| 27 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: হাত । কিঞ্জল রায়চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
 
 
 
ছোটবেলায় ভারতের ম্যাপ ছিঁড়ে ফেলেছিলাম বলে বাবা বকেছিল খুব। জীবনের গোটা পঞ্চাশ বছর কাটানোর পর আজ কিছুটা বাবার প্রতিক্রিয়া বুঝি। ছিঁড়ে ফেলবার কারণও ছিল অবশ্য। ভূগোল পরীক্ষার খাতার সঙ্গে ম্যাপ পয়েন্টিংয়ের জন্য যে সাদাকালো স্কেচ পেপারটা দেওয়া হত, সেটা ছিল আমার না-পসন্দ। ধান কোথায় ভালো হয়, জল কোথায় ভালো বয় এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার ছিলনা। খানিকটা রেগেমেগেই তাই ছিঁড়ে ফেলা।  ব্যস! ছেঁড়া ম্যাপ পড়বি তো পড় সোজা গিয়ে বাবার হাতে। বাবার হাবভাব সেদিন কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। যেন বুকে ছুরি চালিয়ে দিয়েছে কেউ। ছুটে এসেছিল।
 
-“হেইডা তুই কী করলি রিন্টু! 
দ্যাশটারে ছিঁড়া  টুকরা টুকরা  কইরা ফালাইলি? কত রক্ত বইতাসে দ্যাখ চাইয়া, দ্যাখ!” আমি পড়ার টেবিলের এককোণে গুটিসুটি। মা রান্না ফেলে ছুটে এসেছে। বাবার কান্ড দেখে থ বনে গেছি দুজনেই। কাগজের ভেতরে রক্ত খুঁজছি আমরা। মাথা মুন্ডু কিচ্ছু বুঝছিনা। রক্ত যদি থেকে থাকে সেদিন সেটা ছিল বাবার দুই চোখে। চোখদুটো লাল টসটসে।গাল বেয়ে জল নামছিল গড়িয়ে।  রক্তের মতোই।
 
মাইগ্রেশানের পর ভূগোলের গন্ডগোল চেপে বসেছিল বাবার মাথায়। মাঝেমধ্যেই লুম্বিনিতে নিয়ে যেতে হত।ইঞ্জেকশান , ঘুমের ওষুধ। আসলে এখানকার  কলোনিপাড়ায় অবস্থানটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলনা বাবা। পাঁচ কথার মধ্যে খালি ফরিদপুরের কথা মিশিয়ে গুলিয়ে ফেলছিল সবকিছু।  বয়স যত বেড়েছে, তত ধীরে ধীরে কমে এসেছিল কথা। শেষদিকে আর কিছুই প্রায় বলতনা। কিন্তু আমি বাবার সেদিনের সেই রূপটা আর ভুলতে পারিনি। মাঝেই মাঝেই দৃশ্যটা ঘুমের ভেতর হানা দিত।দেখতাম– টুকরো করা ম্যাপের গা চুঁইয়ে নামছে ঘন লাল তরল। বাবার আঙুল বেয়ে কব্জি থেকে গড়িয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরে পড়ছে মাটিতে!ভূগোলের ক্লাসগুলো মনোযোগ দিয়ে অ্যাটেন্ড করতামনা। ম্যাপ আমি আর কখনও ছিঁড়িনি। পারতপক্ষে আর ছুঁয়েও দেখিনি। একটা ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়াত ক্রমাগত। ভূগোলকে এড়িয়ে গেলেও ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারিনি। আসলে লেখাপড়া বিষয়টাই বুঝি এমন।একটা বিষয়ে কিছু কথা এড়িয়ে গেলেও অন্য পথ ঘুরে ঠিক সেসব এসে পড়বে।
 
ভারতের ইতিহাসে আগ্রহ ছিল। সেটা অবশ্য তৈরি হয়েছিল শুভেন্দু স্যারের কারণে।  একেকটা চ্যাপ্টার ধরে ধরে উনি অসাধারণ লেকচার দিতেন। গল্প করে করে বলে যেতেন। ছেলেরা সেখান থেকেই  নোট নিত। আমিও, কখনো লিখতাম বা মন দিয়ে শুনতাম। বিয়াল্লিশের আন্দোলন। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা। দেশভাগ…
 
-“আরে ধূর কী হল কী! কাঁচি থামালি কেন?”
আমার আচমকা পাল্টে যাওয়া মেজাজ দেখে নাপিত রাজেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে।
-“ছ্যার! আপনি কীসব বিড়বিড় করতেচেন, আর খালি খালি মাথা নাড়তেচেন! কাঁচি চালাই কেমন করে!” আমি হাসতে গিয়েও গম্ভীর হয়ে যাই। হ্যাঁ, ঘাড় কাত করে চেয়ারে এলিয়ে স্বপ্ন একটা দেখছিলাম বটে। সেই ছেলেবেলার স্কুলের দৃশ্যগুলোই ভেসে ভেসে উঠছিল, ফিল্মের নেগেটিভের মতো। শুভেন্দু স্যার ভারত –পাকিস্তান বর্ণনা করতে গিয়ে চকখড়ি দিয়ে আঁক কষছিলেন ব্ল্যাকবোর্ডে। সাদা চকের গুঁড়ো ধীরে ধীরে লাল হয়ে যাচ্ছিল। সেই লাল রঙ হাত বেয়ে নেমে আসছিল শুভেন্দু স্যারের জামার হাতায়। সাদা শার্ট রক্তের ছিটেয় লাল। ক্লাসে হই হই!
সেদিন ওই দৃশ্য দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। খানিকক্ষণ পর চোখে মুখে জলের ঝাপটা লেগে চোখ মেলে দেখি অন্য সব ছেলেরা আমার মুখের কাছে প্রায়  হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ওদের মাঝখানে শুভেন্দু স্যার। জ্ঞান ফেরাতে জলের বোতল খুলে উনিই জলের ঝাপ্টা দিচ্ছিলেন।ওঁর হাত ভিজে ছিল। আমি ঝাপসা চোখে লক্ষ্য করার চেষ্টা করছিলাম সত্যিই রক্ত লেগে আছে! নাকি আমারই চোখের ভুল!
সেদিন তাড়াতাড়ি ক্লাস ছুটি হয়ে যায়।
 
এখন প্রতি রোববার দাড়ি কামানো বা চুল কাটবার অছিলায় সেলুনে ঢুকলেই মাঝে মাঝে সেই ভয়টা তাড়া করে। মনে হয়– একটা সূক্ষ্ম হাত যেন কাঁচি হতে চুপিসারে এগিয়ে আসছে। আমি নাপিতকে ফস্ করে জিজ্ঞেস করে ফেলি –“হ্যাঁরে তুই কি মাউন্টব্যাটেন?”
নাপিত হকচকিয়ে যায়।
-“ওসব ব্যাটন ফ্যাটন বুঝিনা ছ্যার! আমি রাজেন নাপিত। এই কাঁচিই আমার অস্তর। আমার বাবাও নাপিত ছেলো…”
-“আচ্ছা নে হয়েছে, আর বকতে হবেনা। চুল কাট! ঘাড়ের কাছে অল্প ছেঁটে হাল্কা করে বিট দিয়ে দিস তো!”
-“ইডেন গার্ডেন টাইপ? আচ্ছা বুঝেচি ছ্যার!”
রাজেন দাঁতের পাটি বার করে এক গাল হাসি ছড়িয়ে কাঁচি বাগিয়ে ধরে। আমি চোখ বুঁজে মাথাটা ঝুলিয়ে দিই সামনের দিকে। ঝিম লাগে। ঘাড়ের কাছে, কানের পাশে সুড়সুড় করে ঘুরে বেড়ায় কাঁচি। আমি বন্ধ চোখে দেখতে পাই – লর্ড মাউন্টব্যাটেন গম্ভীর মুখে করিডরে পায়চারি করছেন। ওনার সামনে এসে কাঁচি হাতে দাঁড়াল নাপিত রাজেন। সাহেব বেজায় খুশি। বললেন, “আই উইল গিভ ইউ বখশিস্! ক্যান ইউ ডু দিস জব?”
-“ইয়েছ ছ্যার! ইয়েছ ছ্যার!” বলে টেবিলে রাখা বিরাট এক মানচিত্রের দিকে এগিয়ে গেল রাজেন।
সাহেব ‘ওয়ান, টু, থ্রি স্টার্ট ‘ বলামাত্রই মনের সুখে ম্যাপের ওপর চালাতে শুরু করল কাঁচি। কচুত্ কুচুত্ কুচুর…আকাশি অংশ থেকে খানিক জল ছিটকে পড়ল টেবিলে। বাদামি অংশ থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো মাটি…আর…সরু রেখার মতো রক্ত! রক্তধারা! রাজেনের হাত থমকে গেছে…
-“উফ্! কান কাটবি নাকি রে হতচ্ছাড়া! অ্যাঁ!” রাজেন দুকদম পিছিয়ে দাঁড়ায়। কাঁদো কাঁদো অবস্থা।
-“আমার কী দোষ ছ্যার! আপনিই তো বললেন নাইন্টিন ছেভেন্টি ওয়ান! আরও ভেতর দিয়ে কাঁচি চালা! আমারে একদিন আপনি খুনের দায়ে ফেলবেন দেখছি!” সেলুন বদলে ফেললাম।
 
কলোনি পাড়া ছেড়েছি বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। নতুন ফ্ল্যাট কিনেছি বাইপাসে।ছেলেকে ভালো একটা ইংলিশ মিডিয়ামে দিলাম। লাখ দুলাখ মতো খসে গেল। একটা ছোটখাটো স্ট্রোক হয়ে গেল একদিন ঝট করে। বাবারও হয়েছিল, হার্ট অ্যাটাক। একটু বেশি বয়সে। আমার মাত্র পঞ্চাশেই…
সামলে নিলাম। আরও একটা স্ট্রোক হওয়ার আগেই চোখে পড়ল রাস্তায় ঝোলানো সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের   আকাশ ছোঁয়া বিজ্ঞাপন –‘চার ইঞ্চি কেটে হার্ট বাইপাস। প্যাকেজ মাত্র ১,৫০,০০০’। পাশে ছোট্ট একটা কাঁচি।
কাঁচি আমার জীবন থেকে যাওয়ার নয়। আমার ছেলেটা আমারই মতো হয়েছে। ম্যাপ ট্যাপ নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়না। প্রোজেক্টের কাজটাজ সবই গুগুল থেকে ডাউনলোড করে সারে। বড়জোর কলুটোলায় গিয়ে পথ হারিয়ে ফেললে গুগুল ম্যাপের সাহায্য নেয়। ও বলে গুগুল সব জানে। সবকিছু খুলে দেখায়। একেবারে পিন পয়েন্ট লোকেশান পর্যন্ত যা চাইবে সবকিছু।
ছেলে সেদিন ওর প্রোজেক্টের জন্যই বোধহয় গুগুল খুলে বাংলাদেশের ম্যাপ নিয়ে খুটর খুটুর করছিল। হঠাৎ পড়ার ঘর ছেড়ে ছুটে এল ড্রইং রুমে। “বাবা, দ্যাখো দ্যাখো এইটা কিসের লাইন? জাস্ট লাইক আ ব্লাড স্ট্রিম!  এটা কোন এরিয়া?”
আমি চমকে উঠি! আবার সেই ব্লাড! এই জমানায় গুগুল ম্যাপের মধ্যেও? টিভি মিউট করে ছেলের হাত থে‌কে স্মার্টফোনটা নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যাই। বাংলাদেশের ম্যাপের বিশেষ কিছু জায়গায় রক্তের দাগের মতোই লালচে কিছু লাইন। ভালো করে দেখব বলে ক্লিক করলাম। গুগুল আরও একটু গভীরে দিক নির্দেশ করল। আরও জুম করলাম। এবার নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের নাম। যশোর, খুলনা…যশোরে বাবার মামারবাড়ি ছিল। ভিসা পায়নি বলে শেষবারের মতো সেখানে বাবার যাওয়ার ইচ্ছেটা পূরণ হয়নি। শেষদিন পর্যন্ত সেই চাপা কষ্টটা নিজের মধ্যে গুমরে রেখেছিল বাবা।
আস্তে আস্তে জায়গার নামগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। হাসনাবাদ… টাকি। হ্যাঁ ওখানেই তো ছোড়দির শ্বশুরবাড়ি। প্রতিবার দূর্গাপূজোয় ওরা যায়। আর দূর থেকে দেখা যায় বর্ডার এরিয়া। জলকে  কাঁটাতারে আটকানো যায়না। তবু ছড়িয়ে আছে এক অদৃশ্য সীমারেখা। দুইপাড়ে রাখা নৌকোয় দুই দেশের পতাকা। তবু কিছু মানুষ লুকিয়ে লুকিয়ে  নিত্যদিন পারাপার করে। ভেলায় হাত পা বাঁধা গরু ভাসতে ভাসতে পার হয়ে যায় প্রতিবেশির দেশে… কিন্তু শুধু এইটুকু না। রক্তধারার উৎস কোথায়! আজ আমি খুঁজে বার করবই! জেদ চেপে গেছে। আরও নির্দিষ্ট পয়েন্ট অফ ভিউ আমার চাই। 
 
আমি জুম করে চলেছি সমানে… প্রায় মাইক্রোস্কোপিক রেঞ্জে গুগুল খুলে দিচ্ছে জায়গার ভেতরকার জায়গ।দু আঙুলে টেনে টেনে আমি ক্রমশ বড় করে চলেছি দৃশ্যপট। গুগুল ম্যাপের স্যাটেলাইট অপশানে গেলাম।জিপিএস ট্র্যাক  করছে লোকেশান— জল জমি ঘরবাড়ি টাওয়ার…এবার একটা বাড়ি দেখা গেল। বাড়ির বারান্দাও দৃশ্যমান হল। বারান্দার দুইদিকে দুই দেশ।খাবার ঘর শোবার ঘরের লোকেশান  ইন্ডিয়া,  রান্নাঘর-বাথরুম পড়েছে বাংলাদেশে। এখানেও কোনও তারকাঁটা নেই।তবে মাঝখানের ওই বারান্দায় বন্দুক হাতে রাউন্ড দিয়ে চলেছে শ্যাওলা পোশাক পরা বি এস এফ।আশেপাশে পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন কিছু দেহ। মৃত সৈনিক…অথবা ওই শোবার ঘর থেকে বাথরুমে যাওয়ার পথেই কাটা পড়েছে কিছু মানুষ।কাটা পড়েছে দেয়ালের কিছু ইঁট। কেটে টুকরো হয়ে পড়ে আছে কিছু ভোটার কার্ড… যাদের সিটিজেনশিপ বাংলাদেশ,  ভোটার অ্যাড্রেস ইন্ডিয়া! মাঝখানের ওই বারান্দা থেকে রক্তধারা গড়িয়ে চলেছে আজও…
 
“বাবা! ফোনটা হ্যাং করছে! প্লিজ্ এবার ছাড়ো! হাউ ক্রেজি ইউ আর! ইস্, স্ক্রিনে কি বিচ্ছিরি স্ক্র্যাচ ফেলে দিলে তুমি!” ছেলে ফোনটা কেড়ে নিল হাত থেকে। আমার বুকের বাঁদিকটা চিন চিন করছে। দেখতে পাচ্ছি একটা কাঁচি… চার ইঞ্চি কাটবে বলে ক্রমশ আমার হৃৎপিণ্ডের দিকে এগিয়ে আসছে।
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত