| 26 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: জননী গজাননী ও গাঁজাভূতের গল্প । তুষার বসু

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

       গল্পের শিরোনামেই সহৃদয় পাঠক বিস্মিত হবেন, এই বিশ্বাস থেকে প্রণোদিত হয়ে প্রথমেই তার যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দেবার প্রচেষ্টায় রত হই৷ পাঠক ‘গজাননী’ শব্দের অর্থ সম্পর্কে নানা ভাবনার কাল্পনিক জগতে বিচরণ করার আগেই জানিয়ে রাখি এ গল্পের প্রধান চরিত্র যে মহিলা, সেই রাজেশ্বরীদেবীর রূপসৌন্দর্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল তার অত্যুচ্চ নাসিকা৷ সেই বৃহৎ দীর্ঘ নাসিকা তার সকল সৌন্দর্যকে অবহেলায় নস্যাৎ করে সবার আগে নিজেকে প্রদর্শন করে৷ ঈষৎ শ্যামবর্ণা, দীর্ঘ আয়ত চক্ষু এবং কুঞ্চিত কেশদাম, সমস্ত কিছুই  অপ্রাসঙ্গিক হয়ে, হিমালয়ের মধ্যে এভারেস্ট, ধর্মতলার মধ্যে দ্য ফর্টিটু, প্যারিসের মধ্যে আইফেল টাওয়ার, ব্রাজিলের মধ্যে যীশুমূর্তির মতোই সগৌরবে সেই নাসিকা দৃশ্যমান হতো৷ সেই সূত্রেই গ্রামমধ্যস্থ ললনাদের কাছে তার আর একটি নাম বিশেষভাবে প্রচলিত হয়৷ দ্বিপ্রাহরিক সর্বজনীন পরনিন্দা-পরচর্চার অবসরে তিনি ‘নাকেশ্বরী’ নামেই উল্লেখিতা৷ কিন্তু সেই সর্বনারীস্বীকৃত নামটি স্থানীয় যুবকদের কাছে অনভিজ্ঞাত বা অমনোনীত হওয়া, কোন কারণে জানা নেই, তারা ভিন্নতর একটি অভিধার সন্ধান করতে থাকে৷ অবশেষে বিনায়ক গজাননের স্ত্রী-সংস্করণ হিসাবে তারা ‘গজাননী’ নামটি সাদরে গ্রহণ করে এবং এইনামেই সর্বদা তাকে নির্দেশ করে৷ বলাবাহুল্য যে সেটি তারা করে থাকে জনান্তিকে৷ কারণ এহেন যুবকোচিত চাপল্যবাহিত নামকীর্তন যদি অণুমাত্রও রাজেশ্বরীর কাছে পৌঁছায় তবে যুবকদের ঊর্ধতন চতুর্দশ পুরুষের আদ্যশ্রাদ্ধ পুনরায় সম্পন্ন হবে এই স্থির বিশ্বাসও তাদের ছিল৷ এভাবেই রাজেশ্বরী নতুনতর  নাম ধারণ করেন৷ এরপর আসে বিশেষণ প্রয়োগের বিষয়টি৷ ‘জননী’ শব্দ নারীমাত্রেরই অলঙ্কারস্বরূপ৷ কিন্তু এক্ষেত্রে জননী বিশেষণটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি জনশ্রুতি আছে৷ শোনা যায় এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক কোনও এক দ্বিপ্রহরে এসে দাঁড়ায় রাজেশ্বরীর দরজায়৷ বেশ কয়েকবার ‘দুটি ভিক্ষা দেবে মা জননী’-  এই প্রার্থণাবাক্য উচ্চারণ করে৷ রাজেশ্বরী তখন অন্যকাজে ব্যস্ত থাকায় তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হতে পারেননি৷ একটু পরে পাত্রে চাল নিয়ে যখন তিনি ভিক্ষুকের কাছে উপস্থিত হন, তখন সেই বৃদ্ধের ক্লান্তিতে এবং ছায়ার আবেশে চোখদুটি বুজে এসেছিল৷ অভ্যাসবশতঃ সেইভাবেই ‘মা জননী দুটি ভিক্ষা দাও’ বলে যাচ্ছিল৷’জননী’- বলে হঠাৎই চোখ খুলে সামনে রাজেশ্বরীকে দেখে৷ তাঁর সেই অত্যুচ্চ নাসিকা বৃদ্ধকে এমনই বিহ্বল এবং কিংকর্তব্য- বিমূঢ় করে দেয় যে, সে অচেতনভাবে ‘দুটি ভিক্ষা নাও’ বলে হস্তধৃত ঝুলিটি উপুড় করে দেয়৷ দ্বারপ্রান্তে ভিক্ষালব্ধ চাল ছড়িয়ে পড়ে৷ তার থেকে বেশি তীক্ষ্ণ চিৎকারে রাজেশ্বরী সেই বৃদ্ধ ভিক্ষুককে যৎপরোনাস্তি ভর্ৎসনা করতে থাকেন৷ কয়েকটি বৃক্ষবাসী কাক ও পক্ষী যারা উৎসুকনেত্রে সেই বিক্ষিপ্ত চালগুলি উদরসাৎ করার চেষ্টায় ছিল, তারা সেই সুতীক্ষ্ণ কণ্ঠধ্বনিতে ভয় পেয়ে নিরুদ্দেশ সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে৷ প্রত্যক্ষদর্শীর মতে সেই সময় একটি কাক হতচেতন হয়ে বৃক্ষশাখা থেকে ঝুপ করে পতিত হয়৷ কিন্তু এইযুগে প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যও সর্বদা আদালতগ্রাহ্য নয়, তাই আমরা সে প্রসঙ্গটিকে শিল্পের অতিরিক্ততা হিসাবে বাদ দেব৷ কিন্তু সহদেব বাউরির স্ত্রী, যে রাজেশ্বরীর বাড়িতে ঠিকে কাজের লোক হিসাবে নিযুক্ত, সে ঠিক এভাবেই লোকসমক্ষে ঘটনার বিবরণ দিয়েছিল৷ ফলশ্রুতিতে রাজেশ্বরীর আরও একটি বিশেষণপ্রাপ্তি ঘটে,- ‘জননী’ ৷এই হল ‘জননী গজাননী’ নামের উৎপত্তির প্রামাণ্য ইতিবৃত্ত৷

       এরপর থেকে এই আখ্যান বর্ণনায় আমরা রাজেশ্বরীকে ‘গজাননী’ নামেই উল্লেখ করতে থাকব, কারণ এর ফলে একদিকে তাকে চিহ্নিত করা সহজতর হবে এবং অন্যদিকে এই নামদাতা যুবকেরা আত্মশ্লাঘা অনুভব করে অধম লেখককে তাদের রোষবহ্নি থেকে দূরে রাখবে৷ সে যাই হোক 

অবসরপ্রাপ্ত স্বামী মুরলীধর এবং কলিকাতার একটি ছোটখাটো অফিসে কর্মরত পুত্র রতনলালকে নিয়ে গজাননীর দিন একরকম সুখেই অতিবাহিত হচ্ছিল৷ ‘সব সুখই সুখ নয়’ এই আপ্তবাক্য অনুযায়ী গজাননী স্বামীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে তাদের একতলা একঘর ও একদালানবিশিষ্ট বাড়িটিকে দ্বিতলে পরিণত করার প্রয়াস করল৷ গজাননীর একমাত্র পুত্র রতন বাড়িটির নির্মাণ এবং পরিবর্ধন-পরিমার্জন কার্যে নিবিড়ভাবে মনোযোগী হয়ে উঠল৷ এতদিন রতনের যাবতীয় অবসর সময় ব্যয়িত হত মা গজাননীর সঙ্গে জাগতিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানগম্ভীর আলোচনা করে৷ রতনের পূর্ণ বিশ্বাস ছিল তার মা সব জানে৷ তাই সে কখনওই এই সমস্ত বিষয় নিয়ে তার পিতা মুরলীধরের সঙ্গে আলোচনা করেনা৷ কাজেই অবসরপ্রাপ্ত প্রৌঢ় মুরলীধরের সময় কাটে প্রাতঃকালীন বাজার করায়, মধ্যাহ্নকালীন সংবাদপত্রপাঠে, বৈকালিক আড্ডায় এবং সান্ধ্যকালীন দূরদর্শন-দর্শনে৷ পিতা ও পুত্রের দৈবাৎ সাক্ষাৎ বিনা আলাপচারিতায় কাটে৷ এনিয়ে রতনের যেমন আগ্রহ নেই তেমনই মুরলীধরেরও নেই কোনও ব্যগ্রতা৷ এহেন নির্বান্ধব রতনলালের সঙ্গে আকস্মিক সখ্যতা জন্মায় বাড়ি তৈরির কাজে নিযুক্ত প্রায় সমবয়সী যুবক জটাধরের৷ বাড়ি তৈরির নানান খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে জানার সীমাহীন আগ্রহের অন্ত ঘটায় জটাধর৷ একটিন সিমেন্টের সঙ্গে কতটিন বালি মেশালে গাঁথনির মশলা তৈরি হবে, ইঁটের কতরকম নম্বর আছে, সরু বালি মোটা বালির তফাৎ কি,বালি কোথা থেকে আসে, কেন আগের দিনের গাঁথা দেওয়ালে জল দিতে হবে, ইত্যাকার এক অসীম প্রশ্নমালা নিয়ে রতন ব্যস্ত রাখে জটাধরকে৷ অন্য মিস্ত্রিরা রতনের এইসব প্রশ্নের দায়সারা উত্তর দিলেও জটাধর অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে রতনের এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়৷ ফলে জটাধরকে পছন্দ হয় রতনের৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় জটাধরকে আর পাওয়া যায় না৷ আর অসংখ্য অনুত্তরিত প্রশ্নমালা রতনের মগজে ছুঁচ ফোটাতে থাকে৷ অবশ্য অচিরেই তার সমাধান করে ফেলে রতন৷ জটাধরকে চা-মুড়ি-তেলেভাজার লোভ দেখিয়ে রোজ সন্ধ্যায় ডেকে নেয় রতন এবং অফিস থেকে ফিরেই জামাকাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে জটাধরকে নিয়ে ছাদের উপর উঠে যায় সে৷ নতুন দেওয়ালে হাত বুলিয়ে দেখে কতটা বাড়ি তৈরি হল৷ তার সঙ্গে নতুনতর প্রশ্নের উত্তর খোঁজে সে৷

       এইসূত্রেই অচিরে একটি ঘটনা ঘটে৷ বাড়ির কাজে ব্যবহৃত বালির রুক্ষ কণার উপর অনভ্যস্ত পায়ে চলাফেরার মধ্যেই কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে তার পায়ের একটি অংশে ক্ষতের সৃষ্টি হয়৷ প্রথমে তাতে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি রতন৷ কিন্তু দিনদুই পরে সেই ক্ষতটি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে৷ রতনলালের জ্বর আসে, সঙ্গে পায়ে প্রচন্ড যন্ত্রণা৷ স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে এসে খাওয়ায় জ্বর ও যন্ত্রণা সাময়িকভাবে কমে৷ কিন্তু আবার জ্বর আসে, ডাক্তার আসে এবং অবিলম্বে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে বেশ কিছুদিন যন্ত্রণাভোগের পর রতন বাড়ি আসে৷ এই ঘটনা রতনের মনে এমন ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যে, বালির সঙ্গে তার শত্রুতা জন্মায়৷ ইতিমধ্যে বাড়ির কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যায়৷ জটাধর যথারীতি সন্ধ্যায় আসে এবং  রতনের সঙ্গে নতুন ঘরে ও ছাদে ওঠে৷ কিন্তু এখন রতন সর্বত্র একটি করে ঝাঁটা রেখে দেয়৷ দোতলার ঘরে পা দিয়েই রতন জটাধরকে জিজ্ঞাসা করে-

– আজ দোতলায় ঝাঁট দিয়েছে তো?

জটাধর উত্তর দেয়

-ঝাঁট কি বলছো, সব ঘরে-দালানে ন্যাতা দিয়ে মোছা পর্যন্ত হয়েছে৷

-তাহলে আর বালি নেই, কি বলিস?

-নাঃ৷ বালি আসবে কোত্থেকে?

    কিন্তু অসীম যত্নে এবং তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানে রতন ঘরের মেঝেয় প্রতিদিনই দু’একটি বালুকণা আবিষ্কার করে৷ এরপর রতন দোতলার ছাদে অভিযান করে এবং সেখানেও তার বালুকানুসন্ধান চলতে থাকে৷

-দ্যাখ ছাদে কত বালি৷

-কোথায় বালি? ঢালাইয়ের ছাদ ওরকম খরখরে হয়েই থাকে৷

     জটাধর তার বিশেষজ্ঞের মতামত জানায়৷ কিন্তু রতনের মনে বিশ্বাস জন্মাতে ব্যর্থ হয়৷

-বালি নেই বলছিস? আচ্ছা দেখি৷- এই বলে  রতন ছাদে সাবধানে হাত বুলোতে থাকে এবং যথারীতি হাতের ঘর্ষণে ছাদ থেকে বালি উঠে আসে৷ সোল্লাসে রতন জটাধরকে বালির নমুনা দেখায়-

-এই দ্যাখ, এখানে পা দিয়ে দ্যাখ বালি কিনা!

-হ্যাঁ, তাইতো দেখছি৷ বাধ্য হয়ে বালির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় জটাধর এবং রতনলাল পুনরায় ঝাঁটা সংগ্রহ করে আনে৷ ছাদে ঝাঁট দেওয়া হয়৷ পুরোটা ঝাঁট দেওয়া শেষ হতে প্রায় দশটা-সাড়ে দশটা বেজে যায়৷ জটাধর বিদায় নেয়৷ এই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় রতনলালের বাড়িতে ঝাঁটার আকাল পড়ে এবং অনতিবিলম্বে ছাদের ঢালাইয়ের উপরিভাগে পাথরকুঁচির প্রাধান্য দেখা দেয়৷

        প্রাত্যহিক এই নতুন কর্মসূচীতে এতদিনের ধরাবাঁধা রুটিনের কিছু পরিবর্তন ঘটে৷ ছাদ থেকে নেমে নৈশভোজ এবং তারপর গজাননীর সঙ্গে তার আলোচনা শুরু হয়৷ এই পর্ব শেষ হতে প্রায়শই রাত্রি সাড়ে বারোটা-একটা বেজে যায়, কারণ এই যে, আলোচ্য বিষয়ের পর্যাপ্ত উপস্থিতি৷ অফিসযাত্রা এবং অফিসের বিষয় ছাড়াও নানা বিষয়ে আলোচনা চলে৷ নারী নিগ্রহ, করোনা পরিস্থিতি ইত্যাকার ‘কারেন্ট টপিকস’ তো আছেই, সঙ্গে মোহনবাগানের জাতীয় লিগ জয়, ভারতীয় ক্রিকেটদলের বিদেশ সফর, বাড়ির পাশের পুকুরটির জল কমে যাওয়া, গ্রামে হনুমানের উপদ্রব, কালিবাড়ির ঘন্টার দড়ি ছিঁড়ে যাওয়া, নতুন গামছা কেনার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নানান বিষয়সমূহ নিয়ে এই আলোচনাপর্ব শেষ হতে হতে অর্ধরাত্রি পার হয়ে যায়৷ আসলে গজাননী তার এই পুত্রটিকে যেমন একান্তভাবে নিজের অঞ্চলছায়ে বেঁধে রাখতে চেয়েছে, রতনলালও তেমনি বাধ্য পুত্রের মতো সেই অঞ্চলটিকেই আশ্রয় করেছে৷ প্রৌঢ় স্বামীর সঙ্গে যেমন গজাননীর প্রয়োজনের কথা ছাড়া অন্য কথা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, পুত্র রতনেরও তেমনি জননী ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তির সঙ্গে এই সমস্ত বিষয়ে আলোচনার অবকাশ বা আগ্রহ নেই৷ সে যাই হোক গজাননী ও রতনলালের এই জীবনচর্যা পৃথিবীর আহ্নিকগতির মতোই ধ্রুব ও নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে যাচ্ছিল৷

        এরপরই অবধারিতভাবে এ কাহিনীতে যে প্রসঙ্গটি আলোচিত হওয়া উচিত, সেটি হল রতনলালের বিবাহ৷ চাকুরিরত যুবক যার নূতনগৃহ নির্মিত হয়েছে, এমন পাত্রের জন্য বিবাহপ্রস্তাব আসাটা নিতান্ত স্বাভাবিক৷ কিন্তু গজাননীর সে বিষয়ে উৎসাহের যথেষ্ট অভাব৷ তার কারণ পুত্র নিজঅঞ্চলছায়া থেকে বের হয়ে কোনও এক নবযৌবনার বস্ত্রচ্ছায়ায় আশ্রয়গ্রহণ করবে এটা ভেবেই আশঙ্কায়-দুর্ভাবনায় গজাননীর দিনের আহার এবং রাত্রের নিদ্রা দুইই যথেষ্ট পরিমানে কমে যেতে থাকে৷ এ পৃথিবীতে, বিশেষত গ্রামবাংলার মতো পৃথিবীতে অপরের সুখে উৎকন্ঠিত হয় না এমন মানুষের নিতান্তই অভাব৷ এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গজাননীর আত্মীয়-পরিজন, জ্ঞাতি-কুটুম্ব, পাড়া-পড়শি সকলেই গজাননীকে পুত্রের বিবাহ দেবার পরামর্শ দিতে থাকে৷ গজাননী কিন্তু নিজ বিশ্বাসেই অটল থাকে৷ তবে শেষপর্যন্ত যেদিন সহদেব বাউরির স্ত্রীও তাকে অনুরোধের সুরে পরামর্শ দান করে

-এবার রতন দাদাবাবুর বিয়েটা দিয়ে দাও মা,

তখন আর থাকতে না পেরে মুখ ফসকে বলেই ফেলেন- তা একটা মেয়ে টেয়ে দেখো৷ এটা যে নিতান্ত কথার কথা তা গজাননীর থেকে কেইবা ভালোাজানবে! কিন্তু তার ফল এই যে, গ্রামস্থ কারোরই জানতে বাকি রইল না যে রতনলালের

জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে৷ অতঃপর সকলেরই বিবাহযোগ্যা আত্মীয়-অনাত্মীয়কন্যার গুণাবলী সমন্বিত বায়োডেটা এবং ফটোশপের বাহাদুরিকৃত

অসামান্য আলোকচিত্রের সম্ভার গ্রামে এসে পৌঁছাতে লাগল৷ বলাবাহুল্য গজাননীর সঙ্গে আলাপচারিতার অবসরে সেই সমস্ত ছবি ও বিবরণ জমা দেবার জন্য অনেকেই তৎপর হয়ে উঠল৷ নিতান্তই বিরক্ত এবং একান্তই বাধ্য হয়ে গজাননী এক রবিবার সপুত্র ও সজটাধর পাত্রী সন্দর্শনে রওনা দিলেন৷ তিনজনে একসঙ্গে যাওয়া শুভকর নয় বলে জটাধরকে একমাইলল এগিয়ে বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে হল৷ পাত্রীর সঙ্গে রতনলালের পক্ষ নিয়ে যাবতীয় কথাই জটাধর বলে এবং গজাননী নানান প্রচলিত-অপ্রচলিত

উপায়ে পাত্রী যাচাই করে৷ অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় এই পাত্রীর সঙ্গেই রতনলালের শুভবিবাহ সম্পন্ন  হবে৷

       যথাসময়ে ও যথালগ্নে রতনলালের সঙ্গে নির্বাচিতা পাত্রী মাধবীর বিবাহ সম্পন্ন হল৷ ডেকরেটার, কেটারিং, ফুলওয়ালা, পুরোহিত, নাপিত ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে গজাননী নিজেই সিদ্ধান্ত নিল৷শুধু রতনলালের বিবাহে বরকর্তা সেজে যাওয়া এবং প্রীতিভোজের আসরে সিল্কের পাঞ্জাবি ও চওড়া ধাক্কাপাড় ধুতি পরে হাসিহাসি মুখ করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া মুরলীধরের আর কোনও দায়িত্ব ছিলনা৷ অবশ্য কয়েকবার ফোটোগ্রাফারের অনুরোধে নববধূর দুইপাশে গজাননীর সঙ্গে তাকেও দাঁড়াতে হয়েছিল৷

        পুত্রের বিবাহ দিয়ে গজাননীর বুক বারংবার আশঙ্কায় দুলে উঠতে লাগল৷ এবার বোধহয় তার সাতরাজার ধন এক রতন হাতছাড়া হয়ে যায়৷ কিন্তু গজাননীর সব আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে রতনলাল তার বিবাহ-পূর্ববর্তী রুটিনের প্রায় সবটুকু অনুসরণ করতে লাগল৷ ঘুম থেকে উঠে দ্রুত প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে সে স্নান করে এবং আহারাদি করে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷ অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় ছাড়ে, মুখহাত ধোয়, সামান্য কিছু জলখাবার খেয়ে জটাধরকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে উঠেযায়৷ সেখানে বালি সরানো সেরে নিচে নামে, নৈশভোজ সারে এবং যথারীতি গজাননীর সঙ্গে আলোচনাচক্র চালিয়ে যায়৷৷ ঘড়িতে সময় অর্ধরাত্রি পার হয়ে যায়৷ যখন রতনলাল নিজশয্যায় মাধবীর পাশে শুতে যায় তখন সারাদিনের ক্লান্তিতে সে যেমন নিদ্রাতুর হয়ে ওঠে, নববিবাহিতা বধূটিও গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে থাকে৷ বস্তুত জননী গজাননী ভিন্ন দ্বিতীয় কোনও মহিলার সঙ্গে রতনলাল একটি-দুটির বেশি কথা বলতে পারেনা৷ তার গলা শূকিয়ে আসে, জিভের অবাধ্যতা স্পষ্টই টের পেতে থাকে সে৷ তার জিভ একই ধ্বনিগুচ্ছে আটকে যায় এবং পরবর্তী কথার অভাব দেখা দেয়৷ ফলে রতনলালের পক্ষে নববধূর নিদ্রামগ্নতা ঈশ্বরের অযাচিত আশীর্বাদ বলেই বোধ হয়৷ মাধবীও রতনলালের সঙ্গে দু’একবার বাক্য বিনিময় করতে গিয়ে দেখেছে তাতে শুধু বাক্যদানই হয়, বিনিময়ে  বাক্যপ্রাপ্তি ঘটেনা৷ সে কারণেই সেও বিশেষ কথা বলার চেষ্টাও করেনা৷ এভাবেই কাঁটাতার ঘেরা ভারত পাকিস্থানের দুই পৃথক ভূমিখন্ডের ন্যায় দুজনে শয্যায় থাকে৷ রাত্রি অতিবাহিত হয়৷

     সূর্যের নিজস্ব নিয়মে পৃথিবীতে দিন ও রাত্রি পর্যায়ক্রমে আসে ও যায় এবং  ঋতু পরিবর্তনও ঘটে৷ ফলতঃ গ্রীষ্মের পর বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত,বসন্ত পরম্পরা মেনেই পরপর আসে৷ কিন্তু রতনলালের জীবনে কোনও পরিবর্তন ঘটেনা৷ গজাননীর রাত্রের নিদ্রা আবার গভীরতর হয় ও দিনের আহারের পরিমান বাড়তে থাকে৷ এইসময়েই বাউরিপাড়ায় একটি গুজবের উৎপত্তি ঘটে৷ মদন বাউরি অধিক রাত্রে বাড়ি ফেরার পথে একটি ভূতের দর্শন পায়৷ বলা বাহুল্য প্রকৃতই এমন কোনও ভূত মদন দেখেনি৷ লক্ষ্মণসাধুর আশ্রমে গঞ্জিকাসেবন করার সময় কলিকাটি ফেটে যায় এবং শীতের পোষাকে আগুন ধরে যাওয়ায় তার শরীরের কয়েকটি জায়গায় আগুনের তাপে ফোস্কা পড়ে৷ বাড়ি ফিরে মদন একটি ভূতের গল্প প্রচার করে৷ গল্পটি এই যে কীর্তন শুনে বাড়ি ফেরার পথে সে ভূতের পাল্লায় পড়ে৷ সেই ভূতটি মাঠের বটতলায় বসে গঞ্জিকা সেবন করছিল৷ প্রসাদ পাবার আশায় তার কাছে গিয়ে মদন জিজ্ঞাসা করে- কিগো, একছিলিম হবে নাকি? একথা শুনে ভূতটি তার হাতে ছিলিমটি দেয় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়৷ ছিলিমটি তৎক্ষণাৎ ফেটে যায় এবং চতুর্দিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷ সত্যমিথ্যা মিশিয়ে এ গল্পটি মদনকে বানাতে হয়, কারণ লক্ষ্মণসাধুর আড্ডায়গাঁজা খেতে যাওয়ার কথা শুনলে তার স্ত্রী এই ফোস্কার উপরেই ঝাঁটার আস্ফালন ঘটাবে এই আশঙ্কা তার ছিল৷ পরদিন থেকে সকলেই প্রায় সে গাঁজাভূতের দর্শন পেতে থাকল৷ সরকারদের নারকেলগাছে, ফটিক সামন্তর গোয়ালঘরে, ঘরের জানালায়, বোসেদের সদরপুকুরে ইত্যাদি নানা জায়গায় ভূতটির দর্শন পাওয়া গেল৷ বাস্তবিক এই সমস্ত ঘটনার পিছনে গ্রাম্য অপকর্মগুলিই এতাবৎকাল ছিল বলে কেউই সেগুলিকে গুরুত্ব দেয়নি৷ কিন্তু মদনকথিত গাঁজাভূতের গল্প প্রচারিত হওয়ায় গাঁজাভূতের রহস্যময় উপস্থিতি সকলকে আতঙ্কিত করে তুলল৷ গজাননীও আতঙ্কিত হল এবং গ্রামস্থ অন্যান্য ভূতসহ গাঁজাভূতের গল্প বলে বধূমাতাকেও সন্ত্রস্ত করে তুলল৷

           এ পর্যন্ত কাহিনীসূত্রটি পাঠ করে বিচক্ষণ এবং ধৈর্যশীল পাঠক অবধারিতভাবেই প্রশ্ন তুলবেন যে, গজাননীর এই আখ্যানবৃত্তে গাঁজাভূতের মতো একটি কল্পিত গাঁজাখুরি ভূতের কি সম্পর্ক থাকতে পারে? পাঠক, আমি হলেও এই একই প্রশ্ন করতাম৷ কিন্তু এই আখ্যানবৃত্তের পরিশিষ্ট ঘটনাপ্রবাহে গাঁজাভূতের গুরুত্ব প্রকাশ পাবে এবং অচিরেই পাঠক তার প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করতে পারবেন এ বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চিত৷ অতএব হে সহৃদয় পাঠক, আসুন আমরা এই আখ্যানের পরবর্তী অধ্যায়ে প্রবেশ করি৷

       সেদিন ছিল চৈত্রমাসের কৃষ্ণা দশমী বা একাদশীর রাত্রি৷ দিনে না হলেও রাত্রির শেষদিকে শীত অনুভব হয়৷ রতনলাল তার প্রাত্যহিক অভ্যাসমতো রাত্রি বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ মাধবীর শয্যাপার্শ্বে শয়ন করেছে৷ তারও কিছু পরে মাধবীর ঘুম ভাঙল৷ শীত বোধ হওয়ায় শয্যাপার্শ্বের জানালাটি সে বন্ধ করতে যায়৷ শেষ রাতের মরা জ্যোৎস্নায় সে

 অকস্মাৎ দেখে তাদের বাড়ির পাশে আমগাছের নিচে কেউ বসে আছে৷ ভালো করে দেখতে যেতেই সে উঠে দাঁড়ায় এবং তার অস্পষ্ট অন্ধকার মুখের সামনে একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷ তারপরেই দড়াম করে জানালাটি বন্ধ করেই  ভীত আতঙ্কিত মাধবী- বাবাগো, গাঁজাভূত, এই বাক্যবন্ধ উচ্চারণ করে সবলে রতনলালকে জড়িয়ে ধরে৷ হঠাৎ নরম পেলব নারীশরীরের স্পর্শে ধীরে ধীরে রতনলালের জাগরণ ঘটল৷ সদ্য নিদ্রোত্থিত দুই চক্ষুর সম্মুখে দুটি বন্ধ চক্ষু এবং তার ঠোঁটের সম্মুখে এক মধুময় ওষ্ঠাধর৷ বিহ্বল রতনলালের বিস্মিত শরীরে এক অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দের শিহরণ প্রবাহিত হতে থাকল৷ সে দেখে সেই বন্ধ চক্ষুদুইটি ক্রমশ প্রস্ফুটিত হল এবং কমলালেবুর কোয়ার মতো ওষ্ঠাধর তার ঠোঁটের উপরে অধিষ্ঠান করল৷ রতনলাল তার জন্মজাত প্রবৃত্তিবশে সেই নরম, পেলব, কমনীয় এবং কামনীয় নারী শরীরটিকে দুই বাহুর আবেষ্টনীতে বদ্ধ করল৷

       পরদিন থেকেই সূর্য হয়ত পশ্চিমদিকে উঠল না, কিন্তু আমূল পরিবর্তিত হল রতনলাল৷ এখন সে অনর্গল স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে যায়৷ যা দেখে গজাননী গজগজ করে- এতো কি কথা আছে রে বাপু বৌয়ের সঙ্গে৷ রতনলাল অফিস থেকে  ফিরে মুখ-হাত ধুয়ে মাধবীর সঙ্গে নানান জাগতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে৷ জটাধর এসে বসে থাকে আর মশা চাপড়ায়৷ আর গজাননী প্রায়ই ছাদে উঠে যায় এবং ঝাঁটার খোঁজ করে৷

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত