| 26 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ গল্প সাহিত্য

জুলিয়ান বার্নসের ‘পটুয়া’

আনুমানিক পঠনকাল: 18 মিনিট

 

পটুয়ার মজুরি-বারো ডলার এবং ক্যানভাসের সাইজ কত বড় হবে সেটা নিয়ে শুরু থেকেই কাস্টম কালেক্টর মি. টাটল বাদানুবাদ শুরু করেছিলেন, এদিকে জানালা থেকে বিস্তৃত দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। সৌভাগ্যবশত, সেখানে দ্রুত যে বিষয়ে মতের মিল হল তা হচ্ছে বসার ভঙ্গি এবং পোশাক। এতে, পটুয়া ওয়ার্ডসওয়ার্থ এই কাস্টম কালেক্টরের সন্তুষ্টিতে সুখি হয়েছিল; আরো সুখি হয়েছিল তাকে চেহারা দিতে পেরে, একজন ভদ্রলোকের চেহারা, যেটা তার দক্ষতার বাইরে। ওটা ছিল, সর্বোপরি তার ব্যবসা। সে একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি আঁকিয়ে কিন্তু সে একজন শিল্পীও, এবং একজন শিল্পীকে দাম দেয়া হয় তাই যা খদ্দেরের পক্ষে সম্ভব। ত্রিশ বছর বয়সে কাস্টম কালেক্টর দেখতে কেমন ছিল এটা মনে করা কষ্টকর; তার শারীরিক উপস্থিতির শুধুমাত্র ধ্বংসাবশেষ আছে, হয়তো এই ছবির কারিগরের সঙ্গে পরে সে দেখা করেছে। এবং ওয়াডসওয়ার্থের অভিজ্ঞতায়, খদ্দেররা শান্ত, ঈশ্বরভীত নর-নারী হিসেবে অঙ্কিত হয়ে সে ছবি গুরুত্বের সঙ্গে ধরে রাখে—এরপর তারা একটি সত্যিকারের ভালোলাগা প্রস্তাব করে। এটা এমন কোন বিষয় নয় যে তা তাকে বিচলিত করে।

ওয়াডসওয়ার্থ চোখের কিনার দিয়ে দেখে সতর্ক হয়ে গেল যে তার খদ্দের কথা বলছে, কিন্তু, তার চোখের স্থিরদৃষ্টি রঙের ব্রাশের শীর্ষ থেকে সরাচ্ছে না। বদলে সে বাঁধাই করা নোট বইয়ে যাতে বহু ছবি আঁকার জন্য বসিয়েরা মন্তব্য লিখেছে, তাদের প্রশংসা এবং নিন্দা জ্ঞান এবং নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করেছে, তাতে মন্তব্য করল। সে যথারীতি তার বইয়ের যে কোন পৃষ্ঠা খুলে ধরে এবং পাঁচ-দশ বছর আগে যেসব খদ্দের যথাযথ মন্তব্য করেছে তা থেকে যথাযথ মন্তব্য নির্বাচন করতে বলে। এই কাস্টম কালেক্টরের  মতামত তার ভেতরকোটের বোতামের চাইতেও কম পূর্ব সংকেতের যোগ্য, কিনা কম কৌতূহলোদ্দীপক। সৌভাগ্যবশত, ওয়াডসওয়ার্থকে ভেতরকোটের উপস্থাপনের জন্যই মূল্য দেয়া হয়, মতামতের জন্য নয়। অবশ্যই এটা আরো বেশি জটিল হয়ে পড়ছে তার চেয়ে : ভেতরকোটের প্রদর্শন, এবং পরচুলার, পাজামার প্রদর্শন একটি মতামতের প্রদর্শনই ছিল—প্রকৃতপক্ষে, তাদের একটি পরিপূর্ণ শরীরের। ভেতরকোট আর পাজামা নিচে যেমন শরীরের নিচের অংশ দেখায়, যেমন পরচুলা আর টুপির নিচে মেধা দেখায়—যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে, আদৌ কোন মেধা যে পরচুলা বা টুপির নিচে থাকে এটার সিদ্ধান্তে পৌঁছা ছিল একটি সচিত্র অতিশয়োক্তি।

সে এই শহর ছাড়তে পেরে সুখি, তার রঙতুলি এবং ক্যানভাস, রঙ এবং প্যালেট বাঁধাই-ছাঁদাই করে, তার ছোট্ট ঘোড়ার গাড়িতে ভরে, তার ঘোটকীর উপরে জিন চাপিয়ে, এরপর বনমধ্যের পথচিহ্ন ধরে, তিন দিন, সে তার বাড়ির দিকে অগ্রগামী হবে। সেখানে সে হয়তো বিশ্রাম নেবে, প্রতিক্রিয়া করবে, এবং এই যন্ত্রণার সঙ্গে পরিশ্রমণ ও ইতস্তত পরিভ্রমণ ছাড়াই সম্ভবত ভিন্নরকম কোন জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নেবে। একটা ফেরিওয়ালা একটা অনুনয়কারীর জীবন থেকে আলাদা কোন জীবন। যে রকম সবসময় হয়ে থাকে, সে এই শহরে আসে, রাতের জন্য অস্থায়ী আবাস নেয়, এবং তার যোগ্যতা, তার কাজের মজুরী আর কোথায় তাকে সহজে পাওয়া যাবে তা উল্লেখ করে খবরের কাগজে একটি বিজ্ঞাপন দেয়। “যদি ছয় দিনের মধ্যে কোন আবেদন না আসে,” বিজ্ঞাপনটি বন্ধ হয়ে যায়, “মি. ওয়াডসওয়ার্থ শহর থেকে চলে যায়।” সে ইতিমধ্যে মুদি দোকানীর ছোট মেয়ের ছবি এঁকেছে, এবং ডিকন জেবেডিয়াহ হ্যারিসের ছবিও এঁকেছে, যে তাকে তার ঘরে খ্রিষ্টানীয় আথিতেয়তা দিয়েছে এবং তাকে কালেক্টর অব কাস্টমসের কাছে তার জন্য সুপারিশ করেছে।

মি. টাটল তাকে থাকতে বলেনি, কিন্তু পটুয়া নিজের উদ্যোগে তার ঘোটকীকে সঙ্গ দেবার জন্য আস্তাবলে ঘুমিয়েছে এবং রান্নাঘরে খেয়েছে। এবং এখানে কথা হচ্ছিল তৃতীয় দিন বিকেলের কথা, তার ব্যর্থতার বিরুদ্ধে—অথবা প্রতিরোধ করতে অসমর্থ এটা অনুভব করে। এটা তাকে সহজভাবে ঘুমোতে দেয়নি। এটা তাকে আহতও করেছে, যদি সত্যিটা জানা থাকত। সে এবছরে যথেষ্ট ছবি এঁকেছে—এবং বিষয়বস্তু ভুলেও গিয়েছে। সম্ভবত সে অবসর গ্রহণে জোর দেবার জন্য তার ঘোটকীকে মোটা হতে দিয়েছে, এবং যে সকল জিনিস সে জন্মাতে পারে এবং যা কিছু খামারের জমা করা জিনিস সে বাড়াতে পারে তা দিয়ে জীবন যাপন করেছে। সে সব সময় মানুষের পরিবর্তে দরজা-জানালা রঙ করেছে ব্যবসার কাজ হিসেবে; এবং সে এই কাজ করাকে কোন অসম্মান হিসেবে মনে করেনি।

প্রথম সকালের শেষে, ওয়াডসওয়ার্থ কাস্টম কালেক্টরকে এই নোটবইটা অনুগ্রহ করে পরিচিত করিয়ে দিয়েছে। এই লোকটা, অন্য অনেকের মতোই, কল্পনা করল যে এটা কেবল তার কথা বলা বাড়িয়ে দেবে যা পরস্পরের যোগাযোগের জন্য যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে। ওয়াডসওয়ার্থ দেখল টাটলের কলম খাতার উপর কিছু আঁকিবুকি কাটল, এবং তর্জনী অসহিষ্ণুভাবে চেপে বসল।  সে লিখল, “যদি খোদা দয়ালু হয়, সম্ভবত স্বর্গে গিয়ে তুমি শুনতে পাবে।” এবং জবাবে সে অর্ধেক হাসল এবং বিস্ময় এবং ধন্যবাদের সঙ্গে কিছু একটা বোঝার মত করে মাথা ঝোঁকাল, যা থেকে উপসংহার বোঝায়। সে এই চিন্তাটা আগেও বহুবার পড়েছে। প্রায়ই এটা খ্রিস্টান অনুভূতি এবং সমবেদনাময় আশার সত্যিকারের প্রকাশ: এখনকার মতোই, আনুষ্ঠানিকভাবে এটা উপস্থাপিত হয়, পৃথিবীই ওগুলো ধারণ করে, এধরনের হতাশাব্যঞ্জক বধিরতার খুঁতকে, কষ্টে ভীতবিহ্বলতা লুকানো যায়। মি. টাটল এধরনের মালিকদের মধ্যে একজন যারা বধির, বোবা এবং অন্ধ চাকরদেরকেই পছন্দ করে—অন্যথায়, অন্যদের গ্রহণ করে যখন ঘটনা থেকে সুবিধা আদায় করে। অবশ্যই, মালিক এবং চাকর নাগরিক হয়ে ওঠে এবং একসময় সাহায্য ভাড়া করে ঠিক রিপাবলিকরা এটা ঘোষণা করে। কিন্তু প্রভু এবং চাকররা বিলুপ্ত হয় না; অথবা আবশ্যকীয় মনের ঝোঁকে কিছু করে না।

পটুয়া এটা ভাবছে না যে সে কালেক্টরকে একটি অ-খ্রীষ্টানীয় পদ্ধতিতে বিচার করছে। তার ধারণা প্রথম দেখায়ই মিথ্যা রচনা করেছিল, এবং নিশ্চিত করেছিল ঐ তৃতীয় সন্ধ্যায়। এই নির্দেশনাটি নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল একটি শিশুকে জড়িয়ে, একটি বাগান পরিচর্যাকারী বালক যে পটুয়ার বহু বছরের বুঝতে পারার সক্ষমতায় অনেক কষ্টে তার মনে স্থান করে নিয়েছিল। সে সবসময় শিশুদের প্রতি সহানুভূতিশীলতা অনুভব করত : তাদের জন্য, তার নির্দেশনায় যে মহান ঘটনাটি সে দেখেও না দেখার ভান করেছে, এবং একারণেও যে এটা তার নিজের কোন সন্তান ছিল। সে নিজে কখনো একজন স্ত্রীর সঙ্গ লাভ করেনি। যদি সে বিয়ে করতোও, তাহলেও সে নিশ্চিত হতে পারে না যে তার স্ত্রী সন্তান পালনের বছরগুলো সন্তানের পিছনে ব্যয় করতো। সে তার নিজের ত্রুটি অন্যদের উপর আরোপ করতে চায়নি। কিছু বন্ধু বলেছে যে তার ভয় নিতান্তই অমূলক, কেননা তার শারীরিক মানসিক অসুস্থতা জন্মগত নয় বরং পাঁচ বছর বয়সে থেমে থেমে কয়েক বার হওয়া একটা জ্বরের সময় থেকে তার এই অসুস্থতা। তারপর তারা চাপ দিত, সে পৃথিবীতে নিজের মত চলতে পারে না, এবং হয়তো তার একটা বাচ্চা-কাচ্চাও হবে না, গাঠনিকভাবে যে কোন রকমই হোক না, একই কাজ করবে? সম্ভবত এটা একটা কারণ, কিন্তু একটা কন্যার ক্ষেত্রে? একটা মেয়ে শিশুর সমাজ থেকে বের হয়ে বসবাস করা তার জন্য খুবই যন্ত্রণার হবে। সত্য হচ্ছে সে ঘরে থাকবে, এবং সেখানে তার সঙ্গে বাবার একটা সমব্যথী সম্পর্ক থাকবে। কিন্তু পটুয়া মারা যাবার পরে এ ধরনের একটা শিশুর কি হবে?

 

না, সে হয়তো বাড়ি ফিরে যাবে এবং তার ঘোটকীর একটা ছবি আঁকবে। তার সবসময়েই এমন একটা ইচ্ছা ছিল, এবং এখন হয়তো সে এটাকে কাজে পরিণত করবে। ঘোটকীটি তার সঙ্গে বার বছর ধরে আছে, পটুয়াকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে, এবং যখন তারা বনপথে একেবারে নিঃসঙ্গভাবে চলতে থাকে কোন ধরণের কোন গোলমাল পাকায় না। তার উদ্দেশ্য ছিল : তাকে ছবি আঁকা, সেই একই আকারের ক্যানভাস সে মি. টাটলের জন্য ব্যবহার করেছে, যদিও তা দিগন্ত সমান্তরাল অক্ষে পরিবর্তন হয়েছে, এবং, পরবর্তীতে, একটি কম্বল দ্বারা ছবিটাকে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল এবং সেটা শুধুমাত্র ঘোটকীটি মৃত্যুর পরে উন্মুক্ত করা হয়েছে। এটা ছিল ঈশ্বরের দৈনন্দিন সৃষ্টির সঙ্গে মানুষের অদক্ষ হাতের পুন:উৎপাদন কাঠামোর একটি সাহসী তুলনা—নিরপেক্ষভাবে, যদিও এটা খুব একটা লক্ষ্য ছিল না যে জন্য তার গ্রাহকরা তাকে কাজ দিত।

সে এটা প্রত্যাশা করেনি যে ঘোটকীর ছবি আঁকা খুব সহজসাধ্য হবে। ঘোটকীর ধৈর্য কমে যাবে, তার জন্য স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারে গর্ব তৈরি হবে, একটি খুর গর্বিতভাবে সামনে এগিয়ে থাকবে। কিন্তু যখন, এরপর, তার ঘোটকীর কোন গর্ব হল না এবং সে যখন ক্যানভাসে কাজ করছিল তখনও সে ক্যানভাসটি পরীক্ষা নীরিক্ষা করল। কাস্টম কালেক্টরও এখন তাই করল, তার কাঁধের ওপর শুয়ে উঁকি মারতে থাকল এবং নির্দেশ করতে থাকল। এখানে কিছু আছে যা সে প্রমাণ করতে পারে নি। ওয়াডসওয়ার্থ উপরের দিকে একঝলক দেখল, একটি চলন্ত মানুষের শরীরে একটি অচঞ্চল মুখ, এমনকী যদিও তার শোনা এবং বলায় দূরত্বব্যঞ্জক স্মৃতি রয়েছে, সে কখনো জিহ্বায় শব্দ পড়ে ফেলার সুবিধা শিখতে পারেনি। ওয়াডসওয়ার্থ তার সবচেয়ে সরু ব্রাশটি তার ভেতরকোটের বোতামের বস থেকে এবং তার চোখদুটো নোটবুকে ফেলে দেখল কালেক্টর তার কলম কালিতে ডোবাল। লোকটা লিখল, “আরো মর্যাদাপূর্ণভাব”, এবং এরপর শব্দটিকে আন্ডারলাইন করল।

 

