| 27 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: আড়বাঁশি অথবা রাতপরীর গল্প  । গৌতম বিশ্বাস 

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

   দুধসাদা জোঁছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। চরাচর বলতে গাঁয়ের মাঠ,ধানখেত,গাছপালা, আকাশ,আর বাড়িগুলো। শুনসান চারিদিকে। গাছের পাতায় কেবল যেটুকু বাতাসের নাড়া দেওয়ার আওয়াজ। ঘুম নেমেছে লক্ষ চোখে। একমাত্র সে ই জেগে আছে কেবল। পূব মুখো ঘরের দাওয়ায় বসে চেয়ে আছে মাঠটার দিকে।জোঁছনায় ভেসে যাওয়া চরাচর অমোঘ আকর্ষনে ডেকে চললেও তার দুটো চোখ কেবল খুঁজে চলেছে তাকে।আকাশটার থেকে নেমে এসে কখন ডাক দিয়ে যাবে- সেই অপেক্ষায় বসে আছে।অগত্যা যেন ভরে গেল আলোর বন্যায়। আকাশ থেকে ডানা মেলে নেমে এলো সেই কাঙ্খিত স্বপ্নের রাতপরী। মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর দাওয়া থেকে নেমে এসে হেঁটে চললো মাঠের দিকে।মিষ্টি একটা সুবাস ছড়ানো মাঠ জুড়ে কেবল আলোর নাচন।পরী হাঁটছে।পেছনে সে হাঁটছে। দূরত্বটা এই বুঝি কমে এলো।মুহূর্তেই বেড়ে গেল ফের।ফের কমলো। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেল সে।আর তক্ষুনি ভেঙ্গে গেল ঘুমটা।

   শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে আজ। কথায় বলে মাঘের শীত বাঘের গায়।বাঘের গায়ে সত্যিই যে লাগে কিনা তা পরান জানে না। কিন্তু তার নিজের গায়ে যে বেশ লাগে সেটা সে জানে।অথচ ওই জানা ই সার। নিস্তার পাওয়ার খুব বেশি উপায় তার জানা নেই। রাত জেগে যার আয় –  লেপ, কম্বল মুড়ি দিয়ে সে তো আর শুয়ে থাকতে পারে না। চাদ্দিকে রস চোরের যা উৎপাত তাতে পাহারা দিয়ে না রাখলে ভোরবেলা ফাঁকা হাঁড়ি গুলো ই কেবল নামাতে হবে গাছ থেকে।এত খেটেখুটে রোজগারের ধন যদি চোরেতেই সাবড়ে দেয় তো তার নিজের জন্যে আর পড়ে থাকে কী? মালিকও কী আর পরের বছর থেকে গাছ গুলো দেবে? আর তা যদি না দেয় পরানের সংসার চলবে কেমন করে?

   অবশ্য কেউ বলতেই পারে ওর আবার সংসার কী? হ্যাঁ,একা মানুষ পরান।মা টা ছিল, তাও বছর দুই হল স্বর্গে গেছে।চ থালা ভাত এনে সামনে দিত। তেষ্টায় গলা টা ফাটা ফাটা হয়ে এলে জলের গেলাস এগিয়ে দিত।হাঁসফাঁস গরমে মাঠ থেকে ফিরে এসে দাওয়ায় বসতে না বসতে তালপাখা নেড়ে হাওয়া করতো। আরও যে কত সব করতো কে জানে। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেও পারতো ঘর উঠোন।

   এ সব ভাবতে গেলেই একটা কষ্ট ঠেলে ওঠে বুকের ভেতর। আর তখনই আড়বাঁশিটা নিয়ে বসে পরান।ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে সুর তোলে। লোকে বলে হারান মন্ডল ছিল জাত বাঁশুড়ে।বাঁশি বাজিয়ে কত সব ভালো ভালো মানুষের কাছ থেকে বাহবা পেয়েছে মানুষটা।তো তেমন মানুষের সন্তান পরান।বাপের গুন এক আধটু তো ভেতরে থাকবেই। তো বাঁশি বাজায় পরান।কষ্ট পেলেই আড়বাঁশিটা তুলে নিয়ে তাতে সুর তোলে। এমবই সে সুর যে নিজের ভেতরটাও জুড়িয়ে যায়। দিনমানে কাজের চাপে সময় হয় না পরানের। কিন্তু রাতের বেলায় তার অফুরন্ত সময়। একলাটি থাকলেই বাড়িটাকে মনে হয় বিরাট এক শূন্যতার গোলক দিয়ে ঘেরা। এক সাগর আয়তন নিয়ে দিনের পর দিন স্থির হয়ে আছে গোলকটা। এই গোলক ছেড়ে বেরিয়ে আসতে এখন বড়ো ইচ্ছে হয় পরানের। মনে হয় আর একজনা কেউ পাশে থাকলে বড়ো ভালো হত। আর সেই একজনা যদি হত তার একান্তই কাছের বিয়ে করা বৌ।

   বৌয়ের কথা ভাবলেই ভেতর থেকে ঠেলা মারে কষ্টটা। লক্ষ কোটি সূচ ফোটার যন্ত্রণা অনুভব হয়। কিংবা যেন জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যেতে চায় ভেতরটা। তার থেকে নিস্তার পেতে তুলে নেয় আড়বাঁশি।মুখে দিয়ে সুর তোলে।ঘরের দাওয়া থেকে নেমে উঠোন পেরিয়ে সেই সুর ছুটে যায় পূব পাশের ফাঁকা মেঠো প্রান্তরে। হয়তোবা তারও ওপাশে যে গ্রামটা রয়েছে তারই কোনও বাড়ির মাটির দাওয়ায়। হয়তো কোনও অন্য হৃদয়ে গিয়ে আঘাত হানে সেই সুর।পরান বাজিয়ে চলে। এদিকে রাত্রি বাড়ে। বড়ো বেশি নির্জন হয়ে আসে চারপাশ।গাছের পাতায় বাতাসের নাড়া দেওয়ার শব্দ ওঠে।নিঃস্তব্ধ হয়ে আসে ঝিঁঝিঁর ডাক।পৃথিবীর নিঃশ্বাস পড়ে।একটু একটু করে ছোট হয় শূন্যতার গোলক।ভেতরের জ্বলুনি শান্ত হয়। আড়বাঁশিটা চালের বাতায় গুঁজে শুতে যায় পরান।  

পরানের কষ্টটা একা হরিমতী ই বোঝে।হরিমতী বৃদ্ধা।আশির ওপরে বয়স।মাথায় শনের মত একগোছা চুল।চোয়াল ভাঙা।শরীরটা সামনের দিকে বেঁকে গেছে অনেকখানি।হাড়ের কাঠামো চামড়া টেনে যেন জোর করে ঢেকে রাখা আছে। এক একদিন দুপুর বেলায় পরানের দাওয়ায় এসে বসে হরিমতী।বলে,” তুই বাপ ইবার একখান বে’ কর দিনি।কত কাল আর একা একা থাকপি?”
পরান হাসে।
হরিমতী বলে,” হাসিস ক্যান?যেডা কই সেডা শোন।”
পরান বলে,” আমারে নে তোমার দেহি বড়ো চিন্তে।”
“হবে না?ওরে সেই জম্ম থ্যিকে দেকচি তোরে।কত কোলে পিঠি নিচি এডা ওডা খাওয়াইচি।তুই বে’ না করে একা একা থাকপি আর আমি…”
এবার আর হাসে না পরান। ভেতরে ভেতরে সিরিয়াস হয়। বলে, “বে’ কত্তি আমারও যে ইচ্ছে হয় জেঠি।কিন্তুক…”
“আবার কিন্তুক কী? বয়াস কী তোর কম হল রে?সেই য্যিবার বান আলো।বানের জলে ভাসায়ে নে গেল সপ।চারদিকি কেবল জলের রাজত্বি।কত মানষে ঘর ছাড়লো।কত গোরু ছাগল মলো।স্যিবার জম্ম হল তোর।সেকি আজগের কথা।দু কুড়ি বয়াস হল তোর। “
   “কিন্তুক জেঠি যার জন্যি বে ‘ করবো সেই মা ইতো –  “
   “ওরে পোড়ার মুখো বে কেউ পরের জন্যি করে না।করে নিজির জন্যি।নিজির একখান সোংসারের জন্যি।”
   “নিজির সোংসার কী আমার নাই? “
  “খালি ঘর থাকলিই সোংসার হয়না রে। ঘরণীও থাকতি হয়। তোর ঘর আছে।কিন্তুক ঘরণী নাই। তুই পুষ্যি মানুষ। সারাদিন খাটা খাটনি করে মাঠ থ্যিকে ফিরে যহন জিরেন দিবি, তহন সে জল এগোয়ে দেবে। পাঙ্খা দে হাওয়া দেবে। রাত্তির বেলা বুকির মধ্যি নে’-  ওরে মেইয়েগের বুকির মধ্যি বড়ো একখান সমুদ্দুর লুকোন্
আছে। সেই সমুদ্দুরি ডুব না দিলি বুঝবি ক্যামনে কত সুখ স্যিখানে?” বুড়ি হরিমতী আরও কত কিছু বলে যায়।পরানের কানে আর কিছুই পৌঁছোয় না। সে পরিস্কার দেখতে পায় আদিগন্ত বিস্তৃত সীমাহীন এক জলাশয়।কত বড়ো বড়ো ঢেউ। ঢেউয়ের মাথায় লাল, নীল হরেক রঙের স্বপ্ন। সেখানে ডুব দিয়ে চলে যায় কোন অতল গহীনে। সেখানে আলাদা একটা জগৎ। অন্য রকমের সব ভালোলাগা। যে রাতপরীর স্বপ্ন ঘুরে ফিরে আসে রোজ রাতে, সেই রাতপরীর দেখাও সে পায় সেখানে। রাতপরী তাকে ইশারায় ডাকে। দু হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে চায় পরানকে।   

আর ঠিক তক্ষুনি ভাবনার ঘোরটা কেটে যায় হরিমতীর ডাকে,” ওরে ও পরান, কী অ্যাতো ভাবচিস রে?”
পরান বলে,” ভাবছি সমুদ্দুরির কথা। বড়ো একখান সমুদ্দুর। কত জল। আর নিচেয় কী সোন্দর এট্টা জগৎ।” “অমন একখান জগৎ তোর জন্যিও পিতিক্ষে করে আছে।তুই বে ‘ কর পরান।জগৎডারে নেড়্যে চেড়্যে দ্যাক।”   

পরানের ইচ্ছে হয়। এক এক সময় ভীষণ রকমের ইচ্ছে হয় একটা বিয়ে করার। কিন্তু কাউকে মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারে না। আর তাই ভিতরের কষ্টটা মাঝে মধ্যে তীব্র ভাবে নাড়া দেয়। অগত্যা রাতপরীর স্বপ্নে বিভোর হয় সে। মুখে আড়বাঁশি নিয়ে সুর তোলে। যদি কোনওদিন ওই বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে আপনা থেকে এসে রাতপরী ধরা দেয়।  

এমনিতেই অনেকটা রাত করে শুতে যায় পরান। সারাদিনের খাটা খাটনির শরীরটা নিয়ে রাতের বেলায় যখন মাটির দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে, তখন যেন আপনা থেকেই আড়বাঁশিটা উঠে আসে হাতে।ঠোঁটের সামনে ধরতেই উঠে আসে মোহময়ী সুর। সে সুরের জাদু মূর্ছনায় বিভোর হয় পরান। ওই বাঁশির সুরে হয়তো আকাশ থেকে সত্যি সত্যিই নেমে আসে তার স্বপ্নের রাতপরী, যার বুকের মধ্যে লুকিয়ে আছে বিরাট এক সমুদ্দুর। সমুদ্দুরির তলায় এক অন্য জগৎ। তবে ইদানিং কাজের জন্যেই বেশি বেশি করে রাত জাগতে হয় তার। সারা বছর অন্যের জমিতে জন খাটলেও তার প্রথম পরিচয় সে ‘গাছি’।  

খেঁজুরগাছ কেটে সে রস বের করে। অঘ্রাণে পড়তেই তার ব্যস্ততা বাড়ে।খেঁজুরগাছের মাথার এক পাশের ডেগো কেটে পরিস্কার করে চেঁছে নুলি বসায়। নুলির দুই পাশে দুটো কাঠি গুঁজে ‘ঠিলে’ বসিয়ে রস নামায়। এ কাজ চলে তার চৈত্রের শুরু পর্যন্ত। এই ক মাস দিন রাত তার কাজ।দুপুরের পর থেকে শুরু হয় গাছে ‘ঠিলে’ বসানো। চাদ্দিকে রস চোরের উপদ্রব। রাতে তাই অনেকটা সময় পর্যন্ত জেগে পাহারা দিতে হয়। মাঝ রাত গড়িয়ে যা একটু ঘুমিয়ে নিতে পারে। শেষ রাত পড়লেই আবার উঠে পড়তে হয়। সকাল হতে না হতে সব গুলো গাছ থেকে রস নামানো শেষ না করলে রসে ‘গাঁজলা’ উঠে  ‘তাড়ি’ হয়ে যায়। সে রসে ভালো গুড় হয় না। মালিকের মুখ গোমড়া হয়। সেই গোমড়া মুখের ছায়া পড়ে পরানের মুখে। মুখ থেকে বুক। বুক থেকে বুঝি অন্য কোথাও।

কাল গোটা পঞ্চাশেক গাছে হাঁড়ি বসিয়েছিল পরান। দিগম্বর বিশ্বাসের শ’ দেড়েক গাছ পালা করে কাটতে গিয়ে প্রতিদিনই দুই বেলা গাছে চড়তে হয় পরান কে।ঠিকমত রস নামলে মনটা শরীরের কষ্টটাকে ভুলিয়ে দেয়।আর তা না হলে…

এখন মাঘের মাঝামাঝি। রসের ভরা মরশুম।শীতের বেলা কাত না হতেই যেন সন্ধে নামে। সে জন্যে দুপুর হতেই বেরিয়ে পড়ে সে। দিগম্বর বিশ্বাসের বাড়ির পূর্ব দিকে ফাঁকা মাঠ। অবশ্য ঠিক ফাঁকা বলা যায় না। সারি সারি ফসলের খেত জুড়ে সর্ষে কলাইয়ের রাজত্ব। খেতের আল বরাবর গাছ। বিভিন্ন বয়স আর আকারের গাছ খাড়া হয়ে উঠে গেছে খেত ছাড়িয়ে। ফলে ফসল নষ্টের ভয় নেই।উপরি পাওনা সারা শীতকাল জুড়ে হাঁড়ি হাঁড়ি রস। রস জ্বাল দেওয়ার লোক রাখা আছে দিগম্বর বিশ্বাসের। রস জ্বালিয়ে গুড় করে চালান দেয় নটেখালির হাটে।ফি রোববার হাট।হাটে হাটে দশ বিশ হাঁড়ি গুড়।ঝোলা পাঞ্জাবির পকেটহ ভর্তি টাকা।টাকা নিয়ে সন্ধেবেলায়  বাড়ি ফেরেন দিগম্বর বিশ্বাস।পরান তখন হয়তো শেষ গাছটায় উঠে ‘ ঠিলে ‘ ঝোলাচ্ছে।বিশ্বাস মশাই হাঁক ছাড়েন, ” কীরে,ঠিকঠাক কাটলি তো? “
   গাছে বসেই জবাব দেয় পরান, ” কি কথা যে কও জ্যাডা।গাছে উঠে কোনও গাছি বে ঠিক  কাটে নেকি? “
   ” সে তুই ই ভালো জানিস।ঠিকঠাক কাট।রস বেশি নামলে তোরও দু পয়সা বেশি আসে।আর আমারও বাড়তি কিছু হয়।”
   ” ইজ্ঞে তা আমি ভালোই জানি।”
   ” তুই জানবিনে তো কে জানবে।তোকে বিশ্বাস করি বলেই তো ফি বছর গাছগুলো তোকেই দিই।হাবু,অনাদী,গনশারা বছর বছর চেয়েই যায়।তোর কথা ভেবেই তো খালি হাতে ফেরাই ওদের।”
   গাছের রস বেরোনোর জায়গায় ধারালো দা এর পোঁচ দিতে দিতে নিঃশব্দে কেবল হাসে পরান।নুলি বেয়ে গড়িয়ে পড়া রসের ফোটা টুপ টুপ করে পায়ের উপর ঝরে পড়ে। ভিজে পায়ে একটা আঠালো অনুভূতি জাগে তার।নিচ থেকে ফের দিগম্বর বিশ্বাস জিজ্ঞেস করেন,” আজ কটা গাছে ঠিলে বসালি? “
   ” ইজ্ঞে পঞ্চাশ ডা।”
   ” বাঃ,বেশ।তা আর কতক্ষণ লাগবে তোর? “
   ” এডাই শ্যাষ।”
   ” আচ্ছা। “
     আর কথা বাড়ান না বিশ্বাস মশাই।তিনি তখন আগামীকাল ক ‘ হাঁড়ি রস নামতে পারে,তা থেকে কতটুকু গুড় হবে,আর গুড় বেচে ক টাকা আসবে –  সে হিসাব করতেই ব্যস্ত।
   ক্লান্ত আর ধ্বস্ত শরীরটাকে নিয়ে এক সময় গাছ থেকে নামে পরান।চাদ্দিকে ততক্ষণে দিনের আলো মুছে গিয়ে সন্ধে নামতে শুরু করেছে।উত্তরের হাওয়ার গতি যেন আরও একটু জোরালো।হাড় মাংসে কামড় বসায় শীত।তবুও ভেতরে ঘাম ঝরে।পেটের ভেতর খিদের উৎপাত শুরু হয়।
   সন্ধে উতরে বাড়ি ফিরে উনুনে হাঁড়ি চড়ায় পরান।আ্যানামেলের হাঁড়িতে চাল ফুটে ভাত হতে পেটের ভেতর জড়িয়ে আসে হিজিবিজি চিন্তার জট।দুই কানে ঝিঁঝিঁ পোকা চেঁচামেচি শুরু করে।
   ভাত হয়ে গেলে আলু,বেগুন সেদ্ধ দিয়ে মেখে এক পেট খেয়ে নেয়।তারপর দরজার ঝাঁপ টাকে ভালো করে টেনে দিয়ে আড়বাঁশিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পরান।অনেকটা রাত পর্যন্ত প্রতিদিনের কাটা গাছগুলোর কাছ দিয়ে ঘুরে বেড়ায়।রস চোরেরা সরে যায় তাকে দেখে।কিংবা হয়তো আসেই না।একলা জেগে থাকতে থাকতে চোখ দুটো এক সময় বিদ্রোহ করে।মাথার ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আরও তীব্র হয়।উত্তুরে হাওয়ায় বাড়তে থাকে শীতের প্রকোপ।সর্ষে কলাইয়ের খেতে ঝাঁকে ঝাঁকে নামতে শুরু করে রাতের কুয়াশা।পায়ের পাতা ভিজে যায় শিশিরে।দু চোখ থেকে ঘুম তাড়াতে তখনই মুখে আড়বাঁশি তুলে নেয় পরান।সুর তোলে।রাতপরী নামানোর সুর।রাতপরী নামেও হয়তো বা।তবে রাতের আঁধার আর মাঘের কুয়াশা আড়াল হয়ে দাঁড়ায় পরানের সামনে।পরানের ইতস্তত দৃষ্টি তবু খুঁজে বেড়ায় তাকে।স্বপ্নে দেখা সেই রাতপরী।যার মুখে হাসি।হাসিতে ইশারা।
   কিন্তু কাল রাতে যে কী হয়েছিলো। একটুতেই হাঁপিয়ে উঠেছিল পরান।বাঁশিটা বড্ড বেসুরো বাজছিলো।দুইচোখ জুড়ে আসছিলো রাজ্যের ঘুম।হাজার চেষ্টা করেও যখন ঘুমটা তাড়াতে পারলো না,তখনই ফিরে এসেছিলো বাড়ি।আর ঘুমিয়েও পড়েছিলো সকাল সকাল।ফলে যা হওয়ার তাই হল।শেষ রাতে রস নামাতে গিয়ে দ্যাখে বেবাক গাছ খালি।হাঁড়ির তলানিতে বাটি টাক পড়ে আছে।তার মানে মাঝ রাত্তিরেই – 
   চোর বোধকরি অপেক্ষাতেই ছিল।পরান বাড়িমুখো হতেই –
   ফাঁকা হাঁড়ি দেখে বেজায় খেপে গিয়েছিলেন দিগম্বর বিশ্বাস, ” এতই যদি তোর ঘুম পায়,গাছগুলো ছেড়ে দে না।আর কাউকে দিয়ে কাটাই।ভাত ছড়ালে কী কাকের অভাব? বলি গাছির কী চাদ্দিকে এতই আকাল পড়েছে যে তোকে দিয়ে না কাটালেই আমার হবে না?”
   মিনমিনিয়ে পরান বলেছিল, ” না মানে জ্যাডা কালকে শরীলডা  –  “
   ” শরীর কী কেবল তোর একার আছে? হাবু,অনাদী,গনশার নেই? তাও বুঝতাম ঘরে যদি বৌ থাকতো।তাও তো  –  “
   ” আর অমন হবে না জ্যাডা।এবারকার মতন ক্ষেমা করে দেও।”
   ক্ষমা না করলেও চুপ করে গিয়েছিলেন দিগম্বর বিশ্বাস। উঠোনের রোদে চেয়ার নিয়ে বসে রাগে গজ গজ করছিলেন।পঞ্চাশটা গাছে সাকুল্যে নেমেছিলো পাঁচ হাঁড়ি রস।তার থেকে আর ভাগ নেয়নি পরান।সবটাই দিয়ে দিয়েছিলো মালিককে। কিন্তু আর না।ঢের শিক্ষে হয়েছে তার।শালা ঘুম যদি আঠা হয়ে দু চোখে লেপেও বসে,যে করেই হোক তাকে তাড়াবে পরান।দরকার হলে বড়ো খেঁজুর গাছটার গায়ে ঠুকিয়েই দেবে মাথাটা।তবু ঘুম ‘ নৈব নৈব চ ‘।
   আর তাই সন্ধে উতরে পেটে কোনও মতে চাট্টি দিয়ে চালের বাতা থেকে আড়বাঁশিটা নামিয়ে নিয়ে হাঁটা দিল সে।গোটা সাতেক বাড়ি পেরোলেই দিগম্বর বিশ্বাসের বাড়ি।পূর্ব দিকে রান্নাঘর। সেখান থেকে মাংসের সুঘ্রান উঠে আসছে। কতদিন মাংস খায় না পরান।মাথার ভেতরে কেমন একটা করে উঠলো।একটু ঝোল পেলে এখনও পাঁচ হাতা ভাত সে খেতে পারে।
   রাত্রি এদিকে দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে।এমনিতেই শীতের রাত।তার ওপর আজ আবার য ঠান্ডা পড়েছে।ভীষন কাজের চাপ যার সেও বোধ করি লেপ কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। আর যে শোয়নি সেও শীতের পোশাকে সারা শরীর মুড়ে এমনি গুটিশুটি মেরে ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে আছে যে বেরোলেই যেন ‘ খপাৎ ‘ করে গিলে নেবে কেউ।গাঁ – গেরামে সন্ধে হতে না হতেই রাত্রি নামে। আবার সে যদি হয় পোষ মাঘের সময় তো কথাই নেই।সারাদিন খেটেখুটে হয়রান মানুষগুলো সন্ধে হতেই ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় নিয়ে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়।আঠালো আঁধারটা দ্রুত দখল নিয়ে নেয় চারপাশের।সেই ভৌতিক আঁধারে ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর মাথায় মাথায় ঝাঁক বাঁধে জোনাকির দল।তাদের ওই সামান্য আলোকেও তখন অনেক মনে হয়।
   এমনটাই এখন মনে হচ্ছে পরানের। কত জোনাকি চারপাশে।আলো বলতে যেটুকু তা ওদেরই।যদিও দু চারটি বাড়িতে এখনও আলো জ্বলছে,তবে সারা গ্রামের প্রেক্ষিতে তা সামান্যই।আর একটু পরে নিভে যাবে ও গুলোও। কিন্তু আধখানা চাঁদ ততক্ষণে উঠে আসবে।পূবের আকাশে তারই স্পষ্ট ইশারা। অবশ্য ততক্ষণে কুয়াশারা দখল নিয়ে নেবে চারপাশের।আঁধারে তবু খানিক দূরে দৃষ্টি চলে।কুয়াশায় ওটুকুও চলবে না।একটা সাদাটে পর্দা আড়াল হয়ে দাঁড়াবে চোখের সামনে।চোখেমুখে ঝাপটা মারবে উত্তরের ভিজে বাতাস।
   রাস্তা থেকে মাঠে নেমে পড়লো পরান।সাত বিঘের সর্ষে খেত দিগম্বর বিশ্বাসের। ফুল ঝরার সময় হয়ে এলো।গাছগুলোর গা থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ উঠে আসছে।দিনের বেলাতেও গন্ধটা থাকে।তবে রাত্তিরে আরও বেশি মনে হয়।
   খেতের আল দিয়ে একটু ফাঁকে ফাঁকে খেঁজুর গাছ।বিভিন্ন বয়স।বিভিন্ন আকৃতি। কেউ সোজা হয়ে উঠে গেছে আকাশে।  তো কেউ কোনও দিকে বাঁক নিয়েছে।কত বছর ধরে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। বয়সে একটু নবীন যারা,তারা অনেকটাই সতেজ।রসও দেয় তারাই বেশি।ওদেরকে একটু বেশিই ভালোবাসে পরান।মাঝেমধ্যে গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়।বলে, ” বেশি বেশি করে রস দে বাপ।মালিকির মুহে হাসি ফুটুক।রোজগার পাতি বাড়ুক আমারও।”
   তা বলে বেশি বয়সের গাছগুলোকেও সে পর মনে করে না।যতই হোক তার বাপের আমল থেকে রস দিয়ে আসছে ওরা।ওদের দিকে তাকালে আজও যেন বাপের মুখটা ভেসে ওঠে কোথাও।যেমনি বাঁশুড়ে,তেমনি রস নামাতে পারতো গাছ থেকে।এ তল্লাটে গাছি হিসেবে বেশ নাম ডাক ছিল মানুষটার।বয়েস হয়ে গেলেও গাছগুলোর প্রতি এক অন্য রকমের মমতা আছে পরানের।সারাটা শীত তো এদের সঙ্গেই কাটে।
   সবগুলো গাছের কাছ থেকে একবার ঘুরে আসতে আসতে খানিকটা সময় কেটে গেল পরানের।আকাশের তারাগুলো কুয়াশায় ঢাকতে শুরু করেছে।পূর্বদিকে আধখানা চাঁদ উঠে আসায় আঁধার এখন অনেকটাই ফিকে।
   একঝাঁক শেয়াল খানিক দূরে ডেকে উঠতেই গাঁয়ের কুকুরগুলো ডাকতে শুরু করেছিল।এখন থেমে গেছে ওরা।চারিদিকে নিস্তব্ধ। দিনের বেলায় যাদের জন্য মুখর হয়ে থাকে গ্রাম,তারা ঘুমিয়ে পড়তেই কেমন নির্জন হয়ে এসেছে চারপাশ।এই নৈঃশব্দ্য গা সওয়া পরানের।কত রাত এমনি করেই কেটে গেছে তার।আরও যাবে হয়তো অনেকদিন।কিন্তু তবুও এই নির্জনতা ভালো লাগে না।কেউ একজনের কথা যেন বড়ো বেশি করে মনে পড়ে।আজকের নির্জনতাও নাড়া দিয়ে গেল ভেতরটা।অমনি আড়বাঁশিটা মুখে তুলে সুর তুললো পরান।তারপর কেবল হেঁটে চললো আলপথ ধরে।
   হাঁটতে হাঁটতে কখন একটা ঘোরে পেয়ে বসলো পরান কে।এই ঘোরটাই তাকে জাগিয়ে রাখে অনেক রাত পর্যন্ত। আর ঘোরে থাকলেই সে স্পষ্ট দেখতে পায় তার রাতপরী কে।পরানের আগে আগে মেঠো আলপথ ধরে হেঁটে চলে রাতপরী।বাঁশির সুর গিয়ে যেন আছড়ে পড়ে তার পায়ে।তাতে ছন্দ ওঠে।সেই ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে রাতপরী হেঁটে যায়।কত ভাবে রাতপরীকে ধরার চেষ্টা করেছে পরান।রাতপরী ধরা দেয়নি।আলেয়ার মত দেখা দিয়েই মিলিয়ে গিয়েছে ফের।হারিয়ে গিয়েছে রাতের আঁধারে।
   ঘোরের মধ্যেই হাঁটছিলো পরান।বাঁশি যেন বেঁজে চলছিলো আপন খেয়ালে।আহা,কী মধুর সুর।আজও কী নামবে রাতপরী?
   প্রশ্নটা মাথার মধ্যে উঁকি দিয়ে যেতেই আকাশের দিকে তাকালো পরান।ওই ওখান থেকেই তো নেমে আসে রাতপরী।ওই মহাশূন্যের পথ ধরে সাদা ডানা মেলে –
   একটা ধূসর কুয়াশার পর্দা ছড়িয়ে পড়েছে সারাটা আকাশ।অল্প গুটিকয় তারা আর পূর্ব আকাশের ক্ষয়াটে চাঁদটা তখনও দেখা যাচ্ছে বটে,তবে তাদের আলো এতটাই ম্রিয়মান যে মনে হচ্ছে পচা ডিমের কুসুম কে যেন গুলে দিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়।তারাদের দুই চোখে ঘুমের ঘোর।ঘুম নামছে আধখানা চাঁদের চোখেও।পৃথিবীটাই বুঝি ঘুমিয়ে পড়লো।অথচ পরানের চোখে ঘুম নেই।মেঠো আলপথ ধরে বাঁশি বাঁজাতে বাঁজাতে সে খুঁজে চলেছে তার স্বপ্নের রাতপরী।
   এভাবেই রাত্রি বাড়ে। নির্জনতা আরও গভীর হয়।শরীরের ওপর চেপে বসা শৈতী আবহ হিংস্রতায় ভরে ওঠে।শিশিরে ভিজে হিম হয়ে আসে পরানের পায়ের পাতা।অথচ কোনও কিছুই টলাতে পারে না পরানকে।তার বাঁশির সুর মেঠো প্রান্তর পেরিয়ে ভেসে যায় আরও দূরে।ছুঁয়ে যায় অসংখ্য ঘুম ঘোর মানুষের অন্তর।ছুঁয়ে যায় রাতপরীকেওবা।আর তাই এক সময় পরান স্পষ্ট দেখতে পায় তার সেই স্বপ্নের রাতপরীকে।আকাশ থেকে নেমে আসা রাতপরী আলোয় আলোয় ভরিয়ে দেয় মেঠো প্রান্তর।হেঁটে চলে আলপথ ধরে।সারাটা রাত ধরে তাকে ছোঁয়ার খুব চেষ্টা করে পরান।রাতপরী তবু অধরাই থেকে যায়,ঠিক অন্যদিনের মত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত