Categories
উৎসব সংখ্যা:সাতটি দিবসের কবিতা । মারুফ আহমেদ নয়ন
আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
শনিবার
আশ্চর্য এক শীতের সকাল। দুটো চোখ ঠান্ডায় জমে পাথর হয়ে গেছে। পাথরের চোখ কখনো মানুষের ভাষায় কথা বলে না, তার সুখ দুঃখের কোন অনুভব নেই। ফলশ্রুতিতে প্রথম দৃশ্যের আড়ালে বাদ পড়ে যায়, হরিণ শাবকের সাথে বাঘিনীর সন্ধি প্রস্তাব।
চর্তুদিকে স্বর্ণ ও হীরের পর্বত আবিষ্কৃত হলে, দীর্ঘ বনভূমি জুড়ে পড়ে থাকে করাত কলের হাহাকার। পশু ও পাখির হাড়ের বাদ্যযন্ত্র। আমাকে কি করে প্রলুব্ধ করবে একটি মাত্র কমলালেবুর জন্যে ! দেখো, আমি হয়ে গেছি জাগতিক মোহ শূন্য বালক।
জানো তো, পৃথিবী এক প্ররোচনাময় কারাগার। একটি তামার আংটি ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে যায়, তাকে উদ্ধার করো। সঙ্গিনীকে উপহার দাও, মৃত গোলাপগুচ্ছ। যদি এর ব্যতিক্রম হয়, তবে তুমি অভিশপ্ত হবে, পেয়ে যাবে নিঃসঙ্গ মানুষের জীবন।
রবিবার
এক অন্ধ মেয়ের গল্প জানি, সম্ভবত জেলে পল্লীতে তার ঘর। সারা দেহে নুন ও আমিষের ঘ্রাণ। বুঝি, সমুদ্র তার খুব নিকটেই তবুও সে হেঁটে গেলো এই অরণ্য পথের দিকে একাকী। তার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে পৌঁছে গেছি বনের গভীরে।
যেখানে থাকে না মানুষ, সেখানে ভেঙ্গে যায় বাহারী ফুলের শরম। নিজেকে নগ্নের মতো মেলে দেয়।মুখরিত হয় মৌমাছিদের গুঞ্জন। তখন তুমি আমাকে একটি তিমি বিষয়ক কবিতা শোনাতে পারো। কেনো যে তারা মৃত্যু ভালবেসে উঠে আসে, তীরের বালিতে।
চিরকাল এইসব মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকবো। জল ও মাছের স্বভাব জেনে নিয়ে, আমিও পুচ্ছ লাগিয়ে সাঁতার কাটবো জলে। এরই ফাঁকে ঝরে যাবে, আসন্ন গ্রীষ্মের গীতিকা, ভরা বর্ষার মৌসুম, যৌবনাবতী মেঘের গর্জন, ঘুমোতে পারিনা। বন্দরে ঘোষণা হয়, বিপদ সংকেত। অহংকারী মেয়ে তুমি। তুমি কি হারিয়ে ফেলা কোনো রবিবার, মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি।
সোমবার
গহীন অরণ্যের পথে পথে ফুটছে গোলাপ ও চন্দ্রমল্লিকা। তার পাশে নাম না জানা উদ্ভিদের সারি।
কোনটির মধ্যে লুকিয়ে আছে বিষের বহর, কোনটির মধ্যে মধু। জানি না, শব্দ মোহে আছন্ন হয়ে আছি। অথচ আমাকেও জেনে নিতে হবে, উদ্ভিদের শ্রেণী বিভাগ, প্রাণের বিকাশ।
আমার উড়ু উড়ু প্রজাপতি মন, ঝোপের কাঁটায় বসে থাকে। বিষন্ন বালকদের মার্বেল গড়িয়ে দেয়া দেখে। ফিরিয়ে চায় আরও কিছু বালক বেলা, দুপুরের তপ্ত রোদের লিরিক। তখন স্মৃতির ভেতরে, আমার একটা পেয়ারা গাছের দুঃখবোধের কথা স্মরণ হয়, তাকে কেটে করাতিরা কয়েকটি টুকরো বানিয়ে ফেলে মুহুর্তেই।
জানি, পৃথিবীর দুঃখবোধ একমাত্র করাত এবং মানুষ। জীব জগৎ এর শৃঙ্খলা ও বৈচিত্র্যতায় মুগ্ধ হয়েছি বহুবার। গাছেদের শরীরে দগদগে ক্ষতের কাল। আমার বেঁচে থাকার আকাঙ্খা লীণ হয়ে যায়। তোমাকে আবিষ্কার করি, এমন মুমুর্ষ দিনে, আমার আত্নার অনুবাদ। প্রিয় সোমবার, আমি হাওয়ায় কান পেতে রই, তুমি আসবে বলে।
মঙ্গলবার
তোমার মঙ্গল হোক, সৌন্দর্যের দেবী। আমার এই শুভ কামনা তোমাকে আবিষ্ট করে রাখুক। যেমন, চুম্বক লোহাকে আবিষ্ট করে রাখে। অথচ লোহা ছিন্ন করে যেতে পারে না চৌম্বকীয় টান। কেমন জানি, আমিই তোমার থেকে ছিটকে গেলাম। ভালবাসার ভূমিতে ভুল চাষাবাদে বাড়ালাম কীটের ফলন।
নভেম্বরের এক রাত্রিতে, পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলাম। তারপর থেকে হাঁটছি, শেষ হয়নি পথ এবং তোমার দূরত্ব। আমার ক্লান্তি তোমার ক্ষমার মতো সুন্দর। বেদনা খুঁড়ে খুঁড়ে নিজেকে পান করেছি। চিবিয়ে খেয়েছি, যেনো যকৃত ও ফুসফুস। কবিতা, আমাকে তুমি করো ক্ষমা।
আমিও যেনো সেই গরুর রাখালের মতো দিন কাটাই। সন্ধ্যায় গৃহে ফিরি। বুঝি, অবলা প্রাণীদের ভাষা। কেনো যে বুঝতে গেলাম তোমার রহস্যময়তা। মাথার ভেতরে এখন বাজপাখির ছানা কিচিরমিচির করতে থাকে। রক্তের ভেতরে একটা মাকড়সা জাল বোনে। বুঝি, সবই প্ররোচনা, এইসব রাত্রি, অর্থাৎ মঙ্গলবারে দেহ থেকে অন্ধকারে বাঁদুড়ের মতো বেরিয়ে পড়ি।
বুধবার
লোকশ্রুতি এমন, পৃথিবী থেকে বহুদূরে। সূর্যের নিকটে, চন্দ্র গ্রহের মতো সহস্র খাদের নগরীকে বলা হতো বুধ। অথচ একটি দিনকে সকাল ও সন্ধ্যায় ক্ষীণ আলোক রেখায় চলে যেতে দেখি। তখন তোমাকে ভাবি, উনুনের হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটে উঠা ভাত, ঝেরে ফেলা মাড়ের মতো নির্মল আনন্দ।
যেনো আমার ক্ষুধা-পিপাসা-বাসনা তুমি। অন্য কিছু চাইনি। যেমন লোকে কামনা করে অফুরন্ত দৌলতের পাহাড়। অথচ তৃপ্ত হবার মতো কিছু নেই, সকলই মায়া ও মোহের প্রাচুর্য। কেবল শিশুদের শেখা আধো বুলির আনন্দ রয়ে যাবে। এস্কিমোদের গ্রামে একদিনের অতিথি হবো।
শীল মাছের হৃদপিন্ডের তেলে জ্বালানো আগুনের প্রদীপ নিভে যাবে।
সাদা ভাল্লুকগুলো বরফের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করবে। গড়িয়ে পড়বে। অচেনা মানুষের গায়ের গন্ধে তাদের এসে যাবে বিরক্তি। নগরে থাকা মানুষ, তুমি কেনো এলে এই উওর গোলার্ধের দেশে। অথচ আমার সমস্ত ক্লান্তি উড়িয়ে দিয়েছি বাষ্পাকারে। দিনটি সম্ভবত বুধবার ছিলো।
বৃহস্পতিবার
বহুকাল ধরে, তোমার ঘৃণার মেঘপুঞ্জ ভেসে বেড়িয়েছে আকাশে, তারপর বৃষ্টি নামছে। একটানা একটা গাড়ির বিকট আওয়াজ, তন্দ্রার ভেতরে আমাকে পিষে চলে যাচ্ছে। এড়াতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে, কেনো তোমাকে ভালবেসে, নিজেকে খুন করলাম। এর চেয়েও তো মুক্ত পাখিদের জীবন বেশ ছিল। উড়ে বেড়াতাম গাছের শাখা-প্রশাখায়।
স্ত্রী পাখিটির প্রতি মুগ্ধতায় গাইতাম, গানের স্বরলিপি। অথচ ভুলে গেলাম সবকিছু। যেমন স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষ, মনে করতে পারে না, পথের বাঁক ও সরল রৈখিক দূরত্ব। ফলে সার্কাস পালানো জোকারের জীবনি লিখি, দাপিয়ে বেড়ায় জীবনের রঙ্গমঞ্চ। তুমি তাকিয়ে রাখো।
মৃতের ঘুম ভালবেসে জড়িয়ে গেছি, কাফনের মোড়কে। পড়ে আছে স্নানের পোশাক-পরিচ্ছদ, সাবানের মায়াবী ত্বক। জানি, একদিন শিকার হয়ে যাবো, সবুজ আলোর সংকেতে। তখন আমি না থাকলেও, এইদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার থাকবে, তোমাকে পীড়িত করবে।
শুক্রবার
কি লিখি ! শিশুদের মলিন মুখের মতো নীরবতা। যেনো কবেই তোমাকে হারিয়েছি তোমাকে। তারপর বিমর্ষ স্মৃতির মরে পড়ে আছে একটা কবুতর। যেনো মৃত্যুর আগে ঝরে গেছে তার সমস্ত পালক। ক্ষতের চিহ্ন লাল বর্ণ ধারণ করেছে। যেনো ধারণা করা হচ্ছে আত্নহত্যা। প্রাণীদের ক্ষেত্রে এমন ধারণা সত্য হতে পারে।
যদিও তোমাকে ভালবাসার মতো প্রবল বিস্ময়তা গ্রাস করেনি। স্থির হয়েছি। যেমন স্থির গাছ, চোখ নেই তবুও চেয়ে দেখে অন্তহীন আকাশের ছায়া। হেঁটে চলে যেতে চায়। অথচ বনভূমির মায়ায় প্রোথিত শেকড় তাকে টেনে ধরে থাকে। যেনো ঘাটে বাঁধা নৌকা, তীরের বালি ছেড়ে যেতে পারে না বহুদূরে।
কেবল তোমাকে পড়ে মনে, আমার প্রতিধ্বনি তাড়িত শব্দ। তুমি বিদায়ের মতো করুণ কন্ঠস্বর। মানুষ জন্মে কেবল ঘৃণায় পেয়েছি সম্বল রুপে। মধ্য দুপুরে তপ্ত রোদের আয়তক্ষেত্রে আমি ব্যর্থ এক গম্বুজ। আমাকে তুমি ক্ষমা করো। যা লিখি, কেবল ভ্রমের বাজনা। এমন দিন অর্থাৎ শুক্রবারে নিজেকে কেবল বিষন্ন বালক মনে হয়।
জন্ম ১২ ই নভেম্বর ২০০০। বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার অন্তর্ভুক্ত ক্ষেতলাল উপজেলার তিলাবদুল মৃধাপাড়া গ্রামে। বর্তমানে জয়পুরহাট সরকারী কলেজে দর্শন নিয়ে স্নাতক স্তরে পাঠরত। নিয়মিত লেখার কাগজ কবিতা পাক্ষিক, অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক পত্রিকা, এছাড়াও দুই বাংলার অজস্র লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালেখি। কবিতা ছাড়াও গল্প, নিবন্ধ, ছড়া প্রভৃতি লেখালেখির বিষয়।