কাটে… তার শরীরে ডোরাকাটা দাগের বদলে চিতাবাঘের মতো ফুটকি ফুটকি চিহ্ন আঁকা । আর মুখটা ভারি মায়াকাড়া বেড়ালের মতো। লেজটা নরম লোমের আবরণে ফুলে আছে। সে আমাকে দ্বিতীয়বার উইঙ্ক করে… এইবার তার ডান চোখে! সে যখন আমাকে উইঙ্ক করে তার নাকের নিচের হালকা গোঁফের বাড়ানো শিংগুলোও দুলে ওঠে! আমি বুঝে যাই যে, সে বাঘরোল! এবং বাঘরোলই! তাও আমি আমার মাথা থেকে রয়েল বেঙ্গলের ভাবনাটা উড়িয়ে দিতে পারি না। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে হালকা শিরাশিরানি হতে থাকলে আমি বাবুর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাই। আমি যা দেখছি তা বাবুকে জানাতে চাই। বা আন্দাজ করতে চাই… বাঘের থাবা থেকে এখন কতদূরে বাবু? তখুনি আমি বাঘরোলের বাম চক্ষু থেকে তৃতীয় উইঙ্ক পাই। আজব! সে কী আমার প্রেমিক নাকি? বারবার উইঙ্ক করেই চলছে। কিন্তু তার এই ‘চোখ- টেপাকে’ আমি অশ্লীল ইঙ্গিত বলে ভাবতে পারছি না! কীভাবে তা ভাবা যায় বা যাবে? বাঘরোলের পাশেই বাবু দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধ নয়নে। বাবুর মুগ্ধতা দেখে আমি খানিকটা ঘাবড়েও যাই… যদিও আমার এমনটা অত্যন্ত ভালো লাগে। আর আগেও দুই/একবার আমরা জলাজংলার ধারে মিলিত হয়েছিলাম। কাঠের পাটাতন বিছানো একটা ঘরের নিচ দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছিল ছলাৎছল ঘুঙুর বাজিয়ে। আর আমার দৃষ্টির বৃত্তে ছিল কচুরিপানার বেগুনি রঙের ঘোর। আমি সেই জলঘুঙুরের শব্দে মোহিত হতে হতে চোখ বুঁজে ফেলেছিলাম। অবশ্য আমি বাবুর কাছাকাছি এলেই এমন আবেশাক্রান্ত হয়ে উঠি। অদ্ভুত ভালোলাগায় শিহরণে মরতে মরতে যেন ভুল করে ভুশ করে শ্বাস ফেলে বেঁচে উঠি!
উন্মুক্ত আকাশ দেখতে দেখতে আমার ঘিয়ে-রঙা নগ্ন-শরীর যে মেঘের মতো জলভারে নত হয়ে ওঠেÑ এ তথ্যটা বাবু জানে। বাবু ছাড়া আর কেই-বা জানবে? কারণ বাবুর মতো করে আমার শরীরী-বীণা কেউ-ই বাজাতে পারে না… সাতটি তারেই এমনভাবে একই সাথে সুর ঝংকৃত করে সে।
আমি স্মৃতির কলোরোলে ঘোরগ্রস্ত হতে হতে আকুল নয়নে বাবুর দিকে তাকাই…
সত্যিই বাবু এখন চাইছে কিনা, এই বনভূমির বনজ-গন্ধ-মাখা নির্জনতায়, পাখিদের মধুর ডাকাডাকির মাঝে আমাদের চরম আকাক্সিক্ষত জলপুলকের পাপড়িগুলো মেলতে?
আমি বাবুর কাছ থেকে সেরকম কোনো ইঙ্গিত না পেয়ে তার মুগ্ধতা অনুসরণ করলে দেখি…
অদূরেই একটা পাহাড়ি-ঝিরি বয়ে যাচ্ছে অরণ্যের রুমঝুম সংগীত বাজিয়ে!
২.
বাবু আমাকে দুহাত বাড়িয়ে ডাকেÑ
আসো
কিন্তু আমি বাবুর ডাকে সাড়া দেওয়ার আগে সভয়ে নিচের ঝিরির দিকে তাকাই। ওই ঝিরির কাছে যেতে হলে আমাকে আরও বেশ-খানিকটা খাড়াই বেয়ে নামতে হবে। কিছু ঝোপঝাড় পেছনে ফেলে বাঁশের ছোট্ট একটা সাঁকোÑ সাঁকোটা পেরোলেই ওই নিরবধি জলধারা। খলখলিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনীতে ভারি মিহি অথচ অপরিচিত সুর! যেন এই পাহাড়-অরণ্য-টিলা গলা চেপে চেপে গান গাইছেÑ যার অর্থ আমি জানিনা! কিন্তু ওই অবুঝ-সুরের-ধারা আমাকে অবশ করে দিতে পারে!
আমি খাড়াই ধরে নামতেই নামতেই ফের শুনিÑ
আসো
স্বরটা এখন এমন অচেনা মনে হচ্ছে কেন? টিলার খাদে পা হড়কাতে হড়কাতে নিজেকে সামলে নিয়ে তাকাতেই আমি ফের বিভ্রমে পড়িÑ
বাঘরোল আমাকে এইবার তার ডানচোখে উইঙ্ক করে কেমন মোলায়েম হাসি হাসে। এ যে ভারি বিপদে পড়া গেল দেখছি! বাবুর আহ্বান আর বাঘরোলের উইঙ্কের মাঝখানে আমি দাঁড়িয়েÑ
আমাকে ‘আসো’ বলে ডাকল কে? বাবু না বাঘরোল? কিংবা আমাকে উইঙ্ক করল কে? বাঘরোল না বাবু? কেন আমি আসতে চেয়েছিলাম এই নির্জন অরণ্যে? আমার নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আমি কি আগে কখনও শুনি নাই যে, জঙ্গলে ‘মায়া’ নামক অশরীরীরা ঘুরে বেড়ায়। তাদের কাজ লোকালয়ের মানুষদের ভুলিয়ে ভালিয়ে মায়ার ফাঁদে ফেলে চিরকালের জন্য জঙ্গলে রেখে দেয়া। আমি এসব জেনেশুনেই এসেছি। আমি যে কেন এসেছি তা বাবুও জানে না। আমি বাবুকেও বলিনি। আমি এসেছি বাবুর অসমাপ্ত কবিতা লেখা যাতে শেষ হয় সেই জন্য।
বছর তিনেক আগে আমরা এ রকম এক বনবিহারে গিয়েছিলাম। সেই কটেজের নাম ছিল ‘সুবলং কটেজ’। বাবুর কবিতা লেখার ডায়রিটা ওই দুই দিনেই ভরে উঠেছিল। আরও কিছু কবিতা আসবে ভেবে বাবু কতগুলো পৃষ্ঠা খালি রেখে পরবর্তী পাতাগুলো ভরিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ‘সুবলং কটেজে’ হারানো কবিতাগুলো এতদিনেও আর ফিরে আসে নাই। আমি মনে মনে এই ভেবে এসেছিÑ বাবু যেন সেই অধরা কবিতাগুলোকে ধরে ফেলতে পারে। একজন কবির জন্য সবচাইতে দুঃখজনক ঘটনাÑ হারানো কবিতাদের ফিরে না-আসা! কিন্তু আমি ভেবেছি কী আর এখানে হচ্ছে কী?
বাবুকে এখনও বলি নাই কেন এই জলাজংলার-ভুবনে ফের তাকে আমি নিয়ে এসেছি?
বাবু আর বাঘরোল দুজনেই ঝিরির ধার ঘেঁষে বসে আছে। আর আমার দিকে তাকিয়ে মিচকি মিচকি হাসছে… আজব! হাসাহাসির কী এমন হলো এইখানে?
মন খারাপ করে এমন ভেবে ভেবে আমি টিলার খাড়াই ধরে এগোতে থাকি। আচানক আমার মনে পড়ে যায়… এই অরণ্যে বাঘরোল দেখে আমি এত অবাক হচ্ছি কেন? এইখানে ঝিরি বয়ে চলেছে, ঝিরিতে মাছের দাপাদাপিও দেখা যাচ্ছে… ঝিরির খরস্রোতা জলে দুই-একটা রুপালি ঘাঁই আমিও তো দেখেছি। মাছ থাকবে আর আশেপাশে বাঘরোল থাকবে না তাই কি হয় নাকি?
বাঘরোল তো মাছ খেয়েই বাঁচে। হয়তো সে শিকার ধরার আশাতেই আজ ঝিরির জলস্রোতের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।
আমি কয়েক কদম এগিয়ে ফের পিছিয়ে আসি। আমি কিছুতেই একা এই নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে ঝিরির কাছে পৌঁছাতে পারব না। বাবু এসে আমার হাত না-ধরা পর্যন্ত আমি আর এক-কদমও আগ বাড়ব না। বাবু হয়তো আমার ইচ্ছেটা বুঝতে পারে। ফলে সে-ই এক লাফে সাঁকো আর গুল্মের ঝোপঝাড় পেরিয়ে আমার কাছে চলে আসে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখি বাবুর মতো লাফ দিয়ে দিয়ে বাঘরোল ব্যাটাও আমার কাছাকাছি চলে এসেছে! আজব! ভালো মুশকিলে পড়া গেল দেখি! এই বাঘরোলও কি এই কটেজের মালিকপক্ষ নাকি? কিংবা এদের সিকিউরিটি গার্ড?
আমি মনে মনে ভাবি… ব্যাটা তোর যা খুশি কর, আমি আর তোকে দেখবই না।
কিন্তু বাবু কেমন নির্বিকার। একটা এত বড় জন্তু যে লাফ দিয়ে আমাদের কাছে এল তাতে তার বিন্দুমাত্র ভাবান্তর নাই। আমার রাগ লাগেÑ বাবুর এই গা-জ্বালানো নির্বিকার ভাব দেখে প্রায়ই ওকে কষে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করে। আর বলে দিতে ইচ্ছে করে…
ওই ব্যাটা, এত ভাব ধরস কেন? এত ভাব ধরলে নিজের রাস্তা মাপ। তোর মতো চুনোপুঁটি কবি এই বঙ্গদেশের সবখানেই দাঁত কেলিয়ে আছে। এমন ভাব করিস ব্যাটা যেন তুই কবি কালিদাস!
কিন্তু আমি বাবুকে এইসব বলি না। দাঁত চেপে বাবুর ‘ভাবধরা’ সহ্য করি। আমি যে সহ্য করি তার কারণও আছে… আমি নিজে একলাইনও লিখতে পারি না… নিজে লিখতে না পারলেও কবিতা ও কবি দুই-ই আমার ভালো লাগে।
বাবুর পাশে যে বাঘ-ব্যাটা না বাঘের-মাসি দাঁড়িয়ে আছে আমি তা ইঙ্গিতেও বাবুকে বলতে পারি না। কীভাবে বলব? বাবু যতবার আমার দিকে তাকায়, ওই বাঘরোল ব্যাটাও আমার দিকে তাকায়। বাঘরোলের চোখ থেকে তীক্ষè আলো ছিটকে এসে আমাকে খানিকটা অন্ধই বানিয়ে তোলে।
আমি এইবার একটা চালাকি করিÑ রুমের চাবিটা বাবুর হাতে দিয়ে দিইÑ ব্যাটা জঙ্গলের মায়াপীরÑ বাঘরোল, এইবার দেখি তুই কী করিস?
বাবু হাতের সিগারেট দুই-ঠোঁটে চেপে ধরে রুমের তালাতে চাবি ঘোরায়। বাবু সিগারেট ধরালো কখন? এইখানে আসা অব্দি আমি তো গোলকধাঁধার চক্করে খাবি খাচ্ছিÑ কখন কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি মনে মনে ফন্দি আঁটিÑ
রুমের তালা খোলা মাত্রই আমি বাবুকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেও ঢুকে পড়ব, যাতে ওই বাঘরোল আমাদের নাগাল আর না-পায়। যা ব্যাটা Ñএইবার ঝিরির মাছ খেয়ে পেট ফুলিয়ে সুবোধ জন্তুর মতো নিজের ডেরায় ফিরে যা। আমাদের পিছু নিয়েছিস কেন?
ফন্দি মোতাবেক আমি তা-ই করি। বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেÑ
কী হলো ধাক্কাধাক্কি করছ কেন?
আমি বাবুর কথার উত্তর না দিয়ে দ্রুত দরোজা বন্ধ করতে করতে ছিটকে সরে আসিÑ বাঘরোলের বড়সড় দেহের পুরোটাই আমাদের রুমের ভেতরে, শুধু লেজের অর্ধেক দরোজার দুই-পাল্লার চাপে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে আছে। আমি সরে আসতেই সে লেজটা পাল্লার চাপ থেকে সরিয়ে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে রুমে ঢুকে পড়ে।
আমার মাথায় রাগ ঝাঁ ঝাঁ করে। বাবুর যদি একটা জন্তুকে নিয়ে মাথা ব্যথা না-হয় তাহলে আমি কেন খামাখাই তাকে ঝাড়তে চাইছি? আর সে তো আমার কোনো ক্ষতি করে নাই। শুধু চারবার বেশ অশ্লীলভাবে দুই চোখের পাতা উইঙ্ক করেছে।
করুক। আমি তো এখনও জানি না এই বাঘরোলটা মাদি না মরদ? মাদিও হতে পারে, আমাকে উইঙ্কের ভুলভুলাইয়াতে ফেলে সে আদতে বাবুর পিছুই নিয়েছে।
আর বাবুরও খাসলত তেমন সুবিধার নাÑ এর আগেও সে কি আমার কাছে অন্য নারীর সাথে প্রণয়ের নামে ব্যাভিচার চালানোর কালে বার কয়েক ধরা খায় নাই? জিনাত জাহান নাম্নী এক ভাব-ধরা-কবিকে জান, সোনাপাখি, কলিজা ইত্যাদি লেখা এমএমএস ভুল করে আমার মোবাইলে সেন্ট করে দিয়েছিল। আমি রাগে-অপমানে বাবুকে চিরতরে ত্যাগ করতে চেয়েছিলাম। আমি যখনই তাকে ত্যাগ করতে চাই, তখনই সে একেবারে ভেজাবেড়াল হয়ে আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। আমার তখন তাকে ছেড়ে যেতে খুব মায়া লাগে।
আমি এটা ভেবে পাই নাÑ একজন নারীর কাছে সবকিছু থাকার পরেও মরদেরা অন্য দিকে চোখ ঠারে কেন? একজন নারী যদি হয় তার সবকিছু জুড়িয়ে দেওয়ার মতো পরিপূর্ণÑ তাহলে অন্য জলাধারে মুখ দিয়ে জল ঘোলা করে তোলার মানে কী? কেন একজন পুরুষ তার দেহের নগ্নতা বেসকের মতো জনে জনে বিলিয়ে বেড়ায়? আর বড়াই করে বলেÑ আমি না অমুক তমুককে! ভালো কথা, তোমাকেও কি ওই নারীগুলা একেবারে চিবিয়ে খায় নাই? খেতে খেতে ছোবড়া বানিয়ে ফেলে নাই?
এখন আমার সন্দেহ বাবুর দিকে ধাবিত হয়। তার বদ-খাসলতের জন্য সে একটা বাঘরোলকেও ইশারা করে ঘায়েল করেছে! এই যোগাযোগ হয়তো তাদের আগেই ঘটেছে, নইলে বাবু এখানে এসে রুমে না ঢুকেই কেন ঝিরির দিকে ছুটে গেল? আর এই কটেজে যে ঝিরি আছে তা বাবু জানলো কী করে? এর আগেও নিশ্চয়ই সে এসেছে, এবং বাঘরোলের সঙ্গে ঘরঘাট বেঁধে রেখে গেছে।
আমার মন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। আমার ইচ্ছে করে এই গহিন অরণ্যে চীৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলিÑ
এত প্রতারক কেন তুমি? এত অসৎ কেন? লুইচ্চা, বদমাশ, লোভী, কালপ্রিটÑ তোমার লজ্জা করে না? এখন মেয়েমানুষ রেখে জন্তুর সাথেও লেনদেন করছ? তুমি নিজেও একটা ইতরপ্রাণী!
আমি বাথরুমে ঢুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি। এত জঘন্য এই লোক? নারী শরীরে তার আর চলছে না? জন্তুর সাথে সঙ্গম স্পৃহায় সে আগেভাগেই এইখানে এসে ওই বাঘরোল-মাগিটাকে পটিয়ে রেখে গেছে।
আমি অঝোরে কাঁদতেই থাকি। বাবু তিন-চারবার বাথরুমের দরোজা ধাক্কা দিয়ে বলে, কী হইছে তুমার? কানতেছ ক্যান? খাইবা না?
আমি কোনোরকমে বলতে পারিÑ
আমার খুব মাথা ধরেছে। তুমি গিয়ে খেয়ে আসো।
বাবু বলেÑ
আচ্ছা তাহলে ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে থাকো। আমি তোমার খাবার রুমে দিতে বলে দিচ্ছি।
আমি মনে মনে বলিÑ
যাও, এখন গিয়া বাঘরোল বেটিরে ইচ্ছামতো… তোমার পাছার সাথেই লাইগ্যা রইছে!
৩.
আমার যখন ঘুম ভাঙে আমি ঠিক বুঝতে পারিনা এখন কী দিন নাকি রাত? রুমের জানালা গলিয়ে কিছু অন্ধকার ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আমি লাইটের সুইচ খুঁজে না পেয়ে দরোজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসি। আহা! কী মনোরম এই বনভ’মি। সন্ধের বিষণ্নতা এখন যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। দিনের আলো ফিকে হতে শুরু করলেই বৃক্ষেরা কেমন অসহায় বোধ করে! তারা জানেÑ তাদের শোভা রাতের কালো-শামিয়ানায় ঢেকে ফেললে পাখিদের গান গাওয়া থেমে যাবে। তাদের পাতার নাচন আর শাখার দুলুনি তাল তাল অন্ধকারের ভেতর আড়াল হয়ে পড়বে। বৃক্ষদের কাছে রাত্তির মানেই বিষাদের স্বরলিপি। রাত্তির মানেই কোনো বিদায়ী- বাদামী-বিকেলের করুণ-গল্প। যে বিকেলগুলোতে তাদের দেহে সোনার-আলো ঝরে পড়ে। সূর্য ডুবে যেতে যেতে বৃক্ষদের পাতায়-মাথায় অজস্র চুমকুঁড়ি রেখে যায়। আলো নিভে যেতে যেতে পাখিদের কলকাকলি স্তব্ধ-ঘুমের দেশে ঠাঁই করে নেয়। ফের কোনো সুবর্ণ ভোর নিয়ে ফিরে আসবার আশ্বাস রেখে এই পৃথিবীতে সূর্য ডুবে যায়। আমি যখন বাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে ফিরি, নিজেকে আমার এরকম বিষাদিত বনভূমির মতো অবসন্ন মনে হয়। যেন আমার সামনে আর কোনো আলো নাই। তাল তাল জমাট অন্ধকারের ভেতর আমি পথহারা হরিণীর মতো অবিশ্রাম ছুটে চলেছি।
আমার সহসা মনে পড়ে যায়Ñ আরে বাবু কই? সেই যে আমাকে বাথরুমে কান্নারত রেখে খাবারের কথা বলে বেরিয়ে গেল আর তো তাকে দেখি নাই।
আমি এবার নিশ্চিত হই… বাঘরোলটা মাদি না হয়েই যায় না।
আমি ইতিউতি তাকালে দেখি, বাবু ঝিরির পাশে চুপ করে বসে আছে। এখন অরণ্যের মরে-যাওয়ার-কাল। সূর্যের আলো নিভে যাবার সাথে সাথে অরণ্যের একটাই রঙ থাকে… কালো কেশরের মতো নিñিদ্র আঁধার।
আবছা-আলো-আঁধারে বাবুকে দেখায় কোনো গুল্মগাছের ঝোপের মতোÑ যেন সে তার সমস্ত খর্বতা এক করে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। কিন্তু ওই মাদিটা এখন কই? তাকে আমি কোথাও দেখতে পাই না। কিংবা আমার দেখার ভুল হতে পারে। বনভূমিতে সন্ধ্যা নামার প্রাক্কালে নানান বিভ্রমের সৃষ্টি হয়। আমাকে দেখে বাবু ঝিরি থেকে উঠে আসে।
আমি তখনও বাঘরোলের ফুটকি আঁকা শরীরটা দেখতে পাই না।
বাবু আমার কাছে এসে বলে…
তুমি ঘুমুচ্ছিলে, তাই আমি রুমে যাইনি। পথের ধকল নিশ্চয়ই তোমাকে ক্লান্ত করে ফেলেছে?
বাবুর কথা শুনে আমার মাথায় ফের রাগ ঝাঁজিয়ে ওঠেÑ
নখরা! এতক্ষণ একটা মাদি কাছে পেলে কে তার কোন জন্মের প্রেমিকাকে মনে রাখে?
কিন্তু আমি আমার রাগ অরণ্যের নিভু-নিভু-আলো আর উদ্ভাসিত-আঁধারের ভেতর ছুড়ে ফেলে দিই।
বাবু আমার কোমর জড়িয়ে ধরে জোরে আলিঙ্গন করে। আমি তার হাত ছাড়িয়ে দিতে যেয়েও ব্যর্থ হই।
আমি বাবুর আলিঙ্গনের মাঝে থেকেও তার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখতে পাই… বাঘরোলের মার্বেল চোখ অন্ধকারে আগুনের মতো জ্বলছে!
আমি বাবুকে ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি…
লুইচ্চা পুরুষ, কালপ্রিট… মাগিটাকে কাছে কাছেই রেখেছে!
আর নারীরাও তো ইদানীং একেকজন ছ্যাঁচড়ার ছ্যাঁচড়া। অন্যের পুরুষ নিয়া দড়ি-টানাটানি তারা হরহামেশাই করে, এখন এখানে এসে দেখি বন্যজন্তুরাও একই কাজে লিপ্ত!
বাবু তার হাতের বাঁধন শিথিল না করেই বলে… শোনো, আমি বহু দূর থেকেই এই ঝিরির জলের শব্দ পেয়েছিলাম। এই শব্দ আমার অতি পরিচিত। আমি তো ছোটবেলা থেকে এই শব্দ শুনেই বড় হয়েছি।
বাবুকে আমার তৎক্ষণাৎ কোনো আদিবাসী যুবকের মতো মনে হয়, সেরকমই মজবুত তার শরীরের বাঁধন। তার কুচকুচে-কালো দুই-হাত দিয়ে এক্ষুণি মাদলের বোল তুলে যে বনের নির্জনাতাকে খানখান করে ভেঙে দেবে। আর বুনোফুলের গুচ্ছ আমার হাতে তুলে দিতে দিতে বলবে…
মুই তরে কুচপাং
ধুর, কেন এইসব ছাতামাতা ভাবছি আমি? এক ‘ভাবধরে-থাকা-কবি’ কোনোদিন এই রোমান্টিকতাকে প্রশ্রয় দিতেই পারে না। অথচ সে লিখবে…
যাবার বেলায় যেন মনে হয়/ আরেকটু তোমার কাছে থাকি/ আরেকটু ঝর্নার মতো/ খলখলে /টাটকা জীবন/ এখানে বইয়ে রাখি,/ মৃত্যুহারা হই।/ আবার হৃদপিণ্ড ছেড়ে/ পৃথিবীর অমর বুদবুদ/ এখানে ঝুলিয়ে দিই/ ছেঁড়াপাতা হই/
বনের সবুজ-ঘ্রাণের ভেতর আমরা দুজন যেন অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমরা দুই আদিম-মানুষ… আমাদের যেন আর কোনো পরিচয় নাই। পিছুটান নাই। আমাদের জীবন বয়ে যাচ্ছে অদূরের ওই ছুটন্ত ঝর্নাজলের মতো। অথবা আমরা যেন সেই হংসমিথুনÑ একজন শরবিদ্ধ হলে অন্যজন নিজের ডানাটি মেলে দেয় আরেকটি শর ছুটে আসবার আশায়!
আমাদের সুদীর্ঘ চুম্বনের শব্দ পাতার মর্মরের মতো বনভূমির নির্জনতাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করে!
৪.
রুমে ঢুকেই বাবু পানির বোতল আর গ্লাস নিয়ে বসে। সিগনেচারের সবুজ বোতলের কর্ক আলগা করতে করতে বাবু আমার দিকে তাকায়। বাবু এটা বরাবরই করে। ড্রিংক করতে বসার পূর্বে আমার অনুমতি প্রার্থনা করে। আমি হেসে মাথা নেড়ে বলিÑ
আমি কিন্তু তিনটার বেশি নেব না।
বাবু আমার কথাকে পাত্তা দিলো বলে মনে হয় না। আপনমনে সোমরসের সংগে জল মিশিয়ে দুইটা গ্লাসে পেগ বানায়। এইবার আমি সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তার হাতের কাজ দেখিÑ বাবু কয়টা গ্লাসে পেগ বানাচ্ছে? দুইটা না তিনটা? আজ তো সে তিন গ্লাসে তিনটা পেগই বানাবে। এখানে আসা অব্দি যার সাথে ফষ্টিনষ্টি চালাচ্ছে, তাকে ছাড়া এই ঘোর-যামিনির পান-মচ্ছব সকলই বাবুর বৃথা যাওয়ার কথা। আমি এতক্ষণ ভুলেই গেছিলাম সেই মাদিটার কথা! আমি অবাক হয়ে দেখি সে আমার সোফার হাতলে লেজ ঝুলিয়ে বসে আছে! ভয়ে আমি চীৎকার করে উঠতে গেলেও বাবু উঠে এসে আমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে সেই চিৎকার খেতে শুরু করে। আমি নিজেকে তার কবল থেকে কিছুতেই ছাড়াতে পারি না। আজ এই ব্যাপারটা এখন শুরু হলো। অথচ আমি আর বাবু যতবার দেখা করেছি, মিলনের সুতীব্র আকাক্সক্ষা আমাদের আকাশে ভাসন্ত ঘুড়ির মতো দোলাচলে রেখেছে। যেন এক্ষুনি আমরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ব হাওয়ার প্রকোপ সইতে না-পেরে! কিংবা ক্লান্তিহীন উড়ে বেড়াব মেঘেদের ধার ঘেষে!
আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবু আজ আমাকে অল্পতেই ছেড়ে দিলো! ছেড়ে দিয়ে গ্লাসের সোমরসে চুমুক দেওয়ার ছলে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে নিলো। আমি ছাড়া পেয়ে আজ খুশিই হলামÑ এবার বাছা বাঘের-মাসি, তুমি কত বড় সেয়ানা হয়েছ ধরা যাবে!
আমি আমার গ্লাস টেনে নিতেই দেখি আরেকটা গ্লাসের সোনালি-তরল মৃদু মৃদু দুলছে, যেন কেউ এইমাত্র এক সিপ দিয়েই টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছে। তার মানে বাবু আদতে তিনটা গ্লাসেই সিগনেচার ঢেলেছিল। কিন্তু আমি যে তখন দেখলাম দুইটা গ্লাস! বাবুর এই হাতসাফাইয়ের মানে কী? আমি প্রচণ্ড রাগে চিৎকার উঠতে চাইলেই দেখি, বাবু তার কবিতার ডায়েরি খুলে বসেছে! আমি বরাবরই বাবুর কবিতা পড়ার প্রহরকে নীরবতার তুলি দিয়ে এঁকে রাখতে চাই বলে চুপ করে থাকি। এখনও তাই থাকলাম। বাবু ডায়েরি খুলে পড়তে শুরু করল…
এ ভাবে তো হয় না কিছুই/ একটি জীবন থেকে/ সব অন্ধকার দূর করে/ সবার জীবনে আলো ভরে রাখা/ একটি অভীষ্ট ইশারায়/ লক্ষ্যভেদ সহজে হয় না/ জানি/ আকাশ নক্ষত্র ছিল/ সত্য ছিল পাশে/ সূর্যের বন্ধন ছিল ঠিকঠাক/ হয়তো আমাদেরও কিছু ভুলভাল ছিল/ আমাদেরই দোষে/ জীবনের আকাঁড়া কার্বনে জেগে/ পথভ্রষ্ট হতে হয়েছিল/ তৃষ্ণার ভেতরে যে/ যাত্রা থাকে, মনভাঙা থাকে/ নিদ্রার ভেতরে যে ফুলডালি থাকে/ দীপ থাকে হাসিমুখে/ সামনে জ্বালানো/ সবকিছু/ একদিন ফুটন্ত বাতাসে / ঝাঁঝরা হয়ে গেল/ এই তো কাহিনি/ এ কাহিনি শুনে আর /কী হবে এখন/ আমাদের?/ আমরা তো জানতে পারিনি/ কোন অন্যায় বা/অন্তরাল বিধানের হেরফেরে বৃন্ত থেকে মর্ম ঝরে গেল/ কবিতা পড়তে পড়তে বাবু কত পেগ যে বানায় আর ধীরে ধীরে পান করে… আমি নজর রাখতে পারি না। কারণ আমি ততক্ষণ বাঘরোলের মদ্যপান করা খেয়াল করছিলাম। একেবারে মানুষের মতো গ্লাস হাতে ধরে সে-ও ধীরে-সুস্থে সিপ করছিল। সিপ করতে করতে পাশে রাখা হাফপ্লেট থেকে দুই-একটা করে ফ্রেঞ্চফ্রাই তুলে নিচ্ছিল! আরে! ফ্রেঞ্চফ্রাই আনলো কে? বাবুর কাজই হবে হয়তো। দুপুরে খেতে গিয়ে নিয়ে এসেছে সে।
বাবু তার ডায়েরি নামিয়ে রেখে আমরা দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলেÑ
দেখ, তোমার সাথে এই রিলেশনটা আমি রাখতেই চাইনা, শুধু আর কাউকে পাচ্ছি না বলে এই রিলেশনটা টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
মাতালেরা সর্বদাই সত্য কথা বলে!
বাবুর এরকম ভঙ্গির কথা শুনে আমি বজ্রাহতের মতো বসে থাকি। আমাকে হঠাৎ এমন অপমানের মানে কী? তুমি কাউকে পাচ্ছ না সে দোষটাও কি আমার নাকি? আর আমিও যে লাইন ধরে থাকা আর দশজন পুরুষকে পাত্তা দিচ্ছি না, সে দোষটাও তোমার নয় নিশ্চয়ই।
আমি ঝাঁ ঝা করে উঠিÑ
যাও, পাইলে যাও। আমি কী তোমারে বাইন্ধ্যা রাখছি? যাও, এক্ষুনি যাও।
বলে আমি পাশের ছোট্ট একটা খাটে শুয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে কাঁদতে শুরু করি। আজ আমি কিছুতেই বাবুর বিছানায় যাব না। বাবু যদি আজ মারাও যায়, তবুও যাব না।
কাঁদতে কাঁদতে আমার হেচকি ওঠেÑ কিন্তু আমি কিছুতেই কান্না থামাতে পারি না। কম্বলের ভেতর থেকে আমার কান্নার করুণ-সুর অন্ধকার বনভূমিতে ছড়িয়ে পড়ছে কিনা, আমি সেটাও বুঝতে পারি না। কেউ আমার মাথায় যত্নের হাত বুলিয়ে দিচ্ছে টের পেয়ে আমি চোখ মেলে তাকাই। বাবু নাকি? আমাদের ঝগড়ার পরে বাবুর আচরণ এমন মিনমিনে ভেজাবেড়ালের মতো হয়ে যায়। বাবু নয়Ñ বাঘরোল! বাঘরোল তার ধারালো-নখগুলো থাবার ভেতর পুরে ধীরে ধীরে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে! আমি ভয় পেয়ে তার হাত সরিয়ে দিতে চাইÑ কিন্তু বাঘরোলের কোমল স্পর্শ আমার ভালো লাগতে থাকে। আচানক আমার মনে উদয় হয়Ñ আচ্ছা বাঘরোলটা কী তবে মরদ?
