পিছুটান

Reading Time: 4 minutes
আজ সকালটা একটু অন্যরকম ভাবে শুরু হল মায়াদেবীর। অন‌্যদিন হলে সকালে উঠে স্নান করে বাড়ির  বাগান থেকে ফুল তুলে নাড়ুগোপালকে পূজো করে, শয্যাশায়ী স্বামী কে আয়া কে দিয়ে পরিস্কার করিয়ে, তাকে নিজের হাতে খালি পেটে খাওয়ার ওষুধ নিজের হাতে খাইয়ে নীচে নামেন।তারপর লালুর মা কে কি কি রান্না হবে সেগুলো জানিয়ে যান ছোট নাতিকে ঘুম থেকে তুলে দিতে। কিন্তু আজ! ঘুম থেকে উঠেই আয়া কে বললেন ওনাকে আজ তাড়াতাড়ি পরিস্কার করিয়ে ঔষুধ গুলো খাইয়ে দিতে। তিনি বাড়ির ঠাকুরের পূজো সেরেই গেলেন শান্তিময়ী কালিবাড়িতে। 
মা, আজ যেন ছেলে টা আমার অপমানিত না হয়, বাইশ বছর, বাইশটা বছর পর সে ফিরবে এ বাড়িতে, তাও ঘন্টা দুয়েকের জন্য। আসার কারনটাও তার নিজের জন্য নয়। এই বিশাল সম্পত্তি হেলায় ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আজ যেন নিজের সম্মানটা নিয়ে ফেরে, বলে চোখ মুছে পুজো সেরে বাড়ির পথ ধরলেন। ফিরে লালুর মা কে বললেন আজ সব রান্না নিজে করবেন, সেইমতো সব সবজি কুটে রাখতে আর মাছগুলো ভেজে রাখতে। বলে ওপরে উঠলেন। ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই কানে আসল অভয়চরন বাবুর উদ্ধত কন্ঠস্বর
-কোথায় গেল ঐ মাগী? মাগীর ভাতারের পাপটা‌ আজ আসবে বলে কি এই বুড়োর মুখ দেখবেনা?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মায়াদেবী, ভাবলেন “এই সন্দেহ তার সংসারটা জ্বালিয়ে দিল। এত বয়স হল, তাও ভাষা সংযম শিখলোনা লোকটা। তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে আরো অকথ্য ভাষায় কথা বলা শুরু করলেন অভয়চরন বাবু। মায়াদেবী বললেন -অন্তত, আজকের দিনে আর এই কথা গুলো বোলোনা হাত জোর করছি- বলে চলে গেলেন।
ঠাম্মা, আজ নাকি পাপ্পার দাদা আসবে? কেন আসবে? এতদিন কেন আসেনি? ও ঠাম্মাআআ কখন আসবে বলোও না? এই হলো ঋষি, মায়াদেবীর ছোটছেলে অভিজিৎ এর ঘরের নাতি। ছয় বছরের বালক, তার বড়ই কৌতুহল তার জেঠুর ব্যপারে কারন, সে কোনদিন দেখেনি জেঠুকে এমনকি কোন ফটো অবদি ‌না। বাথরুম থেকে বেরোতে বেরোতে অভি বলল আরে, এই তো চলে আসল বলে। তুই শিগগির ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে।
মায়াদেবী আর অভয়চরন বাবুর তিন সন্তান। বড় ছেলে অরিজিৎ, মেজ ছেলে অভিজিৎ আর ছোট মেয়ে বৈশালী। বৈশালীকে সুপাত্রে দান করেছেন।জামাই আর্কিটেক্ট, পুনা শহরে কর্মসূত্রে স্থিত। মেজছেলে কলেজের পাঠ শেষ করে পারিবারিক সোনার ব্যবসায় যোগ দিয়েছে। ওর রক্তে ব্যবসা। বেশ উন্নতি করেছে। তার গিন্নি লোকাল এক স্কুলে পড়ায়। এই বাড়ির বউর চাকরি করার ব্যাপারে মায়াদেবী কম লড়েন নি। তবে গিয়ে বৌমার পাশে দাঁড়াতে পেরেছেন। আর বড় ছেলে অরিজিৎ, বড় আদরের ছেলে সে। অনেক ছোট বয়সেই বিয়ে হয়ে মা হয়েছিলেন তিনি। এই আভিজাত্যে ঘেরা মেকি জগতে সেই ছিল তার এক মুঠো শান্তি। পড়াশোনায় দারুন ছিল সে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরি পেয়ে বহু বছর হল সে বাড়ি ছেড়ে বিদেশে চলে গেছিল, তাও মিথ্যা বদনামের শিকার হয়ে। ওদেশেই সে বিয়ে করেছে তারই এক সহকর্মীকে। দুটো ছেলেও আছে চিঠিতে জেনেছিলেন । 
মায়াদেবীর বড়দা আর অভয়বাবুর খুড়তুতো ভাই ছিল বন্ধু। তাদের ঘটকালিতেই অপরূপা অথচ দরিদ্র ষোড়শী মায়ার গাঁটছড়া বাঁধা হয় শহরের কলেজে পড়া ধনী, উশৃঙ্খলত মদ্যপ, চরিত্রহীন যুবক অভয়চরনের সাথে। বিয়ের রাতে মদের নেশায় চুর হয়ে ফুলসজ্জার ঘরে ঢুকে শুধু একটা শরীরকে নিঙরে খেতে খেতে বলেছিল _কিরে শালী, তোর নাকি এক  ভাতার ছিল? তা দেখি সে আবার আমার জন্য কি এঁটো মাল রেখেছে নাকি? সেই রাতের পরে অনেক দিন ঘেন্নায় নিজের মুখটাও আরশিতে দেখেননি। আর দোষ দিয়ে গেছেন নিজের ভাগ্যকে। বিয়ের মাসেই বড়ছেলে পেটে আসে তার। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বড় ছেলে কোলে আসায় অভয়চরন বাবুর মনে গেঁথে গেল গেল এ ছেলে তার নয়, নইলে ওমন ধবধবে গায়ের রং কি করে হল যেখানে তার গায়ের রং ভূষকুন্ডির ন্যায় কালো। বহুবার মায়াদেবী বলার চেষ্টা করেছেন বোঝানোর, যে মায়ের মতোন হয়েছে। লাভ হয়নি উল্টে  অত্যাচার বেড়েছে। বহুবার চেয়েছেন চলে যেতে , কিন্তু কোথায় যাবেন? যাওয়ার জায়গা নেই যে তার যমদূয়ার ছাড়া। কালের নিয়মে আবার তিনি মা হয়েছেন।
এইবার দুই সন্তানের রঙই চাপা হওয়ায় তাদেরই নিজের সন্তান মানেন অভয়চরন বাবু। অরিজিৎ বড় শান্ত ছেলে ছিল। নিজের পড়াশোনা, গান নিয়ে থাকতো আর প্রতিনিয়ত বেজন্মা তকমায় অপমানিত হত। যেদিন সরকারি কলেজে প্রায় বিনা পয়সায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেয়ে হষ্টেলে আসলো মা কে বলে আসলো মা চাকরি পেয়েই তোমায় নিয়ে এখান থেকে চলে যাব। চাকরি পাওয়ার পর সে এসেছিল মাকে নিয়ে যেতে কিন্তু মায়াদেবী যেতে পারেন নি। সেদিন‌ অভয়বাবু বড়ছেলে কে আবারো বেজন্মা আক্ষ্যায় আক্ষ্যায়িত করে বলেন হ্যাঁ, যাও মাকে এখন নিয়ে গিয়ে তোমার বাপের সাথে সংসার‌ পাতাও। এরপর সে আর ভাবেনি, বেরিয়ে এসেছিল ঐ নরককুন্ড থেকে।
এরপর অনেক বছর পার হল। অভয়চরনের শরীর তার সঙ্গে ছাড়ল। এতদিনের অত্যাচারের জবাব  শরীর ও নিল। প্যারালাইসিজড হয়ে বিছানা নিলেও মুখের বিষ কমলো না। তিনি এইবার সব সম্পত্তি ভাগ করে দিতে চান তার তিন সন্তানের দুই জনের মধ্যে, যার জন্য আইনি কিছু কাজ সারার জন্য আইনি চিঠি গেছে তার ঠিকানায়। তাই সে এত বছর পর আসছে বাড়িতে।
মায়া দেবী রাধলেন সোনামুগের ডাল, বেগুনী, দই ইলিশ, আঢ় কালিয়া, চিতল‌মাছের মুইঠ্যা, খাসির মাংস আর আমের চাটনি। এই সব গুলোই অরির খুব প্রিয়। গাড়ি থামার আওয়াজ হল বাইরে। এসে দাঁড়ালেন দোর গোড়ায়। চোখের জলটা আর বাধ মানছেনা, বড় অবাধ্য এই জিনিসটা। মা, কেমন আছো? বলতেই বুকে টেনে নিলেন মায়াদেবী তার আদরের ধনকে। আশীর্বাদ করলেন বৌমা নাতিদেরকে। কুশল জেনে নিয়ে গেলেন বাবার সাথে দেখা করাতে। বলাবাহুল্য, মুখদর্শন না করে তিনি শুয়ে থাকলেন। আলাপ করালেন ভাইয়ের বৌ, ভাইপোর সাথে। কায়দা করে এড়িয়ে গেল ভাই, যদি সম্পত্তি হাতছাড়া হয়। সেটা চোখ এড়ালোনা মায়াদেবীর। 
ইতিমধ্যে উকিলবাবু উইল নিয়ে হাজির হলেন। এবং সইসাবুদ করিয়ে আইনত সকল সম্পত্তি থেকে বেদখল করা হল অরিজিৎ আর তার ওয়ারিসনদের। মায়া দেবীর জোড়াজুড়িতেতে খুব সামান্য কিছু মুখে তুলল অরিজিৎ। নাতিরা তো ঠাম্মার রান্নার ফ্যান হয়ে গেল। এবার, বিদায়ের পালা। কিন্তু চোখে জল নেই মায়া দেবীর। তিনি যেন জানেন কি করবেন তিনি। গেলেন স্বামীর কাছে! নিজের গহনার বাক্স, চাবীর গোছা পায়ের কাছে রেখে প্রনাম করে বললেন, এবার আমি আসি, এতদিন স্ত্রীর কর্তব্য করেছি। আজ যদি মার কর্তব্য না করি তাহলে যে মাতৃত্বের অপমান  হবে। বলে মেজ ছেলে, বৌমাকে জানিয়ে শুধু একটা ছোট্ট টিনের বাক্স যাতে রাখা তার কৈশোরে প্রথম প্রেমের কিছু স্মৃতি, মেলার থেকে তার  কিনে দেওয়া ভাঙা কাঁচের চুড়ির টুকরো, মাটির একটা রঙচটা শকুন্তলা মূর্তি, আর কয়েকটা চিঠি বুকে জড়িয়ে বড়ছেলের হাতটা ধরে বেড়িয়ে আসলেন প্রাসাদোপম বাড়িটা থেকে। যে বাড়িটা সম্মান দেয়নি, স্বীকৃতি দেয়নি তার প্রথম সন্তানকে। সকল পিছুটান কাটিয়ে আজ তিনি চলেছেন তার মাতৃত্বের অপমানের জবাব দিতে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>