| 27 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: অন্ধকারের আলো । ঈশানী রায়চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

-তাহলে ওই কথাই রইল সামনের মাসের  সতেরো তারিখ আমরা পুরী যাচ্ছি। পুরো এক সপ্তাহেরট্রিপ। ট্রেনেই যাওয়া আসা। সি-ফেসিং ভালো হোটেলের ঘরটর চন্দ্রিমা বুক করে রাখবে; ওর চেনাজানা আছে যখন। সকলে হইহই করে উঠল; শুধু জয়শ্রী আমতাআমতা করে বলল,
-আমার যাওয়া হবে না রে। মানে রাতুলের খুব অসুবিধে হবে।
-কীসের অসুবিধে? কচি খোকা নাকি? বৌ-হ্যাংলা? তোকে সাতটা দিন চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে না  দেখতে পেলে শোকে শয্যা নেবে? আরে, তোর শাশুড়ি আছেন তো! এক সপ্তাহের তো মামলা! অবিশ্যি আমরা তো শুনেছি, তুই একরাতের জন্য বাপের বাড়িতে গেলেও রাতুল নাকি পেছন পেছন যায়!

মাথা নিচু করে চুপ করে বসেছিল জয়শ্রী। কী বলবে, কতটুকু বলবে …বুঝে উঠতে পারছিল না।      

ওরা পাঁচজন। অপালা, মহুয়া, সোনালি, চন্দ্রিমা আর জয়শ্রী। কলেজে পড়ত যখন, ফচকে ছেলেরা নাম দিয়েছিল ‘পাঁচালি’। সেও অবশ্য আজ এক যুগ আগের কথা। তারপর তো একে একে প্রায়  সকলেরই বিয়ে-থা হল, ছেলেপুলেও হয়ে গেল একটা দুটো করে। তবে সকলেই কলকাতার বুকে থাকে বলেই আজও নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎটুকু টিকে আছে।

অপালা আর সোনালির বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে। মহুয়ার বিয়েটা প্রেমজ ; পাশের পাড়ার ছেলে। চন্দ্রিমা ছাদনাতলায় যেতে রাজি হয়নি কারণ তার দাদা দীর্ঘকাল বিদেশে, বৌদি বিদেশিনী। দাদা কলকাতার বাড়িতে মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে কর্তব্যপালন করে মাত্র ; তিন চার বছর পরে পরে সপ্তাহ দুইয়ের জন্য এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করে যায়।তবে দাদাকে দোষ দিতে পারে না চন্দ্রিমা। দাদা অনেকবার তার বিয়ের চেষ্টা করেছে, মাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে। চন্দ্রিমা মনে মনে জানে, দোষ তার বিধবা মায়ের; তিনি স্রেফ স্বার্থপরতা করে মেয়ের বিয়ের কথা উঠলেই চৌষট্টিরকমের অজুহাত খাড়া  করেছেন; ধানাইপানাই, ফিটের ব্যামো, বাতের ব্যথা কিচ্ছুটি বাদ যায়নি। শেষে বীতশ্রদ্ধ হয়ে চন্দ্রিমা মাকে আর দাদাকে জানিয়ে দিয়েছে যে সে বিয়ে করবে না।পড়াশুনোয় ভালো ছিল, একটা নামী  কলেজে  পড়ানোর  চাকরি পেয়ে গেছে; বাকি জীবনটা নিজের মতো করে কাটিয়ে দেবে।দাদা রাগারাগি করেছে, মা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। রইল বাকি জয়শ্রী। তার বিয়েটা আধা সম্বন্ধ করে, আধা ভালো লাগা থেকে। জয়শ্রীর বর রাতুল সম্পর্কে জয়শ্রীর মাসতুতো দিদির দ্যাওর। দিদির বিয়ের সময় আলাপ, তারপর দু-বাড়ির মধ্যস্থতায় বিয়ে। রাতুল-জয়শ্রী নিঃসন্তান। জয়শ্রীর বন্ধুরা এক আধবার খুঁচিয়ে জানার চেষ্টা করেছে  কারণটা; কিন্তু জয়শ্রী এড়িয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আর ঘাঁটায়নি।

পাঁচজনের মধ্যে কলেজবেলা শেষ হয়ে যাবার পরে চুক্তি হয়েছিল, যদি কলকাতায় থাকে সকলে … প্রতি  মাসের শেষ শুক্রবার কোনও না কোনও জায়গায় জড়ো হয়ে দু-চার ঘণ্টা আড্ডা দেবে। এত বছরেও এই নিয়মের হেলদোল হয়নি, নেহাত কোনও বিশেষ কারণ ছাড়া। তবে এভাবে পাঁচজনের ‘একা একা’ বেড়াতে যাওয়া এই প্রথম | সকলেই একমত, যে বর-বাচ্চা নিলে নিজেদের মতো করে সময় কাটানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত কিছুতেই রাজি করানো গেল না জয়শ্রীকে। একগুঁয়ের মতো মাথা নেড়ে নেড়ে সকলের সব অনুরোধ, জোরজবরদস্তি নস্যাৎ করে দিল। বাকি চারজন কেউ রাগ করল, কেউ বা অভিমান ; কিন্তু জয়শ্রীকে টলানো গেল না।

জয়শ্রী গেল না কেন? সে  রাতুলকে ছেড়ে থাকতে পারে না, বা তাকে ছেড়ে থাকতে পারে না রাতুল ? শাশুড়ি-মা খুব জাঁদরেল? মোটেই নয়। আজকাল সংসারে দমবন্ধ হয়ে আসে তার। আজকালই বা কেন! এই এতগুলো বছর সে গুমরে মরেছে বিয়ে হয়ে ইস্তক। সন্তানহীনতার দুঃখ ছাপিয়ে মনে শুধু তিক্ততা বাসা বেঁধেছে একটু একটু করে। রাতুলের অসম্ভব অধিকারবোধ আর অকারণ সন্দেহবাতিক। সে চব্বিশ ঘণ্টা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জয়শ্রীর কাজকর্ম, গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। এই যে দু-তিন ঘণ্টার জন্য মাসে একটা দিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, এতেও প্রবল আপত্তি রাতুলের। শুধু শাশুড়ি-মায়ের সমর্থনে এই যুদ্ধে জিততে পেরেছে জয়শ্রী। তাও যেখানেই তারা বন্ধুরা আড্ডা মারুক, কারও বাড়িতে বা কোনও কফিশপে… উলটোদিকের ফুটপাথ ঘেঁষে বাড়ির গাড়িতে রাতুলের পেটোয়া ড্রাইভার অপেক্ষা করে। পুঁটলি বেঁধে ম্যাডামকে তুলে নিয়ে আসে বাড়ি থেকে, আবার পুঁটলি বেঁধেই বাড়িতে জমা করে দেয়। না মরা পর্যন্ত এই নরকযন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই নেই জয়শ্রীর। কাউকে মন খুলে বলতেও পারে না এইসব কথা। এক-আধবার বাপের বাড়িতে কথা তুলেছিল আলগোছে, তারা বলেছে সবই নাকি জয়শ্রীর মনগড়া বাতিক! রাতুল তাকে  এত বছর পরেও যে চোখে হারায়, এ নাকি বিশাল সৌভাগ্য ! সব কষ্ট বুকে চেপে রাখে জয়শ্রী; বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে বড়ো সঙ্কোচ হয় তার। ছোটোবেলা থেকেই ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল খুব ! এখন রঙের প্যালেট শুকিয়ে গেছে, ক্যানভাসে ধুলোর পরত, রঙের টিউব টিপলে রং বেরোয় না, পেন্সিলগুলো ভোঁতা মুখে অবহেলায় পড়ে আছে ড্রয়ারের অন্ধকার কোণে। রাতুল তার ছবি আঁকাও সহ্য করতে পারে না ! ছবি আঁকতে বসা মানে নাকি রাতুলকে, তাদের দাম্পত্যকে অবহেলা করা; নিজের ভালো লাগাকে, নিজের খুশিকেই প্রাধান্য দেওয়া ! কেউ বুঝতেই পারছে না, এভাবে একটু একটু করে কেমন মরে যাচ্ছে জয়শ্রী !

ভাগ্যিস সে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে চলে যায়নি! কী কেলেঙ্কারিই না হত তাহলে! মাঝখান থেকে ওদের সকলকে ফিরে আসতে হত জয়শ্রীর সঙ্গে।  ওরা যেদিন রওনা হল, তার পরের দিন ভোরবেলায় বাথরুমে অজ্ঞান হয়ে গেল রাতুল। হাসপাতাল পর্যন্ত আর নিয়ে  যেতে হল না। পাড়ার ছেলেরা দৌড়ে গিয়ে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনল। পরীক্ষা করে গম্ভীর মুখে ঘাড় নেড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। কিছুই করার ছিল না।ম্যাসিভ সেরিব্রাল অ্যাটাক।

রাতুলের মা খুব শক্ত মনের মহিলা। নীরক্ত সিঁথির, সাদাটে শাড়ি পরা, আভরণবিহীন পুত্রবধূকে আঁকড়ে ধরে এত বড়ো শোক সামলে নিলেন তিন-চার দিনের মধ্যে। পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজনরা অবাক হল, কানাঘুষোও হল খানিক। কারও কথায় কর্ণপাত করলেন না তিনি। জেদি গলায় বললেন,
-আমাদের নিয়ে অত ভেবো না তোমরা। আমরা মা-মেয়েতে ঠিক দু-জন দু-জনকে সামলে নেব।
জয়শ্রীর মা চেয়েছিলেন, কাজকর্ম মিটলে যদি মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে দু-চারদিন রাখা যায়। জয়শ্রী রাজি হল না।
সে নিজে থেকে বন্ধুদের খবর দেয়নি। কী লাভ শুধুশুধু বেচারিদের আমোদআহ্লাদ মাটি করে? তবে খারাপ খবর তো বাতাসের আগে আগে ছোটে; বাকি চারজন ফিরে আসা মাত্র খবরটা পেয়ে গেল।

নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছিল ওরা চারজন। কী করে জয়শ্রীর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াবে ? কী বা বলবে তাকে? সান্ত্বনাবাক্যের ভার যে এত দুর্বহ, আগে তো মনে হয়নি কখনও !

ভরদুপুরে একতলার দরজায় টুং করে বেল বাজল যেই, অনেকদিনের কাজের মাসি সরলা এসে দরজা খুলে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,‘
-ওপরে  যাও। মা বিশ্রাম নিচ্ছেন, বৌদিমণি মায়ের ঘরেই আছে। আমি চা করে নিয়ে আসছি।
ওরা কুণ্ঠিত পায়ে ওপরে এল। ছড়িয়েছিটিয়ে বসল। কেউ খাটে, কেউ বা চেয়ারে। এলোমেলো কথা। রাতুলের, সংসারের। একটানা নয়; থেমে থেমে, থমকে থমকে। আসলে কী যে বলার আছে, খেই হারিয়ে যাচ্ছিল সারাক্ষণ।
দুপুর ফুরিয়ে বিকেল হল, তারপর সন্ধের আঁধার ঘনাল। ওরা বাড়ি ফিরবে বলে উঠল। কথা দিল, আবার আসবে। বাদ্যযন্ত্রের  পাঁচটা তারই যে যার মতো করে বাজছিল; তবে সন্তর্পণে আর  চুপিচুপি।

সকলে চলে যাওয়ার পরে নিজের ঘরে এল জয়শ্রী। সব ক’টা বাতি জ্বেলে দিল। দেওয়ালে রাতুলের ছবি। স্থির, অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জয়শ্রীর দিকে। জয়শ্রী পায়ে পায়ে এগিয়ে এল খোলা  জানলার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা ক্যানভাসটার দিকে। ওপরের পাতলা সাদা কাপড়টা সরিয়ে নানান কোণ থেকে নজর করে দেখছিল তার আঁকা  অসমাপ্ত ছবি। কাল দুপুরের মধ্যেই শেষ করতে হবে আঁকাটা। সমস্ত রংহীনতা উড়িয়ে দিয়ে খুনখারাপি আর  ঝলমলে রঙে ভরিয়ে তুলতে হবে এতদিন ধরে ফেলে রাখা সাদা ক্যানভাস।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত