আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিটআজ ০৯ মার্চ সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক মনিজা রহমানের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
‘যখন মানুষ একটা মিথ্যা কথা বলে তখন তার সব কিছু মিথ্যা হয়ে যায়। আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম বললে কম হবে, আমি তার ভালোবাসায় অন্ধ ছিলাম। তার সঙ্গে আমার এক বছর ছিল স্বপ্নের ঘোরে বসবাস! হয়ত এই স্মৃতিটুকু নিয়ে জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়ে দিতে হবে।’
রেস্টুরেন্টের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল বানু। স্রোতে আমি নাকি ওই সিলিং বুঝতে পারছিলাম না। আরবরা ইংরেজি বললেও যেন সেটা আরবির মতোই শোনায়। ভারতীয়দের ক্ষেত্রে এ বিষয়টা আমি খেয়াল করেছি। বানুর কথার ধরন নাকি কথার মর্মার্থ কোনটা আমাকে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করল সেটা ভাবছিলাম। চুপচাপ বসে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। অজানা অচেনা একজনকে কেন যে ওর নিজের জীবনের কাহিনি বলতে চাইছে আমার মাথায় আসছিল না। বানু আমার সহকর্মী সুরাইয়ার মতো মরোক্কান মেয়ে। বানুর সঙ্গে আমার আজকের সাক্ষাতের পিছনে সুরাইয়ার কিছুটা হলেও ভূমিকা আছে। সেটা রীতিমত আজব। ভাবতে আমার হাসি পেল। বানুর আমার দিকে কোনো খেয়াল নেই। সে এখনো সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি যে স্কুলে চাকরি করি সেখানে আমার ক্লাসে মূল শিক্ষক জেনিফার ছাড়াও আমরা দুজন সহকারী আছি,- আমি আর সুরাইয়া। আমাদের মধ্যে সুরাইয়া বয়সে বড় হলে কী হবে, সে সবচেয়ে হালকা-পাতলা আর ফিট। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নাচানাচিতে, প্লেগ্রাউন্ডে গিয়ে ছোটাছুটিতে ওর জুড়ি নাই। এত প্রাণবন্ত ও যে বলার নয়। লাঞ্চের সময় ক্লাসের সবচেয়ে উচুঁ চেয়ারটাতে বসে টেবিলের ওপর মোবাইল রেখে তার্কিশ সিরিয়াল দেখা ওর প্রিয় অভ্যাস। বাসাতেও নাকি সারাক্ষণ এই কাজ করে। এজন্য স্বামী আবদালের সঙ্গে প্রায় ঝগড়াঝাঁটি লেগে যায়।
সুরাইয়াও সময় পেলে স্বামীকে শুনিয়ে দেয়। ওর স্বামী খুব আড্ডাবাজ আর বন্ধুপ্রিয়। সপ্তাহে একদিন কোনো রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের নিয়ে লম্বা সময় আড্ডা তাকে দিতেই হবে। সেই আড্ডায় মদ-সিগারেট-মারিজুয়ানা কোনো কিছু বাদ যায় না। এমনকি বন্ধুদের টানে বছরে একবার নিজের জন্মভূমি মরক্কেশে চলে যায় মাস খানেকের জন্য। কোনো কাজ ছাড়া শুধু আড্ডা মেরে ঘুরে ফিরে আসে। তখন চাকরির পাশাপাশি সংসারের সব দায়িত্ব সুরাইয়ার ঘাড়ে।
‘তুমি স্বামীকে ডিভোর্স দাও না ক্যানো?’ সুরাইয়ার স্বামী সম্পর্কে নানা অভিযোগের বয়ান শেষ হলে জেনিফার মন্তব্য করে। ‘এমন দায়িত্বহীন লোকের সঙ্গে কীভাবে থাকো? তোমার উচিত ওকে ছেড়ে চলে আসা।’ অস্বস্তি আর অসহায়ত্ব নিয়ে হাসে সুরাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে। জেনিফার চলে যাওয়া মাত্র বলে- ‘জেনিফার আমাদের সমস্যা কখনও বুঝবে না। এই সামান্য কারণে আটাশ বছরের পুরনো স্বামীকে ছেড়ে দেব! ছেড়ে দিয়ে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে কীভাবে চলব? তাও আমার এই সামান্য আয়ে! ওদেরও তো বাবা দরকার।”
আমিও তাই ভাবি। ভালো-মন্দ যাই ঘটুক, স্বামীকে ছেড়ে নতুন জীবন গড়া কি আমাদের পক্ষে সম্ভব? যত ঝগড়াঝাটি হোক, আবার লাঞ্চের সময় আমি ‘জান’ আর সুরাইয়া ‘ইয়া হাবিবী’ সম্বোধন করে ফোনে স্বামীর খবর নেই। তবে আমাদের কথা দুই-তিন মিনিটে শেষ হয়ে যায়। জেনিফার আয়েস করে কানে হেডফোন লাগিয়ে ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্প করে। আর আমি সুরাইয়ার প্রিয় তার্কিশ সিরিয়াল দেখি। হিন্দি সিরিয়াল দেখতে অভ্যস্ত আমি এখন অন্যরকম জীবনযাপনের বৈঠকখানায় প্রবেশ করি। সুরাইয়া আর আমি দুজনে সুদর্শন নায়কের ভক্ত, যে কারণে একই সিরিয়ালের ভক্ত হতে সময় লাগে না। সিরিয়ালের নামকরা সেভদা, যাকে ইংরেজিতে বলে এন্ডলেস লাভ। বাংলাদেশে একটা সিনেমা আছে না অনন্ত প্রেম, অনেকটা সেরকম! সিরিয়ালের নায়িকা নিহান পরিবারকে বাঁচাতে প্রেমিক কেমালকে প্রত্যাখান করে আমির নামে একজনকে বিয়ে করে।
বাংলায় যাকে কামাল বলে ডাকি, সেই নাম অদ্ভুত উচ্চারণে ওদের ভাষায় কেমাল হয়ে যায়। প্রত্যাখানের পরে কেমালের বেদনার্ত চোখ, আবার নিহানকে দেখার পরে আনন্দময় অভিব্যক্তি আমাদের দুজনের চোখে মুগ্ধতার ঘোর নামায়। সুরাইয়া স্কুল ছুটির পরে রাত জেগেও সিরিয়াল দেখে। সেদিন দেখি- সকালে স্কুলে ঢোকার মুখে গাড়ি পার্কিং করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে সুরাইয়া। চোখেমুখে ঘুমের ঘাটতি থাকলেও অন্যরকম ভালো লাগায় উজ্জ্বল। দ্রুতহাতে ক্লাস রুমের চেয়ারগুলো ঠিক করে রাখতে রাখতে সুরাইয়াকে বলি- ‘হাই নিহান’। হাসিতে ওর মুখ ঝলমল করে ওঠে। উপচে পড়া হাসি মুখে নিয়ে ও বলে, ‘ফাজলামি কর!’
আমি সেই হাসিমুখের সংক্রমণে আক্রান্ত হতে হতে বলি- ‘তোমার জন্য চমক আছে। আমি কেমালের ইন্সটাগ্রাম এ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছি।’
‘কী বল!’ সুরাইয়ার চোখে মুখে আগ্রহ ঠিকরে বের হয়। ‘ওর বউয়ের ছবি আছে?’
‘হ্যাঁ’ মাথা নেড়ে আমি বলি, ‘লাঞ্চের সময় দেখাবো।’ বলতে বলতে ব্যাগ আর লাঞ্চ বক্স ক্লোজেটে ঢুকিয়ে রাখি।
আগের রাতে কেমাল অর্থাৎ প্রকৃত বরাক অজটিভিটকে ইন্সটাগ্রামে আবিষ্কারের পরে দেখলাম আমার বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র ‘বানু ডাহমানি’ নামে একজন আগে থেকে ওকে ফলো করে। হঠাৎ আমার মনে হলো বানু নামের এই ভদ্রমহিলা শুরু থেকে আমার সঙ্গে ইন্সন্টাগ্রামে আছে। আমার প্রত্যেকটা ছবিতে লাইক দেয়। কিন্তু তার সম্পর্কে কিছু জানি না। মাঝেমধ্যে তার ছবি দেখি। কিছুটা স্থুলকায়া, কিন্তু ভারি মিষ্টি একটা চেহারা। মাথায় একটা স্কার্ফ দেয়া থাকে সব সময়। আমি ওকে টেক্সট পাঠাই।
ও সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর দেয়, ‘ভালো।’
‘ইন্সটগ্রামে তোমার ছবিগুলি খুব সুন্দর!’
এরপর আর কোনো টেক্সট করি না। ফেসবুক আর ইমেলে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অনেকক্ষণ পরে ইন্সটগ্রামে গিয়ে দেখি, ওর আরেকটা মেসেজ: ‘তোমার সঙ্গে একবার আমার পরিচয় হয়েছিল জ্যাকসন হাইটসে, মনে পড়ে?’
আমার বিদ্যুচ্চমকের সঙ্গে সঙ্গে সব মনে পড়ে যায়। কারণ স্কুলে চাকরি নেবার আগে আমার সঙ্গে খুব বেশি আরবের পরিচয় হয়নি। জ্যাকসন হাইটসে একটা অফিসে পরিচয় হয়েছিল এক দম্পতির সঙ্গে। স্বামী মিশরীয় আর স্ত্রী মরক্কান। স্বামী লোকটি খুব সুদর্শন ছিল মনে আছে, লম্বা, আকর্ষণীয় চেহারা। স্ত্রী স্বামীর তুলনায় ছোটখাটো, স্থুলকায়াও বটে। আমি ভদ্রমহিলার স্বামী ভাগ্য দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। বানু নিজেও আনন্দে ঝলমল করছিল। ও তখন গর্ভবর্তী ছিল। দেখে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
আমার সব কিছু মনে পড়ে যায়। তবে অনেক রাত হওয়াতে আমি আর বানুর মেসেজের উত্তরে কিছু লিখি না। ভাবি পরে লিখব।
দুপুরে লাঞ্চের সময় সুরাইয়ার সঙ্গে প্রবল উৎসাহে কেমাল ওরফে বরাকের ছবি দেখতে থাকি। বেশি আগ্রহ ওর স্ত্রী কেমন দেখতে সেটা নিয়ে। আহারে কি সৌভাগ্যবান সেই নারী! সুরাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমি মন্তব্য করি, ‘ওর স্ত্রীর চেয়ে সিরিয়ালে ওর যে নায়িকা নিহান, সে বেশি সুন্দর দেখতে!’ সুরাইয়া একমত হয়।
কেমাল আর নিহানের ভালোবাসায় তখন তীব্র সংকটকাল। ভাইকে খুনের দায় থেকে বাঁচাতে অহংকারী-মেজাজী আমিরকে বিয়ে করেছে নিহান। কিন্তু দুজনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। কেমালের জীবনেও এসেছে আরেকজন নারী। কিন্তু দুজনে কেউ তাদের প্রথম প্রেমের কথা ভুলতে পারছে না। কোথাও দুজনের দেখা হয়ে গেলে দুজনের চোখে ঠিকরে ওঠে তীব্র ভালোবাসার আলো। আমি আর সুরাইয়া মনে মনে ভাবি- কোনোদিন কি এই আলো দেখতে পাব কারো চোখে?
বানু এমন আলো দেখতে পেয়েছিল একজনের চোখে। কিন্তু তাতে যতনা ছিল ভালোবাসা, তারচেয়ে বেশি প্রতারণা! হঠাৎ করে আমার ভাবনার জগতের বানু পাকাপোক্ত জায়গা করে নেবে দুই দিন আগেও ভাবতে পারিনি।
বাসে উঠে সিট পাবার পরে টেক্সট করি বানুকে। বাসায় গিয়ে কাজের চাপে ভুলে যাব। ‘হ্যাঁ, তোমার কথা ও তোমার স্বামীর কথা খুব মনে আছে। তুমি তখন গর্ভবতী ছিলে তাও মনে আছে। কদিন আগে একটা ছোট্ট ছেলের ছবি দিয়েছিলে, সেটা কি তোমার?’
একটু পরে বানুর প্রত্যুত্তর আসে। আমার ধারণা সঠিক, ও মনে হয় সারাক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়াতে থাকে। ‘ওই লোক মানে মোহাম্মদ জোবায়ের আমার এখন আর স্বামী নন। আসলে কখনও হয়ত আমার স্বামী ছিলেন না।’ পরে আবার লেখে, ‘ছবিটা আমার বোনের ছেলে।’
আমি আকাশ থেকে পড়ি। দেখলাম স্ত্রী গর্ভবতী বলে স্বামী কীভাবে আগলে রাখছিলেন ওকে, এখন বলছে লোকটা ওর স্বামী না! ‘কী বল, বুঝতে পারছি না!’ ওর উত্তর দেখার সময় হয় না। আমার স্টপেজ চলে এসেছে। দ্রুত বাস থেকে নেমে যাই। বাসায় এসে নানা ঝামেলার মধ্যে বানুর বিষয়টা মাথায় ঘুরতে থাকে। কোনোভাবে মাথা থেকে সরাতে পারি না।
পাশে বসে না থাকলে আমার ছেলে আর মেয়ে ঠিকভাবে হোমওয়ার্ক করে না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় লিভিংরুমে ওদের মাঝখানে আমাকে বসে থাকতে হয়। ওরা পড়াশোনা করে আর আমি ফেসবুক-মেসেঞ্জার চষে বেড়াই। কখনও বন্ধুদের ফোন করে খোঁজখবর নেই। অনলাইনে গিয়ে কেনাকাটা করি। আজ সব বাদ দিয়ে ইন্সটাগ্রামের মেসেজ বক্স খুললাম।
‘আমি কিছু বুঝলাম না তোমার কথা।’ আমি লিখলাম বানুকে।
ও কিছুক্ষণ পরে উত্তর দিল, ‘সে এক লম্বা কাহিনি।’
‘আপত্তি না থাকলে আমাকে বলতে পার!’
‘আগে বলেছি মোহাম্মদ জোবায়ের লোকটার নাম। অনলাইনে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। সে আমার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। সে মিশরে থাকতো। আমাকে বলতো মরক্কোর মেয়েরা তার খুব পছন্দ।’
‘তারপর কী হলো?’ আমি জানতে চাই। ও কোনো উত্তর দেয় না। আসলে অল্প পরিচিত কাউকে নিজের জীবনের গল্প বলতে হয়ত ওর সংকোচ হচ্ছিল। আবার ও মনে মনে কাউকে চাইছিল যে নিরপেক্ষ জায়গা থেকে ওর কথা শুনবে। ‘ও পরে নিউইয়র্কে এসে আমাকে বিয়ে করে। পরের ঘটনা আরেকদিন বলব।’
আমি ‘আচ্ছা’ লিখে চুপ করে থাকি। মনে অসম্পূর্ণ রহস্য উপন্যাস পড়ার উত্তেজনা।
পরের দিন স্কুলে লাঞ্চের সময়ে সুরাইয়াকে জিজ্ঞাসা করি, ‘মিশরীয় ছেলেরা কি মরক্কান মেয়েদের খুব পছন্দ করে?’
‘তুমি জান না! মিশরীয় স্ত্রীরা স্বামীকে ধরে পেটায়!’ এত জোরে কথাটা বলে সুরাইয়া যে জেনিফার কানের হেডফোন লাগিয়ে কৌতূহলি চেহারা নিয়ে আমাদের দিকে তাকায়। ও এবার জেনিফারের কাছে চেয়ার টেনে বসে। আমিও একটা চেয়ার টেনে নেই। ‘এক গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবীতে স্ত্রী কর্তৃক সবচেয়ে নির্যাতিত স্বামী হলো মিশরীয়রা। এজন্য অনেকে মিশরীয় পুরুষ সীমান্ত অতিক্রম করে আমাদের দেশে আসে বিয়ে করার জন্য।’ সুরাইয়ার কথায় আমার চোখে পার্কে দেখা বিশালদেহী মিশরীয় রমণীদের ছবি ভাসে।
‘আমি তো তাহলে মিশরীয় নারীদের স্যালুট দেব।’ জেনিফার বলে হাসতে হাসতে।
‘তোমাদের দু’দেশের সংস্কৃতি কি একরকম?’ আমি জিজ্ঞাসা করি।
‘না ওরা অনেকটা মধ্যপ্রাচ্যের দেশের মতো। সকালের নাস্তায় জায়রো-ফালাফাল ইত্যাদি খায়। আমরা অনেকটা ইউরোপীয় ধরনে চলি।’
সুরাইয়ার পোশাক-আশাকে একদম ইউরোপিয়ানদের মতো। সব সময় ‘স্লিভলেস’ শার্ট বা টপস পরে আসে। ওর ফিগারও চমৎকার, সেটা ও জানে, বুঝেশুনে এমন পোশাক পরে যেখানে ওর শরীরের বাঁকগুলি স্পষ্ট বোঝা যায়। সেই তুলনায় জেনিফারের ফিগার তেমন আকর্ষণীয় নয়। ওর সুন্দর একটা মন আছে। কিন্তু অতি স্পষ্টবাদিতার কারণে জীবনে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে ওকে।
হয়ত বানুও আগে এমন বেঢপ ছিল না। অচিন আশা আর আশাভঙ্গের বেদনা ওর জীবনের তারুণ্যকে শুষে নিয়ে পরিণত করেছে নেতিবাচক মানুষে।
শুক্রবার স্কুল ছুটির পরে আমি সাধারণত জ্যাকসন হাইটসে যাই। কিছু বাজার সদাই করি। মাঝেমধ্যে ভারতীয় পোশাকের দোকানগুলিও ঘুরে ফিরে দেখি, নতুন কিছু চোখে পড়ে কিনা! বাসায় গেলে আলসেমি পেয়ে বসবে, যে কারণে স্কুল থেকে সরাসরি চলে যাই। প্রথমে বাসে কুইন্সব্রিজ, সেখান থেকে এফ ট্রেনে একটা স্টপেজ জ্যাকসন হাইটস।
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ইন্সটাগ্রামে দেখি বানুর মেসেজ। ও আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি ওকে জ্যাকসন হাইটসে যাবার কথা বলি। আমি জানি জায়গাটা ও খুব ভালো চেনে। ওর সঙ্গে আর ওর কথিত সুদর্শন স্বামীর সঙ্গে ওখানে আমার দেখা হয়েছিল। বানু করোনাতে থাকে। সেভেন ট্রেন নিয়ে
যে কোনো সময়ে চলে আসতে পারবে।
দেখা গেল আমি বাস-ট্রেন করে জ্যাকসন হাইটসে পৌছানোর আগে বানু চলে এসেছে। আমার জন্য ডাইভার্সিটি প্লাজা বলে নামে পরিচিত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে হাত বেঁধে। আমি দূর থেকে ওকে দেখে একটু ব্যথিত হই। খুব মলিন পোশাক পরনে, পায়ের স্যান্ডেলটাও সাধারণ। আগের বারের সেই উপচে পড়া আনন্দময় চেহারা খুঁজে পাই না।
পড়ন্ত দুপুরেও জায়গাটা বরাবরের মতো জমজমাট। দূরে ব্যানার টাঙ্গিয়ে একদল তিব্বতীরা যেন কি উদযাপন করছে। জায়গাটা দক্ষিণ এশিয়ান মানুষের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রস্থল।
আমি ভেবেছিলাম বানু তিব্বতীদের অনুষ্ঠান দেখছে। কিন্তু খেয়াল করলাম- ও ফুলের দোকানের দিকে তাকিয়ে আছে মনোযোগ দিয়ে। আমি ওকে হালকা জড়িয়ে ধরে গালে গাল মেলাই। হাত ধরে টেনে নিয়ে যাই ‘ইত্যাদি’ নামে পাশে বাঙালিদের এক রেস্টুরেন্টে। এক কাপ চা খাওয়ার জন্য তৃষ্ণার্ত আমি। চায়ের সঙ্গে সিঙ্গারা ও সমুচাও দিতে বলি। দুপুরে বাসায় যাওয়া হয়নি বলে খাবার আসার সঙ্গে আমি খেতে শুরু করি। বানু চুপচাপ বসে থাকে। ইশারায় বলে পরে খাবে।
‘স্যারোগেট’ কাকে বলে জান? হঠাৎ করে বানু আমার কাছে জানতে চায়। আমি ওর প্রশ্নে খুব বিস্ময় নিয়ে তাকাই।
‘অনেক সময় কোনো দম্পতি সন্তান না হলে অন্য কোনো নারীর গর্ভ ভাড়া নেয়। কৃত্রিম উপায়ে গর্ভধারণ করা হয়। কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন?’
‘আমি ছিলাম মোহাম্মদ যোবায়েরের সন্তানের স্যারোগেট মা।’ অনেকটা নিরাবেগ কণ্ঠে বলে বানু।
‘কিন্তু, স্যারোগেট মাকে তো কেউ বিয়ে করে শুনিনি। কারণ এখানে তো প্রাকৃতিক উপায়ে সন্তান ধারণ করে না মা।’
‘আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল। আমাকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলেছিল মোহাম্মদ যোবায়ের। তার মতো সুর্দশন কেউ আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে এটা ছিল আমার কল্পনার অধিক কিছু ছিল। আমার বয়স এখন পঁচিশ বছর। বিয়ের সময় ছিল বাইশ বছর। আমাকে মিথ্যা কথা দিয়ে ভুলিয়েছিল ও। অথচ সে বিবাহিত ছিল। স্ত্রীসহ কায়রো থেকে নিউইয়র্কে আসে ও। তাকে কোনো আত্মীয়ের বাসায় হয়ত রেখেছিল। তারপর ও আমাকে বিয়ে করে। ওকে দেখে আমার মা ও বোনও বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।’
‘বিয়ের কাগজপত্র তোমার সঙ্গে নেই?’ বানু লম্বা কথা বলে দম নেওয়াতে আমি জিজ্ঞাসা করি।
‘আমাদের বিয়ে হয়েছিল মুসলিম আইনে। এদেশের আইনে হয়নি। আমি ওকে বিশ্বাস করেছিলাম। বিশ্বাস করে না পড়ে কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছি। সেখানে স্যারোগেট মায়ের ব্যাপারে লেখা ছিল। আসলে আমার কল্পনা ত্রিসীমানায় ছিল না, আমাকে এভাবে প্রতারিত করবে ও। জান, আমার সন্তানকে বুকের দুধ পর্যন্ত খাওয়াতে পারিনি। তার আগে সে ওকে নিয়ে আমেরিকা থেকে মিশরে চলে যায়।’
জমজমাট রেস্টুরেন্টে বাংলার বাউল গান আর লোকজনের হৈচৈ শব্দের মধ্যেও আমরা দুটি মানুষ বিষণœ চেহারা নিয়ে বসে থাকি। ওর চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি নামে। এই বেদনা সন্তান হারানো নাকি ভালোবেসে প্রতারিত হওয়া- কোনো কারণে বেশি আমি বুঝতে পারি না। তবে ওর নীরব কান্না আমাকে আরো বেশি কষ্ট দেয়। মনে মনে ভাবি কী দরকার ছিল ওর কাহিনি শুনে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর।
ও কাঁদতে কাঁদত বলে, “তুমি কারা নেভাদায় দেখেছ নিহানকে কত ভালোবাসে কেমাল। নিহানের বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও সে অপেক্ষা করে থাকে। এমন ভালোবাসা শুধু সিনেমা-নাটকে থাকে। বাস্তবে হয়ত কারো জীবনে সামান্য কদিনের জন্য আসে, কিন্তু সারা জীবন তার স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়।”
মেয়েটার জন্য অসম্ভব মায়া হয়। এত কম বয়সে কি প্রচন্ড আঘাত সহ্য করতে হয়েছে ওকে। ‘আচ্ছা, ওই মানুষটার সঙ্গে তোমার এমন কোনো স্মৃতি নেই, যেটা এখনও তোমাকে একটু হলেও আনন্দ দেয়?’ আমি ওর হাতে হালকা চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করি।
ও টেবিল থেকে একটা টিস্যু নিয়ে চোখের পানি মোছে। তারপর গলা পরিষ্কার করে কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। একটু পরে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে, ‘জোবায়ের আমাকে বিয়ের দিন জিজ্ঞাসা করেছিল, তোমার প্রিয় ফুল কী? আমি বলেছিলাম- সাদা লিলি। ও বিয়ের দিন রাতে আমাদের বেডরুম সাদা লিলি দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিল। পরে যে দশ মাস ও আমার সঙ্গে ছিল প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমার জন্য সাদা লিলি নিয়ে আসতো। এখনো রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কোথাও সাদা লিলি দেখলে থেমে যাই। কাছে গিয়ে ফুলের গন্ধ নেই। যেন তাতে আমার জীবনের সেরা যে দশটি মাস ওর সঙ্গে কাটিয়েছিলাম, সে দিনগুলোর গন্ধ পাই।’
লেখক ও সাংবাদিক।
জন্ম ৯ মার্চ, বরিশালের পিরোজপুরে, নানাবাড়িতে। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের পুরো সময় কেটেছে পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। বিয়ের পরে দীর্ঘদিন থেকেছেন ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডে। দেশান্তরী জীবনে বাস করেছেন শুরুতে নিউইয়র্কর সিটির জ্যাকসন হাইটসে ও বর্তমানে এস্টোরিয়ায়। লেখকের লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে এসব স্থানের স্মৃতি। গেন্ডারিয়া মনিজা রহমান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পরে বেছে নেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার মতো নারীদের জন্য অপ্রচলিত এক পেশা। দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, দৈনিক জনকণ্ঠ ও দৈনিক মানবজমিনে। নিউইয়র্কে আসার পরেও নিজেকে যুক্ত রেখেছেন লেখালেখির সঙ্গে। প্রথম আলো উত্তরের নকশার বিভাগীয় সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন এস্টোরিয়ার একটি স্কুলে। গেন্ডারিয়া কিশলয় কচিকাঁচার আসর, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, কণ্ঠশীলন ও বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০০৮ সালে প্রথম বই প্রকাশিত হবার পরে এই পর্যন্ত তাঁর বইয়ের সংখ্যা তেরটি।
Related