থাকা সেই কবে থেকে একটি অমর্ত্য ফুঃ.. যার জন্য তুলো তুলো হয়ে আছে জমাট মাংসের আয়তাকারচারদিকে বালিসমুদ্র। মৃত হাঙরের মতো এর নীচে শুয়ে আছেন এক অমরত্বলোভী সম্রাট। স্থির চোখের তারায় থেমে আছে মরুঝড়, ব্যর্থ অশ্বক্ষুর , বুকের ওপর কিউবিক পাথরের স্তুপএর পাশাপাশি একটি নীলাভ জল, ধারাবতী, শেষ না হওয়া সমাধিক্ষেত্রের গায়ে থেকে যাওয়া খোদাই এর দাগ, অজ্ঞাত অক্ষরের জিহ্বায় লেপ্টে থাকা অমরত্বলোভী লালা.. সেও রয়ে গেছে। আয়ুর ব্যারেল ঠেলে বেরিয়ে এসেছে গোধূলির আভা।
ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এসে নাকি ডেকে তোলে এই বাঁশি! নভোমন্ডলীর ওপার থেকে কেউ এসে দিয়ে যায় ফু… দেবতার ইঙ্গিতে। বছরের পর বছর রোজ কাফ্রিরা এখানেই বয়ে এনেছিলো রাজার ঘুমকক্ষের মার্বেল, চিরশায়িত ভঙ্গির পাথরেরা ছুটে এসেছিলো রাজ আজ্ঞায়… যার ওপর আচ্ছাদিত মরুবালিকার স্বপ্নের মতো সব ঝুরোবালি। তাঁরা জানে সম্রাটের দেহকলাগুলিও এই বাঁশির অধীন।
পাথরের ঢাকনায় চেপে থাকা অমরত্বলোভী নিঃশ্বাসগুলি আসলে সম্রাটের নয়, বাঁশিটিরও নয়। দ্রাক্ষা আর কুহকে মেশানো গল্পের পৃথিবীতে এসে দেবতাদের অনুরোধে তবু এখানেই শুয়ে আছেন এক অমর্ত্য মরুসম্রাট……
অপার্থিব রূপালী জ্যোৎস্না ও স্বর্গীয় গোশকটগুলি
কি এক অপার্থিব রূপালী জ্যোৎসনায় আজ আকাশ ছেয়েছে। কাল পূর্ণিমা। গ্রামের রংচটা পথগুলিও ফুঁটে উঠবে সন্ধ্যায়। উঠোনের কোনে ফুঁটে উঠবে লক্ষীর পা। প্রায় শতবর্ষ পুরোনো সরোজিনী চা বাগানের চিমনির মুখগুলো আজ শান্ত,নিরব। চা গাছের ফুলে ভাদু ঠাকুরের আশির্বাদ প্রতিবছর বৃষ্টির পর এ সময়েই ফুঁটে ওঠে, হারান সাঁওতালের ঘরে গান হয়, হাওয়া ফোঁটে। কি এক অপার্থিব রূপালী জ্যোৎসনায় আজ আকাশ ছেয়েছে! আশ্বিনের শেষে ঝরে পড়ছে তার ষোলকলা রূপের অহঙ্কার।
টানা বৃষ্টির পর আকাশে আজ মেঘ নেই। আশ্বিনের রোদেও আজকাল বিটুমিন গলে যায় কতো সহজেই! গ্রামের শেষ প্রান্তে যেখানে ভৈরবের থান, জ্যোৎসনায় চিক চিক করে ওঠে মানতের থালা লাল ফুল প্রার্থনার নির্জন সেখান থেকেই শুরু-
সেখান থেকেই শুরু ভাদু ঠাকুরের গান। ছোটবেলায় দেখা চাবাগানের কাঁটা জড়ানো বেড়াগুলোর পাশের রাস্তা এখন পাকা হয়েছে। কিন্তু আশ্বিনের রোদেও সে বুকে ধরে আছে খানাখন্দের জল,নির্গলিত বিটুমিন,ভাঙাচোরা ট্র্যাকারের চাপ!
কি এক অপার্থিব জ্যোৎসনায় আজ আকাশ ছেয়েছে! রূপালী চাঁদের আলোয় চাঁদমারির জয়োল্লাস, হারান সাঁওতালের নির্ভূল শর। প্রায় শতাব্দী পেরোনো এই সরোজিনী চাবাগানের প্রথম সর্দার ছিলো হারানের দাদু। বাগানের চিমনির মুখগুলো এখন নিরব নিস্তব্ধ। পাতি বিক্রির টাকায় মালিকের আয় ব্যায় শুন্যস্থিতি। ভাদু ঠাকুরের আশির্বাদ এখনো প্রতি বছর লালমাটির টিলায় টিলায় ফুঁটে ওঠে। চায়ের সাদা ফুল বৃষ্টি শেষের দিনে মিটি মিটি ফুলকুমারীর মতো হাসে। হারানের দাদুর ডাকে নাকি ঈশানে মেঘ জমতো বৃষ্টি নামতো চায়ের পাতায় পাতায়। সরকারি চাকরির সুবাদে হারানের এখন আর বাগানে ফেরা হয় না। পুজোর ঠিক পর পরই কলকাতার যাত্রাদল আসে। অপেরার চিৎকারগুলি দূর্গামন্ডপের ইটখসা দেয়ালের গায়ে ঠোক্কর খেয়ে ফিরে ফিরে আসে…
কি এক অপার্থিব জ্যোৎসনায় আজ আকাশ ভাসছে। গ্রামের শেষ প্রান্তে যেখানে অবিরাম করাতের কল,কাঠগুঁড়োর ঢিবি,বৃষ্টিধোয়া লালমাটির রঙ নামছে অকাতরে এখানেই এসে থেমে গিয়েছিলো শক্তিশেল বেঁধা রামায়ণের আপ্রাণ কনসার্ট,তীরের টিকিট কেটে সর্বস্বান্ত হয়ে ঘরে ফিরে হাঁড়িয়ায় বুঁদ হয়ে ডুবে গিয়েছিলো খেলা বাউরির ছেলে। প্রায় শতাব্দী পুরোনো এই জুড়িন্দা নৌকোর ঘাটে এসে পৌঁছোতো কাঁধের জোয়াল, কুঁজে বাঁধা স্বর্গীয় গোশকটগুলি…
২৭ অক্টোবর,১৯৬৫
জন্মস্থান-
মনুভ্যালি চা বাগান, কৈলাসহর, ত্রিপুরা।
শিক্ষা-
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ।
পেশা-
তথ্য আধিকারিক (ত্রিপুরা সরকার)।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ –
উনকথন , খন্ড পাড়ায় জলবার্ষিকী , ধর্মগোধূলী, নিরিবিলি সেন্ট আইটেমস, শ্রেষ্ঠ কবিতা, বিকেলের হার্টক্রেন