আমার পরনের রাতের স্বচ্ছ-পোশাক সরিয়ে বাঘরোল আমার পিঠে-পেটে-বুকে তার লেজ আলতো করে বুলিয়ে দেয়। কেমন একটা অচেনা-মমতা নাকি প্রেম নাকি মায়া নাকি স্পর্শÑ আমার ঘুম এসে যায়। আমি কতক্ষণ ঘুমাই জানিনা, রাত্রি শেষের দিকে শুনতে পাইÑ
বউ, ওঠো, আমার বিছানায় এসে ঘুমাও।
ঘুমের ভেতর মরে থাকা আমি বুঝতে পারি না… কে ওমন করে ডাকছে? বাবু নাকি বাঘরোল? বাঘরোল নাকি বাবু? কে আমায় ডাকছে আমি ঠিক ধরতে পারিনা।
৫.
পরেরদিন আমি বেসিনের আয়নায় নিজেকে দেখে একেবারে চমকে উঠি। অতিরিক্ত কান্নার ফলে আমার নাকচোখে রক্ত-জমাট হয়ে জবাফুলের মতো লাল হয়ে আছে। আমার নাক-চোখের সংগে ঠোঁটজোড়াও জমাট-রক্তে একেবারে মেরুন রঙের হয়ে আছেÑ বাবু আমাকে অত্যধিক চুম্বন করলে যেমন হয়! বাবুকে দেখি রুম-লাগোয়া ছোট বারান্দায় কবিতা লেখার ডায়রি আর সিগনেচারের বোতল খুলে বসেছে। আজব! এই সকাল সকাল মদ্যপান করার মতো স্বেচ্ছাচারী-লোক বাবু ছাড়া আর কেউ আছে বলে আমার স্মরণে নাই। রাগে আমি বারান্দা পেরিয়ে বনভূমির দিকে হেঁটে কয়েক পা যেতেই বাঘরোলের সাথে দেখা হয়ে যায়। আমি এখন আর তাকে দেখে ভয়ে চীৎকার করে উঠতে চাই-না। গতরাতের পর থেকেই বাঘরোলকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। বাঘরোল জন্তু হতে পারে, কিন্তু মানুষের মতো অত হিংস্র আর অসভ্য নয়। বাঘরোল তো আমাকে বেড়াতে নিয়ে এসে অপমানকর কথাবার্তা শোনায় নাই। বাঘরোল আমাকে সারারাত অন্য বিছানায় রেখে মদ্যপান করে নাই। বরং আমার কান্নাতে সে সমদুঃখী হয়েছিল।
বাঘরোল আর আমি পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। উচ্চতায় সে মাত্র আমার কোমরের সমান। সামনে জ্বলছে তার উজ্জ্বল দুই চক্ষু আর পেছনে ঝুলছে ফুলো-ফুলো-লেজের বাহার। সে যে এত খর্বÑ তাতে নিজেকে আমার বিন্দুমাত্রও উচ্চতর প্রাণী মনে হয় না। বেঁটে বা কুৎসিত হলে কীই-বা আসে যায়… যদি তার ভেতর ভালোবাসা থাকে। মায়া-মমতার ফুলগুলি যত্নে প্রস্ফুটিত থাকে।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে বনভূমির বেশ গভীরে ঢুকে পড়ি। বাঘরোল আমাকে বলে…
গত রাতে তুমি এত কানছিলা… আমার খুব মায়া লেগেছে তোমার জন্য।
আমি দাঁড়িয়ে পড়ি…
ক্যান, আমার জন্য তোমার মায়া লাগার হেতু কী?
তা তো আমি জানিনা। তবে মেয়েরা কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়।
শুনে আমি চমকিত হই। তার মানে এই বাঘরোলটা মরদ! নইলে সে আলাদা করে ‘মেয়েরা’ শব্দটা বলার কথা নয়।
বাঘরোলের কণ্ঠ আরও ধীর হয়ে আসে। সে নিচুস্বরে বলে…
দেখছ, তুমি কানছিলা বলে এই বনের কতশত বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে গেছে?
আরে তাইতো! আমরা যে হাঁটছিÑ আমাদের পায়ের তলায় শুকনো পাতার নূপুর রুমঝুম বেজে চলেছে। আমি ওপরে তাকালে দেখি কিছু কিছু বৃক্ষও কেমন শুষ্ক হয়ে উঠেছে… যেন এখন তুমুল বসন্তকাল আর পাতা ঝরে পড়ার বিলাপিত মরশুম!
দেখো তুমি আর কাঁদবা না, কিন্তু। এই বনে এর আগে এত পাতা আর ঝরে পড়ে নাই।
আমি অবাক হয়ে বাঘরোলের দিকে তাকিয়ে থাকি। একটা জন্তুর অনুভূতি মানুষের চাইতেও মানবিক হয় কী করে?
বাঘরোল বলে…
চল এইবার ফিরে যাওয়া যাক।
কিন্তু আমার ফিরতে ইচ্ছে করে না। আচ্ছা, আমি কি এই বাঘরোলের সাথে চলে যাব? বাঘরোল মাছ ধরে আনবে, সেই মাছ খেয়ে আমরা দিব্যি সুখে দিন কাটাতে পারব। আর আমি তো তেমন কাউকেই চাই, যে আমাকে কোনদিন কাঁদাবে না।
যে আমাকে মর্যাদা দেবে। আমি একজন অত্যন্ত মমতাময় কারও সংগে জীবন কাটাতে চাই।
আমাদের পায়ের তলায় ফের শুকনো পাতার নূপুর। আর মাথার ওপর শুষ্ক-শীর্ণ বৃক্ষদের ছায়া। দৃষ্টির সম্মুখে দুই-একটা খরগোশের দূরন্ত ছুটে চলা।
ফিরে এসে দেখি বাবু গোসলটোসল করে রেডি হয়ে বসে আছে। আমাদের দেখেই রুক্ষ গলায় বলে…
কই গেছিলা? আমাদের তো এই রুমটা ছাড়তে হবে। ফিরতে হবে। ফেরার গাড়ি ঠিকমত পাওয়া যাবে কিনা কে জানে? আর তুমি এতক্ষণ কই চক্কর মাইরা আসলা?
বাবুর কর্কশ-আচরণে আমার চোখের কোনে জল জমে ওঠে! কিন্তু আমি নিজেকে সামলে ফেলি। বাঘরোলের দিকে জলভরা চোখে তাকালে সে আমাকে বাম চোখের পাতা ফেলে উইঙ্ক করে… এ নিয়ে পঞ্চমবার!
এইবার আমি হেসে ফেলি। দেখি বাঘরোলও তার লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাসছে!
হঠাৎ সূর্যের আলো নিষ্প্রভ হয়ে যেতে শুরু করে। আমি ভাবি আকাশে হয়তো আজ মেঘ ঘনাচ্ছে। কিন্তু ওপরে তাকিয়ে আমি হতবাক হয়ে যাই…
কালো কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেছে। এত ধোঁয়া কোত্থেকে আসছে? কোথাও কি আগুন লেগেছে?
বাঘরোল আমাকে বলে…
সর্বনাশ! দাবানল! চল চল, দ্রুত চল এখান থেকে।
আমি বাবুর দিকে তাকাই। বাবুও দেখছে আগুনের শিখা লকলক করে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে! বাবু তার সাইড-ব্যাগটা দ্রুত ঘর থেকে তুলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। আমি দেখি হরিণের ক্ষিপ্রতায় সে গুল্মের ঝোপঝাড়, নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে ঠিক ঝিরির মাঝখানের টিলাতে গিয়ে দাঁড়াল। ওই সামান্য উঁচু-টিলার চারদিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা জলের ধারা। বনের দাবানল এখন বাবুকে আর কিছুতেই গ্রাস করতে পারবে না।
বাঘরোল আমাকে বলে…
তুমিও দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও যাও, এই অরণ্য থেকে দ্রুত বের হয়ে যাও।
আমি বলি…
তুমি তাহলে কী করবে?
কথাবার্তার ফাঁকে দাউ দাউ-আগুন আমাদের চারদিক দিয়েই ঘিরে ধরেছে।
আগুনের আঁচে বাঘরোলের গায়ের লোম ঝলসে যেতে শুরু করে।
বাঘরোল চিতাবাঘের মতো তড়িৎ গতিতে দীর্ঘ-লাফ দিতে দিতে আমাকে বলে…
এই আগুন সাত দিনেও নিভবে না। তোমাকে কত করে বললাম, যাও যাও পালাও।
ওহ তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম… অরণ্য আর কবির ওপর কোনো দিন ভরসা করতে নাই, এই দুই-ই বিশ্বাসঘাতক!
চক্ষের পলকে বাঘরোল যেন বহু দূরে উড়ে চলে যায়। আমি ঝিরির জলে ঝপাৎ করে কিছু পতনের শব্দ পাই… কে জলে ঝাপ দিয়ে পড়লো? বাবু না বাঘরোল? বাঘরোল না বাবু?
দাউ-দাউ আগুনের ঘেরের ভিতর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমি।
বনের কোন দিকে গেলে দাবানল থেকে বাঁচার পথ খুঁজে পাব ঠিক বুঝতে পারি না!
[গল্পে ব্যবহৃত কবিতার পংক্তিমালার রচয়িতা কবি নূরুল হক; উৎসর্গ, নাহিদা আশরাফী অনুজপ্রতিমেষু।]
কৃতজ্ঞতা: শব্দঘর
জন্ম ১৯৬৫, ঢাকা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। লেখক, সম্পাদক, গবেষক এবং অনুবাদক।