| 26 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: অস্তি । রিমি মুৎসুদ্দি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

একবার মাত্রই শব্দটা উচ্চারিত হল।

জ্যোৎস্নার রূপালি কিরণেরমধ্যে দিয়ে গহীন বনের গাঢ় অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন ক্ষীণতনু দীর্ঘাঙ্গী এক ঋষি। ঋষির চলে যাওয়া পথএকদৃষ্টে নিরীক্ষণ করছেন এক সীমন্তিনী। নিস্তব্ধ নিশ্চুপ তাঁর মুখমণ্ডলে ঘন মেঘের ছায়া। তাঁর কর্ণে ভুজঙ্গ কুণ্ডল। তাঁর গলায় উরগ হার। তিনি একে একে আভরণ মুক্ত হলেন। সরীসৃপেরাও অন্ধকার বনের পথে অথবা কোনও গাছের কোটরে সঙ্গী খোঁজে বের হল।

চরাচর জুড়ে মিলন সঙ্গীত, আঁধার কেবল বিরহিণীর বুকে।

নাভিমূলে তখনও তাঁর স্বামীর স্পর্শ লেগে আছে। সেটুকু স্পর্শ আর ‘অস্তি’ শব্দে মনসা ভুললেন স্বামী বিচ্ছেদ বেদনা। ওই একটা শব্দে স্বামী বলে গেলেন, “আছে। ওই গর্ভেই আছে তাঁর ঔরসজাত সন্তান।”

জরৎকারু মুনির বাক্য অনুযায়ী যথাসময় মনসার গর্ভে জন্ম নিলেন মহাঋষি আস্তিক। নাগজাতি আর কুরুবংশের চির বিবাদের মধ্যে আস্তিকের জন্ম ও বড় হওয়া। নাগরাজ বাসুকি তাঁর মাতুল। সমস্ত নাগকুল তাঁর দিকে তাকিয়ে। শক্তিধর কুরুবংশের রোষ থেকে তিনি তাঁদের উদ্ধার করবেন। কিন্তু কী উপায়ে? কেউ জানেন না।

নাগরাজ বাসুকি তাঁর ভগিনীকে বললেন,

“যা অনিবার্য তাই অভিশাপ। নাগজাতির এই ধ্বংস অনিবার্য। তাই মাতা কদ্রু উচ্চারণ করছিলেন সেই অভিশাপ– রাজা জনমেজয়ের সপর্সত্রে ধ্বংস হবে নাগজাতি। স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা তা অনুমোদন করে বলেছিলেন, “তথাস্তু।” আর আমি তখন সমুদ্র মন্থনে দেবতাদের সহায়ক হতে মন্দার পর্বতের গায়ে নিজেকে দড়ির মতো জড়িয়ে রেখেছিলাম।”

মনসা জিজ্ঞেস করলেন,

-“এর কি কোনও প্রতিকার নেই?”

-“এর প্রতিকারের জন্যই জরৎকারু আর তোমার বিবাহ। এর প্রতিকারের নিমিত্তেই তোমাদের সন্তান আস্তিকের জন্ম।”

ঋষি প্রমতির কাছে আস্তিক বেদ বেদাঙ্গ-এর পাঠ নিলেন। তাঁকে ঘিরে এক অলৌকিক উরজা সমস্ত নাগকূলকে আশ্বাস দেয়, “আছো, আছো। তোমরা আছো।”

আস্তিক শুনলেন তক্ষকনাগ আর কুরুবংশের বিবাদের কথা। রাজা পরীক্ষিৎ মৃগয়ায় গিয়ে একটি বন্য হরিণের খোঁজে বনের ভেতর এসে দেখলেন শমীক মুনি ধ্যানরত। ঋষি মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন। তাই রাজা বারবার প্রশ্ন করে পলাতক হরিণের খোঁজ করলেও ঋষি কোনও উত্তর দিলেন না। একটা মৃত সর্প গাছের নীচে পড়েছিল। পরীক্ষিৎ ধনুর সাহায্যে তা তুলে নিয়ে মুনির গলায় পরিয়ে দিলেন। ঋষি তখনও স্তব্ধ। ক্ষমা করলেন এই ঔদ্ধত্য।

ঋষিপুত্র শৃঙ্গী রাজাকে ক্ষমা করতে পারলেন না। পিতার অপমানে ক্রুদ্ধ শৃঙ্গী রাজাকে অভিশাপ দিলেন, সপ্তরাত্রির মধ্যে তক্ষক দংশনে মৃত্যু হবে রাজার।

ঋষি শমীক এই অভিশাপ শুনে ছুটে এলেন রাজ দরবারে। রাজাকে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলে গেলেন। ঋষি বাক্যে বিশ্বাস রেখে পরীক্ষিৎ নির্মাণ করলেন এক সুবিশাল দুর্ভেদ্য প্রাসাদ। সেখানে পাত্র মিত্র ও পরিবারসহ বাস করতে লাগলেন। তক্ষকও চুপ করে বসে রইল না। অভিশাপ সত্যি করতে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। পথে ঋষি কশ্যপকে দেখতে পেলেন। ধন্বন্তরি মহাবিদ্যার অধিকারী ঋষি কশ্যপ।

কশ্যপের মহাবিদ্যার পরীক্ষা নিতে একটা বটগাছকে নিজের বিষে দগ্ধ করলেন তক্ষক। কশ্যপ সঞ্জিবনী মন্ত্র উচ্চারণ করে মৃত দগ্ধ বটগাছকে পুনরায় জীবিত করলেন। রাজা পরীক্ষিৎ সমীপে কশ্যপকে যেতে বারণ করলেন তক্ষক। বিনিময়ে প্রচুর ধন রত্নও দিলেন কশ্যপকে।কশ্যপ তক্ষকের কথা অনুযায়ী রাজার কাছে গেলেন না।

এইবার ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তক্ষক এসে রাজাকে আশীর্বাদ করলেন ও কয়েক প্রকার ফল খেতে দিলেন। অভিশাপের শেষতম দিন। দিনমণি অস্ত যাওয়ার আগে একটিবারের জন্যই উজ্জ্বল হয়েছেন। রাজা পরম নিশ্চিন্তে ফলে কামড় দিলেন। আর সেই মুহূর্তে ফল থেকে একটা ভয়াল দর্শন কীট রাজা পরীক্ষিৎকে দংশন করল ও সেই কীটরূপী তক্ষকের বিষে সমস্ত রাজপুরী নিমেষে ছাই হয়ে গেল।

একদিকে যেমন যুবক আস্তিক শুনলেন তক্ষক পরীক্ষিৎ কাহিনী, আরেক দিকে হস্তিনাপুরের রাজা জনমেজয় তাঁর অমার্ত্যদের কাছেও শুনলেন একই কাহিনী। তাঁর পিতৃহত্যার কাহিনী।

রাজা জনমেজয়ের সহপাঠী ঋষি উতঙ্কও তক্ষক বিরোধী। সকলেই রাজাকে পরামর্শ দিলেন সর্প নিধন যজ্ঞ করতে।

যজ্ঞের আয়োজন শুরু। এইবার কেবল শব্দের প্রাবল্যে ও মন্ত্রোচ্চারণের নিনাদে বিলুপ্ত হবে এক প্রবল বিরোধী জাতি। যে জাতি কুৎসিত কদাকার। যার নিজস্ব কিছুই নেই কেবল এক বিষময় জিহ্বা ছাড়া। এই জাতি সমূলে বিনাশপ্রাপ্ত হলে কুরুবংশ নিষ্কণ্টক হবে। হয়ত সমগ্র মানব জাতিও কালরূপ বিষ দংশন থেকে মুক্তি পাবে?

যজ্ঞের আয়োজন সম্পূর্ণ। কিন্তু এই যজ্ঞ সম্পাদন করতে প্রয়োজন জ্ঞান, মেধা ও প্রজ্ঞার অধিকারী এক অত্যাশ্চর্য মানুষ। যুগে যুগে অত্যাশ্চর্য মানুষরাই প্রবল বুদ্ধি ও মেধার অধিকারী হন। কোথায় পাওয়া যাবে সেই বুদ্ধিজীবী? যিনি নাশ করবেন শত্রুপক্ষ?

আসন্ন বিনাশের আশঙ্কায় সমস্ত নাগকুল ভয়ে ও বিষাদে আচ্ছন্ন। প্রজ্ঞাবান মহামুনি আস্তিক তাঁদের আশ্বাস দিলেন।

সমগ্র নাগজাতিকে আশ্বস্ত করলেও তিনি নিজে চিন্তাগ্রস্ত। তিনি জানেন এই নির্বিচারে হত্যায় তিনি সবাইকে বাঁচাতে পারবেন না। তিনি জানেন না মামা বাসুকি ও তাঁর সন্তানরা বাঁচবে কিনা? আর তক্ষক?

রাজদ্বারে এসে আস্তিক মুনি রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে দ্বাররক্ষীর অনুমতি পেলেন না। তিনি জানেন স্তুতিই একমাত্র অস্ত্র এই সঙ্কট মুহূর্তে। তাই প্রথমে দ্বাররক্ষীর স্তুতি তারপর সমগ্র রাজ্যের স্তুতি ও শেষে প্রবল দীপ্ত উচ্চারণে মহারাজ জনমেজয়ের ও তাঁর বংশের সকল বীরদের স্তুতি গাইতে লাগলেন।

প্রাসাদের প্রতিটা দেওয়ালে অলিন্দে বেজে উঠল সেই স্তুতিগান।

রাজাও শুনলেন সেই গান। রাজা মহাঋষি আস্তিককে ভেতরে আসার অনুমতি দিলেন। ঋষির প্রবল জ্ঞান, ও তেজোদীপ্ত মেধায় রাজা ও সভাসদরা আকৃষ্ট হলেন। আস্তিককেই সর্পসত্র যজ্ঞের পুরোহিত নির্বাচন করলেন।

রাজাজ্ঞায় ও সর্বসম্মতিক্রমে যজ্ঞের পুরোহিত নির্বাচিত হয়েও আস্তিক একটা শর্ত রাখলেন। বুদ্ধিজীবী হলেও তিনি ভুজঙ্গ জননী বিষহরির সন্তান। তাঁর মাতা অপমান মেনে না নিয়ে একবস্ত্রে নিজ পিতৃ আবাস কৈলাসভূমি ত্যাগ করে সিজুয়া পর্বতে নাগজাতির মাতা হয়ে দিনযাপন করছেন। সেই মায়ের সন্তান রাজ দরবারে নিজের জন্য কিছু ভিক্ষা চাইতে আসেননি। এসেছেন একটা জাতিকে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে। এসেছেন, নির্বিচারে হত্যা বন্ধ করতে। নিরস্ত্র মুনির একমাত্র অস্ত্র তাঁর বুদ্ধি। সেই বুদ্ধিবলে তিনি বললেন, তাঁর শর্ত- যখনই বলবেন রাজাকে থামতে হবে। অর্থাৎ যজ্ঞ বন্ধ করতে হবে।

রাজা তখন মনসা পুত্রের মোহে আচ্ছন্ন। শর্তে রাজি হলেন রাজা।

সর্পমেধ যজ্ঞ শুরু হল। সেই যজ্ঞে প্রযুত প্রযুত, অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ সর্প হত্যা হল। নিহত হলেন বাসুকি পুত্র ও কুলজাত প্রবল পরাক্রমী পর্ণ, শাল, পাল, পিচ্ছল, কোণপ, চক্র, হিরণ্যবাহু, কালবেগ, শরণ্য, কালদন্তক। তক্ষক বংশের সন্তানরাও রেহাই পেলেন না। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার প্রজ্বলিত আগুনে দগ্ধ হলেন পুচ্ছাণ্ডক, মণ্ডলক, পিণ্ডসেক্তা, রভেণক, উচ্ছিক, শরভ, ভঙ্গ, বিল্বতেজাঃ, বিরোহন, শিলী, শলকর ইত্যাদি ভয়ঙ্কর সব নাগেরা। এছাড়াও আরও অনেক বিষধর ও নির্বিষ সাপেদের আহুতি হল।

মহাতেজঃ তক্ষক এবার ভয় পেলেন। পন্নগপুরী ছেড়ে তিনি ইন্দ্রলোকে আশ্রয় ভিক্ষা চাইলেন পুরন্দরের কাছে। ইন্দ্র তাঁর সুহৃদ তক্ষককে আশ্রয় দিয়েছিলেনও। কিন্তু যজ্ঞাগ্নির ধূম ও মন্ত্রের তেজ যমদূতের সেনানীর মতো নিঃশব্দ ঘাতক হয়েতক্ষকের খোঁজে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ইন্দ্রপুরীতে।

ইন্দ্রপুরীতে কী প্রবল হাহাকার!

এই সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি স্বয়ং দেবরাজেরও নেই। তিনি তক্ষককে ত্যাগ করলেন।

মৃত্যু অনিবার্য। তক্ষক চলেছেন যজ্ঞভূমির দিকে। যজ্ঞের আগুনের খুব কাছে এসে তক্ষক প্রস্তুত। নিজেকে ওই ধূমায়িত অগ্নিতে সমর্পণ করে জনমেজয়েরপিতৃহত্যার শাস্তি মাথা পেতে নেবেন। শুধু একবার তাকালেন যজ্ঞের পুরোহিতের দিকে। চারিদিকে হোমকুণ্ডলীর ধোঁয়া। তাছাড়া, দৃষ্টিশক্তি কোথায় তক্ষকের? কেবল তো ঘ্রাণ জানান দিতে পারে উষ্ণতা।

তক্ষকের মৃত্যুই কি এই ধ্বংসলীলা শেষ করবে? নাকি আরও অনেক পন্নগজাতিকে আহুতি দেবে এই যজ্ঞ?

প্রশ্নটা নিজের ভেতরে নিয়েই যজ্ঞাগ্নির প্রায় কাছে চলে এসেছেন তক্ষক।

বেদজ্ঞানী মহাঋষি আস্তিক তক্ষকের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলেন,

“অস্তি।”

“তুমি আছো। আছো।”

তক্ষক থেমে গেলেন। মহামুনি রাজাকে বললেন,

“বিরোধী বিনা কি রাজ্যে সুশাসন হয়? তক্ষক আপনার প্রবল বিরোধী। কিন্তু এই বিরোধীর অস্তিত্বেরও প্রয়োজন রাজ্যের সুশাসনের জন্য। প্রকৃত প্রজাপালনের জন্য। বিরোধীও তো আপনারই প্রজা। এইভাবে সমস্ত বিরোধী নিধন করলে আর কেউ কি রাজ অনুশাসনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করতে পারবে? বিরোধীর জিহ্বার বিষে মরণকামড় আছে জেনেও তাকে রক্ষার দায়িত্ব রাজার। নাহলে যুগে যুগে এই বার্তাই বাহিত হবে যে বিরোধী শূন্য বিরোধী শূন্য।”

রাজা জনমেজয় ছিলেন সুশাসক। তিনি মেনে নিলেন তাঁর আশ্রিত বুদ্ধিজীবীর বিধান। যজ্ঞভূমি থেকে নাগলোকে ছড়িয়ে পড়ল একটাই শব্দ- “অস্তি”।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত