ইরাবতী উৎসব সংখ্যা: কবিতাগুচ্ছ । রাখী সরদার
একটি আতর – হরিণ
সীতাকুণ্ডু থানার অদূরে
জোনাকিদের আস্তানা। মৃৎ-প্রদীপের
মতো টিম টিম করছে ঘর গুলি।
কয়েকটি বাবুই রোজ সন্ধ্যাবেলা
মারীচ কুমারের দস্তখত নিয়ে
জোনাকিদের ঘরে উঠে আসে।
সারারাত ঝাপটাঝাপটি…
থানার দারোগা শ্রীরামচন্দ্র বটব্যাল
এতটাই ধর্মপ্রাণ যে সন্ধ্যা হলেই
ভাগবত নেশায় আকণ্ঠ ডুবে যায়।
হাবিলদার লক্ষ্মণ ভুঁইয়া
ওদিকপানে ইশারা করলে –
তিনি দেখতে পান
একটি আতর-হরিণ খুব দ্রুত
দৌড়ে যাচ্ছে এর ওর বুকপকেটের সুড়ঙ্গ ধরে
তার গায়ের সুগন্ধে কাঁপছে
পঞ্চবটী বন।

শিকার
কেন এত বিনম্র বৈরিতা?
সামান্য বাঁচার মতো করে তাকাই
তোমার দিকে।এই অমার্জনীয় চোখ
আর কদিন পরেই ধৃতরাষ্ট্রের
মিউজিয়ামে জমা পড়বে।
আমি তো নিজের কাছে কবেই
হয়েছি নিঃস্ব, যে নিঃস্বতার কমন্ডুল
চুঁইয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে।আর
একটা লাজুক বাঘ প্রতিদিন সেই
রক্ত পান করে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে।
ভয় করে,যদি কোনোদিন সেই
লোলুপ মাংসাশী গর্জনে গর্জনে
তোমার সতর্ক বেড়া ভেঙে দেয়!
সাবধান, তোমার চোখের নীচে
লাফিয়ে পড়ার পূর্বে ছুঁড়ে মেরো
ভ্রুভঙ্গের তির
এফোঁড় ওফোঁড় করে দিও
নির্লজ্জ বাঘের হাহাকার।

অনন্ত সন্ন্যাস
প্রভু আমার,
না পাওয়া হাতের কাছে
কেন এতকাল বসিয়ে রাখলে?
যতবার তার কাছাকাছি গিয়েছি
পূর্নিমার চাঁদ ঢেকে গেছে
বিষণ্ণ কুয়াশায়।পৃথিবীর ধূসর ঝাঁপি
থেকে বেরিয়ে এসেছে রাগী শঙ্খচূড়।
তাকে যতই খেতে দিই দুধ কলা
তাও ঘুরে ফিরে ফোঁস ফোঁস করে
জুঁইগন্ধ স্তনের দিকে চেয়ে।
যার নাম আমাকে বাঁচায়,
যার নাম আমাকে কাঁদায়,
সুখ ও শোকের মাঝে লুটিয়ে পড়া
সেই জ্যোৎস্নার কস্তূরী আর নেই।
বিরহ বাজিয়ে বাজিয়ে এ দেহ
ধুলো ধুলো…
প্রভু আমার, প্রসন্ন হও।
সকল শূন্যতায় আমাকে দাও
অনন্ত সন্ন্যাস।

সোনালি আঙুল
আমার আঙুল দিন দিন কেমনতর
রূপ বদলায়, এই চুপিচুপি হরিৎবর্ণ
আবার একেবারে সোনালি।
যেন যাদু জানে!
মুঠো বন্ধ করলে অন্ধকার কারাগারে
দেবকীর কান্না শোনা যায়,মুঠো
খুলেছি কি ছায়া ভেঙে আকাশময়
নীল লাল প্রজাপতি
অনেক তুকতাকের পরেও
আমার আঙুল বশে নেই
যখন তখন ভুল গল্পগাথা লিখে ফেলে,নরম সুতোর জালে বেঁধে
ফেলে নিসর্গের নদী!
শুধুমাত্র একটি সময়ে
আমার প্রশ্নের মধ্যে তারা চুপচাপ,
অসহায়।
নিজের ভিতর বন্দী হয়ে
যখন বাঁশিতে ঝড় তুলি,সোনালি আঙুল আপনাআপনি নতজানু!
কারো স্পর্শের বিরহে
লুটিয়ে বাঁশির ফুটো হাড়ে…

মল্লার যেখানে নামে
যার নামে জীবন ও পৃথিবী অফুরান
তাকে কোনোদিন দেখিনি,
লোকে বলে
তার শান্ত অলৌকিক চোখ
সুন্দরের পরেও
যে আশ্চর্য সুন্দর তারা ফোটে
তার থেকেও পবিত্র, উজ্জ্বল
তার চোখ।
কবিতায় লেখা হয় সে সব
বিস্ময় উচ্চারণ।তাকে দেখিনি
তবুও কিভাবে যেন তার
খোঁজ পেয়েছিলাম
একদিন টক ঝাঁক মুনিয়া সন্ধ্যের
আকাশে ভেসে যেতে যেতে
বলেছিল –
এত অস্থির কেন! তার দেখা পাবে
আসন্ন আষাঢ়ের মেঘরাগে
মল্লার যেখানে নামে।

বসবাস পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদনী পুর।পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ চারটি(“খয়েরি কেরকেটা,” “জল ছুঁয়েছে কৌশধ্বনি ” “বাদামি চুলে স্বপ্ন সনেটগুচ্ছ ” ” শস্য ভেজা চোখের দোহাই”)কবিতার পাশাপাশি গল্প ও প্রবন্ধ লেখেন। আজীবন কবিতা লেখার সাধনায় জীবন কাটাতে চান।