Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,poet-binoy-majumdar

ফুল-ই বটে বিনয়ের কবিতা । এহসান হায়দার

Reading Time: 4 minutes

গায়ত্রীকে কি তুমি ভালোবাসতে?’
‘আরে ধ্যুৎ, আমার সঙ্গে তিন-চারদিনের আলাপ, প্রেসিডেন্সি কলেজের নামকরা সুন্দরী ছাত্রী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, তারপর কোথায় চলে গেলেন, আমেরিকা না কোথায়, ঠিক জানি না।’
‘তাহলে ওকে নিয়ে কবিতা কেন?’
‘কাউকে নিয়ে তো লিখতে হয়—আমগাছ, কাঁটাগাছ, রজনীগন্ধা নিয়ে কি চিরদিন লেখা যায়!’

উপরের প্রশ্নোত্তর পর্বটি ফিরে এসো চাকা-র কবি বিনয় মজুমদারের।

সম্ভবত বিনয় মজুমদারই একমাত্র কবি যার একটি কবিতার বইয়ের নাম তিনবার দেয়া হয়েছে। বইটির প্রথম সংস্করণে নাম ছিল ‘গায়ত্রীকে’, কোনো উৎসর্গপত্র ছিল না, ধরে নেওয়া যায় বইয়ের নামেই উৎসর্গ। দ্বিতীয় সংস্করণে হলো ‘ফিরে এসো চাকা’। আর এর তৃতীয় সংস্করণে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—কবির কবিতা লেখা বন্ধ, তাই এই বইয়ের নাম আবারও বদল করবেন। এবারের নাম হলো ‘আমার ঈশ্বরীকে’, উৎসর্গে আমার ঈশ্বরীকে। এই ঈশ্বরীর পরিচয় আমরা জানি উপরের দুটো প্রশ্ন ও উত্তর থেকে। পশ্চিমে যিনি এখন খুব দমকে বেড়াচ্ছেন—একাধারে লেখক, তাত্ত্বিক ও একজন চিন্তক হিসেবে—সেই গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, বিনয় মজুমদারের মানসী।


বিনয় মজুমদার নিয়ে সাম্প্রতিককালে কারো কারো মধ্যে দেখা যায় বেশ উপচে পড়া আবেগ। আবার একইভাবে বিরক্তিও। স্বয়ং বাংলা সাহিত্যের সমকালে অত্যন্ত দাপুটে কবি আল মাহমুদ-ই বলেন, ‘বিনয় অগোছালো একজন কবি আর আমি খুব গোছানো একজন কবি।’

কথাটা শুনে চমকে গেছিলাম—আরে, আল মাহমুদ এই কথা বলেন কিভাবে? তখন আবার আমি আল মাহমুদের কাছে জানতে চাইলাম, কেন বিনয় অগোছালো আর নিজেকে গোছানো বলছেন? উত্তরে মাহমুদ বলেছিলেন, ‘আমি যা করেছি ভেবে করেছি, উল্টোপাল্টা কিছু করি নি।’

বাহ, বেশ তো! আমার তখন মনে হয়েছিল কবিতা দিয়ে আল মাহমুদ অনেক কিছু করেছেন, কিন্তু কবি বিনয় মজুমদার কিছুই করেন নি। ভারতের সর্বকালের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হয়েও, এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কিছু করলেন না। হাতছানি দেয়া দামি চাকরি, বিলাসবহুল জীবন সব কিছুকে দু-পায়ে ঠেলে যখন বিনয় দাঁড়ান কবিদের সারিতে তখন সর্বাগ্রে আমি দেখি কেবল তাঁকে, আর কাউকেই দেখি না। অর্থলোভী, ভোল-পাল্টানো কাউকেই দেখি না, কেবল একজন প্রচারবিমুখ কবিকেই দেখি, তাঁর নাম বিনয় মজুমদার। কার্যত, আজ বিনয় ভাবনার দুর্বলতার টুকরো টুকরো কারণ বলছি। এই লেখায় কাউকে তুচ্ছ করে দেখার প্রয়াস আমার নেই, যদিও কোনো কোনো লেখক কবি বিনয় সম্পর্কে অনেক হতাশাজনক কথা বলেছেন তবুও বিনয় বিনয়-ই। কবি বিনয় মজুমদারের বিনয় ও অভিমান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।

বিনয় মজুমদার—এই নামের ভেতর থেকে উঠে আসে একটা স্পষ্ট ইন্দ্রিয় অনুভূতি, নির্জন আকাশের ধ্বনি, ছায়াঘন জৈব জ্যামিতি। তাঁর কবিতা একটা অফুরন্ত উদাসীন স্পর্শকাতরতা নিয়ে অপেক্ষা করে পাঠকের আনন্দ ও মর্ম-হাহাকারের জন্যে।

হৃদয়, নিঃশব্দে বাজো, তারকা, কুসুম অঙ্গুরীয়—
এদের কখনো আর সরব সংগীত শোনাবো না।
বধির স্বস্থানে আছে; অথবা নিজের রূপ ভুলে
প্রেমিকের তৃষ্ণা দ্যাখে, পৃথিবীর বিপণিতে থেকে।

কবিতা লিখেছি কবে, দুজনে চকিত চেতনায়।
অবশেষে ফুল ঝ’রে, অশ্রু ঝ’রে আছে শুধু সুর।
কবিতা বা গান… ভাবি, পাখিরা—কোকিল গান গায়
নিজের নিষ্কৃতি পেয়ে, পৃথিবীর কথা সে ভাবে না।

কবি নিজের হৃদয়কে উদ্দেশ্য করে এ কথাগুলো বলেছেন, মানে তা নিজেকে বলছেন। অথচ বলার ভঙ্গিটি পুরোপুরি বস্তুগত না; কারণ হৃদয় বিষয়টি বস্তুগত, অথচ এর অনুভূতি দেখা যায় না, অবস্তুগত, তাই এই কথাগুলো আলাদা করে হৃদয়কে লক্ষ্য করে বলে ওঠেন। ফলে এই কবিতার সুর শুরু থেকেই তন্ময় ব্যক্তিগত; কিংবা মন্ময় বস্তুগত বলা যায়। এই ধরনের অ্যামবিভ্যালেন্স (Ambivalence) বা উপযোজ্যতা আছে সম্পূর্ণ কবিতাটির শরীরে।

এইসব কারণেই, ১ম পঙ্‌ক্তির ‘বাজো’ এই অনুজ্ঞাটি ২য় পঙ্‌ক্তিতে আত্মগত হয়ে ‘শোনাবো না’য় রূপ পেয়ে যায়। আর ‘নিঃশব্দে বাজো’র ভেতর রয়ে যায় একটা স্ববিরোধ। এ ধরনের বিশেষ কম্পাঙ্কের নিচে শব্দ হলে কান তা ধরতে পারে না। কিন্তু নিঃশব্দে বাজবার কথা যখন বলা হয় তা নীরব থাকে না—কারণ, এরই মধ্যে কবিতার শরীর নির্মাণ হচ্ছে, কবিতাটি শব্দে সমর্পিত হয়েছে, উচ্চারিত হওয়ার জন্যে তৈরি একটি বাক্য শব্দে নিবিষ্ট : ‘হৃদয়, নিঃশব্দে বাজো।’ বিনয়ের এই যে আত্মগত উচ্চারণ, আত্মার সাথে কথা বলা খুব কম কবির কবিতায় লক্ষ করা যায়। বিনয় এখানেই নতুনতর প্রেমের সন্ধান করেন পুনর্বার। বিনয়ের কবিতার শরীর ও মন এক হয়ে লীন হয়—যেন কোনো অজানায় হারায় পাঠক। একবার বোধহয় বিনয় বুঝে গেছি, আবার পরমুহূর্তে মনে হয় আরে কিছুই তো বুঝি নি। বিনয় সহজ যত, তার চেয়েও অধিক হলো বোধের। বিনয়ের কবিতায় লিরিসিজম, নারী-পুরুষ, প্রেম-প্রকৃতি, বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিসন্ধান—এক একটি বিষয় জড়িয়ে রয়েছে নিবিড়ভাবে।
বিনয় বলে যান একজন খবরওয়ালার মতো, একেবারে অন্য এ বলার রীতি—

গ্রহণ দেখতে গিয়ে দেখলাম মেঘের আড়ালে
সূর্য চলে গেছে, আমি দুইখানি আলোকচিত্রের
ফিল্ম একসঙ্গে নিয়ে তার মাঝ দিয়েই দেখেছি
সূর্যের গ্রহণ প্রায় দশবার, তবে বর্তমানে
সূর্যকে ঢেকেছে মেঘে।…

সূর্যের গ্রহণ দেখার বিষয় যখন কবি বলেন, তখন মনে হয় যেন একজন রিপোর্টার খবর বিবরণী দিচ্ছেন—যাকে ধারাভাষ্যও বলা যেতে পারে। বিনয়ের এই গুণ আমার ব্যক্তিগত পাঠরুচিকে আরও যুক্তিবাদী করে সরল দৃশ্যে রূপ নেয়, যার পেছনে পাওয়া যায় একটি পজেটিভ দৃশ্য। বিনয় কবিতার বিজ্ঞানকে কবিতায় প্রয়োগ করেন নি বরং বিজ্ঞানকেই কবিতায় প্রয়োগ করেন আর তাই হয়তো বিনয় আরও ‘সহজ আর কঠিন’—এই  দ্বান্দ্বিকতার মাঝখানে পাঠককে হাতছানি দেয়।

‘দেখো, গাছ দীর্ঘকাল মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকলে মাটি কিন্তু গাছের সারটুকু ছাড়া সবই খেয়ে নেয়। কবিতাও তেমনি শত শত বছর পরে দেখা যায়, সময় তার সারটুকু বাদে সবই খেয়ে নিয়েছে।’


বিনয় নব্বই দশকে এসে ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। একদিকে পত্রিকায় তার অভাব অনটন নিয়ে লেখা হচ্ছে, অন্যদিকে তার অসুস্থতাও বাড়ছে। তিনি মানসিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরের দিকে বিনয়কে এই মানসিক সমস্যা থেকে কখনো আর পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা যায় নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে চিকিৎসা করান দীর্ঘদিন কিন্তু সুস্থ আর হন নি। মাঝে মাঝে সব কিছু ভুলে যেতেন, অকারণে রেগে যেতেন। মেয়েদের দেখলে বিরক্ত হতেন। মাঝে মাঝে বলতেন, তাঁর নামে যে বই বের হয়েছে, তা তাঁর না। তাঁর সই নকল করে করা হয়েছে। কবির চারপাশে তখন কেউ নেই, খবরের কাগজে তাঁকে সহযোগিতার জন্যে বিজ্ঞাপন আর খবর ছাপা হয়, প্রকাশকের বইয়ের কাটতি বাড়ে, বিনয় অর্থ পান না— অর্থের কারণে খেতে পারেন না। সরকার পাঁচশ টাকা পেনশন দেয়, তাও পোস্ট অফিসে আনতে যেতে হয় এই মানুষটিকে—কী দুর্দশাটা তাঁকে পোহাতে হয়েছে!

কী পেয়েছেন এই কবি? জীবনের অধিকাংশ সময় না খেয়ে রোগে-শোকে ভুগে এক নির্জনতার মধ্যে শেষ হয়ে গেছেন। বাংলা ভাষার এত বড় কবি, যাঁকে ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, ‘আমি সাম্প্রতিকালের এক কবির সম্পর্কে আশা রাখি, যিনি কবিতার জন্যে যথার্থ জন্মেছেন। আমার মনে হয় একালে বাংলাদেশে এত বড় শক্তিশালী শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন কবি আর জন্মান নি। তিনি হলেন বিনয় মজুমদার।’

কবি বিনয় মজুমদার শুদ্ধ নন কেবল, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে অত্যন্ত যৌক্তিক ছিলেন। বিবেচনা আর আবেগ যত ছিল, তার চেয়ে শতগুণ বেশি ছিল বিজ্ঞানচিন্তা। ১৯৮৮ সালে প্রায়-ই তিনি নিয়ম করে ডায়েরি লিখেছেন। ডায়েরিটি পাঠ করলে বোঝা যায় বাংলা ভাষার একজন শুদ্ধচারী কবি কবিতার মতো নয়, কবিতার জন্যে নিজের সমস্ত কিছু ত্যাগ করে কী রকম দীন জীবন যাপন করেছেন, নিয়ম করে। বিনয় যে সমস্ত কিছু হিশেব করে আর যুক্তি দিয়ে চলতেন তা সহজেই বোঝা যায়।

‘দেখো, গাছ দীর্ঘকাল মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকলে মাটি কিন্তু গাছের সারটুকু ছাড়া সবই খেয়ে নেয়। কবিতাও তেমনি শত শত বছর পরে দেখা যায়, সময় তার সারটুকু বাদে সবই খেয়ে নিয়েছে।’ শত শত বছর পরে হয়তো দেখা যাবে কোনো কোনো কবির কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফিরছে, আবার কারো-বা কেবল নামটিই থাকবে বেঁচে অথবা শত শত বছর পর কেউ থাকবে না। বিনয় ছিলেন এমন-ই। কেবল যুক্তি দিয়ে কবিতার স্বর তৈরি করেছেন। বিনয়কে তাই ভাবতে ভাবতে এইসব দুর্বলতায় আটকে যাই—যিনি গণিতজ্ঞ, তিনি কবি এবং তিনি কালজয়ী এক প্রেমিক। বিনয় নিজে বলতেন, ‘আমি গণিতবিদ, আমার অধিকাংশ সময় কাটে গণিতচিন্তায়। আর কবিতা, মানুষ যে রকম কাজের অবসরে সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান করে, তেমনি।’

বিনয়কে, বিনয়ের লেখাকে আলাদা করে চেনা যায় সুর, ছন্দ, গন্ধ, ছায়া, শব্দ, বোধ—এই সবকিছু থেকে; আবহমান বাংলা কবিতা এবং পূর্বসূরি কবি জীবনবাবুর কাব্যগণ্ডি মুছে বিনয় তৈরি করেছেন নিজস্ব এক কবিতার ধারা বা প্রবাহ। যার পুরোটায় রয়েছে বস্তুবাদী গাণিতিক আবহ। বিনয় কেবল তাই আমার ভাবনার দুর্বলতায় থাকে, কারণ তার কাব্য সমীকরণ বুঝে মেলানো যাবে যখন, তখন মনে হয় রসায়নের গোপন ভুলগুলো জেগে উঠছে—ঠিকই তো এক একটি কবিতা সুন্দর ফুল, ফুল-ই বটে বিনয়ের কবিতা।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>