| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

শুধাময়ীর পুতুল

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

শুধাময়ীর পুতুল দাঙ্গার সময়কে তুলে ধরেছে। দেশভাগ, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গায় একটি পরিবার ও জনগোষ্ঠী কিভাবে পুতুলে পরিনীত হয়েছিল এ গল্প তার। দেশ ছাড়ার যন্ত্রণা বুকে করে করুণাময়ী, ধীরেন মন্ডলরা যেন মানুষ রূপী পুতুল যাদের দেশ নেই, নিরাপত্তা নেই আছে কেবল আতঙ্ক ও ছেড়ে যাবার তাড়া। এই গল্প জুড়ে সেই সুরই শোনা যায়।


 

শুধাময়ী পুতুল নিয়ে খেলে। ঝিনুক দিয়ে আমের গুটি কেটে খাওয়ার বয়স হয়নি তবু তার ছুরির শখ।মা বলেছে চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় কিনে দেবে। মেয়ের তর সইছে না। তার আজই চাই। এখনি চাই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। যতটা না চোখ গলে তার চেয়ে দু’হাতে ডলে বেশি। অগত্যা পারুলের কোলে দিয়ে কামার বাড়ী পাঠাতে হয়।

– ও পারুল, গনেশকে বলিস ছুরিতে যেন ধার না দেয়। মেয়ের যেন হাত না কাটে।

বৌদিমনি পারুলকে ডেকে বলে দেয়। বৌদিমনি মানে শুধাময়ীর মা। সবাই যাকে বৌদিমনি বলে ডাকে। আসলে তার নাম করুণাময়ী। যে নাম এখন করুণাময়ী নিজেও ভুলে গেছে। ও নাম ধরে তো এখন আর কেউ তাকে ডাকে না।

পারুল মেয়েটা বেশ বোকাশোকা। উত্তর অঞ্চলের দিকে বাড়ী ছিল। ওর স্বামী হারাণ যে গৃহস্থের বাড়ীতে কাজ করত তার গরু হারাল। হারাণ গরু খুঁজতে খুঁজতে মহাদেবপুর হাটে এল। এখন যার নতুন নাম হয়েছে মহাম্মদপুর হাট। সেখানেই দা’ঠাকুরের সাথে দেখা। দা’ঠাকুর সবকিছু শুনে বলল, এক মাস আগে তোমার গরু হারিয়েছ আর এখনও তুমি হাটে হাটে ঘুরে মরছ? মানুষ হলেও কথা ছিল, খোঁজ পেলে টাকা পয়সা দিয়ে ছাড়ানো যেত। তোমার গরু কি আর আস্ত আছে? সে এতো দিনে ছুরির নিচে চলে গেছে। যার যা গতি। বেচারা হারাণ দা’ঠাকুরের কাছে কেঁদে পড়ল। গরু না পেলে যে আমায় কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেবে। নতুন বিয়ে করেছি বউকে খাওয়াবো কি? দা’ঠাকুরের দয়ার শরীর। বলল, কাঁদছিস কেন? বউ নিয়ে চলে আয়। আমার জমিতে ঘর তুলে থাকবি। আমার বাড়ীতেই দু’জন মিলে কাজ করবি। সেই থেকেই হারু আর পারু দুজনেইএ বাড়ীতে আছে। এক ঘর পড়শি বেড়েছে। দেশ ভাগের পরে সুড় সুড় করে পাড়ার লোক সব ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। ধীরেন মন্ডল মানে শুধাময়ীর দা’ঠাকুর এখন এই ভাবে পাড়ায় বসতির সংখ্যা বাড়াচ্ছে।

ধীরেন মন্ডল প্রভাবশালী মানুষ।এক সময় হাঁক দিলে একশ’ লাঠি বের হতো। হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ ছিল না।যোগেন মন্ডল তখন তাদের নেতা, দেশের মন্ত্রী। তার কথাতেই ধীরেন মন্ডলরা দেশ ছাড়েনি। বর্ণ হিন্দুরা সব সময়ই তাদেরকে নিচু চোখে দেখে। ইন্ডিয়ায় গেলে সেই সব হিন্দুদের অসম্মান সহ্য করতে হবে। তার থেকে ঢেড় ভালো মুসলমানদের সাথে বসবাস করা। তা ছাড়া শরনার্থীর জীবন দুর্গতি আর অসম্মানের জীবন। তাই সম্মান নিয়ে বাঁচার জন্যই যোগেন মন্ডল লোকজনকে দেশ ছাড়তে নিষেধ করেছিল। কয়েক বছর যেতে না যেতেই যোগেন মন্ডল নিজেই লেজ গুটিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। দেশ ভাগের পর ভিতরে ভিতরে যে তুষের আগুন জ্বলছিল তিন বছরের মাথায় এসে তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সারা দেশে। তবে দাঙ্গার সময় সব মানুষ তো আর খারাপ হয় না। ধীরেন মন্ডলের শ্বশুর বাড়ী ছিল বরিশালে জেলার আগরপুর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণদিয়া গ্রামে। সুধাময়ীর ঠাকুমা আন্নাকালী তখন ছোটবোনের আঁতুর সারতে বাপের বাড়ী । আশেপাশের গ্রাম থেকে হাজার হাজার হিন্দুরা এসে আশ্রয় নেয় সেখানে। ধীরেন মন্ডলের বিশেষ বন্ধু আলতাফউদ্দীন মোহাম্মদ নামে একজন মুসলমান, যিনি বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি তার দলবল নিয়ে পাহারা বসান। নিজের বন্দুক থেকে গুলি ছোড়েন দাঙ্গাকারীদের দিকে তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। হাজার হাজার আশ্রিত মানুষের সাথে আলতাফউদ্দীন নিজেও নিহত হন। তারপর থেকেই ধীরেন মন্ডল বিপত্নীক। আন্নাকালীসহ শ্বশুর বাড়ীর কারোরই কোন হদিস পাওয়া যায়নি। শুধাময়ীর বাবা কানুবাবুর তখন সবে কলেজ পাশ করে খুলনা শিপইয়ার্ডে নতুন চাকরি ।

সে বছর ধীরেন মন্ডলের গ্রাম রামনগর, এখন যার নতুন নাম হয়েছে আমনগর, সেখান থেকেও অনেক লোকজন দেশ ছেড়েছে। লোকজন কমতে কমতে গ্রামটা একেবারে কামার-কুমোর ধোপা নাপিত শূন্য হয়ে গিয়েছিল। এখন এখান ওখান থেকে দু’ এক ঘর ছিন্ন মূল মানুষ এসে বসায় পাড়ার খাঁ খাঁ ভাবটা একটু কমেছে।

গনেশ কামারও এ গ্রামে নতুন। আগে যেখানে বাস করত সেখানে লোকজনকে বড় বড় তরবারি ফলা বর্শা বানিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে গ্রাম থেকে তুলে দিয়েছিল। গনেশ বলে, ৫০’র রায়ওটের সময় সবাই আমার বানানো অস্ত্র দিয়েই আমাদের মারতে আসে। আমি আর মানুষ মারা অস্ত্র বানাব না। লাঙ্গলের ফাল বানাব, ধান কাটা কাচি বানাব। দরকার হলে খোন্তা কোদাল বানাব। কিন্তু ছুরি চাকু তরবারী বানাব না। তারপর থেকে গনেশ কামারও এই গ্রামের বাসিন্দা। গ্রামে বাস করতে গেলে ঠাকুর নাপিত ধোপা মুচি সবই লাগে। এক সময় সবকিছু দিয়েই গ্রামটা সাজানো ছিল। এখন হারাতে হারাতে সবই হারিয়ে যাচ্ছে। জাত ধর্মও সব উঠে যাচ্ছে। এখন কে চুল কাটে আর কে জুতা সেলাই করে তার কোন ঠিক নেই। শোনা যায় শহরে নাকি এখন গৃহস্থ ঘরের ছেলে বউরা মেথরের চাকরি পর্যন্ত নিচ্ছে।

পারুল গনেশ কামারের চালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শুধাময়ীকে কোল থেকে নামিয়ে দুজনের পরনের শাড়ী ঠিক করে নিল। গনেশ কামার তখন হাপোর টানা বন্ধ করে একটা লাঙ্গলের ফাল আগুন থেকে তুলে রেলের ওপর শাঁড়াসি দিয়ে ধরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। একবার গনেশ মারে তো আরেকবার নিমাই মারে। নিমাই গনেশের ছেলে। বাপ বেটায় হাতুড়িতে বেশ তাল তুলেছিল। হঠাৎ অসম বয়সের দুই মেয়েকে দেখে হাতুড়ি পেটা বন্ধ করে।

– কি চাইগো মা সগল?

– ছুরি। পারুল উত্তর দেয়।

– ছুরিতো আমি বানাই নে।

– বানাইনি বললি হবে। শুধাময়ীর ছুরি। বৌদিমনি পাঠিয়েচে। দেখ বাপু, ছুরিতে ধার যেন না-হয়। মেয়ের যেন হাত না কাটে।

– কলার ছাড়া জামা বানাব কি ভাবে বাপু। গনেশ হাসতে হাসতে উত্তর দিল।

– জামা না। জামা না। আম কাটা ছুরি। শুধা আর পারু দুজনেই চেঁচিয়ে ওঠে।

– ওই একই কথা। কলার ছাড়া যেমুন জামা হয় না তেমুন ধার ছাড়া কি ছুরি হয়?

– অতশত বুজিনে, বৌদিমনি পাটিয়েচে শুধাময়ীর আম কাটা ছুরি। হাত যেন না কাটে।

– আচ্ছা মা সগল, বাড়ীর ভেতরে গিয়ে বস। আমি হাতের কাজটা শেষ করে আসি।

কামার বাড়ীর ভেতরে ঢুকতেই দেখে বারান্দায় একজন মাঝ বয়সী লোক শুয়ে আছে। মাথায় চুলের ঝুঁটি, মুখ দাঁড়ি গোঁফে ঢাকা। হাতে লোহার বালা। পাশে একটা একতারা। পারু দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কে গা তুমি? তোমারে তো এ গাঁয়ে আগে কখনও দেখিনি।

কামার বউ উত্তর দেয়, ও ভিন গাঁর মানুষ, বোরগী। তারপর পারুর কানের কাছে মুখ এনে বলে, বোরগীর বউ হারাইচে। তাই বউ খুঁজতে এয়েচে। কথাটা শুধাময়ীর কানে যেতেই হেসে আট খানা। বলে, বউ আবার কারও হারায়? বউ কি পুতুল, যে কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে? কামার বউ শুনে বলে, হারায় রে মা হারায়। মেয়ে হয়ে জন্মেচ এদেশে, বড় হও সব জানতি পারবা।

– তো, কোন খোঁজ পেয়েচ? কে নিল, কোতায় গেল? পারু কামার বউকে জিজ্ঞাসা করে।

– খোঁজ পেয়েই তো এয়েচে এ গাঁয়ে।ওপাড়ার সুলতান কবিরাজের বাড়ী আচে। কবিরাজের শালা বোষ্টমীকে তুলে নিয়ে এয়েচে।ওই বেটার ঘরে আরও দুটো বউ আচে। কবিরাজরা হল ডাকাত মানুষ। এখন কে যাবে ওই বোষ্টমীরে উদ্ধার করতে?

– তো, ধীরেন কাকারে যেয়ে বলুক। কাকা যদি কিচু করতি পারে।

– সেই কতাই তো কচ্চি। যে যাও, বৌদিমনিরে গিয়ে ধর। সে যদি ধীরেন কাকারে বুজয়ে বলে তো সে নিশ্চয় একটা ব্যাবস্থা নেবে। কবিরাজরা শুনলে একমাত্র ধীরেন মন্ডলের কথাই শুনতি পারে। আর কাউরে বলে তো কোন লাভ নেই। সকাল থেকে গুতচ্চি যাও যাও। তা না, মন মরা হয়ে শুয়ে আচে। পারু, তুই একটু বোরগীরে সাথে করে নিয়ে যা তো বৌদিমনির কাচে।

শুধাময়ী তখন চিৎকার দেয়, আমার ছুরি? আমার ছুরি বানায়ে দেও আগে। গনেশ কামার কাজ ফেলে উঠে আসে। ঘর থেকে একটা পুতুল নিয়ে এসে শুধাময়ীর হাতে দিয়ে বলে, ভালো ছুরি বানাতে তো সময় লাগে। এখন এই পুতুলডা নিয়ে যেয়ে খেল। ছুরি বাননো শেষ হলে আমি গিয়ে দিয়ে আসব। শুধাময়ী পুতুল পেয়ে মহাখুশি। বলে, ওর বউকি এই পুতুলডার মতো সুন্দর? ওর বউয়ের কি এমন শাড়ী পরা ছিল? কামার বউ বলে, হ্যাঁ গো হ্যাঁ, বউ তো শাড়ী পরাই ছিল। ওই পুতুলের মতোই সুন্দর বলেই তো পোড়ামুখীর মুখ পুড়ল। শুধাময়ী বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করে, বউডা কি আগুন নিয়ে খেলা করত যে ওর মুখ পুড়ে গেল? কামার বউ বলে, মা রে, মেয়ি মানুষ পরের হাতে গেলি কি আর মুখ থাকে। মুখ যে আমাদের সবারই পুড়েচে। এসব কথার মানে হয়তো শুধাময়ী বোঝে না। তবে তার খুব রাগ হয়।বলে, চোরডা তো খুব পচা। বউ চুরি করেচে, শাড়ী চুরি করেচে আবার মুখও পুড়ায়চে। আমি এখনি দা’ঠাকুরকে বলব চোরডারে ধরে পিটু দিতে।

বোরগীর নাম নিতাই। পারুর সাথে এসে সরাসরি ধীরেন মন্ডলের সাথেই কথা বলে।সে সব কিছু শুনে বলল, দেখ বাপু সময় পাল্টেচে। এখন তো কেউ কারো কথা শোনে না। তবু তুমি যখন বলচ চেষ্টা করে দেখব। তা তোমার বউ কি তোমার সাথে থাকতে চায় নাকি নিজের ইচ্ছায় ওই লোকটার সাথে গেছে। কি যেন নাম বললে লোকটার?

– কর্তা মশাই, ওর নাম রহিম। ডাকু ধরণের মানুষ। দিনে দুপুরে খুন খারাপি করতি পারে। সে বলেচ, আমার বোষ্টমি যদি তার সাথে না যায় তো সে আমারে খুন করবে।এখন তো এসব কতই হচ্ছে। ছেলেরে খুন করবে, স্বামীরে খুন করবে, এই সব ভয় দেখায়ে বাড়ী থেকে বউ ঝিদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ভোলা নোয়াখালির ওদিকে নাকি রাতে নিয়ে যায় আবার সকালে ফেরত দিয়ে যায়।

– তা হলে তুমি বোষ্টমীরে ফেরত পেলেও তো তোমার গাঁয়ে ফিরে যেতে পারবে না।

– আপনি যদি একটু আশ্রয় দেন তো এখানেই থেকে যাব। না হলে ইন্ডিয়া চলে যাব। গ্রামে আর ফিরে যাব না।

সুলতান কবিরাজকে জরুরী তলব পাঠানো হলো। সে যে মানুষ ভালো না সে কথা এ অঞ্চলের সবাই জানে। ডাকাতের দল আছে। মানুষ খুন করা তার কাছ ওয়ান-টু’র ব্যাপার। দুই হাতে শরকি চালাতে পারে। এক সময় চরে জমি জাগলে কাইজার জন্য ভাড়া খাটত। সুলতান কবিরাজের নাম শুনলে প্রতিপক্ষের লোকজন ঢাল-শরকি ফেলে পালিয়ে যেত। ধীরেন মন্ডলের পক্ষেও অনেক বার চরের জমি দখল করে দিয়েছে। সেই সুবাদে মনিব হিসাবে ধীরেন মন্ডলকে সে সমীহ করে। সমীহ করার আরও একটি বড় কারণ আছে। কবিরাজ দুবার দুটো খুনের মামলায় জেলে গিয়েছিল, ধীরেন মন্ডল তাকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনেছে। যোগেন মন্ডল তখন দেশের মন্ত্রী। সেই সূত্রে ধীরেন মন্ডলের তখন অনেক ক্ষমতা। দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে পারত। এখন সে রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। তবু লোকে মান্য গন্য করে। ধীরেন মন্ডলের যেমন লাঠিয়াল দরকার হয়, লাঠিয়ালদেরও তেমন ধীরেণ মন্ডলকে দরকার হয়। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ ভূমিহীন। জমিদারী আমল থেকেই ধীরেন মন্ডলের জমি বর্গা আবাদ করে। তখন জমিদারদের কাছ থেকে তালুক পত্তন নেয়া ছিল ধীরেন মন্ডলের নামে। জমিদাররা থাকত কলকাতায়। এরপর দেশ ভাগ হয়েছে। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হয়েছে। আইনের মারপ্যাঁচে জমির মালিক হয়েছে ধীরেন মন্ডল আর চাষি প্রজারা সব ভূমিহীন। তবে দেশ ভাগের পরে ভূমিহীন চাষিরা অনেকেই ব্যবসা বানিজ্যে মন দিয়েছে। কিছু মানুষ দেশ ছাড়া হওয়ায় তারা শূন্যস্থান পূরন করার সুযোগ পাচ্ছে। চাকরি বাকরির আশায় ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া শেখাচ্ছ। সেই সব লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়া ছেলেরা, না ঘরকা না ঘটকা, একটা বাউন্ডুলে মাস্তান শ্রেণী হিসাবে গজিয়ে উঠছে। সমাজপতি কেন্দ্রীক সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। সুলতান কবিরাজের শালা তেমনি স্বল্প শিক্ষিত এক বাউন্ডুলে মাস্তান। কবিরাজ নিজেও ভরসা পায় না, শালা তার কথা রাখবে কি না। তাছাড়া শালা তার ক্ষমতাবান ভগ্নিপতির বাড়ীতে ভরসা করে আশ্রয় নিয়াছে, তাকে রক্ষা করাও তার একটি দায়িত্ব। সে কথাই সুলতান কবিরাজ ইনিয়ে বিনিয়ে ধীরেন মন্ডলকে বুঝানোর চেষ্টা করছিল। ধীরেন মন্ডল কবিরাজকে ঠিক তার সাথে যুক্তি তর্কের যোগ্য বলে মনে করে না। তাই সব কথা শোনার পর সরাসরি জানিয়ে দিল, মেয়েটা তোমার বাড়ীতে আছে। তুমি আজকে দিনের ভিতরে মেয়েটাকে আমার বাড়ীতে পৌঁছে দেবে। এ নিয়ে আমি তোমার সাথে আর কোন কথা বলেতে চাইনা।

কবিরাজ ধীরেন মন্ডলের কথা শুনে থামল না বরং শেষ কথাটি বলল, ‘কর্তা, দিনকাল পাল্টেছে। তবু এখনও আমরা আপনাকে মন্য গন্য করি কিন্তু আমার শালা ভিন গাঁয়ের মানুষ। তার দলবল আছে। আমি ফেরত দিয়ে যাওয়ার পরে সে তার দলবল নিয়ে যদি কোন ঝামেলা করে তখন আমার কিছু করার থাকবে না।’ ধীরেন মন্ডল তার কথাগুলো শুনলেন। তবে এ কথার কোন জবাব দিলেন না। বললেন, তুমি এখন আসতে পার। মেয়েটাকে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে দিও।

রেণু বোষ্টমী উদ্ধার হওয়ার পর গ্রামে আরেক ঘর মানুষ বাড়ে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বোরগীর বাড়ীতে কীর্তনের আসর বসে। সেখানে হিন্দু মুসলমান অনেকেই আসে। যদিও সবার উদ্দেশ্য এক নয়। কেউ আসে সময় কাটাতে। কেউ আসে পান তামাক খেতে। কেউ আসে সুন্দরী বোষ্টমীর সাথে একটু রঙ-তামাশা করতে। শুধাময়ী আর পারু তার নিয়মিত শ্রোতা। শুধাময়ীর জন্য একটি করতাল কেনা হয়েছে। গানের তালে তালে সে করতাল বাজায়। মাঝে মাঝে গানের সাথে গলা মেলায়। তারপর এক সময় পারুর কোলে ঘুমিয়ে গেলে বাড়ী ফিরে আসে। ভোরে রেণু বোষ্টমী প্রভাতফেরী করে।

রাই জাগো রাই জাগো

শুকশারী বলে

কত নিদ্রা যাও গো রাধে

শ্যাম নাগরের কোলে

শুকশারীর রব শুনি

জাগিলো রাই বিনোদিনী

আপনি জাগিয়া রাই

কানুরে জাগাইলে।

এই পর্যন্ত গাওয়া পর বোষ্টমী শুধাময়ীকে ডাকে। কই গো মা জননী ঘুম থেকে ওঠ। এই যে তোমার জন্য ফুল এনেছি গো। উঠে দেখ। শুধাময়ী তখন ঘুমে কাতর। বৌদিমনি বলে, ও রেণু ফুলের সাজি পুজোর ঘরের বারান্দায় রেখে যা। ওবেলা এসে চাল ডাল নিয়ে যাস। বোষ্টমী গানের বাকি অংশ গাইতে গাইতে অন্য বাড়ীর পথে পা বাড়ায়।

নিদ্রার আবেশে রাধে

ঢুলুঢুলু করে

হেলিয়া ঢলিয়া পড়ে

শ্যাম নাগরের কোলে

শুক বলে ওগো শারী

কি কার্য করিলে

তমালে কনকলতা

কেন ছাড়াইলে।

ঘুম থেকে উঠে বৌদিমনি সেই গানের সাথে গলা মেলায় আর শ্যাম নাগরের কথা ভেবে নিজের স্বামীর জন্য ব্যাকুল হয়। কোন কোন দিন বোষ্টমী আসার আগে ঘুম ভেঙে গেলে নিজেই গুনগুন করে গাইতে থাকে, ‘হেলিয়া ঢলিয়া পড়ে শ্যাম নাগরের কোলে ….। আর ভাবে, ইস্ এখন যদি শুধাময়ীর বাবা বাড়ী ফিরে আসত।

একদিন ভোরে শুধাময়ীর বাবা কানুবাবু সত্যি সত্যি বাড়ী ফিরে এল। ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা। পোশাকে কাদা মাটি লেগে আছে। সেদিন রেণু বোষ্টমী আর গান গাইতে এলো না। বেলা বাড়লে পারু হন্তদন্ত হয়ে খবর নিয়ে এল, রেণু বোষ্টমীকে সুলতান কবিরাজের লোকজন তুলে নিয়ে গেছে। বোরগী ঘরে শুয়ে কান্নাকাটি করছে। আমাদের বাড়ীও নাকি লুট করবে।

তখন ধীরেন মন্ডল আর কানুবাবু বাবা-ছেলে ঘরে বসে কি যেন শলা পরামর্শ করছিল। বৌদিমনি ঘরে ছুটে গিয়ে বলল, শুনেছেন বাবা? কথা শেষ না হতেই ধীরেন মন্ডল বলল, শুনেছি মা, দেখছি কি করা যায়। কানুবাবু বলল, কিছু দেখার নেই বাবা। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। যত তাড়াতাড়ি পার গুছিয়ে নাও। আমাদের আজই রওনা হতে হবে। কথা শুনে বৌদিমনি কানুবাবুর পাশেই বসে পড়ে বাবা-ছেলের আলোচনা শুনে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে।

কয়েকদিন আগে ভারতের এক দরগাশরীফে রাখা হজরত মুহাম্মদের চুল চুরি হয়ে গেছে। সেই নিয়ে দাঙ্গা শুরু হয়েছে ভারতে আর তা ছড়িয়ে পড়েছে পূর্ব পাকিস্থানের বিভিন্ন জেলায়। কানুবাবু খুলনা শিপইয়ার্ডে যেখানে কাজ করে সেখানে শত শত মানুষ খুন হয়েছে। সে কোন রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে। ঢাকা নোয়াখালী ভোলা সর্বত্র দাঙ্গা চলছে। রাজশাহীতে ট্রেন থামিয়ে শত শত মানুষকে মারা হয়েছে। ধীরেন মন্ডল বিমর্ষ হয়ে বললেন, জমিদার খানচৌধুরীর সাথে একবার কথা বলে দেখি সে কি বলে। শুনে দেখ, তবে কোন ফল হবে না। ভরসা করাও ঠিক হবে না। এখন তো আর তার সেই জমিদারিও নেই। সেই দাপটও নেই। তাছাড়া তাদের নেতা সবুর খান সাহেবই তো এই দাঙ্গার মূল হোতা।


আরো পড়ুন: হাসান আজিজুল হকের গল্প আত্মজা ও একটি করবী গাছ


ধীরেন মন্ডল ঘর থেকে বেরনো মাত্র বৌদিমনি কানুবাবুর হাত চেপে ধরে বলল, আমার খুব ভয় করছে। চল আমরা পালিয়ে যায়। অনেক দিন পরে আজ তার চোখ থেকে জল ঝরলো। রেণুকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা শোনার পর থেকে বাবা মা’র কথা খুব মনে পড়ছে। তখনও দেশ ভাগ হয়নি। কয়েক মাস আগেই কলকাতায় বড় একটা দাঙ্গা হয়ে গেছে। তার রেশ এসে লেগেছে নোয়াখালীতে। পূজার ছুটিতে যারা কোলকাতা থেকে নোয়াখালী এসেছিল দেশের বাড়ীতে তারা অনেকেই দশমী শেষ করেই তড়িঘড়ি ফিরে গেছে। নোয়াখালীর বাতাসে তখন নানান রকম গুজব ছড়ানো হচ্ছিল। করুণাময়ী তখন বেশ ছোট। মেয়ে শুধাময়ীর থেকে বয়সে একটু বড় হবে। সেদিন ছিল লক্ষ্মীপূজা। মা পূজার আয়োজন করছিল। তখন সবে সন্ধ্যা। পূজার ঘর থেকেই মাকে ওরা জোর করে তুলে নিয়ে যায়। বাবা করুণাময়ীকে নিয়ে পালিয়ে আনোয়ার নামে তার এক বন্ধুর বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। ভোর রাতের দিকে করুণাময়ীকে আনোয়ার কাকার বাড়ীতে রেখেই বাবা পালিয়ে যায়। বাবা-মা কারও সাথেই আর কোনদিন দেখা হয়নি। শোনা যায় বাবা কয়েকদিন এখানে সেখানে লুকিয়ে ছিল। তারপর আশেপাশের গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা অন্যদেরসাথে নোয়াখালীর রামগঞ্জ থানার ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিল। দাঙ্গাকারীরা থানা ঘেরাও করলে পুলিশ তাদের নিরাপত্তা না দিয়ে থানা থেকে জোর করে বের করে দেয়। সেখানে দাঙ্গাকারীদের হাতে শত শত মানুষ নিহত হয়। করুণাময়ীর বাবা আর কোনদিন ফিরে আসেনি। মাস খানেক পর নোয়াখালীর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে আনোয়ার কাকা করুণাময়ীকে নদী পার হয়ে ভোলার চরে মাসির বাড়ীতে পৌঁছে দেয়। সেখানেই সে বড় হয়েছে। তাদের সোনাচাকা গ্রামে আর কখনও ফিরে যাওয়া হয়নি। মা বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে তা করুণাময়ী আজও জানে না। বেঁচে থাকলেই বা কি, জাত ধর্ম নাড়ির বন্ধনকেও ছিঁড়ে আলাদা করে দিয়েছে। মা মেয়ের রক্তের সম্পর্ক এখন মূল্যহীন। হয়তো অন্য কারও ঘর করছে। সে ঘরে ছেলে মেয়ে আছে। আচ্ছা, করুণাময়ীর কথা কি মায়ের মনে পড়ে? মা কি জানে তার করুণাময়ী কোথায় আছে কেমন আছে? এক সময় এসব ভেবে করণাময়ী লুকিয়ে লুকিয়ে কান্নাকাটি করত। তবে বড় হওয়ার পরে সে তার মা বা মায়ের মতো আরও অনেকের উপরে সেই সময়ে ঘটা পাশবিকতার যে সব গল্প শুনেছে তা সে ভুলে থাকতেই চায়। মনে পড়লে মায়ের জন্য বুকের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে। কেউ কোন দিন নোয়াখালীতে তার মায়ের খোঁজ নিতে যায়নি। এমনকি সে সময়ের কোন ঘটনা নিয়ে তার সামনা সামনি কেউই কিছু আলোচনাও করে না। কিছু জানতে চাইলে সবাই চুপ করিয়ে দেয়। চুপ থাকতে থাকতেই একদিন করুণাময়ী সবকিছু ভুলে থাকা শিখে গিয়েছিল। আজ বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো সেই সব ঘটনা বুকের ভেতরে উথাল পাথাল করে তুলছে। শুধাময়ীকে জড়িয়ে ধরে করুণাময়ী হুহু করে কেঁদে ওঠে। কানুবাবু তার পিঠে হাত রেখে বলে, তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও। বাবা খানচৌধুরীর বাড়ী থেকে ফিরে এলেই বেরিয়ে যাব। দেশের যা অবস্থা তাতে আজ রাতে এখানে থাকা কোন ভাবেই ঠিক হবে না। যে কোন সময় যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে।


আরো পড়ুন: দাঙ্গা: স্বাধীনতার আগে ও পরে


ধীরেন মন্ডল যখন জমিদার খানচৌধুরীর বাড়ী পৌঁছাল তখন তিনি সবে মাত্র সবুর খানের ভাইয়ের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছেন। খুব ক্লান্ত আর চিন্তিত চেহারা নিয়ে বললেন, এতোদিন আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে মিলেমিশে ছিলাম। এবার বুঝি তা আর সম্ভব হবে না। স্বয়ং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান সাহেব ঘোষণা করেছেন, হজরতবাল ঘটনার কারণে পাকিস্তানের মুসলিমরা কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখালে তার কোন দায় নেই।সেখানে আমার কথা কে শুনবে বল? ইসলামিক বোর্ডের উপদেষ্টা আব্দুল হাই সাহেব তো রীতিমত জিহাদের ডাক দিয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে মোনায়েম খান, সবুর খান সবার সাথেই কথা হল। কেউ কোন দায়িত্ব নিতে রাজী না। তাছাড়া দেশি মনুষদের সাথে আমাদের অনেক দিনের ওঠা-বসা। তাদের হয়তো বুঝিয়ে বললে শুনবে কিন্তু যারা বিহার কিংবা ওপার বাঙলা থেকে দাঙ্গায় তাড়া খেয়ে রিফিউজি হয়ে ঢুকেছে তাদের আক্রোশ কে তো থামানো যাবে না। এই সাধারণ কথাটা কেউ বুঝবে না যে, এই সব গন্ডগোলে সাধারণ মানুষেরই ক্ষতি হয়। ফাইদা লোটে নেতারা।

খানচৌধুরীর সাহেব একটু থামলেন। কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন, আমার মনে হয় কোন নিরাপদ জায়গা দেখে কিছুদিনের জন্য তোমাদের সরে যাওয়া উচিত। ওপারে তো আত্মীয় স্বজন আছে। সেখানে গিয়ে কিছুদিন থাক। জমি জায়গা বাড়ীঘর যা আছে, থাকবে। আমরা তো আছি, দেখব।

ধীরেন মন্ডল বিমর্ষ হয়ে ফিরে এসে ছেলে-ছেলেবৌকে সব কথা খুলে বললেন। মাঝি পাড়ায় নরেন মাঝিকে খবর দেয়া হল। তার দুটো বড় নৌকা আছে। এসময় নদীপথই কিছুটা নিরাপদ বলে মনে হল। বিকেলের দিকে কয়েকজন বর্গাচষি দেখা করতে এসে জানাল, ‘এলাকায় নানান রকম গুজব শোনা যাচ্ছে। এসব শুনে ভয় পাবেন না। দরকার হলে খবর দিবেন। দেখব, কে কি করে। আমরা থাকতে আপনার কিছুটি ক্ষতি হতে দেব না।’ ধীরেন মন্ডল বর্গাচাষিদের কথা শুনে হাসলেন। ভাবলেন, ধীরেন মন্ডলকে এখন এই সব মানুষের করুণার উপর ভরসা করে এদেশে বাস করতে হবে। মুখে বললেন, ঠিক আছে, তোমরা এখন আসতে পার। দরকার হলে আমি তোমাদের ডেকে পাঠাব।

সন্ধ্যায় তুলসি তলায় প্রদীপ দেয়া হল। আর দশ দিনের মতো শাঁখ বাজল। লালু ভুলু কুকুর দুটোকে শিকল খুলে খাবার দেয়া হল। পুসি বেড়ালটা সন্ধ্যা থেকে বৌদিমনির পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করছিল। একবার হাতে তুলে একটু আদর করে দিল।লাউয়ের ডগাটা রান্নঘরের চাল থেকে গড়িয়ে পড়ছিল। বৌদিমনি আলতো করে চালের উপরে তুলে দিল। ডগাটার জন্য খুব মায়া হল। চারিদিকে শুধু মায়ার বন্ধন। সংসারের ছুতোনাতা যেদিকেই তাকায় তার জন্যই মায়ার টান অনুভব করে আর বুকের ভেতরে ভয় বাড়তে থাকে। অন্ধকার ঘন হলে নৌকার বৈঠা গাঙের জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলল। সেই শব্দে শুধাময়ীর কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। বুঝতে পারল তারা নৌকায় করে কোথাও যাচ্ছে। চোখ খুলে বলল, আমার পুতুল? কানুবাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, কৃষ্ণনগরে অনেক সুন্দর সুন্দর পুতুল পাওয়া যায়। তোমাকে নতুন পুতুল কিনে দেব। শুধাময়ী মায়ের বুকের মাঝে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মেয়ের মাথার ওপরে মায়ের দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। নৌকা তখন মাঝ গাঙ ধরে এগিয়ে চলেছে। ঘন অন্ধকার নদীতে দূরে দুয়েকটা মিটি মিটি আলো দেখা যাচ্ছে।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত