| 29 নভেম্বর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: মনের হারমোনিতে। প্রসেনজিৎ দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

পুরুষ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

আমি তখন বয়সে বেশ ছোট। মা খেলার ছলে আমাকে গেয়ে শোনাত ‘আমাদের ছুটি ছুটি…’ একটু বড় হয়ে জানতে পেরেছি যে, ছুটির গান শুনলে মন উড়ু উড়ু করে চটজলদি খেয়ে নিতাম গপাগপ। বিজয়া সম্মিলনীর ঘটনা। মা বলল, চল তোকে সন্ধ্যা মুখার্জির গান শোনাব। বাড়ির পাশে বাঁধা হয়েছিল মাচা। তখন এখনকার মতো ফাইভারের চেয়ার ছিল না। ছিল কাঠের ফল্ডিং চেয়ার। আশা করি আপনাদের অনেকেরই মনে আছে সেই স্মৃতিমেদুর চেয়ারের কথা। তো, আগে আগেই মাঠে পৌঁছলাম। কারণ যে আগে যেতে পারবে, সে বসবে আগে। তারপর সন্ধে সাতটা বাজল। মাইকে অ্যানাউন্স হল, ‘শুরু হচ্ছে আজকের বিজয়া সম্মিলনী, আপনাদের সামনে উদ্বোধনী সংগীত গেয়ে শোনাবেন আমাদেরই পাড়ার ‘অমুক’। চশমা পরে হাঁদুদা বাজাবে তবলা। ছোট্ট হাতুড়ি দিয়ে তবলার পাগড়িতে মেরে সে কী সব করল। পরে জেনেছি যে, এর আরও নাম আছে। একে কোথাও বলা হয় গজরা, কোথাও বেষ্টনী, কোথাও বা বেড়, ছোর। তারপর পাড়ার ম্যাডাম আসত উদ্বোধনী সংগীত গাইতে। সেই যাইহোক, উদ্বোধনী সংগীত বেসুরো না হলে আসর জমত না। হাহাহা… তার গান শেষ হতে না হতেই দাড়িও’লা ভেল্টুদা আবার অ্যানাউন্স করল, ”করতালি দিয়ে সকলে উৎসাহিত করুন গায়িকাকে, এবার আপনাদের সামনে গাইতে আসছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়…”

আমরা বসেছিলাম প্রথমদিকের দ্বিতীয় সারির ডান কোনায়। মাঠের এক্কেবারে শেষ প্রান্ত থেকে শোনা গেল, ‘ওরে আয়… ওরে আয়… আয়… আয় আয় আয়, আমাদের ছুটি ছুটি চল নেব লুটি ওই আনন্দ ঝরনা।’ পিছন ফিরে দেখি ওমা একজন ছেলে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান গাইতে গাইতে মঞ্চে উঠছে। আমি খুব অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়েছিলাম। মা বলল, ‘তোকে বলেছিলাম সন্ধ্যা মুখার্জির গান শোনাব।’ কিন্তু আমি যে তখন ছোট। বাড়িতে টিভি ছিল না, টেপ রেকর্ডার ছিল না। তাই আমি সেদিন ‘পুরুষবেশী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দেখেছিলাম। বিশ্বাস করুন, তাঁর সেই সংগীত শিল্পীর নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। আরও কিছুটা বড় হয়ে শুনেছিলাম, তিনি নাকি খোদ ‘গীতশ্রী’-কে গান শুনিয়ে প্রশংসা পেয়েছিলেন। বেশ ভালো লেগেছিল গান। এ বছর করোনাকালে বোধহয় বিজয়া সম্মিলনী হবে না। ছোটবেলার স্মৃতিগুলি যেন সম্বল আর বেশি করে।

ও কেন এত সুন্দরী হল

নিজে খুব বিশেষ রোমান্টিক নই, তাই শুনতে ভালো লাগলেও মনের কাছাকাছি ছিল না মান্না দে-র গাওয়া ‘ও কেন এত সুন্দরী হল…’ গানটা। আমাদের বন্ধুমহলের আড্ডায় এ-গান গাওয়া হলে ইয়ার্কি মেরে বলতাম ও সুন্দরী হল তাতে আমার কী? কিংবা ও এমনি করে ফিরে তাকিয়ে দেখলেই বা বোকার মতো মুগ্ধ হতে হবে কেন? কিন্তু এই সুর কিংবা গানটাকে কখনও উপেক্ষা করতে পারিনি। আজ মনটা বেশ আড্ডা আড্ডা করছে। এই অছিলায় ‘ও কেন এত সুন্দরী হল’ গানটা নিয়েই না-হয় একটা গল্প বলি।

একবার দুর্গাপুজো এসে গিয়েছে কিন্তু পুজোর গান তখনও তৈরি হয়নি মান্না দে-র জন্য। এমনই কোনও একদিন মান্নাবাবু ধানবাদের সিন্দ্রিতে গিয়েছেন অনুষ্ঠান করতে। খনি এলাকা সিন্দ্রি ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ মহকুমার ধানবাদের কাছে। যাই হোক, মান্না দে-র সঙ্গে সেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তা সেই সিন্দ্রিতে থাকতেন পুলকবাবুর ভাইরা ভাই গৌরীসাধন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। মান্না দে-ও সঙ্গে গেলেন। বহুদিন আগে ভাইরা ভাই গৌরীসাধনের বাড়ি এসেছিলেন পুলকবাবু। তাই ওনার পাড়ায় এলেও বাড়িটা ঠিক চিনতে পারছেন না পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। খুঁজতে খুঁজতে একটা বাড়ির সামনে এসে তাঁদের গাড়ি থামল। পুলকবাবু বললেন, “গাড়িতে একটু বসুন মান্নাদা, মনে হচ্ছে এই বাড়িটাই…” বলে তিনি চলে গেলেন।

খানিক পরেই বেশ ফুরফুরে মুড নিয়ে ফিরে এলেন পুলকবাবু। মান্না দে-কে বললেন, “আপনার আর চিন্তা নেই দাদা, আপনার জন্য পুজোর গান তৈরি। স্বাভাবিকভাবেই মান্না দে অবাক। এই তো এইমাত্র তাঁকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে ওই বাড়িতে গেলেন পুলকবাবু। গাড়িতে বসেই পুলক বন্দ্যো-কে কলিং বেল বাজাতে দেখলেন তিনি। একজন দরজা খুলে পুলকবাবুকে কী সব বলার পর আবার গাড়িতে ফিরলেন। এরমধ্যে গান তৈরি হল কখন! আসলে কী জানেন? ভাইরা ভাইয়ের বাড়ি ভেবে যে বাড়ির কলিংবেল পুলকবাবু বাজিয়েছিলেন, তা ছিল এক সুন্দরী মহিলার বাড়ি। বেলের শব্দ শুনে বেরিয়ে এসে পুলকবাবুর ভুল শুধরে দিয়েছিলেন অসাধারণ সুন্দরী এক মহিলা। আর এই রূপসাগরে ভেসেই পুলকবাবু লিখে ফেললেন, “ও কেন এত সুন্দরী হল/এমনি করে ফিরে তাকাল/দেখে তো আমি/মুগ্ধ হবই/আমি তো মানুষ/ও কেন এত সুন্দরী হল…” আমিও মানুষ, তাই এমন গান ভালো-না-বেসে উপায় আছে?

হিট গানেও বিরক্তি

আমাদের পাড়ায় দুর্গাপুজোর আলো জ্বলে উঠেছে। প্যান্ডেল হয়েছে। বহরে তা অনেক ছোট। মণ্ডপের বাঁধানো বেদিতে প্রতিমাও এসেছেন। তিনিও দৈর্ঘ্যে অনেক ছোট এবছর। জন্মাবধি এত জৌলুসহীন দুর্গাপুজো আমাদের পাড়ায় আগে কখনও দেখিনি। তবে, এই মহামারি আবহে জাঁকজমকহীন পুজো নিয়ে কোনও নালিশও নেই। তবুও প্রতিদিনের এই মৃত্যুমুখী স্রোতের আবহ থেকে কিছুটা নিস্তার দিচ্ছে মাঝেমাঝে এই আলো, এই মণ্ডপ, এই প্রতিমা। এতদিন যেসব গান পুজোর সময় মণ্ডপে বাজত, তাও এবারে বাজছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একই গান বার বার মাইকে বাজলেও বিরক্ত হতাম না। কিন্তু এবারে যখন মাইকে বাজছে ‘পালকিতে বউ চলে যায়’ কিংবা ‘চোখে চোখে কথা বলো মুখে কিছু বলো না’ অথবা ‘ও পাখি উড়ে আয় উড়ে আয়’ এসব, খুবই বিরক্ত হচ্ছি। না, এমন সময় তো এসব গান কখনোই মনকে ত্রাণ দিতে পারে না। ক্ষমা করবেন, অনেকেরই হয়তো প্রিয় গান এগুলো। আমারও অপ্রিয় নয়। কিন্তু এ বছর কান নিতে পারছে না এসব গান।

৮৫ বছরের প্রেমিকা আমার

আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল একজনের। আমার প্রেমিকা বলতে পারেন। ৮৫ বছর বয়স। নাম অনিমা দাশগুপ্ত। সে আবার সংগীত কিংবদন্তি জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বোন। একদিন নাগেরবাজারে (তখন ওখানে থাকতেন) তার বাড়িতে হাজির। বহু গল্প করলেন। বললেন, “প্রসেনজিৎ লালনের গান গাও।” আমি তো অবাক!

– ইয়ার্কি করছ ! তোমার সামনে আমি গাইব?
– সংগীতে বাছবিচার করতে নেই। লালন ফকির করতেন না।

অগত্যা গাইতেই হয়েছিল, “আর আমারে মারিস নে মা…” শেষ করার পর তাকালাম ভয়ে ভয়ে।

বলল, “শিখবে? আমি তোমাকে আমার ঘরানায় দীক্ষা দেব।”

নাহ। শেখা হয়নি। কারণ, খুব সংক্ষিপ্ত ছিল আমাদের যোগাযোগ। উনি মুম্বই চলে গিয়েছিলেন। যাইহোক, সেদিনের কথায় ফিরে আসি আবার। অনিমাদি বলছিল, সে যখন ছোট ছিল জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের হারমোনিয়ামের ওপর উঠে যেত দাদার গান শুনবে বলে। বলেছিল ড্রাগর ব্রাদারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, সলিল চৌধুরীর সঙ্গে মঞ্চে গান গাওয়া, কিংবা দিল্লির এক স্কুলে ইংরেজি পড়াতে গিয়ে মদনমোহনের গান গাওয়া সহ আরও বহু কথা।

-মদনমোহনের কোন গান গেয়েছিলে?
– আপ কি নজরো মে সমঝা।
– তারপর?
– ছেলেমেয়েরা শোনার পর চুপ ছিল খানিকক্ষণ।
– আমি বঞ্চিত হব?

এরপর গান ধরল সে… আর আমি হওয়ায় ভাসতে লাগলাম। “দিদি, আর একটা… মদনমোহনেরই… লাগ যা গলে… প্লিজ…”

গাইল। দেখলাম যে, তার চোখে জল। আমি বললাম, “দিদি, দুহু কোরে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।” শুনে মাথা নেড়ে বলল, “ধুর পাগল এত অল্প বয়সে এসব বলতে নেই।”

আমার অফিস ছুটি হয় রাত এগারোটারও পরে। প্রতিদিন। যে গাড়িতে করে ফিরি, সেখানে আজ বাজছিল, লতা মঙ্গেশকরের ‘লাগ যা গলে’। বাইরে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমার মনে পড়ল এসব। মন ভারী হল না হালকা হল বুঝতে পারলাম না। সব অনুভূতির ভালোমন্দ থাকতে নেই যে!

মিলন মহান

রাত এগারোটার বনগাঁ লোকাল। ফাঁকা। দরজার এককোণে দাঁড়িয়ে হেডফোন মারফত ভেসে আসছিল কাজী নজরুল ইসলাম… “রাধা-তুলসী, প্রেম-পিয়াসি, গোলকবাসী শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণ।” শুনতে শুনতে ইলিশেগুঁড়ি বৃষ্টি এল। আমার মনের খুব কাছাকাছি একজন বললেন, গানটি কাহারবা তালে। কাহারবায় গাইলে ভজনের আস্বাদ পাওয়া যায়। যদিও গানটি ত্রিতালেও গাওয়া হয়। এই পরিবেশের মধ্যে ভাবছিলাম, প্রকৃত ভারতবর্ষ এমনই। যেখানে ধর্মের বিভেদ নেই। যেখানে কোনও মুসলিম সন্তান ভজন লিখবেন অথবা কোনও হিন্দু ঘরের ছেলে কুরআন বাংলায় অনুবাদ করবেন। হ্যাঁ, আমি কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক গিরিশচন্দ্র সেনের কথা বলছি। আজ নজরুলের জন্মদিন। এমন দিনে অফিস শেষে বাড়ি ফেরার সেদিনের কথা খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান…’ অ্যায়সা দেশ হে মেরা…

বনশ্রী

২০১৭ সালে সরস্বতী পূজা পড়েছিল ১ ফেব্রুয়ারি। এর ঠিক কয়েকদিন আগে এক সংগীতশিল্পীর বাড়ি এসেছিলেন আরও এক কিংবদন্তি শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দেখে এক্কেবারে আহ্লাদিত হয়ে পড়েছিলেন সেই শিল্পী। তিনি জড়িয়ে ধরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে বললেন, “তোমার গান আমার মতো করে কেউ গাইতে পেরেছে দিদি? তুমি বলো দিদি, তোমার গান সবচেয়ে ভালো গাইতাম আমি!” সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় উত্তরে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, তুই-ই আমার গান সবচেয়ে ভালো গাইতিস।” অসুস্থ সংগীতশিল্পী সন্ধ্যার কাছে এমন কথা শোনায় যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই, ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হয়েছিলেন বনশ্রী সেনগুপ্ত। আর সরস্বতী পূজার আগের সেই দিনটিতে ৮৬ বছরের সন্ধ্যা মুখোাধ্যায় যাঁর উদ্দেশ্যে কথাগুলি বলেছিলেন, তিনি বনশ্রী সেনগুপ্ত। বাংলা আধুনিক গানের জগতে প্রতিষ্ঠা পাবার আগে এহেন বনশ্রী সেনগুপ্ত ‘সন্ধ্যাকণ্ঠী’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন।

প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে একদিন সন্ধ্যায় এক মঞ্চে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান গাইছেন বনশ্রী সেনগুপ্ত। দর্শকাসনে ছিলেন এক স্বনামধন্য গায়ক। তিনি এই ‘সন্ধ্যাকণ্ঠী’র গান শুনে অভিভূত হয়ে তাঁর কাছে এগিয়ে গেলেন। সেই গায়ক বনশ্রী সেনগুপ্তকে বললেন, “তোমার নিজের গান গাইতে ইচ্ছে করে না?” বনশ্রী সেনগুপ্ত শুনে বলেছিলেন, “আমার জন্য কে আর গান তৈরি করবে!” এ কথা শুনে সেই গায়ক বলেছিলেন, “দেখি চেষ্টা করে।” তা যেমন বলা, কেমন কাজ। কয়েকদিন পরে তিনি বনশ্রী সেনগুপ্তকে একজন সুরকারের কাছে নিয়ে গেলেন। বললেন, “ইনি বনশ্রী। সন্ধ্যাকণ্ঠী হিসাবে পরিচিত। আপনি এঁকে সন্ধ্যাকণ্ঠী থেকে বনশ্রী সেনগুপ্ত বানিয়ে দিন।” উল্লেখ্য যে, বনশ্রী সেনগুপ্তকে যে গায়ক একজন সুরকারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই প্রখ্যাত সুরকারের নাম সুধীন দাশগুপ্ত। আর যে গায়ক এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তিনি মৃণাল চক্রবর্তী। তারপর বাকিটা ইতিহাস।

গানের লড়াই

টাইম মেশিনে চেপে কয়েক দশক পিছিয়ে গেলে ফিরে যাবেন পুজোয় রিলিজ হওয়া গানের যুগে। সে-ছিল গ্রামোফোন কোম্পানির যুগ। এই কোম্পানি তখন রিলিজ করত একের পর এক প্রখ্যাত শিল্পীর কালজয়ী সব অ্যালবাম। ১৯৭৪ সালের কথা। ঠিক হল, কিশোর কুমার সুর করবেন লতা মঙ্গেশকরের জন্য, অন্যদিকে লতা মঙ্গেশকর সুর করবেন কিশোর কুমারের জন্য। অদ্ভুত একটা মিষ্টি চ্যালেঞ্জও তৈরি হল এই নিয়ে। গান লেখার জন্য ডাকা হল গীতিকার মুকুল দত্তকে। মুকুলবাবু চারটি গান লিখলেন, কিন্তু কোন গান কার জন্য লিখলেন প্রথমে বললেন না। চারটি লেখা থেকে দু’টি করে বেছে নিলেন লতা ও কিশোর। লতা মঙ্গেশকরের সুরে কিশোর কুমার গাইলেন ‘তারে আমি চোখে দেখিনি’ এবং ‘আমি নেই’। আর কিশোর কুমারের সুরে লতা মঙ্গেশকর গাইলেন ‘ভালোবাসার আগুন জ্বেলে কেন চলে যাও’ এবং ‘কী লিখি তোমায়’। বাঙালি সেবার মোহিত হয়ে গিয়েছিল। সত্যি এমন মিষ্টি ‘গানের লড়াই’ এখন দেখা মেলা ভার!

বাপ-ব্যাটার লড়াই

অনেকেই বলে থাকেন যে শচীন দেব বর্মণ যদি আরও কয়েক বছর বেঁচে থাকতেন, তবে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য তাঁর পুত্র রাহুল দেব বর্মণের সবচেয়ে বড় লড়াই তাঁর বাবার সঙ্গেই হত। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে মুক্তি পেয়েছিল হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় হিট সিনেমা ‘চুপকে চুপকে’। সেই সিনেমায় বিখ্যাত সব গানের মধ্যে একটি ছিল ‘আব কে সাজন সাওয়ান মেইন’ (Ab Ke Sajan Sawan Mein)। সুরকার ছিলেন খোদ শচীন দেব বর্মণ। তবে ভারতবাসীকে কাঁদিয়ে ওই বছরেই, মাত্র ৬ মাস পর, ৩১ অক্টোবর অমৃতলোক যাত্রা করলেন এস.ডি বর্মণ। একইভাবে ‘অভিমান’ (১৯৭৩) সিনেমার হিট গান ‘মিত না মিলা রে মন কা’ (Meet Na Mila Re Mann Ka) বানানোর সময় শচীন কর্তার বয়স ছিল ৬৭ বছর। অন্যদিকে, ১৯৭২ সালে আর ডি বর্মণ যখন ‘অমর প্রেম’ সিনেমার ‘রায়না বিতি যায়’ (Raina Beeti Jaye) দিয়ে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন, তার ঠিক এক বছর আগে ‘শর্মিলী’ সিনেমায় এস.ডি বর্মণ ‘মেঘা ছায়ে আধিরাত’ (Megha Chhaye Aadhi Raat)-এর মতো একটি ক্লাসিক গান নির্মাণ করছিলেন। সুতরাং ভারতীয় সংগীত জগতে এই দুই অন্যতম নক্ষত্র তাঁদের সৃষ্টিকে আধার করে একে-অপরের বিরুদ্ধে যদি শ্রেষ্ঠত্বের আসন পাওয়ার জন্য লড়তেন, তাহলে জয় হত সংগীতেরই। কিন্তু বিধাতা তাতে রাজি ছিলেন না হয়তো।

ছোট্ট বাহাদুর

কী থেকে কী হয়, কেউ জানে না। জানেন কেবল শিল্পী। সুরকারের নাম সুধীন দাশগুপ্ত। তাঁর ছেলে সৌম্য তখন ছোট। সে তার বাবার কাছে একবার আবদার করে বসল; তার জন্য বানাতে হবে গান। ছোট্ট সৌম্য বলল, ‘‘বাবা তুমি তো নানান রকম গান বানাও। বাচ্চাদের নিয়ে তো কখনও কোনও গান বানাও না। আর কিছু শুনব না। এবার তোমাকে বাচ্চাদের একটা গান বানাতেই হবে।” বাবা ছোটদের নিয়ে গান তৈরি করার কথা দিলেন তাঁর ছেলেকে। তবে এরপর পেরিয়ে গেল অনেকদিন। গান বানানো হল না। খুব স্বাভাবিকভাবে প্রবল মন খারাপ নিয়ে তার বাবার কাছে আবার ওই একই আবদার করল। ছেলের এই নাছোড় আবদারে বাবা সুধীন দাশগুপ্ত ছোটদের নিয়ে গান বানাতে বসলেন। সেই সময় সৌম্যর সঙ্গে বাহাদুর নামে এক পরিচারক থাকত। সৌম্য ও বাহাদুর বয়সে ছিল সমান সমান।

সুধীনবাবু বললেন, ‘‘তোমার বাহাদুরকে নিয়েই আমি গান লিখব।” কথা রাখলেন তিনি। বাহাদুরকে নিয়েই তিনি লিখে ফেললেন, ‘‘ছোট্ট বাহাদুর যাচ্ছ কতদূর/রাস্তা থেকে কিনে এনো গরম চানাচুর।” এরপর খুশির বাধ ভাঙল সৌম্য এবং বাহাদুরের। এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর, ১৯৬৭-তে পুজোর গান তৈরি করতে বসলেন সুরকার। শ্যামল মিত্রের লিপে যাবে একটি গান। কী রকম সুর হবে, গানের কথাই বা হবে কী রকম, সেসবই তখন ভাবনা-চিন্তা চলছে। হঠাৎ তাঁর মাথায় এলো, আরে ছেলের জন্য তো একটা গান লিখেছিলাম, সেই সুরে তৈরি হয়ে গেল কালজয়ী গান। ‘ছোট্ট বাহাদুর যাচ্ছ কতদূর’ গুনগুন করতে করতে ওই ঘরেই তৈরি করে ফেললেন ‘‘কি নামে ডেকে বলব তোমাকে/মন্দ করেছে আমাকে ওই দু’টি চোখে…” পুত্রের জন্য তৈরি করা সুর রূপান্তরিত হল প্রেমের গানে। মানুষটি ছিলেন এমনই সৃষ্টিশীল। সত্যিই কী থেকে কী হয়, কেউ জানে না।

বুড়ো নবাবের গান

এক বৃদ্ধ নবাব ছিলেন। যিনি সংগীতপ্রেমী নির্বিবাদী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ইংরেজরা সেই বৃদ্ধ নবাবকে ঠাওরাল দুষমন নম্বর ওয়ান। তাই সেই নবাবকে দাও নির্বাসন। সাধের লখনউ ছেড়ে চলে যেতে হবে সেই নবাবকে। নবাব সমস্ত যন্ত্রণার তার নিংড়ে লিখলেন, “বাবুল মোরা নাইহার ছুটো হয় জায়ে…” তারপর নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেল। ১৯৩৬ সাল। ছবি বা বায়োস্কোপ বা সিনেমার নাম ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’। গায়ক এক ও অবিসম্বাদি কে এল সায়গল। সুর দিলেন আর এক কিংবদন্তি সুরকার রাইচাঁদ বড়াল। অভিনয়ের মধ্যেই মানে, অভিনয় ও গান একসঙ্গে করতে চাইলেন শ্যুটিংয়ের সময়। করলেনও। এখনও মাতাল করে সেই কে এল সাইগলের ‘বাবুল মোরা…’। তারপর তো কতজন গাইলেন, ভিমসেন যোশি, রসুলান বাঈ, গিরিজা দেবী, কিশোরী আমনকার, বেগম আখতার প্রমুখ। কিন্তু সায়গলের সেই মায়াবী ভেজা ভেজা গলা নিয়ে নাহ কোনও কথা হবে না।

ও হ্যাঁ, সেই নবাবের নাম ওয়াজেদ আলি শাহ। সিপাহি বিদ্রোহ… ঝাঁসি রানি, তাঁতিয়া তোপে ওঁরা স্থির করেছিলেন ওই নবাব তাঁদের নেতা। সেই নবাব কেবলমাত্র নামেই নবাব ছিলেন তখন। অথচ এক সময়ের দিল্লির রাজপাট তাঁর পূর্বপুরুষের ছিল। আর তাই ইংরেজরা নবাবকে আওধ ছাড়া করল। কলকাতার মেটিয়াবুরুজে তিনি নির্বাসিত হয়ে বাকি জীবনটা কাটান।

ব্রিটিশ রাজ তাঁকে তাঁর প্রিয় লখনউ থেকে নির্বাসিত করার সময় আওধের উনিশ শতকের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ এই গানটি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি বিদাইয়ের রূপক ব্যবহার করেছেন (কনের বিদায়)। তাঁর পিতার (বাবুল) বাড়ির এক কনে এবং তাঁর প্রিয় লখনউয়ের কাছ থেকে দূরে কলকাতা, যেখানে তিনি তাঁর বাকি বছর অতিবাহিত করেছিলেন। জানি না কেন আজ বারবার এই গান শুনছি। গানটি বাঁধা সকালের প্রথম প্রহরের রাগিণী ভৈরবীতে। অথচ সকাল, বিকেল, রাত্রি সবসময়ই শুনে চলেছি। মাঝেমাঝে করুণ যা কিছু, সেও মনকে শান্তি দেয়… নাহলে দুঃখের সময় বেশিরভাগ মানুষ দুঃখের গান শুনতেন না।

ঝুলনা

১৯২৭ সালের ১৭ অক্টোবর ব্যাঙ্কক থেকে পিনাং যাবার পথে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা”। গানটি পিলু রাগের। কাহারবা তালের। আজ শুনছিলাম এই গান। এই রোগগ্রস্ত সময়ে কিছুটা শান্তি এনে দিচ্ছিল মনকে। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, ‘ঝুলনা’ শব্দটি নিয়ে। ‘ঝুলনা’ শব্দটি খোদ এমন একটা শব্দ, যা নিয়ে বাংলা গান তৈরি হয়েছে অনেক। এক্ষুনি মনে পড়ছে ‘দেয়া নেয়া’ সিনেমার ”দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা/দোলে কৃষ্ণ দোলে ঝুলনা”। শ্যামল মিত্র ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান। আমার কাছে এই গানটি আধুনিক সিনেমার গানে পুরুষ কণ্ঠে সেরা ডুয়েট। ঠোঁট মিলিয়েছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার এবং তরুণ কুমার। প্রশান্ত রায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তম আর অসীম চ্যাটার্জি হয়েছিলেন তরুণ। যাইহোক, এরপর মনে পড়ছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ”বাঁধো ঝুলনা, তমাল বনে এসো দুলি দুজনে” গানটির কথা। এক্ষেত্রে আবার ‘দুজনে’ শব্দটাও কমন। তাছাড়াও কাজী নজরুল ইসলামের “বাঁধো বাঁধো ঝুলনা খোঁপায় পরিয়া দোপাটি মালিকা সাজো সাজো অতুলনা”-ও রয়েছে লিস্টে।

এই ‘ঝুলনা’ শব্দের গান মনে করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ল, আরে এই লকডাউনের সময় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজকাহিনী’ আবার পড়ার সময় পেয়েছিলাম নগেন্দ্রনগরে রাজপুত-রাজকুমারীর ঝুলন গান- “আজ কি আনন্দ ! ঝুলত ঝুলনে শ্যামর চন্দ !” পড়তে এত ভালো লেগেছিল যে, কলি ভুলতে পারিনি। গানটির দুর্দান্ত প্রয়োগ করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক, তাঁর ‘সুবর্ণরেখা’ চলচ্চিত্রে। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। কয়েক মাস পরে ঝুলনযাত্রা। এই করোনাকালে গত বছরের ঝুলন কেটেছিল আড়ম্বরহীন। এবারও বোধহয় একই রকম কাটবে। কিন্তু ঝুলনা থেকে ঝুলন, ঝুলন থেকে শ্যাম… কৃষ্ণ-রাধা সবই যেন বাঁধা আছে ভারতীয় তথা বাংলা সংগীতে। এই দিক থেকে আমরা কিন্তু ‘বড়লোক’।

রাজু বন গ্যায়ে জেন্টলম্যান

 

লকডাউনে আমাদের অফিস নিয়ে আসত রাজু। রাজু চৌহান। ওর বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগরের কাছে। কয়েকজন অফিস কলিগের বাড়িও ওখানে। তাদের প্রত্যেককে গাড়িতে তুলতে তুলতে ড্রাইভ করে বালিগঞ্জের কাছে আমাদের অফিস আনা-নেওয়ার দায়িত্ব ছিল ওর। দীর্ঘ পথ। তাই ক্লান্তি ও একঘেয়েমি ভুলতে ও মঝেমাঝেই ওর ভাষায় গান চালাত। ওর ভাষা বিহারি। জন্ম এখানেই। তবে আদিবাড়ি উত্তরপ্রদেশে। তা আমরা গাড়িতে ওঠার পর যে যার পছন্দমতো গান শুনত ব্লু-টুথ কানেক্ট করে। এমনি করেই দিন কাটছিল। একদিন রাজু বলল, “আজ আমি আপনাদের গানা শুনাব।” ভাবলাম, এই রে আবার সেই ভয়ানক টিউনে গলায় মেশিন বসানো বিহারি গান সহ্য করতে হবে! তবে গান চালু হতেই চমকে গিয়েছিলাম। রাজু চালিয়েছে বাউল শাহ আব্দুল করিমের গান, “গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান/ মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম/ আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম…” নির্বাক করে দিয়েছিল রাজু। ও তারপর বলেছিল, “আপনারা যে গান চালাইতে পসন্দ হলে সেগুলো আপনারা অফিসে চলে গেলে ইউটিউবে সেভ রাখলাম।” আরে… হামারা রাজু বন গ্যায়া জেন্টলম্যান।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত