Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: হারেম । অমিতাভ পাল

Reading Time: 4 minutes

১৩ অক্টোবর,২০২১ কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক অমিতাভ পাল পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন অন্যলোকে। ইরাবতী পরিবার এই স্বজন হারানোয় শোকাহত। এই গল্পটি উৎসব সংখ্যার জন্য লেখা অমিতাভ পালের শেষ গল্প।


 

তার মধ্যবিত্ত মনের গর্তে কখন কোন ফাঁক পেয়ে ঢুকে পড়েছে একটা নাছোড়বান্দা চিন্তা- জীবনে এক্সট্রাম্যারাইটাল সেক্স দরকার। চিন্তাটা তাকে জ্বালাচ্ছে, ভাবতে বাধ্য করছে, মনযোগ টেনে নিচ্ছে যেকোন সময়।

তার বিবাহিত জীবন মোটামুটি লম্বা। খুব গোপনে বিয়ের রাত থেকেই সে যৌনক্রিয়ার সংখ্যা লিখে রাখতো- সেটা হাজার পেরিয়ে গেছে বেশ আগেই। ফলে বিবাহিত জীবনকে পুরানো বলায় আর কোন অসুবিধা নাই। দৈহিক লজ্জা কিংবা আড়াল তাদের দাম্পত্যকে আর বিড়ম্বনায় ফেলে না। ছোট দুই শিশুর মতোই তাদের আর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপও নাই। কেবল ছেলেমেয়েরা কাছাকাছি থাকলে একটু সামলে চলতে হয়- এই আর কি। ওরা বাইরে গেলে ঢাকার এই গরমে তার বউতো শরীরে কোন কাপড়ই রাখতে চায় না। তবে সে এখনো লুঙ্গিটাকে সবটা খুলে ফেলতে পারেনি, ল্যা্ঙ্গটের মতো সেটা জড়িয়ে থাকে কোমরে।

এইরকম পরিস্থিতিতে বউয়ের শরীরের প্রতি তার আর কোন কৌতুহলই নেই। এখন তার বাইরের পৃথিবীর দিকে চোখ- যেখানে বিভিন্ন শারীরিক গড়নের বিভিন্ন মেয়েরা প্রজাপতির মতো উড়ছে আর ডাকছে তাকে। সেও সারাদিন মেয়েদের শরীরের টপোগ্রাফি মাপে ভূগোলবিদের মতো, নোট করে বন্ধুরতার মাত্রা। আর এইসব দেখতে দেখতে, নোটখাতায় জমাতে জমাতে সে এখন মেয়েদের শরীরের বন্ধুরতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছে। এখন পোশাকের ওপর দিয়েই একটা মেয়ের নগ্নতাকে সে স্পষ্ট দেখতে পায়- স্তন, নিতম্ব সবকিছু এসে তার সামনে যেন খুলে ধরে নিজেদের।

কিন্তু দেখে কি আর সবটা শান্তি মেলে? কমপক্ষে অংশগ্রহণ না থাকলে ইন্দ্রিয়ের জাদুঘরে জায়গা মেলে না বর্হিবিশ্বের। আকাঙ্খাও কিরকম যেন মনমরা হয়ে থাকে। বউকে দিয়েই এর উদাহরণটা দিতে পারে সে। বউয়ের নগ্নতারতো কিছুই আর তার কাছে অস্পষ্ট না, এমনকি যৌন সংসর্গ্ও নিজের বাসার গলির মতো চেনা- তারপরও মাঝেমাঝে কোন সকালে কিংবা দুপুরে বা রাতে যৌনতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এটা কোন প্রেম বা সম্পর্ক কিংবা অভ্যাস না- এটা তার নিজের শরীরের ক্ষুধা, ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠা একটা শিশুর কান্না।

এই শিশুটারই এখন এক্সট্রাম্যারাইটাল সেক্সের ক্ষুধা লেগেছে ঘুম ভাঙ্গার পরে। হয়তো তার বউয়েরও এই ক্ষুধা লাগে, হয়তো পৃথিবীর মেয়েদের প্রত্যেকটা প্রজাতির প্রত্যেক সদস্যের, হয়তো সব পুরুষের। আর এই ক্ষুধা তাকে অস্থির করে তুলছে একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা ঘোড়ার মতো। বুনো প্রান্তরের ডাক দড়িটাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে।

এইরকম সময়ে একদিন একটা মেয়েকে তার পছন্দ হলো। শরীরে, ব্যক্তিত্বে, কথাবার্তায় মেয়েটা বেশ। এর সাথে শুতে পারলে মন, শরীর- সব একেবারে ভরে যাবে। ক্ষুধা আর কথা বলারই কোন সুযোগ পাবে না। এখন মেয়েটার সাথে পরিচিত হওয়া দরকার। নিজের ইচ্ছার কথা তাকে জানানো দরকার। কিন্তু মেয়েটা যদি পতিব্রতা হয়? সে ঠিক করলো, একটা টোকা দিয়ে দেখতে হবে দরজা খোলে কিনা। কিংবা জানালার একটা পাল্লা।

সেইদিন থেকেই সে লেগে পড়লো দরজায় টোকা দেয়ার কাজে। এখন সে একটু পরপর দরজায় টোকা দেয় আর কান পেতে থাকে দরজার ওই পারে এগিয়ে আসতে থাকা কোন পায়ের শব্দ শুনতে। কিন্তু শব্দ যেন বোবা হয়ে গেছে।

তারপর একদিন একটা অস্পষ্ট শব্দ ভেসে এলো তার কানে। কিসের শব্দ- ঠিক বোঝাও যায় না আবার উপেক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে মধ্যপন্থা- অর্থাৎ ধৈর্যকেই সে করে তুললো তার অবলম্বন এবং অপেক্ষা করতে থাকলো। আর কিছু না হোক, সবুরে মেওয়া ফলার পরীক্ষাটা তো হয়ে যাবে। তার নিজেরও ধৈর্যের গড় আয়ূ মেপে ফেলতে পারবে এই সুযোগে।

ওই যে আবার শব্দটা শোনা যাচ্ছে- মনে হলো তার। এবার সে দরজাটার খুব কাছে গিয়ে কান পাতলো শব্দটাকে অনুবাদ করার জন্য। বিদেশি সিনেমার ভাষা বোঝার মতো উৎকর্ণ হলো সে। বুঝতে চাইলো শব্দটার ইতহাস, বিবর্তন, প্রতিধ্বনি- সব। কিন্তু এবারও শব্দটা অস্পষ্টই থেকে গেল, অধরা পাখির মতো উড়ে হারিয়ে গেল। অবশ্য এতে সে হতাশ হলো না। ধৈর্যের পরীক্ষায় এত তাড়াতাড়ি কি রণে ভঙ্গ দেয়া যায়? ফলে সে আত্মনিয়োগ করলো টোকা দিয়েই দরজায় কান পাতার কাজে।

এইবার অবশ্য অপেক্ষাটা দীর্ঘতর হলো না। তার একটা টোকার পরেই দরজার ওপাশ থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে উঠলো- কি চাই? ভীরু, অস্ফুট ওই বাক্যটা যেন তার হাতে তুলে দিল দরজা খোলার চাবি। আর সেই চাবি দিয়ে দরজাটা খুলেই সে দেখলো মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে চকিতে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে তারপর মাথাটা নীচু করে।

সেইদিন থেকে মেয়েটার সাথে একটা গোপন পৃথিবীতে সে যায়, কথা বলে, জানায় তার ক্ষুধার কথা। মেয়েটাও সব শোনে, কথা বলে, কিন্তু ক্ষুধার কথা উঠলেই কেমন যেন ঋণাত্বক হয়ে পড়ে। দোহাই দেয়, বিভিন্ন অযুহাত জোগাড় করে আনে, তার কাছ থেকে একটু সরে দাঁড়ায়। একটা প্রতীকি দূরত্ব তৈরি করে যেন- হাত বাড়ালে ধরা যাবে, কিন্তু হাতটা বাড়াতে হবে ওই দূরত্বটা পার হতে চাইলে। অথচ সে চায় মেয়েটা তার কাছে আসুক, ঘনিষ্ট হোক, বলুক- তারও ক্ষুধা আছে, ইচ্ছা আছে, আগ্রহ আছে। এই দলিলটুকু থাকলে অন্তত ধর্ষণের অভিযোগ চাপবে না তার ঘাড়ে। এই অভিযোগটাকে বড় ভয় পায় সে।

এভাবেই দিন কাটছিল আর একঘেঁয়ে হচ্ছিল গোপন পৃথিবী, কথার নহর এবং ক্ষুধার অনুভূতি। এইসময়ই একদিন হঠাৎ তার মনে হলো মেয়েরাতো সব কথা বলে না বরং ইশারার ভাষা তাদের হয়ে দোভাষীর কাজ করে। বউকেও সে দেখেছে বহুবার এই দোভাষীর সাহায্য নিতে। অথচ এই ব্যাপারটাই সে খেয়ালই করেনি এতদিন। কথাটা মনে আসতেই সে মনযোগী হলো মেয়েটার আচরণের দিকে। দেখলো- সব কথাই বলে ফেলেছে মেয়েটা। এখন শুধু হাত বাড়াতে হবে- তাহলেই আলিঙ্গন, চুমু, নগ্ন ঘনিষ্টতা, এক্সট্রা ম্যারাইটাল সেক্স।

গোপন পৃথিবী থেকে বেরিয়ে সে লাফিয়ে লাফিয়ে বাসায় ফিরলো সেদিন। তারপর সারাক্ষণ ভাবলো প্রথম উন্মোচনের খুঁটিনাটিগুলিকে নিয়ে। কিভাবে ব্যাপারটা শুরু হবে, কিভাবে সবকিছু এগোবে, কিভাবে সবকিছুর স্বাদ নিতে নিতে নিজেকে রিক্ত করে ফেলবে- সবকিছুই সে ছকে ফেললো সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্যের মতো। এবার শুটিংপর্ব। বউও কয়েকদিনের জন্য ভাইয়ের বাড়ি যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। বাসাটাই হবে তার এক্সট্রাম্যারাইটাল সেক্সের সেট। অন্য কোন বাসার সেট ভাড়া করার ঝামেলাও এতে থাকছে না। সবকিছু মিলিয়ে খুব নির্ভার লাগছে ব্যাপারটা। 

২.

বউ চলে গেছে। আজ অফিসেরও ছুটি। আজই মেয়েটাকে তার বাসায় নিয়ে আসবে। এইরকম একটা আভাসও সে দিয়েছে গতকাল। ইশারা দোভাষীর মাধ্যমে মেয়েটাও জানিয়েছে, সে আসবে। সকাল থেকেই একটা উত্তেজনা কাজ করছে তার মনে। এরমধ্যেই বারদুয়েক স্নান করে পরিচ্ছন্নতার শেষপর্যন্ত গিয়েছে সে। মেয়েটাকে সে বলেছে তাদের পাড়ার বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসতে। তারপর সে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে আসবে। তবে একটু সাবধানে আনতে হবে। পাড়ার লোকজন এবং বাড়িওয়ালাকে বুঝতে দেয়া যাবে না। হাসতে হাসতে, কথা বলতে বলতে অফিস কলিগের মতো খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আসতে হবে। ভাব করতে হবে যেন অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে দুজনকে। অবশ্য একটা সুবিধা তার আছে- এর আগে কখনোই কোন মেয়েকে সে বাসায় আনেনি। ফলে ফাঁকিবাজিটা মানিয়ে যাবে।

ঠিক তখনি একটা অন্য ভাবনা ঢুকে পড়লো তার মাথায়। আচ্ছা- সবাইকে নাহয় ফাঁকি দেয়া গেল কিন্তু বাসার বিছানাকে, টেবিল চেয়ারগুলিকে, ড্রেসিং টেবিলটাকে, দরজা জানালাগুলিকে সে ফাঁকি দেবে কিভাবে? এরা সবাইতো হা করে দেখবে তার সমুদয় কাজকর্ম। এরা যদি সবকথা বউকে জানিয়ে দেয়? তার প্রায় বুড়িয়ে যাওয়া বউটা তখন কি করবে? তারতো কোথাও যাবারও জায়গা নেই। আর সে থাকার পরও অন্যকোন মেয়ের সাথে শোয়াটা কি তার জন্য অপমানের হবে না? বউ যদি তাকে বাসায় রেখে অন্য কারো সাথে গিয়ে শুয়ে আসে, সেইই কি সহ্য করতে পারবে?

ভাবনাটা তাকে ডুবিয়ে রাখলো এমন নৈতিক দুঃশ্চিন্তার মধ্যে যে, মেয়েটার বাসস্ট্যান্ডে আসার সময় কখন যে পেরিয়ে গেল, সে টেরই পেলো না। কয়েকবার তার ফোনও বেজেছে কিন্তু দুঃশ্চিন্তায় বধির তার কর্ণকূহরে রিঙের শব্দ ঢোকার সাহসই পায়নি। ফলে তার যাওয়া হয়নি বাসস্ট্যান্ডে, মেয়েটাকে রিসিভ করা হয়নি এবং বাসাটা ফাঁকাই থেকে গেছে।

৩.

আজকাল সে এক্সট্রাম্যারাইটাল সেক্সের স্বাদ মেটাচ্ছে যেসব মেয়েকে তার ভালো লাগে- বউকে সেসব মেয়ে ভেবে যৌনক্রিয়া করে।

এখন তার বউয়ের শরীরই তার হারেম।

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>