ওয়াডসওয়ার্থ অনুভব করল সে ইতিমধ্যে মি. টাটলকে পর্যাপ্ত মর্যাদা দিয়ে ফেলেছে। সে তার উচ্চতা বাড়িয়েছে, তার পেট কমিয়েছে, তার ঘাড়ের চুলভর্তি আঁচিলগুলোকে এড়িয়ে গেছে, এবং তার চরিত্রের রূঢ় ও অভদ্র খেঁকি ভাবকে সাধারণ পরিশ্রমীভাবে উপস্থাপন করেছে, বদমেজাজী স্বভাবটাকে ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। এবং এখন সে তার ছবিতে আরো বেশি কিছু চায়! ওয়াডসওয়ার্থ এ অংশে এসে স্বীকার করল এটা একটি অ-খ্রীষ্টানীয় চাহিদা এবং এটা হয়তো একটি অ-খ্রীস্টানীয় ব্যবহার। যে সকল মর্যাদা কালেক্টর চাচ্ছে সে সব কিছু দিয়ে যদি পটুয়া তাকে গর্বিতভাবে উপস্থাপন করে, এটা হবে এরকম একজন মানুষের কাজ যে ঈশ্বরের চোখে আদৌ কোন কাজ করে না।

সে শিশুদের, বাচ্চাদের, মানুষদের এবং নারীদের এঁকেছে, এবং এমনকী শস্যক্ষেত্রও এঁকেছে। তিন তিন বার সে জোর তাগিদ অনুভব করেছে, যখন তার ঘোটকীটি মৃত্যুশয্যায়, যেখানে তাকে—জীবন্ত কোন কিছু যখন মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে  যাচ্ছে সে দৃশ্যকে তার কাজের মধ্যে দিয়ে শিল্পায়িত করে সে কাজটার পুণ:প্রচলন করতে বলা হয়েছে। যদি সে সেটা করতে পারত, তার ঘোটকী যে মাছি তাড়ানোর জন্য তার লেজ নাড়ে সেই দ্রুততাকেও সে দৃশ্যায়িত করতে পারত, অথবা যখন সে তার ছবি আঁকার ছোট্ট ঘোড়ার গাড়ি রেডি করে তখন অধৈর্যভাবে ঘোটকীটি তার ঘাড় তোলে সেই অসাধারণ মনোরম ভঙ্গিটি আঁকতে পারত, অথবা বনমধ্যে গোলমালের জন্য সে যে তার কান খাড়া করে তোলে তাও দৃশ্যায়িত করতে পারত।

একটা সময় তার অনুসারি-নৈতিকতাগুলোর মাধ্যমে আকার ইঙ্গিত এবং শব্দের সাহায্যে সে তার অর্থ করতে চাইত। এটা সত্যি ছিল যে কিছু সাধারণ প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুকরণ করা যেত : সে নির্দেশ করতে পারত, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একজন ছবি আঁকতে আসা ক্লায়েন্ট কোন ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু অন্যান্য ইঙ্গিতগুলো প্রায়ই অনুমান জ্ঞানের অবমাননাকর ফলাফল হিসেবে আসত। যে শব্দগুলো সে মুখে উচ্চারণ করতে পারত না সেগুলোকে অন্যান্য উপায়ে বোঝাতে চাইত অথবা তার অশীংদারিত্বের স্বভাব ছিল একজন মানুষ হিসেবে—সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাজের অংশ, যদিও আলাদাভাবে তা নির্মিত হয়েছে। নারীরা বিচার করত মনের ভাব বোঝাতে গিয়ে সে যে গোলমাল তৈরি করে তা বিব্রতকর, বাচ্চারা তাতে একধরনের মজার ব্যাপার দেখতে পেত আর পুরুষরা ভাবত এটা তার শারীরিক মানসিক দুর্বলতার পরিচয়। সে এই উপায়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু সফল হয়নি, কাজেই তারা যা চেয়েছিল, সম্ভবত পছন্দ করেছিল পটুয়া আবার সেই নীরবতায়-ই ফিরে গেল। একারণে সে তার বাছুরের চামড়া মোড়া লগবুকটি কিনেছিল, সেখানে সকল মানুষের বক্তব্য এবং মতামত আছে। আপনি কি মনে করেন, জনাব, সেখানে স্বর্গের ছবি আছে? জনাব, আপনি কি মনে করেন, সেখানে স্বর্গের কথা শোনা যায়?   

 

কিন্তু মানুষ সম্পর্কে তার বোঝার ক্ষমতার এত উন্নতি হয়েছিল, যা কিছু মানুষেরা লিখে রাখত তার চেয়ে তার নিরব পর্যবেক্ষণে সে মানুষকে বেশি করে বুঝতে পারত। পুরুষ এবং নারীরা—তাদের মুখমন্ডলে কোন রকম ছায়া ছাড়াই তারা তাদের স্বর এবং কথার অর্থও পাল্টাতো। এভাবে তারা চরমে উঠত। মানুষের ভ্রাম্যমান আনন্দমেলায় সে যেমন পর্যবেক্ষণ করেছে, তার নিজের মুখম-ল তার নিজের জিহ্বার মতোই অভিব্যক্তিহীন, কিন্তু তার চোখ তাকে তাদের অনুমানের চাইতেও অনেক বেশি কিছু বলে দিয়েছে। প্রথমে, সে তার লগ-বুকটির মধ্যে একসেট হাতে লেখা কার্ড বহন করত যাতে উপকারী প্রতিক্রিয়া এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ থাকত, এবং কি কি প্রস্তাব করা হয়েছে সেসব সামাজিক সংশোধনী থাকত। এমন কী সে কিছু বিশেষ কার্ডও বহন করত যাতে সে অবনতভাবে যা সে সঠিক মনে করে সে সব কথোপকথন থাকত। যেমন কেউ পড়ল, “জনাব, বোঝাপড়া শেষ পর্যন্ত কাজে আসে না যখন মনের দরজা বন্ধ থাকে।” কখনো কখনো এটাকে শুধু তিরষ্কার হিসেবে ধরা হত, কখনো কখনো এটাকে ধরা হত কেবলমাত্র আস্তাবলে রাতে ঘুমানো একজন শিল্পীর অধৈর্য কার্যকলাপ হিসেবে। ওয়াডসওয়ার্থ এগুলোকে যেখানে সেখানে ব্যবহার করেছিল, এ কারণে নয় যে সে অন্য কোন প্রতিক্রিয়া পেতে চায় বরং এজন্য যে এটা আরো বেশি জ্ঞানের অনুমোদন করে। এ পৃথিবীতে জিহ্বা যাদের অগ্রসরতা দিয়েছে : তারা তাকে বেতন দেয়, তারা পরীক্ষিত কর্তৃপক্ষ, তারা সমাজের অংশ, তারা তাদের চিন্তা এবং মতামতের বিনিময় স্বাভাবিকভাবেই করতে পারে। যদিও এসবের জন্য, ওয়াডসওয়ার্থ দেখেনি যে কথাবলার শক্তি নিজে পূণ্যের জন্য অগ্রণী। তার নিজের দুটি সুবিধা ছিল : যারা কথা বলতে পারে তাদেরকে সে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলত, এবং নিরবভাবে তাদের মনের মধ্যে উপলব্ধি করত। দ্বিতীয় সুবিধাটা ছেড়ে দেয়া বোকামী হত।

 

উদাহরণ হিসেবে পিয়ানো নিয়ে কাজ করার কথা তোলা যায়। ওয়াডসওয়ার্থ প্রথমে অনুসন্ধান করল, তার বেতন কত দেবে তা ঠিক করে, যদি কাস্টম কালেক্টর পুরো পরিবারের ছবি প্রত্যাশা করেন, তার এবং তার স্ত্রীর ছবি একত্র করান অথবা একটি যুগল ছবি আঁকান তার সন্তানদের ছোট ছবিসহ। মি. টাটল তার স্ত্রীর দিকে না তাকিয়েই তার নিজের বুকের দিকে নির্দেশ করে তার বেতনপত্রে লিখল, “আমার একার ছবি।” এরপর সে একঝলক তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তার হাত তার চিবুকে দিয়ে এবং আরো লিখল, “পিয়ানোর পাশে।” ওয়াডসওয়ার্থ দেখল সেই সুদর্শন, নখরযুক্ত থাবা আকৃতি পায়ার রোজউড কাঠে নির্মিত যন্ত্রটি, এবং ইঙ্গিতের মাধ্যমে বলল, যদি সে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে মি. টাটল বেশ কয়েকটা পজ দিল : আলগাভাবে পিয়ানোয় বসে একটা পছন্দের গান কিবোর্ডে বাজাল আবার  পিয়ানোর পাশে খুব আনুষ্ঠানিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। কাস্টম কালেক্টর ওয়াডসওয়ার্থের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিল, পা বাড়াল, এবং এরপর কিছুটা বিবেচনা করে পিয়ানোর ঢাকনাটা বন্ধ করল। ওয়াডসওয়ার্থ এ থেকে অনুমান করল কেবল মাত্র মি. টাটলই পিয়ানো বাজান এই ঘরে; এছাড়া আরো অনুমান করল, সে চাইছে পরোক্ষভাবে পিয়ানোকে ছবির মধ্যে অর্ন্তভূক্ত করা হোক। পরোক্ষভাবে এবং আরও কম খরচে।

 

পটুয়া কাস্টম কালেক্টরকে কিছু শিশুর ছবির ছোট আকার দেখাল, আশা করল যে সে হয়ত তার মন পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু টাটল একগুঁয়ের মতো তার মাথা নাড়াল। ওয়াডসওয়ার্থ খুব হতাশ হল, কিছুটা টাকার জন্য, আবার বেশিটা এজন্য যে তার শিশুদের ছবির উজ্জ্বলতা  বাড়ছে এমনভাবে যে তাদের পূর্বপুরুষদের পতন হচ্ছে। শিশুরা বড়দের চেয়ে অনেক অস্থির, অনেক বেশি আহ্লাদিত চেহারার, এটা সত্যি। কিন্তু তারা তাকে সেই চোখ দিয়েই দেখত, এবং যখন তুমি কানে শুনবে না, তুমি কিন্তু তোমার চোখ দিয়েই সব শুনবে। শিশুরা তার দৃষ্টি ধরতে পারত, এবং পটুয়া তাদের স্বভাব বুঝতে পারত। বড়রা প্রায়ই এদিক ওদিক তাকাত, হয় নম্রতায় অথবা কিছু একটা গোপনতার ইচ্ছায়। কিছু লোক অবশ্য এই কালেক্টরের মত যারা, তাদের দৃষ্টি রাখত যেন চ্যালেঞ্জ করতো একটা মেকী সৎভাবের সঙ্গে, যেন তারা বলতে চায়, হ্যাঁ, আমার চোখ অবশ্যই বুঝতে পারে, কিন্তু এটা মনের অনুভূতির মাধ্যমে বোঝার ক্ষেত্রে তোমার ঘাটতি রয়েছে। কারন তুমি কানে শোনো না, তুমি বোবা। এধরনের খদ্দেররা ওয়াডসওয়ার্থের বিচার করত একটা শিশুর মত হিসেবে ধরে, যেভাবে সে শিশুদেরকে স্বল্প যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবে বুঝে বিবেচনা করত। যাহোক, ওয়াডসওয়ার্থ শিশুদের অসম্পূর্ণ যোগ্যতাকে বিশ্বাস করত তার নিজের প্রমাণে যে সে যেভাবে মানুষের মনের গহনতল পর্যন্ত পড়তে পারে ঠিক তেমনি শিশুরাও কিন্তু পারে।

 

যখন প্রথম সে এই কাজটা শুরু করে, তখন সে তার ছবি আঁকার সরঞ্জাম অর্থাৎ পেইন্ট ব্রাশ এবং রঙ ও ক্যানভাস সব তার পিঠে করে বহন করত, এবং এই বনমধ্যে একজন পরিব্রাজকের মত পথ ধরে হাঁটত। সে নিজেকে সুপারিশযোগ্য এবং বিজ্ঞাপনের জন্য আত্মবিশ্বাসী হিসেবে আবিষ্কার করল। কিন্তু সে ছিল পরিশ্রমী এবং সঙ্গীসাথী পেতে ইচ্ছুক মানসিকতা তাকে অধিকার করে ফেলল, এটা খুবই সৌভাগ্যের কথা যে তার দক্ষতার জন্য সে অন্যদের সঙ্গে বসবাস করতে পারছে। সে কোন বাড়িতে ঢুকে আস্তাবলে একটা জায়গা করে নেয়, কিছুটা সাহায্য পায়, অথবা খুব অল্পই সে কোন বাড়িতে অতিথির মর্যাদা পায় এবং সে সব বাড়ির অধিকাংশই খ্রিষ্টান পরিবার, যেখানে সে বেশ কিছুদিন থাকতে পারে, কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং যথেষ্ট সম্মান পায়। এ কথা দিয়ে এটা বোঝাচ্ছে না যে সে অন্যান্য কারুশিল্পীদের চেয়ে কম সৌজন্য পায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে একজন সাধারণ মানুষের মতোই বিচার করা হয় : এটা বলা যায় যে, একজন যে কিনা সৌজন্য লাভ করবে কারণ সে কোন বিশেষ গুণের অধিকারী হবার কারণে, তা কিন্তু গুণীরা প্রায়ই লাভ করতে পারে না। সে সুখি ছিল, সম্ভবত তার জীবনের প্রথম দিনগুলোয়।

এবং সেসময়, তার নিজের অনুভূতির মাধ্যমে অন্য কোন ধরনের সাহায্য ছাড়াই সে বুঝতে শুরু করে সে শুধুমাত্র একজন মানুষের ছবি এঁকে পেট চালানো পটুয়া ছাড়াও আরো বেশি কিছু; তার শক্তি রয়েছে তার অন্তঃস্থলে। এটা এমন কিছু নয় যে যারা তাকে কাজ দেয় তারা তা মেনে নেবে, কিন্তু আসল ঘটনা কি তার চোখ তাকে বলে দেয়। ধীরে ধীরে, সে বুঝতে পারে সত্যই হচ্ছে তার নৈপুন্য : যদি গ্রাহক প্রভু হয়, সে জেমস ওয়াডসওয়ার্থ যখন তা গ্রহণ করে, তাহলে সে নিজেও গ্রাহকের প্রভু। শুরুতে, সে গ্রাহকের প্রভু ছিল যখন তার চোখ দূর থেকে অনুভূতির সাহায্যে লক্ষ্য করত, তার ছবি আঁকাতে ইচ্ছুক গ্রাহকটি তা তার কাছে কি কি গোপন রাখতে চায়। একজন স্বামীর অপমান। একজন স্ত্রীর অপরিতৃপ্তি। একজন সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণীর পাদরীর কূটকৌশল। একটি শিশুর যন্ত্রণা। একজন পুরুষ তার স্ত্রীর রোজগারের বা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া টাকা খরচ করে ফেলতে খুব আনন্দ বোধ করে। একজন স্বামীর চোখ থাকে ভাড়া করা মেয়েমানুষের প্রতি। ছোট্ট রাজত্বে বড় বড় ব্যাপার।

 

এবং এসব ছাড়াও, সে বুঝতে পারত যখন সে আস্তাবলে ঘুম থেকে জেগে উঠত এবং তার কাপড়ের সাহায্যে ঘোড়ার আসনটা ঝাড়ত, এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য প্রাণীর লোমের সাহায্যে তৈরি একটি ব্রাশ নিত, সে যা নিত তার চেয়ে বেশি কিছু বোঝাত। যারা তার কাছে বসত এবং তাকে দাম দিত তারা ঠিক সত্যি জানতে পারত না তাদের টাকায় কি কেনা হচ্ছে। তারা তাই জানত যাতে তারা রাজি হত, এটা শুধু বাহ্যিক ব্যাপার, যেমন—ক্যানভাসের আকার, বসার বা দাঁড়াবার ভঙ্গি এবং ছবি সাজানোর জিনিসপত্র যেমন স্ট্রবেরি ভর্তি গামলা, দাঁড়ে বসা পাখি, পিয়ানো, জানালা থেকে দেখা দৃশ্যাবলী, এসব স্থূল বৈষয়িক বিষয়—এবং এসব বিষয়ে তারা রাজি হতে প্রভুত্ব ফলাত। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ওটা যখন প্রভূত্ব ক্যানভাসের অন্যপাশ দিয়ে গড়িয়ে যেত। অদ্যাবধি তারা তাদের জীবনে তারা নিজেকে দেখেছে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় এবং হাত আয়নায়, চামচের পিছনে যেমন দেখা যায়, এবং স্বচ্ছ স্থির জলে অস্পষ্টভাবে। এটা বলা হয় যে প্রেমিকেরা তাদের নিজেদেরকে একে অপরের চোখে দেখতে পারে, কিন্তু পটুয়ার এ বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া এসব ছবি নির্ভর করে যারা আয়নার সামনে, চামচের সামনে অথবা জলের সামনে আছে তাদের ওপর, তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। যখন ওয়াডসওয়ার্থ তার খদ্দেরদের তাদের পোর্ট্রেট সহ দেখায়, এটা সাধারণভাবেই তারা প্রথমবারের মত নিজেদেরকে অন্যকারুর চোখে দেখে, যে তাদেরকে দেখছে। কখনো যখন ছবিটি দেখানো হয়, পটুয়া অনুভব করতে পারে হঠাৎ করে বরফস্রোত যেন যার ছবি আঁকা হয়েছে তার চামড়ার উপর দিয়ে গড়িয়ে নামছে, এরকম সে ভাবত। কাজেই, এটা সত্যি কি করে আমি হই? খদ্দেরের এরকম মনোভাব হয়। এটা অগনণীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত : এই ছবিতে তাকে কীভাবে স্মরণ করা হবে যখন সে মারা যাবে। এবং সেখানে এর চাইতে বেশিও একটি সিরিয়াসনেস আছে। ওয়াডসওয়ার্থ নিজেকে কখনো অতিবিশ্বাসী ভাবে না যেখানে তার চোখ প্রায়ই বলে যে প্রায়ই তার বিষয়বস্তু মানে খদ্দেরের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া হয়, “এবং এটা সম্ভবত সর্বশক্তিমান স্রষ্টা আমাকে যেমন দেখে থাকেন তেমনও কি?”

 

যাদের আচরণ নিঃসন্দেহে কালেক্টরের মত, যাদের এরকম সততার মুখোমুখি হবার পরও অন্তরের ভেতরে কোন নম্রতা তৈরি হয় না, তারা এরপর যা করে : পটুয়াকে বলে যে পটুয়ার হাত ও চোখে সমস্যা আছে তাই সে এমন ছবি এঁকেছে, তারা ওয়াডসওয়ার্থকে সমঝোতায় আসতে বলে এবং ছবিটিকে আরো ভালো করে আঁকতে বলে। তারা কি এরকম গর্বের সঙ্গে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে বলতে পারে, যে আমাকে তুমি ভুলভাবে তৈরি করেছ, আমাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তৈরি করে দাও? দু’রাত আগে মি. টাটল রান্নাঘরে বসে সবচেয়ে অপ্রীতিকর যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা হল, “আরো মর্যাদা ঢালো আমার ছবির মধ্যে, আরো বেশি মর্যাদা”।

 

ওয়াডসওয়ার্থ তার দিনমজুরী শ্রমে পরিতৃপ্ত হয়ে রাত্রে তার খাবার খাচ্ছিল। সে মাত্রই পিয়ানোর ছবিটি শেষ করেছিল। বাদ্যযন্ত্রটির সরু পা যেগুলো মি. টাটলের বৃহদায়তন পায়ের সমান্তরালে ছিল, যার শেষপ্রান্তে ছিল চমকানো নখরযুক্ত থাবা, যেগুলোতে ওয়াডসওয়ার্থের কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু, আগুনের মাধ্যমে নিজেকে উষ্ণ গরম ও বিস্তৃত করে, খেয়ে, এবং এই সমাজের সহযোগিতা কারীদেরকে পর্যবেক্ষণ করে, এখন সে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করে নিতে পেরেছে। প্রত্যাশার চাইতে অনেক বেশি। একজন কাস্টম কালেক্টর নিশ্চয়ই সপ্তাহে পঞ্চাশ ডলার রোজগার করে, একজন ভাড়া করা মেয়েমানুষ রাখার জন্য যা যথেষ্ট। এছাড়াও, টাটল একজন রান্নার লোক এবং বাগানে কাজ করার জন্য একটি বাচ্চা ছেলে রেখেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না কালেক্টর নিজের টাকায় একজন অপব্যয়ী মানুষ হিসেবে আর্বিভূত হল, ওয়াডসওয়ার্থ সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, এটা মিসেস টাটলের স্ত্রীর টাকা, তার সম্পত্তি থেকে পাওয়া অর্থে এধরনের অভিজাত ও ব্যয়বহুল জীবনযাপন চলছে।

একসময় তারা পটুয়ার শারীরিক ত্রুটিতে অভ্যস্ত হয়ে গেল, তার আচরণ তাকে সহযোগিতা করল, যেন তার বধিরতা প্রত্যর্পন করে তাদের সমতুল্য করে তুলল। এটা একটা সমতা যা ওয়াডসওয়ার্থ সত্য বলে স্বীকার করতে সুখিবোধ করে। বাগানে কাজ করা বাচ্চা ছেলেটি গাঢ় বাদামী রঙের চোখওয়ালা একটি চমৎকার চেহারার শিশু, তাকে আনন্দ দেবার জন্য একটা কৌশল অবলম্বন করল। এটা এমন ছিল যে পটুয়া যেন কথোপকথন বুঝতে পারে, কোন ধরনের মজা বুঝতে পারে না। এটা কোন ঘটনা ছিল না, কিন্তু ওয়াডসওয়ার্থ তার এই দুষ্টুমিকে প্রশ্রয় দিল মৃদু হাসল ছেলেটি তখন  অন্যদিকে হাত পা ছড়িয়ে ঘুরে গেল, কিছু খাবার চুরি করল কুকের পিছন থেকে যখন সে ওভেনে খাবার ভাঁপিয়ে রান্না করার জন্য ফিরে দাঁড়াল, অথবা তার সঙ্গে ‘অনুমান কর অনুমান কর’ খেলা খেলল পটুয়ার খাবারের মধ্যে ওক বৃক্ষের ফল লুকিয়ে রেখে।

পটুয়া মাছ মাংসের পাতলা স্যুপটা শেষ করে নিজেকে একটু গরম করে নেবার জন্য আগুনের সামনে দাঁড়াল—একটা বিষয় যেমন মি. টাটলের এ বাড়িতে কোথাও তার কোন বংশধর নেই—তখন তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে ছাইয়ের ভেতর থেকে একটি কাঠকয়লার টুকরো তুলে নিল, বাগানে কাজ করা ছেলেটির কাঁধে হাত দিয়ে সে যেভাবে চায় সেভাবে দাঁড় করাল, এরপর তার পকেট থেকে একটা ড্রয়িং এর খাতা টেনে বের করল। রান্নার মহিলাটি এবং ভাড়া করা মেয়ে মানুষটি দেখতে চেষ্টা করল পটুয়া কি করছে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা সাধারণ খসড়া তৈরি হয় সে হাত দিয়ে তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখল, যেন এটা বলা যায় যে একটি বিশেষ কৌশল, যেন সে বালকটির দুষ্টুমি কৌশলের প্রতিদান দিল, তার কাজটি কাউকে দেখতে দিল না।এটা একটা সাধারণ প্রাথমিক স্কেচ ছিল—এটা এমনই করা যায়, যন্ত্রপাতির মাধ্যম কর্কশতা আনে—কিন্তু এরমধ্যে কিছুটা চমৎকার পছন্দনীয় বিষয় ছিল। সে তার খাতা থেকে পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ল এবং বালকটির হাতে তুলে দিল। ছেলেটি বিস্ময়াভিভূত ও ধন্যবাদের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, ছবিটি টেবিলের ওপর বিছাল, এবং ওয়াডসওয়ার্থের ছবি আঁকার হাতটি তুলে ধরে তাতে চুমু খেতে লাগল। চোখ দিয়ে ছেলেটির কৃতজ্ঞতাবিহ্বল চেহারা দেখে পটুয়া ভাবতে লাগল, আমি যদি সবসময়ে বাচ্চাদের ছবি আঁকাতে পারতাম।

 

বাকি দুজন মানে রান্না করার মহিলাটি এবং ভাড়া করা মেয়েটি ছবিটি দেখে যখন  উচ্চস্বরে হেসে ফেলে শোরগোল ফেলে দিল, সে বিষয়ে ওয়াডসওয়ার্থ পুরোপুরি অসচেতন ছিল, কারণ সে তো শুনতে পাচ্ছে না তাদের হাসির শব্দ কতদূর যাচ্ছে, এদিকে কালেক্টর এই গোলমাল শুনে রান্নাঘরে চলে এল, এবং রান্নাঘরে আবার ভয়াবহ নীরবতা নেমে এল।

পটুয়া দেখল টাটল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একপা বাড়িয়ে, যেভাবে সে তার ছবিতে দাঁড়ানো আছে, তার মুখ একবার বন্ধ হচ্ছে এবং আরেকবার খুলছে, যেটা তার মর্যাদাকে প্রমান করে না। সে দেখল রান্নার লোকটি এবং মেয়েটি আবার আগের মত শিষ্ট ভূমিকায় যে যার জায়গায় ফিরে গেল। সে দেখল বাগানবালকটি তার প্রভুর তীব্র দৃষ্টির ব্যাপারে সতর্ক হয়ে, ছবিটি নম্রভাবে তুলে নিল, এবং গর্বিতভাবে তার প্রভুর হাতে সেটা তুলে দিল। সে দেখল টাটল ছবির কাগজটি শান্তভাবে গ্রহণ করল, সেটাকে পরীক্ষার দৃষ্টিতে দেখল, ছেলেটির দিকে তাকাল, একঝলক ওয়াডসওয়ার্থের দিকে তাকাল, কী ভেবে মাথা নাড়াল, এরপর একেবারে ইচ্ছাকরে ছবিটি চারটুকরো করে আগুনের মধ্যে ফেলে দিল, যতক্ষণ না ওটা একেবারে পুরোটা জ্বলে উঠে অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হয় ততক্ষণ অপেক্ষা করল, আরো কিছু বলল যার একচতুর্থাংশ বুঝল পটুয়া, এরপর সে নিষ্ক্রান্ত হল। সে দেখল ছেলেটি কাঁদছে।

ছবিটি সমাপ্ত হল : রোজউডের পিয়ানো এবং কাস্টম কালেক্টর উভয়েই ঈষৎ অস্পষ্টভাবে থেকে থেকে জ্বলতে লাগল। মি. টাটলের কনুই একটি ছোট কাস্টম হাউসের জানালা পরিপূর্ণ করল—এটা এমন নয় যে সেখানে সত্যিই কোন জানালা ছিল, অথবা, যদি সেখানে থেকেও থাকে, সেখান থেকে কোন কাস্টম হাউস দেখা যায়। এছাড়াও প্রত্যেকেই এই নম্র উৎকর্ষতা বুঝতে পারবে। এবং কাস্টম কালেক্টর সম্ভবত তার নিজের মনে এই একই ধরনের বাস্তব শ্রেষ্ঠতা বুঝতে পারবে যখন সে আরও বেশি মর্যাদার দাবি করেছে। সে এখনও ওয়াডসওয়ার্থের উপর ঠেস দিয়ে আছে, তার মুখম-ল, বুক এবং পা দিয়ে ইঙ্গিত করছে। এটা মোটেই কোন ব্যাপার নয় যে সে যা বলছে পটুয়া তার কিছুই শুনছে না। সে জানত এ দিয়ে কি বোঝানো হচ্ছে এবং এটা কত অল্পই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে। বস্তুত, এটা শুনতে না পাবার একটা সুবিধা, তার কাছে এদের বৈশিষ্ট্যগুলো সন্দেহাতীতভাবে উন্মোচিত হয় যে পরিমান রাগ বোধ করছে তার চেয়ে সে অনেক বেশি দেখাচ্ছে।

সে নোটবুক খুঁজে লিখল, “জনাব, আমার পাঁচদিনের পরিশ্রমের জন্য আমরা রাজী হয়েছিলাম। আমি অবশ্যই আগামীকাল সকালের সূর্যোদয়ের সঙ্গেই চলে যাব। আমরা এতেও রাজী হয়েছিলাম যে আপনি আমাকে আজ রাতে আমার মজুরী দেবেন। আমাকে মজুরী দিন, আমাকে তিনটি মোমবাতি দিন, এবং আপনি যেসব জায়গায় আরো সৌন্দর্য চাইছেন সে সব জায়গার কাজ রাতভর কাজ করে সকালের মধ্যে শেষ করে ফেলব।”

একজন খদ্দেরের সঙ্গে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এধরনের রূঢ় ব্যবহার সে খুব কমই করে থাকে। এ অঙ্গপ্রদেশে এটা হয়তো তার জন্য দূর্নাম বয়ে আনবে, কিন্তু সে এই বিষয়টা বেশিক্ষণ আমলে আনতে পারছে না। সে তার কলম মি. টাটলের দিকে এগিয়ে দিল, যাকে কলমটা গ্রহণ করার মতো প্রসন্ন মনে হচ্ছে না। এর বদলে, টাটল পটুয়ার কাজ করার রুমটা থেকে বেরিয়ে গেল। অপেক্ষা করতে করতে, পটুয়া তার কাজ পরীক্ষা করতে লাগল, কোথায় কি খুঁত আছে। এটা যথেষ্ট ভালোভাবে করা হয়েছে : সৌষ্ঠব মনে আনন্দ জাগানোর মতো, রঙের ব্যবহার হয়েছে ছন্দময়, এবং প্রতিকৃতিটা সততার প্রতি বাধ্য। কালেক্টর হয়তো সন্তুষ্ট হত, বংশধরগণ প্রভাবিত হবে, এবং তার সৃষ্টিকর্তা- স্বর্গ প্রদান করে সবসময় অহংকার করবে -খুব বেশি তিরস্কার করার দরকার পড়বে না।

 

টাটল হাতে দুটি মোমবাতি আর ছয় ডলার যা মজুরীর অর্ধেক নিয়ে ফিরে এল। সন্দেহাতীতভাবে মূল্য কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে যখন ওটা দেবার সময় এসেছে। যদি এটা দেয়া হত। ওয়াডসওয়ার্থ পোর্ট্রেট এর দিকে তাকাল, যখন শেষ দিনে ধরে নেয়া হয় এটার মাংসল বস্তু তার জন্য সমান বাস্তবতা, এবং এরপর সে কয়েকটা সিদ্ধান্ত নেয়।

সে যথারীতি রান্নাঘরে তার রাতের খাবার খেয়ে নেয়। তার সঙ্গীরা গত দু’রাতে বশীভূত হয়ে গেছে। সে এটা মনে করে না যে তারা তাকে বাগানে কাজ করা বাচ্চাটার ব্যাপারে তাকে দোষ দেবে; তারা চিন্তা করেছে তাদের অবিচারে তার উপহার নষ্ট হয়েছে, কাজেই তারা ছিল মার্জিত। এটা, কোন ভাবেই, ওয়াডসওয়ার্থ ঘটনাটাকে দেখবে, এবং সে মনে করে না যদি সে ঠোঁটের ভাষা পড়তে পারত বা কথা শুনতে পারত তবে এর মানে এর চেয়ে পরিষ্কার হতো; প্রকৃতপক্ষে, সম্ভবত অপরপক্ষে। তার নোটবুকে লেখা মানুষদের চিন্তা এবং পর্যবেক্ষণ দ্বারা যদি কোন কিছু বিচার করা হয়, পৃথিবীর জ্ঞান ওটার মধ্যে আছে, যখন লেখা হয় এবং বলা হয়, জ্ঞানের পরিমান তত বেশি কিন্তু হয়ে ওঠে না।

এবারে সে একটুকরা কয়লা বেছে নিল আরো সতর্কতার সঙ্গে এবং তার পকেটছুরির সাহায্যে সে এটার প্রান্ত তীক্ষ্ণ করে তুলল। এরপর, বালকটি যখন তার মুখোমুখি বসল, স্থির হয়ে নিজেকে ধরে রাখল, একজন ছবি আঁকার জন্য সামনে যখন বসে তার আগ্রহের চেয়েও বেশি অনড়ভাবে বসে থাকল, পটুয়া আবার তাকে টেনে আকর্ষণ করল। যখন সে শেষ করল, সে তার খাতা থেকে কাগজটা ছিড়ল এবং বালকটির চোখের সামনে তা ভাঁজ করল, তাকে মুকাভিনয় করে দেখাল যে ওটা যেন সে শার্টের ভিতরে রাখে, এবং ওটাকে টেবিলের ওপর থেকে দিয়ে দিল। বালকটি সঙ্গে সঙ্গে পটুয়া যেমন দেখিয়েছিল তেমন করে কাগজটি তার শার্টের মধ্যে রেখে দিল এবং ঐ বিকালে প্রথমবারের মত হাসল। এরপর সে তার কয়লা টুকরোটাকে বার বার তীক্ষè করে রান্নার মহিলাটি এবং ভাড়া করা মেয়েটির ছবি আঁকল। প্রত্যেকেই ভাঁজ করা ছবি নিল এবং না দেখেই ছবিগুলো তাদের কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল। এরপর সে উঠে দাঁড়াল, তাদের প্রত্যেকের হাত ধরে করমর্দন করল, বাগানে কাজ করা বালকটিকে গাঢ় আলিঙ্গন করল এবং এরপর তার রাতের কাজে ফিরে গেল।

 

পটুয়া মোমবাতি জ্বালিয়ে রঙের ব্রাশ হাতে নিয়ে নিজেকে নিজে বার বার বলল, “আরও বেশি মর্যাদা”। ভাল, এরপর, একজন সম্মানিত লোক হচ্ছেন এমন একজন তার চেহারায় সম্পূর্ণজীবনের চিন্তাচেতনার ব্যঞ্জনা থাকে, এমন একজন যার কপাল ও ভ্রুভঙ্গি-তে তা প্রকাশিত হয়। হ্যাঁ, এখানে একটু উৎকৃষ্টতা আনা যেতে পারে। সে চুলের রেখা এবং ভ্রুর দূরত্বটা মাপল, এবং ঠিক মাঝখানে, ডান চোখের মণির সরাসরি, সে ভ্রুটাকে বাড়িয়ে দিল : একটু বাড়িয়ে দেয়ায়, একটি ছোট ঢিপি, অনেকাংশে মনে হয় যেন কিছু একটা বাড়তে শুরু করেছে। এরপর সে বা চোখের উপরেও একই রকম করল। হ্যাঁ, এটা আরো ভালো হয়েছে। কিন্তু মর্যাদা একজন মানুষের চিবুকের ব্যঞ্জনায়ও বোঝায়। এটা নয় যে মি. টাটলের চোয়ালে পর্যাপ্ত কিছু নেই। কিন্তু চিবুকের প্রত্যেক অংশে কয়েকটা স্পর্শের ফলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে সম্ভবত কিছু অর্থ বহনে সহায়তা করবে। তাৎক্ষনিক লক্ষ্য করার মত কোন কারণ নেই, একা একার বিদ্রুপের জন্য, কেবলমাত্র একটা ইঙ্গিত।

এবং অন্য ইঙ্গিত সম্ভবত আবশ্যক বোধ করবে। সে অনুসরণ করল কালেক্টরের কঠোর মর্যাদাপূর্ণ পা তার বকলস দ্বারা বাঁধা জুতার ভেতর মোজার মধ্যে। এরপর সে অনুসরণ করল পিয়ানোর সমান্তরাল পা দুখানা বন্ধ কীবোর্ডের ঢাকনার নিচ থেকে নেমেছে তার জ্বলন্ত নখরযুক্ত থাবা তাকে পৃথক করেছে। এই সমস্যা এড়ানো সম্ভব হবে কি? কালেক্টর পিয়ানোটিকে হুবহু আঁকতে বলেনি। জানালায় এবং কাস্টম হাউসে যদি খানিকটা উৎকর্ষতা আনা হয়, পিয়ানোতেও সেরকম উৎকর্ষতা নয় কেন? একজন কাস্টম এর লোকের পাশে একটি নখরযুক্ত থাবার প্রদশর্ণী একটি অর্থলোভী এবং লোলুপ মানসিকতার ধারণা দেবে, যদি সেখানে কোন সাক্ষী থাকে আর নাই থাকে, এ ধরনের ব্যঞ্জনা প্রদর্শন কোন খদ্দেরই করতে চাইবে না। ওয়াডসওয়ার্থ সেখানে বিড়াল জাতীয়প্রাণীর থাবা আঁকল এবং সেটাকে, ধূসর রঙের শান্ত হালকা বিভক্ত একটা খুরের সাথে প্রতিস্থাপিত করল।

কাজ শেষ হবার পর তার অভ্যাস এবং মিতব্যয়িতা তাকে মোমবাতি দুটি নিভিয়ে দিতে প্রণোদিত করল, কিন্তু, পটুয়া এ এদুটোকে জ্বলতে দিল। তারা এখন তার—অথবা, অন্ততপক্ষে, সে তাদের জন্য শীঘ্রই মূল্য দেবে। সে তার ব্রাশগুলো রাণœাঘরে ধূয়ে ফেলল, তার ছবি আঁকার সরঞ্জামের বাক্স গুছিয়ে বেঁধে ফেলল, তার ঘোটকীর উপরে বসার চাদর পেতে দিল, এবং কঠোর ছোট্ট গাড়িটাকে জুতে নিল। ঐ বাড়িটা ত্যাগ করতে পেরে ঘোটকীটিকে তার মতই সুখি মনে হচ্ছিল। তারা যখন আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এল, সে মোমবাতির আলোয় জানালার ফ্রেমটা দেখল। সে নিজেকে বসার আসনের ওপর জোর করে বসাল, ঘোটকীটি তার নীচে সামনে চলার জন্য নড়ে উঠল, এবং তখনই সে তার মুখে ঠা-া বাতাসের স্পর্শ পেল। প্রত্যুষে, মানে এখন থেকে ঠিক এক ঘন্টা পরে, তার সবশেষে আঁকা ছবির ঠিক আগের ছবিটিকে কালেক্টরের ভাড়া করা মেয়েটি পীড়াদায়ক ধ্বংসপ্রাপ্ত মোমে পরীক্ষা করবে। সে আশা করছে এটা হয়তো ঈশ্বরের কাছের ছবি, কিন্তু সে তার চেয়েও বেশি আশা করছে সে হয়তো ইশ্বরের কাছেও বধিরই থাকবে। ঘোটকীটি হয়তো শীঘ্রই তার সর্বশেষ ছবির উপাদান হবে, সে বনপথ মধ্যে নিজের পথ খুঁজে নিল। কিছুক্ষণ পরে, মি টাটলের বাড়িটা অনেক পিছনে ফেলে, ওয়াডসওয়ার্থ বনের নীরবতার মধ্যে ভীষণ শব্দ করে চিৎকার করে উঠল।

 

জুলিয়ান বার্নসের সংক্ষিপ্ত জীবনী

জুলিয়ান বার্নস ইংল্যান্ডের লেইচেস্টারে ১৯৪৬ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম গ্রহন করেন। তিনি উপন্যাস ছোটগল্প এবং সমালোচনামূলক রচনার একজন বহুমূখী বহুপ্রজ লেখক। তিনি ড্যান কেভানাঘ, এডওয়ার্ড পিগগি এবং বাসিল সীল নামে ক্রাইম রিপোর্টসহ বহু রিপোর্ট লিখেছেন। এখন তিনি লন্ডনের ইউরোপীয়ান গ্রাজুয়েট স্কুলে (ইজিএস) সাহিত্য শিক্ষা দেন। যেখানে তিনি একটি গুরুত্ববহ পুঙ্খানুপুঙ্খ সেমিনার পরিচালনা করেন।

তিনি লন্ডন সিটি ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন এবং আধুনিক ভাষা তত্ত্বে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮৬ সালে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছেন। স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর তিনি অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি সাপ্লিমেন্ট বিভাগে বেশ কয়েক বছর কাজ করেন। এরপর তিনি নিউ স্টেটমেন্ট পত্রিকায় রিভিউয়ার এবং এডিটর হিসেবে কাজ করেন। এবং দি নিউ রিভিউ পত্রিকায়, টেলিভিশনের সমালোচক হিসেবে এবং দি অবজারভারে-ও কাজ করেন। লন্ডন রিভিউ অব বুকস, দি গার্ডিয়ান, দি টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট, দি নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস এবং দি নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় তার লেখা নিয়মিত ছাপা হয়।

একজন বহুমুখী এবং মৌলিক লেখক জুলিয়ান বার্নস অনেক পুরস্কারসহ এর আগে তিন তিন বার সাহিত্যে বুকার পুরস্কারের জন্য তালিকাভূক্ত হয়েছেন। সে তিনবার যে সব বইয়ের জন্য তালিকাভূক্ত হয়েছেন সেগুলো হল- ১৯৮৪ সালে ফ্লুবার্ট’স প্যারট বইয়ের জন্য, ১৯৮৮ সালে ইংল্যান্ড বইয়ের জন্য এবং ২০০৫ সালে আর্থার এন্ড জর্জ বইয়ের জন্য। খুবই আশ্চর্যের বিষয় এই তিনবারই তার হাত থেকে পুরস্কার ফসকে গেছে। কিন্তু এবার আর ভাগ্য তাকে হতাশ করেনি। তাই গত বছর ২০১১ সালে তিনি দি সেন্স অব এন এন্ডিং বইয়ের জন্য বুকার পুরস্কারের সৌভাগ্য শেষ পর্যন্ত অর্জন করলেন।  

জুলিয়ান বার্নস ১৯৮০ সালে যখন মেট্রোল্যান্ড প্রকাশ করেন তখন থেকেই তার ঔপন্যাসিক ক্যারিয়ার শুরু করেন।

এরপরে আর তার কলম থেমে থাকেনি, একে একে প্রকাশিত হতে থাকে সব উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ। নিচে তার প্রকাশিত গ্রন্থের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া গেল।

মেট্রোল্যান্ড (১৯৮০, উপন্যাস)

ফিডল সিটি (১৯৮১, উপন্যাস, ড্যান কেভানাঘ ছদ্মনামে)

বিফোর সি মেট মি (১৯৮২, উপন্যাস)

ফ্লুবার্ট প্যারোট (১৯৮৪, উপন্যাস)

পুটিং দি বুট ইন (১৯৮৫, উপন্যাস, ড্যান কেভানাঘ ছদ্মনামে)

স্টার্টিং এট দি সান (১৯৮৫, উপন্যাস)

এ হিস্টরি অব দি ওয়ার্ল্ড ইন ১০ ১/২ চ্যাপ্টারস (১৯৮৯, উপন্যাস)

ডুফি (১৯৮০, উপন্যাস, ড্যান কেভানাঘ ছদ্মনামে)

গোয়িং টু দ্যা ডগস (১৯৮৭, উপন্যাস, ড্যান কেভানাঘ ছদ্মনামে)

টকিং ইট ওভার (১৯৯১, উপন্যাস)

দ্যা পোরকুপাইন (১৯৯২, উপন্যাস)

লেটারস ফ্রম লন্ডন (১৯৯৫, গদ্যরচনা)

ক্রস চ্যানেল (১৯৯৬, ছোটগল্প)

ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ড (১৯৯৮, উপন্যাস)

লাভ, এট্রেস্রা (২০০০, উপন্যাস)

সামথিং টু ডিক্লেয়ার (২০০২, গদ্যরচনা)

দি পিড্যান্ট ইন দি কিচেন (২০০৩, রান্নার বই)

দি লেমন টেবল (২০০৪, ছোটগল্প)

আর্থার এন্ড জর্জ (২০০৫, উপন্যাস)

নাথিং টু বি ফ্রাইটেন্ড অফ (২০০৮, উপন্যাস)

পাল্স (২০১১, ছোটগল্প)

দি সেন্স অব এন এন্ডিং (উপন্যাস)

জুলিয়ান বার্নসের প্রাপ্ত পুরস্কার সমূহঃ

জুলিয়ান বার্নস যেসব পুরস্কার পেয়েছেন এর মধ্যে সমারসেট মম এওয়ার্ড, অস্ট্রিয়ান স্টেট প্রাইজ ফর ইউরোপীয়ান লিটারেচার, দি আলফ্রেড টোইফার স্টিফটাঙ এফভিএস সেকসপিয়ার প্রাইজ, দি প্রিক্স মেডিসিস, দি প্রিক্স ফেমিনা, দ্যা জিওফ্রে ফেবার মেমোরিয়াল প্রাইজ, এবং আমেরিকান একাডেমী অব আর্টস এন্ড লেটারস থেকে প্রাপ্ত ই.এম.ফস্টার পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। ২০০৪ সাল থেকে তিনি ফ্রেঞ্চ মিনিস্ট্রি অব কালচার এর কমানডিউর ডি আই’অর্ডডারে ডেস আর্ট এট ডেস লেটারস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত