| 27 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: পাগলির পুল । সাইফ বরকতুল্লাহ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গভীর হতে শুরু করেছে। বাইরে হালকা বাতাস সাথে কয়েক মিনিট বৃষ্টি হয়ে গেল। মেঘলা আকাশে দুই একটা তারা দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে বাচ্চা দুটোকে দুধ খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ার প্রস্তুতি শুরু করল। ব্লাউজের বোতাম খুলে দিল আয়েশা, আর দেড় বছরের আনিশা দুধ চুষতে শুরু করল। পাশে তিন বছরের আনাছ শুয়ে পড়েছে। আয়েশার  চোখে ঘুম ঘুম ভাব। এরই মধ্যে বাইরে থেকে চিৎকার শুনা যাচ্ছে। খাটের পাশের টেবিলে হারিক্যানটার আলো বাড়ার জন্য ডান হাত দিয়ে সুইচটা ঘুরাল। বাইরে চিৎকার বাড়ছেই।

এরকম চিৎকার শুনলেই আয়েশার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ঠিক তিন বছর আগে একবার এরকম চিৎকার শুনলে পরে খবর পায়, তার ছোট বোনের জামাইকে দুর্বৃত্তরা মেরে ফেলেছে। ছোট বোন আকলিমার দুটো বাচ্চা। আইরিন ও আলিফ। যখন বাবাকে হারায় তখন ওদের বয়স আইরিনের দুই বছর আর আলিফের সাত মাস। বাবা মার অবস্থা ভাল ছিল না। বিয়ের পর কিছুটা সুখেই ছিল আকলিমা। স্বামী হারানোর পর আবারও দুঃসহ জীবন। অন্ধকার আর কান্নাকে সঙ্গী করে দিন যাচ্ছে।

বাইরে চিৎকার একটু কমে এসেছে। আয়েশা ভয়ে ভয়ে হারিক্যানের আলোটা কমিয়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। গত কয়েকটা মাস আয়েশার ঘুম হয় না। রাত হলেই নানা ভয়ংকর সব ঘটনা মাথায় এসে ঘুরপাক খায়। পাশের বাড়ির দিলারার সাথে বিষয়টা নিয়ে অনেকবার কথাও হয়েছে। দিলারা তাকে স্বাভাবিক থাকার জন্য বলেছে। কিন্তু চাইলেই তো আর মাথা থেকে ঘটনাগুলো সরানো যায় না।

শুভ্র সকাল। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা রেডি করে রান্না ঘর থেকে ছাগল দুইটা বের করে উঠানে আনল। ছোট্ট রান্না ঘর। চুলার পেছনে ফাঁকা জায়গায় প্রতিদিন ছাগল দুটোকে থাকতে দেয়। প্রত্যেক বছর সাত থেকে আটটা ছাগল পালে আয়েশা। বছর শেষে বিক্রি করে যে টাকা পায়, তা দিয়ে সংসারে কিছুটা কাজে লাগায় সে।

দুপুরের দিকে বাড়ি থেকে একমাইল দূরে ক্ষেতে ছাগল নিয়ে যায় আয়েশা। প্রায়ই এখানে ছাগল নিয়ে আসে সে। গতকাল খুবই ভয় পেয়ে ছিল।  কাল খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।  সে সময় এখানকার রন্টু তাকে হঠাৎ কাছে এসে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দেয়। এর আগেও কয়েকদিন রন্টু আয়েশাকে নানারকম টিজ করতো। ব্যাপারটা নিয়ে এতদিন আয়েশা কোনো কথা কাউকে বলেনি। দুই বছর আগে দুর্র্বৃত্তদের হাতে স্বামী খুন হবার পর বড় নোনাকষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে। দুর্বৃত্তদের কথা ভেবে রন্টুর ব্যাপারটা আড়াল করে রেখেছিল। কিন্তু গতকাল যখন চুমু দেয়, এরপর সে আর চুপ থাকতে পারে না।

আবারও দিলারার কাছে যায়। দিলারার দুইহাত ধরে ব্যাপারটা বলছিল তখন দুচোখ থেকে টপটপ জল পড়ছিল। দিলারা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলেন, কান্নাকাটি কইরেন না বোন, আমাদের জীবনটাই যে চোখের পানি মেশানো, নদীর মতো।
আয়েশা বলল-চলো, এই চন্দ্রগ্রাম ছেড়ে কোথাও চলে যাই।
দিলারা-কোথাও কেউ নেই। পুরো পৃথিবীটাই আমাদের জন্য কষ্টের। বিষক্ত সব চারপাশ।
আয়েশা কাঁদছে। আনিশা আর আনাছের কথা ভেবে দিলারার কাছ থেকে চলে এলো নিজের ঘরে। পাতিলে রাতের রান্না করা সামান্য ভাত ছিল। কলা দিয়ে ভাত মেখে আনাছকে খেতে দিল। বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে।

ভর দুপুর। বৃষ্টি থেমে গেছে। চন্দ্রগ্রামের পাশেই একটা বড় নদী। নদীতে দশ বারোজন জেলে প্রতিদিন মাছ ধরে। নদীর পাড়ে বাদাম চাষ করে এখানকার কৃষকরা। বাচ্চা দুটোকে রেখে চলে এলো এখানকার কৃষক নুরলের কাছে। কাজের সন্ধানে আয়েশা এর আগেও এখানে এসে কাজ করেছিল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আজ আবারও এলো।
নুরল-কাজ তো করতে পারবা কিন্তু অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে যে।
আয়েশা-আমার জীবনটাই কষ্ট।
নুরল- ওই যে দেখ নাও যাচ্ছে। চল নাওয়ে উঠে ঘুরি।
আয়েশা-মৃদু হাসে। মনে তার চাপা কান্না। পুরুষ তুমি, তোমার মনের অবস্থা বুঝি।
নুরল-কী?
আয়েশা-ঘুরতে পারি কিন্তু আমাকে কিছু করতে পারবি না। আমার হাত ধরবি না।
নুরল কোনো কথা বলে না। আয়েশার চোখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
আয়েশা-ঘরে দুইটা বাচ্চা। তাড়াতাড়ি যেতে যেতে হবে। বল কাজ দিবি কী না?
নুরল-ঠিক আছে কাল দুপুরের দিকে আসিস। কিছু বাদাম বিক্রি করবো। বস্তায় বাদাম ভরে দিস। একশো টাকা নিয়ে যা। আয়েশা কাজের আশ্বাস দিয়ে টাকাটা নিয়ে চলে আসে।

দিলারার ছোট্ট একটা ব্যবসা আছে। তার বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটি হাইস্কুল। সেই স্কুলকে ঘিরে স্কুলের মাঠের পাশে কয়েকটি দোকান আছে। আছে ছোট্ট একটা গ্যারেজও। এই গ্যারেজে রিকশাওয়ালারা ও দোকান মালিকসহ কিছু লোক দুপরে খায়। আর দিলারা তাদের জন্য প্রতিদিন দুপুরে ভাত, তরকারি রান্না করে নিয়ে আসে। প্রতি প্লেট খাবার ত্রিশ টাকা করে বিক্রি করে। এই নিয়ে চলে তার সংসার। দিলারা বিচ্ছেদপ্রাপ্ত। পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল স্কুল মাস্টার জামিলের সাথে। চন্দ্রগ্রামের মেয়ে মালিহার সাথে প্রেম করে বিয়ে করে চলে যায় জামিল। সেই থেকে একাকী জীবন। ছোট বেলায় বাবা মাকে হারিয়ে নানীর কাছে বড় হয়েছে সে। নানী মারা যাবার আগেই জামিলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নানী মারা যাবার পর জামিলও নেই। সেই থেকে হোঁচট  খেতে খেতে এমন দশা হয়েছে দিলারার, সব আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন একাই চলছেন। নিজের কষ্টের কথা খুলে বলারও কেউ নেই। মাঝে মাঝে আয়েশার সঙ্গে সময় কাটে।

অনেক দিন হয়ে গেল আয়েশার সঙ্গে দেখা হয় না দিলারার। রাতে মাঝে মাঝে তার ঘুম ভেঙে যায়। অনেক সময় মাঝ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেলে বালিশের নিচে থেকে গল্পের বইটা নিয়ে দিলারা পড়ার চেষ্টা করে। সকাল হলে ঘরের দরজায় বসে দক্ষিণের রোদে বাইরে দেখে। আকাশে কাক, পাখি উড়ে যায়। গাছ থেকে ফুলের সুবাস এসে ঘরে ছড়িয়ে যায়। দিলারা দরজা থেকে উঠে রান্না ঘরে যায়। ঘরে এসে দাঁড়াতেই দেখে আয়েশা।
দিলারা- আপা কেমন আছেন? আনিশা আনাছ ভালো?
আয়েশা-এই তো যাচ্ছে! আপনার কি খবর?
দিলারা-একা একা সময় কাটে না।
আয়েশা-চলেন, কিছু একটা করি। এভাবে আর চলে না। আপনিও একা, আমিও। চলেন পাগলির পুল যাই। ওখানে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করি। আমাদের জন্য পৃথিবী নয়। সবাই এই পৃথিবীতে সেলফিস। গত কয়েক বছর ধরে ঠিক মতো ঘুমাতে পারিনি। ঘুমাতে গেলেই দুঃখের সব খবর বার্তা এসে আমায় ভর করে। আপনি তো জানেন স্বামীহারা নারীর নোনা কষ্ট। রাস্তায় বের হতে পারি না। এ তাকায়, ও ঠিস করে। ক্ষেতে গেলে কৃষকরা এসে নানা কথা বলে। আর পারি না। আর পারি না। চোখে জল পড়ছে।

পাগলির পুলে ছোট্ট একটা বাজার আছে। এখানে বিভিন্ন গ্রাম থেকে আয়েশার মতো নারীরা এসে ব্যবসা করে। কেউ ছাগল পালে। কেউ ভাতের দেকান, কেউ চা, কেউ পান, সিগারেটের দোকান দিছে। কেউ ঘাষ বিক্রি করে। একেকে নারী একেক রকম ব্যবসা। করে। বিয়ের আগে দুই বছর পাগলির পুলে আয়েশা ছিল। তখন আক্কাস মিয়ার ভাতের দোকানে কাজ করতো।

আজকের সকালটা কেমন বিদঘুটে মনে হচ্ছে। গরম আবার সঙ্গে প্রচ- বাতাস বইছে। গত রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আয়েশা আজ পাগলির পুল যাবে। একু টুকরো সুখ আর বাচ্চা দুটোকে বড় করতে পারলে কিছুটা চিন্তা দূর হবে। এই আশায় পাগলির পুল গিয়ে যদি কিছু করা যায়। অন্তত এখানকার কিছু মানুষের যন্ত্রণা থেকে তো আপাতত কিছুদিন শান্তিতে থাকা যাবে পাগলির পুলে। কারণ নতুন জায়গায়। আনিশা আর আনাছ, সঙ্গে ব্যাগপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো আয়েশা। যাচ্ছে। আকাশে তখন হালকা মেঘ দেখা যাচ্ছে।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত