| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

কবি ও কবিতার জীবনমৃত্যু

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

একটা পত্র – কবি জিললুর রহমানের কাছে 

কবি জিললুর রহমান,

—শুদ্ধতম ভালোবাসা। ” কবিই থেকে যায় কবিরা মরে না ”। আমি বিশ্বাস করি– আমার কবি ও কবিতা বিশ্বাস এ রকম– বিশুদ্ধ কবিতা মৃত্যুহীন এবং বিশুদ্ধ কবি মৃত্যুকে না মেনেই অমর -চিরঞ্জীব। যে কবি কবিতার মৃত্যুকে মানে — সে তো বাঁচে না এবং কবিতার মৃত্যুর আগে নিজেই মরে। প্রশ্ন হচ্ছে– কার কাছে কবি অমর -মৃত্যুহীন। আমার বিশ্বাস –প্রথমত কবির নিজের কাছে –যিনি স্রষ্টা । দ্বিতীয়ত– তার সৃষ্টি কবিতার কাছে। আমার কেন জানি মনে হয় বা বলতে পারেন প্রত্যয় জন্মেছে যে–কিছু কবিতা আছে [ হায়! অভাগা] লেখার আগেই মরে যায়। কিছু কবিতা লিখতে লিখতে [ লেখার সময়ে ] মরে যায়। কিছু কবিতা আছে— সে জানে না মরে কিংবা বেঁচে আছে। কিছু কবিতা আছে সে কবিতাই হতে চায় না –তাকে মেরেধরে কবিতা করে তুলতে হয়। কিছু কিছু কবিতা তরতর করে কবিতা হয়ে জলের নদী হয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে সার্থকতার আনন্দে— কবি নিজেও বুঝতে পারেন না — কবিতা তাকে নিয়ে গেছে — না-কি কবিতাটিকে নিয়ে তিনি সচ্চিদানন্দে মৌতাত সেরে নিলেন। আমার আবার একথা ও মনে হয় — কবি নিজেই অনেক সময় বুঝতে পারেন না কবিতাটি তাকে ছাড়িয়ে অসাধারণ সমৃদ্ধতায় পৌঁছে গেছে। আবার এ-কথা ও মানতে হবে বড় কবির নক্ষত্র, কবির দৃষ্টি ও ঘ্রাণ ক্ষমতা অপরিমেয়। তবে মনে হয়– আমি যে রকম ভাবি— শ্রুতির চেয়েও মহৎ-কবির ঘ্রাণ-ক্ষমতা কবিতা চেনার ক্ষেত্রে বেশি কাজ দেয়। অর্থাৎ কবিতার সমস্ত কলাকে চতুর্দিক থেকে ঘ্রাণ—স্পর্শে ধরে নিতে পারেন — এ যেন আর্কিমিডিসের; ইউরেকা’। আমি এখানে ‘ high brow’ স্বভাবের কবি বা সমগোত্রীয় কাউকে বোঝাচ্ছি না। আত্মিকতায় বা শিল্প মানসের আধ্যাত্মিকতায় যারা প্রকৃত কবি তাদের কথাই বলছি।

এবার আরেকটু এগুনো যাক—কিছু কিছু কবিতা তো কবির নির্মাণ লক্ষ্যের সাথে একমত না হয়ে ভিন্নপথে চলে যায়–পথ হারায়–আর কবিতা থাকে না। আবার কবিতার ইতিহাসে দেখা যায় পথ হারানো কবিতাটিই কারো কাছে অসাধরণত্বে স্বীকৃতি পেয়ে যায় কালেরকণ্ঠে।

কিছু কবিতা আছে কবির সম্মতি পায় না — কিছু কিছু কবিতা একধরনের চলনসই মুদ্রার পথিক হয়ে ওঠে, সাময়িক কাজের বাইরে যায় না, শিল্পের দাবিতে চিরায়ত পথের দিকে যেতে পারে না অথবা সাহস করে না। কিছু কবিতা অকালে-আকালে মরে এবং কবিকেও মারে –মেরে মরে । আবার কিছু কবিতা পাবেন, জিরাফ শিশুর মতো জন্ম গ্রহণ করে মাটিতে পড়েই দাঁড়িয়ে যায়। কারণ ভ্রূণের ভেতরেই জন্মের মন্ত্র— প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার মেধা ও ঐকান্তিক জীবনীশক্তি সে ধারণ করে ফেলে । এবং কবিতাটি বলে আমি কবিতা –আমি সৃষ্টি — এবং তুমি কবি-স্রষ্টা ।

এখানেই প্রধান প্রশ্ন– কবি বাঁচতে চান কি-না। বাঁচতে হলে কী সামর্থ, কী সম্বল, কী আত্মপ্রেরণাশক্তি, সৃজনবাঁচন ক্ষমতা তার আছে। কবিত্বশক্তির ভেতর দিয়ে কবিসত্তার ভেতর দিয়ে বাঁচার পুঁজি ও অধিকার তিনি কতটুকু অর্জন করেছেন। অর্জনের সম্ভাবনা তার সত্ত্বার ভেতরে কি পরিমাণ আছে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কিছুসংখ্যক কবি ও কবিতাকে পড়ে আমার মনে হয়েছে—- ঐকান্তিক সততা কাব্যশিল্পের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা –অধ্যাবসায় নিয়ে যে — দুঃসাহসের সক্ষমতায় যে বলতে পেরেছে– আমি কবি হতে চাই — কবিই হতে চাই — তাদের অধিকাংশই কবি হয়েছে,।আমি এখানে ‘ফুল -হার্ডি’ দের [FOOL-HARDY] কথা– অর্থাৎ গোঁয়ার প্রগলভ হঠকারি অবিমৃষ্যকারী বা আত্মম্ভরিদের কথা বলছি না। শিল্প বা কবিতা কখনো কখনো নির্দোষ অহংকারকে পছন্দ করে– কিন্তু বাচাল বা বাচালতাকে নয়। পৃথিবীজুড়ে এরকম অসংখ্য বাচালের উদাহরণ পাওয়া যাবে। এটা অনিয়ম নয় নিয়মের মধ্যেই পড়ে যায়। সৎ কবিশিল্পী এদের কারণে বিরক্ত হন কিন্তু উদভ্রান্ত হন না।।

প্রিয় জিললুর রহমান, আমরা তো জানি– কবি ব্যক্তিমানুষ –কিন্তু সাধারণ মানুষ নয়। কবি সামাজিক বাসিন্দা- নাগরিক কিন্তু অসাধারণ প্রমা ও প্রজ্ঞায় এবং শিল্পবোধে স্বাতন্ত্র্যে পৃথক এক বিশিষ্ট অস্তিত্ব। এই বিশিষ্টতাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য — আইডেন্টিটি’। আর বিশিষ্ট কবিশিল্পীগণ তো চিরকালই তাদের কালের– সমকালের পরিচয়পত্র । প্রত্যেক কবির – শিল্পীর একটা একান্ত নিজস্ব আত্মভুবন ও সত্তা আছে । এবং যদি সৃজন মৌলিকতা তার স্নায়ু ও মেধাকে আশ্রয় করে হাজার কবির মধ্যেও তিনি শিল্পব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যে, চলনে কথনে লেখনে শিল্পকারিগরিতে প্রকৌশলে পৃথক হয়ে বৈশিষ্ট্যের অনন্যতায় বলে উঠবেন চিহ্নিত হয়ে ঊঠবেন — আমি কবি। তবে আসল কষ্ঠিকথা হচ্ছে কবিতা। কোন কবিতা — কীভাবে এবং কেন কবিকে বাঁচিয়ে রাখবে সাধনার শিল্পজগতে দীর্ঘজীবন দেবে, মৃত্যুহীন করবে, অমর করবে– সেটাই শিল্পময়তা, শিল্পসার্থকতার বিষয়। কবিকে এ জায়গায় নিজের কাছে নিজেকে পরীক্ষা দিতে হবে– আমি কতটুকু কবি– কতদিন আমার বাঁচবার অধিকার আছে ? কে দেবে আমাকে বাঁচার অধিকার? কীভাবে চিরকালের মহৎকবিরা সে অধিকার অর্জন করেছে। আসলেই– আসল কথা শিল্প ও কবিতা অথবা কবিতাশিল্প। আমার কবিতার কতটুকু আত্মবিশ্বাস আছে আমার উপর। এবং অবশ্যই কবির কতটুকু আত্মবিশ্বাস আছে নিজের সৃষ্ট কবিতার উপর।কবিতা বা শিল্প শুধু সখের-সাধের বিষয় নয়——ধ্যানের বিষয়, সাধ্য ও সাধনার বিষয়। সেই সাধনা অবশ্যই আত্মিক প্রমা ও আলোক অর্জনের এবং সৃজনশ্রমনিষ্ঠ ধুনুরির সাধনা। কবিতাকে কবি করে তুলতে হয় এবং কবিকে কবিতা হয়ে উঠতে হয় — এ দুয়ের সম্মিলন শক্তিতে সোনায়-সোহাগা মিলনে জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর সকল মহান কবি ও চিরকালের মহৎ কবিতা।

কবি জিললুর রহমান, আমরা জানি কবিতাকে অর্জন করতে হয় জীবনের সংজ্ঞায়, প্রমার সংজ্ঞায়, করণকৌশলে, বাচনভঙ্গিতে। পৃথক স্রষ্টা হওয়ার জন্য– অন্য কবিসত্তা থেকে বৈশিষ্টে-চরিত্রে ভিন্নতর হওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকতে হয়। কবি অবশ্যই আপাদমস্তক ব্যক্তিত্ব– পার্সোনালিটি। পরিমিতিবোধের ভেতরে অপরিমিতের পরম আস্বাদক। কবিকে তার কালকে জানতে হয় বুঝতে হয় অসাধারণের চোখেয়োজনেজ্ঞাত হতে সমাজ ইতিহাস প্রকৃতিকে– অগ্রগামী দৃষ্টিতে। দেখতে হয় কাব্য-শিল্পের চরিত্রসমূহকে। নিজের কালকে অতিক্রম করে মহাকালের পরিচিতিপত্রের জন্য আরাধনা ও প্রার্থনা জানাতে হয়। কাজে লাগাতে হয় প্রয়োজনে কবির ব্যক্তিগত মানসিক বিশেষত্বকে [সদর্থে idiosyncrasy]। কবির শক্তিমত্তা কোথায়? নিশ্চয়ই তার কাব্য বৈশিষ্ট্যে কলাবিদ্যার নিপুণ আশ্রয়ে। জীবনের – ত্রিভুবনের অজস্র পথ ও মতের মধ্যে দৃশ্য ও দর্শনের মধ্যে তার আলাদা প্রকৃতি – অস্তিত্বটিকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে আমাদেরকে বলেন –এখানেই তিনি কবি কাব্যের বরপুত্র। তিনি যখন বলার ক্ষমতা রাখেন এবং বলেন–এখানেই আমার POETIC PLENIPOTENTIARY—কবিতার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন–শিল্প হচ্ছে উত্তম মহত্তম মানুষের মধ্যকার সারমর্মের সারপ্লাস [the surplus in man] — মানে উদবৃত্ত । আর এই উদবৃত্ত বিষয়টা কী ? জীবনের প্রাণধর্মের শিল্পের সৃজনী শক্তির আত্মিক ভাবনশক্তির কবিত্বশক্তি ও প্রকৌশল শক্তির উদবৃত্ত বা বাড়তি। এ শক্তি সকলের থাকে না — বিশেষের ভেতরে থাকে । এ শক্তি এ সারপ্লাস তো সাধারণের সম্পত্তিও নয়, সম্পদও নয়। এটা অসাধারণ মানুষের, অরূপের ধ্যানী ঋষির অবিস্মরণীয় প্রকল্পনার কৃতিকর্ম। শিল্পী বলি, কবি বলি, দার্শনিক বলি, স্রষ্টা বলি —— প্রকৃত অর্থে তিনি একা। বিশ্বকর্মার মত সৃষ্টির রচনাশালায় তিনি নিঃসঙ্গ অন্তর্যামিরূপেই তার বিচিত্র আত্মপ্রকাশ। আমরা জানি এবং মানতেই হয় জীবনবোধ আর শিল্পবোধের মধ্যে আছে আত্মার সম্পর্ক।

কবি বা শিল্পীর লোকোত্তরণ কীভাবে ঘটে। কবিশিল্পীদের ভাবাবেশ বা ভাবাবেগের অনবদ্য প্রকাশ ক্রিয়াই হচ্ছে পোয়েটিক ট্রান্সপোর্টেশন। এর প্রক্রিয়াটাকে বলা চলে একটি ভাবনচক্র । ব্যক্তিমন থেকে সমাজমনে জীবন জগতের প্রাণের নাচনে চাঞ্চল্যে সুন্দরের অস্তিত্বে নিত্য নবস্নানে শিল্প জেগে ওঠে — তখনই কবির বা শিল্পীর লোকোত্তরণ ঘটে। এখানেই জট, এখানেই জটিলতা এবং সত্যের স্বরূপের উন্মোচন ঘটে। আমাদের শিল্পের অন্তর্যামীর সকল মগ্নচৈতন্যই — আমাদেরকে শুধু শৃংখলিত করে না অবাধ মুক্তানন্দের দিকেও ঠেলে দেয়।এখন, শিল্প যখন শিল্প হয়ে ওঠে– কবিতা যখন কবিতা হয়ে দাঁড়ায় তখন চরাচরে সুন্দরের স্পন্দন জাগে। আসলে কবিতা এক আশ্চর্য ক্রমিক প্রক্রিয়ায় কবির হয়ে ওঠার অবিস্মরণীয় মেধাবী সাধনা । ডব্লিউ এইচ অডেন– আমার প্রিয় কবিদের একজন– বলেছিলেন কবিতা হচ্ছে মূলত মেমোরেবল স্পীচ–অর্থাৎ স্মরণিয় উক্তি। এ কথাতে বাংলাভাষী এক অসাধারণ আকাশপ্রজ্ঞার কবি জীবনানন্দ সুখী হতে পারেননি——স্বস্তি অনুভব করেননি। তিনি বা তার কালবোধ আধুনিক চেতনবোধ– যা অন্য অনেকের চেয়ে হাড়েমাংসে আশ্চর্য স্বতন্ত্র বলেই– উজ্জ্বলতম শুদ্ধতম বা বিশুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ বলেছেন— কল্পনা প্রতিভার মৌলিকে অবিস্মরণীয় উক্তিই প্রকৃত এবং যথার্থ কবিতা।

কবি জিললুর রহমান— অনেকে না জানলেও — আমরা জেনেছি– জীবনানন্দ নামক একজন কবি আমাদেরকে জানিয়ে দিয়ে গেছেন — কেউ কেউ কবি –সকলেই নয় । এ কথাটি জীবনানন্দের আগেও পৃথিবীর কোনো না কোনো কবি জেনে ছিলো [এ রকম বিশ্বাস আমার আছে ], কিন্তু জীবনানন্দের মতো এমন ভাষায় এমন ভঙ্গিতে এমন সাহসে নির্ভীক চিত্তে এবং নিজের রচনার ভেতর দিয়ে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করে — এমন বাণীর প্রকাশ আর কারো কছে শুনিনি। এবং তার পুর্বে কেউ বলে থাকলেও আমাদের [সীমাবদ্ধতার কারণে] শ্রবণের দেখনের মধ্যে আসেনি। আর এ কথাও কি বলা যায় না যে সকলেই পাঠক নয় –কেউ কেউ পাঠক । আবার কেউ কেউ পাঠকের অনেকেই তো কবিতা পাঠক নয়। এটাই নিয়ম বোধ হয় । আর একথা ও দ্বিধা না রেখেই বলা যায় — কাউকে কবি না হওয়ার জন্য আমরা নির্দেশ বা অনুরোধ জানাতে পারি না। সে অধিকার আমাদের থাকা উচিত নয়। এখানে একটু বাড়তি কথা যোগ করতে পারি–পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়– অনেকেই কবি—-তাৎক্ষণিকতার আবেশে অথবা অস্পষ্ট হেঁয়ালিতে উদ্দেশ্যহীন কাব্য ভ্রমণে [fool’s errand] অথবা মানস রোগাক্রান্তিতে অথবা অজ্ঞাত আবেশের বশে কিছু স্মরণীয় উক্তি রচনা করে ফেলেন । আবার সমগ্র জীবনকে নিবেদন করে সাধনার কাব্যে স্মরণীয় বাক্যাবলি রচনার বিষয়টিকে অবশ্যই কবিত্বের আবশ্যিক দায়িত্ব বলেই আমি মনে করি। আর অবিস্মরণীয় উক্তি –রচনা তারাই করেন যারা অবিস্মরণীয় কাব্যশক্তির অধিকারী কবি। আবার একজন কবির সকল বাক্য-পদই অতুলনীয় অবিস্মরণীয় হয়ে উঠবে এমনটা আশা করা ঔচিত্যের মধ্যে পড়ে না। কবি এলডাস হাক্সলির [১৮৯৪-১৯৬৩] কথা বিবেচনায় রাখলে মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ানো যায়–বলা যায় কবির শক্তিমত্তা এবং উজ্জ্বলতম রচনার পরিমাণকে হিসাবে রেখেই কবিত্বের ধারণা করা যেতে পারে।

আমাদেরকে এ কথাটিও মনে রাখতে হবে কবিতার শিল্পত্বে কাব্যকর্মে হাজারো রকমের মত ও পথ আছে এবং আরো অজস্র মত আগতকালের প্রভাবে আসবে। আমাদেরতো জানাই আছে শিল্প এক অনবদ্য সৃষ্টি যা মূলত হৃদয় সংবেদী। অর্থাৎ মন আর হৃদয়ের সাথে জীবন ও জগতের কোটিকোটি অনুভুতি ও বিভূতির সাথে তার কাজকারবার। এ ব্যাপারেও সাবধান থাকা উচিত কবিতা বা শিল্পকর্ম বিশ্বকর্মার [ মিথ ] একক সংসারের সৃষ্টি হলেও– তিনি একার জন্য সৃষ্টি করেন না। কিন্তু তার সৃষ্টি অন্যের চোখে কেমন লাগে সে কথাটি জানতে তার মনে-প্রাণে একটা রহস্যময় আবেগ সর্বক্ষণ জীবন্ত থাকে। তাই সকল কবিত্বকে শিল্পকে শ্রোতার পাঠকের দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণের একটা চেষ্টা রাখতে হয় । এর কারণটা কী ?

শিল্পসৃষ্টির সাধনা বা ক্রিয়া একার হলেও শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায় সমাজের পাঠশালায়। কবির সকল আয়োজন সকল সাধনা করণকৌশল সকলই পাঠকের কাছে আত্নবিস্তৃতির আকাঙ্ক্ষা।কিন্তু আত্নবিস্তারের আকাঙ্ক্ষা কোনো কাজেই আসে না –বরং হাস্যকর হয়ে ওঠে যদি কবির আত্নাতিক্রান্তি না ঘটে। কবির আত্নাতিক্রান্তি মানে কবিতার বিশুদ্ধ ও মহত্তর শিল্প সুষমা অর্জন। আমাদের মনে রাখা জরুরী. কালের ধর্মাচরণ ও রুচির পরিবর্তন না ঘটলে, বা পরিবর্তনটা ধরবার মতো শিল্প ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে, শিল্পেও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বা সম্ভাবনা জাগে না। সঙ্গতিপূর্ণ না হলেও এখানে আমার ব্যক্তিগত একটি বোধের কথা আপনাকে জানাতে চাই এবং জানাতে পারলে ভালো লাগবে। কথটা বলছি কবিতার বোঝাবুঝি নিয়ে। আপনাকে মার্কিন কবি হার্ট ক্রেনের কথা বলছি। প্রচন্ড অস্থির এক কবি। সম্ভবত ১৯২০ সালের দিকে প্যারিসে কিছুকাল কাটিয়েছিলেন। জীবনভঙ্গির কারণে একটি মিথও তৈরি করেছিলেন। লেখার সংখ্যাও বেশি নয় । অল্প লেখা দিয়ে স্বরচিত এই কিংবদন্তি কবি মার্কিন সাহিত্যে ভালো প্রভাব রেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৩২ সালে আত্নহত্যা করে বসলেন। এর আগেও আত্নহত্যার চেষ্টা করেছেন। ‘এট মেল্ভিলস টম্ব’ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা।প্রচন্ড দূর্বোধ্য কবিতা। রচনার করণকৌশল চেতনের- অবচেতনের গভীর জটিলতা উপমা ও চিত্রকল্প-মনোকল্প ব্যবহারের প্রবল অবোধ্যতার কারণেই বৌদ্ধিক পাঠকের কানে কবিতাটি ভালো না বাজলেও তাদের চোখকে দারুণ আকর্ষণ করেছিলো। যে সম্পাদক কবিতাটি ছেপেছিলেন-তিনি বলেছিলেন- আপনার চিন্তা ও ছন্দ আমাকে কৌতুহল জাগায়। কিন্তু আপনার প্রধান প্রধান মিশ্রিত উপমায় এবং চিন্তায় কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। তবে আমি না পেলেও আপনি নিশ্চয়ই সতেচন ছিলেন। যদিও আপনার ঐ সচেতনতা টাই আমাদের অবোধ্যতায় হতবাক করে। কবিতাটি অবোধ্য চিত্রময়তা ও মনোকল্পেরই অধিকাংশই । যে সময়ে আমি পাঠ করেছি বুঝতে পারিনি।তবে শেষের চারটি লাইন আমাকে আজীবন আলিঙ্গন করে রাখবে ।যদিও সন্দেহ হয় ঐ চারটি লাইন আমি ঠিক ঠিক ধরতে পারছি কিনা। তবে প্রশান্তিটা এখানে – আমার বিশ্বাস কবিতা অক্ষরে অক্ষরে বোঝার চাইতে আধাআধি বুঝলেই সবচাইতে ভালো। বিখ্যাত মানুষরা অনেকেই এই মন্তব্য করেছেন বলে এ কথা বলতে সাহস পাচ্ছি। কারণ কবিতার রহস্যময়তা নামক বিষয়টিকে তারা অন্তর্গত ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। বিস্ময় ও রহস্যময়তাই কবিতার প্রধান সম্পদ বলে আমিও মনে করি। যাক ঐ চার লাইন কবিতাটা এরকম ———
‘Compass, quadrant and sextant contrive
No farther tides … High in the azure steeps
Monody shall not wake the mariner.
This fabulous shadow only the sea keeps.’

আমরা জানি কবিতায় ব্যবহৃত সেক্সট্যাণ্ট কুয়াড্রান্ট কম্পাস এসব যন্ত্রাদি সমুদ্রের বা নদীর জলের স্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করে না – মাপজোক করে। কিন্তু যখন সমুদ্রের সুন্দর ও ভয়াবতার মধ্যে মৃত্যুকে এক আশ্চর্য কিন্তু আনন্দ-যন্ত্রণার সংবেদে দেখে তখন বিস্ময়ের শিল্প ঘর জাগে। জাহাজের নীল সিঁড়ির উপরে দাঁড়ানো নাবিকটির মনেও হয়তো বা স্মৃতিময় হয়ে থাকবে না মৃত বা হারানো নাবিক বন্ধুর জীবনের বাণী আচরণ কথোপকথন । কোনো শোকের মর্মান্তিক হাহাকার বিলাপ নাবিকের স্মৃতিতে বেদনার গোলাঘর তৈরি করবে না। কিন্তু সাগরের জলের শরীরে হাওয়ার ঘ্রাণে উত্তাল ঢেউয়ে অথবা গম্ভীর প্রশান্ততায় নাবিকের ছায়া ও জীবনের চনচলতাকে সমুদ্রের মানসিক ছায়ার চিরস্থায়ী সম্পদে পরিণত করে রাখবে। সমস্ত দুর্বোধ্যতা ও জতিলতা অতিক্রম করে হার্ট ক্রেনের কবিতা এখানে বিজয়ী।।

ফাউজুল কবির
০২ আগস্ট ২০২০ পূর্বাহ্ণ ০১:২৬

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত