ইরাবতী উৎসব সংখ্যা: চারটি কবিতা । মুজিব ইরম
রেশমি সুতার কাজ
মা যেমন নকশি কাঁথা শীতল পাটি বোনে, হাতের পাখায় ফুলপাখিগাছ তোলে, নক্সা করা শীতের পিঠা বানায়, জরি পুতি রেশমি সুতায় রঙ্গিন ময়ূর আঁকে, মনের কথা লিখে, তেমনি করে বইয়ের পাতায় লেখার খাতায় তোমার জন্য রঙ্গিন কিছু ফুলপাখি আর প্রজাপতি আঁকতে চেয়েছি।
আর কিছু নয়, এই তো খায়েস মনে, যেমন করে মায়ের হাতের কাজগুলো বসার ঘরে শোভা হয়ে থাকে, যেমন করে দেয়াল জুড়ে মায়ের কথা বলে, তেমন করে তুমি তাকে টাঙ্গিয়ে রেখো মনে, গহিন সঙ্গোপনে।
এই ভাবেই সুঁইসুতা-কাজ জপে জপে হয় যেন গো ইতি: ফুল ফুটে ঝরে যায় এই তার রীতি, মানুষ মরিয়া যায় রেখে যায় স্মৃতি।
ভুলো না আমায়
এত করে লিখি আমি হয় না তবু শেষ, পানা ফুলে মন মজেছে জারুল ফুলে বেশ। হিজল ফুলের লতার মতো লটকে থাকে মন, বাউল গানের সুরের মতো কান্দে তবু তন। দূরের গাঁয়ে কুয়াশা নামে শাইল ধানের মাঠে, ঝুমকো লতা লটকে থাকে পুবের পুকুর ঘাটে। ধানের গন্ধে ঘুম আসে না বৃষ্টি পড়া শব্দে, যতই বলি ওরে ও মন এসব এবার বাদ দে। তবু ওরা লিখতে বলে হয় না লেখা শেষ, আছি আমি দূরের দেশে ওরাই আমার খেশ। ওরাই আমায় কুশল যাচে জিগায় নামধাম, মগডালে ওই লটকে থাকা সূর্যরঙ্গা আম। জানি আমি এমনই হয় বাড়িছাড়া হলে, দিবানিশি এসব এসে লিখতে শুধু বলে। আমি যেন ওদের কথা ওদের নিয়ে লিখি, শব্দবাক্যে তালের পিঠা রাঁধতে যেন শিখি। যেমন করে মায়ের হাতে ফুটতো কচু ফুল, লিখতে যেন ওদের কথা হয় না কভু ভুল। একটা ময়ূর তাইতো আঁকি শব্দবাক্য দিয়ে, যাবে উড়ে মায়ের দেশে আমার কুশল নিয়ে।
যেমন করে মায়ের রুমাল সবার আদর পায়, তেমন করে রাইখো মনে ভুলো না আমায়।
মানুষ ভজন
আমার শৈশব রাঙ্গা ছিলো পূজা পার্বণ ঈদে, আমার শৈশব গীতল ছিলো বাউল গান আর গীতে। আমার শৈশব শীতল ছিলো কাদা জলে পানিতে, আমার শৈশব ভরা ছিলো জিকির দরুদ কীর্তনে। উলুধ্বনি শাখের ধ্বনি ঘণ্টা আজান মাতমে, আমার শৈশব ভরা ছিলো সালাম আদাব প্রণামে। মাসি পিসি মায়ে বোনে মন্ত্র দোয়া পড়ে, আমার শৈশব রাঙ্গিয়ে দিলেন মানবতার বরে। আমার শৈশব কাটলো ঘুরে গির্জা মন্দির মসজিদে, বাউল গজল পীরমুর্শিদি ভজন সাধন কীর্তনে।
সেই যে আমার হুরুবেলায় দোতারা এক বাজিয়ে, কোন এক বাউল নৃত্যগানে মন দিলা যে সাজিয়ে! মানুষ ভজো মানুষ ভজো বাউল কবি কৈলা, তাই তো ইরম মানুষ খুঁজে পদের অধীন হৈলা।
বিপদকালীন কবিতা
কুমড়া ঝাড়ের হলুদ হলুদ ফুল, তুমি ফোটো আমার মনে…সবুজ সবুজ ধনিয়া ক্ষেতে সাদা সাদা ফুল, তুমি ফোটো আমার মনে…নামুক নামুক ঝিঙে ঝাড়ে কনে দেখা আলো, শেষ বিকেলের রোদ, ফুটুক ফুটুক উঠান জুড়ে হলুদ হলুদ ফুল, আমার মনটা ভালো হোক…ফুটুক ফুটুক হইলফা গাছে মন কাঁপানো ফুল, আমার মনটা ভালো হোক…এই ঘোর নিদানে পড়ছে মনে লাই সরিষার ফুল, কী আচানক জিরা ফুলে, চানা ফুলে উঠছে ভরে পড়শি নদীর কূল…শিম ঝাড়ের ওই লাল গোলাপি ফুল, শিম ঝাড়ের ওই সাদা সাদা ফুল, তুমি ফোটো সন্তর্পনে, আমার মনে মনে…নীল তিসি ফুল, রাঙা শাকের ক্ষেত, তোমায় পড়ছে মনে খুব…ঢেড়স ফুলের রঙ, বেগুন ফুলের ঢঙ, তোমায় পড়ছে মনে খুব…আনাজ ক্ষেতে, পেঁয়াজ ক্ষেতে মন ভোলানো ফুল, তুমি চোখের মাঝে ফোটো, তুমি মনের মাঝে ফোটো…এই ঘোর বিপদে মানুষগুলোর মনটা ভালো হোক, এই ঘোর বিপদে মানুষগুলোর মনে শান্তি হোক।
ও আমার শৈশবের ওই আনাজপাতি ফুল, তুমি মনের মাঝে ফোটো, এই মিনতি রাখো, রোগেশোকে একটু না হয় শুশ্রুষার রঙ মাখো।
জন্ম মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামে। পারিবারিক সূত্র মতে ১৯৬৯, সনদপত্রে ১৯৭১। পড়াশোনা করেছেন সিলেট, ঢাকা ও যুক্তরাজ্যে।
তাঁর ১ম কবিতার বই ‘মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে, বাংলা একাডেমি থেকে। তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য কবিতার বইগুলো হচ্ছে: ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮, আদিপুস্তক ২০১০, লালবই ২০১১, নির্ণয় ন জানি ২০১২, কবিবংশ ২০১৪, শ্রীহট্টকীর্তন ২০১৬, চম্পূকাব্য ২০১৭, আমার নাম মুজিব ইরম আমি একটি কবিতা বলবো ২০১৮। পাঠ্যবই ২০১৯, পয়ারপুস্তক ২০২০।
কবিতা ছাড়াও মুজিব ইরম কাজ করেছেন গল্পে, উপন্যাসে, শিশুসাহিত্যে। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস/আউটবই: বারকি ২০১১, মায়াপীর ২০০৯, বাগিচাবাজার ২০১৫। গল্পগ্রন্থ: বাওফোটা ২০১৫। শিশুসাহিত্য: এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ ২০১৬। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস: জয় বাংলা ২০১৭।
এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে ধ্রুবপদ থেকে মুজিব ইরম প্রণীত কবিতাসংগ্রহ: ইরমসংহিতা ২০১৩, বাংলা একাডেমি থেকে নির্বাচিত কবিতার বই: ভাইবে মুজিব ইরম বলে ২০১৩, এন্টিভাইরাস পাবলিকেশনস, লিভারপুল, ইংলেন্ড থেকে নির্বাচিত কবিতার বই: পয়েমস অব মুজিব ইরম ২০১৪, ধ্রুবপদ থেকে উপন্যাসসমগ্র: মুজিব ইরম প্রণীত আউটবই সংগ্রহ ২০১৬, পাঞ্জেরী থেকে: প্রেমের কবিতা ২০১৮, বেহুলা বাংলা থেকে: শ্রেষ্ঠ কবিতা ২০১৮, চন্দ্রবিন্দু থেকে ইরম পদাবলি ২০২০।
পুরস্কার: মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬। বাংলা কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন সংহতি সাহিত্য পদক ২০০৯, কবি দিলওয়ার সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪। কবিবংশ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪। শ্রীহট্টকীর্তন গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘জয় বাংলা’র জন্য পেয়েছেন এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৭। কবিতা ও কথাসাহিত্যে সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন শালুক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯। এছাড়া পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার ২০১৭।