| 8 মে 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা: দুটি গদ্য কবিতা । সৌরভ দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সন্ধ্যামণি  গাছ

বিবরের গান ভুলে গেছে বিষণ্ণ শালিক।রাত্রির ছেঁড়া চিরকুট ভেসে আসে মনোক্রমে।লবণের খনিজ শরীর আগুনের শলাকার মন্ত্রপূত  প্রেতভাষ্য শুনেছে; দ্বাদশীর দীর্ঘতম চাঁদ।মৌনতার আস্তরণে ঢাকা ঘুমের গোপনে ঝুলে আছে মহরহের তাজিয়া।’বিষাদসিন্ধুর’ গ্রথিত রাত আদিম নক্ষত্রের পরশ পাথর ছুঁইয়ে দেয় জানালার শার্সি-পাল্লায়।রক্ত পড়ে বালুচরে, কীটদংশ মানুষের চিৎকার ধ্বনি অন্ধকার বলয়ে বাঙ্ময়।এইখানে অপাপবিদ্ধ হাতে একদিন উঠেছিল অক্ষয় স্মারক।প্রয়োজনে ব্যথাতুর অক্ষরলিপি কখন বরফ হয়ে গেছে জানেনি রমণী।কাঁথা সেলাইয়ের ভিতর পায়ে পায়ে ঢুকে পড়েছে আস্ত সংসার,বিষাদের অন্নজল।মুড়ির টিনের ভিতর ঢুকে যায় বিরহের হাত।তেঁতুলগাছের নীচে ক্ষেত্রবিশেষে  কোন একাকী পাঠক।প্রত্নলিপি গুলির উদ্ধারের হিমেলরঙ।ঘোড়াদের পিঁচুটি কাটা চোখ সরে এসে বসে; সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে ধর্মঠাকুর।দিব্যি হাঁস,মুরগি চরে বেদেদের ঢিপির উপর।হলুদাভ দুধের বাটি,পরমান্ন-বাতাসা নিজস্ব পীরের দরগা মানতের  ঘর।ধুয়ে ধুয়ে নেমে যায় বাঁশবনে,কবরের মাটি।এখানেই জানাজা নামাজ হয় মাগফিরাতের রাতে।পূর্বজন্মের সেইসব ছেলেবেলা একবুক দিঘির সাথে হাঁটে পাকা ধান।মিহিন পাতার ফাঁকে ফাঁকে গোপন ইশারার অনৈতিক আলো বুলবুলি পাখির স্বপ্ন ভেঙে যায়।মেঠো বাউলের বন্দিশে যেন পড়ছে বিসমিল্লা খানের সানাই প্রণত রাতের কথা।বালুচরি আকাশ যেন চুম্বন করছে বৈকুন্ঠপুরের শস্যক্ষেত।জঙ্গল কাব্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে এক অন্য রূপরাম।সেইখানে শরতের রোদ্দুর অযাচিত ভাবে পরে নিচ্ছে সাদা ভয়ের

মুখোশ।ফরম্যালডিহাইডের ঝাঁঝালো গন্ধে বিন্দুমাত্র  স্পর্শ নেই পেলবতার।পুকুরের মাটি ফুঁড়ে উঠে আসা নৃত্যপটিয়সী দেবতা নিঃসঙ্গ পাহাড়ের আপেক্ষিক বার্তার দিকে চেয়ে,চেয়ে কখন মরীচিকা হয়ে গেছে।মৈথুনের ছাই এসে লাগে ব্রহ্মপুস্তকে।অ্যাসাইলাম থেকে বেরিয়ে আজ মৃত্যুপতনের বীজ পোঁতে চরক- সুশ্রুত ।এ কবিতার কোনো পূর্বজন্ম নেই ;নোনাজলের মতো ফাঁক কেটে কেটে এগোয় মীনদল।কবিরাই একদিন কবিতার আধারে জন্মদাত্রী মা হয়ে ওঠে।সন্তানের খিদে,তেষ্টার কাতরতায় বোঝে সোনালি গদ্যের কিউবিক ফর্ম।বাঁক নেয় শৈল্পিক অভিমুখ;প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায়। সাইক্লিক জন্মজননের সূত্রবীজে ছেঁড়াফাটা অযুত তুলোর রাশি চৌদিকে শারদীয়  মাতৃমুখ ঢেকে যাচ্ছে দিশাহীন পতনশূন্যতায়।শব্দময় অরণ্যপথ বাতিল ওষুধের– স্টিপ, শিশি বোতল,অক্সিমিটার সন্নদ্ধ দুটি চোখ যেন পারদআঁখি।ঘরবন্দি দশায় শান্তিকল্যাণের জল আনে না মায়াবী শিশির।দূরে দ্যাখো কিরকম লালনের মতো রাঙাবাস পরে কাশফুল ফুটেছে।আখর সাজিয়ে সাঁই ধরছেন আরশিনগরের গান।কেউ যেন নিরালায় রিফু করছে মধ্যবিত্তের ছেঁড়া-জামাকাপড় গুলো।ওগুলো হয়তো এবার আর নতুন  হবে না।উৎসবের গৃহে গেঞ্জির কলে,লেদের কারখানায় কতদিন কাজ নেই।ছাপাখানায় বাকপ্রতিমার হরফ সাজায় না কোন বোহেমিয়ান সম্রাট

শম্ভুরক্ষিত।স্বাধীনতা দিবসে বাড়িতে শাড়ি বেচতে এসেছিল যে আহাম্বক লোকটা।সেও পাঁচমাসের বাচ্ছাটার মুখে তুলে দিতে পারেনি সামান্য একটা ডেক্সোলাক।তীর্থের কাকের মতো সে তাকিয়ে আছে আমার আর বাবার ঝঞ্ঝাট পূর্ণ চোখের দিকে।হাতের মুঠোয় জমে জমে যাচ্ছে পাঁচশো টাকার নোট দিনযাপনের মৃতব্যয়ী কথাগুলো,স্বাধীনতা দিবসের কবিতা হয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল…।কারো কারো নিখোঁজ শরীরের ছায়া পড়ে থাকে ঋতুবদলের এই ক্রান্তিপর্বে।ইস্কুল-পাঠশাল বন্ধ।গিমিক ভার্চুয়াল ক্লাস;মনের মধ্যে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব চলে রিয়েলিটির ।নদীতে সালতি বায়না দলছুট কিশোরেরা। সকরোনাকালে গ্রামের মোচ্ছবে,রকে কিছুটা পুজো এসে গেছে।উড়ে আসে

দুর্গাটুনটুনির দল…

তবু,যাযাবর সৈনিকের পায়ের তলায় ঝিমিয়ে পড়ে সময়।প্রতিধ্বনি হীন বুলেট আর ফাঁকা তাঁতঘর পড়ে থাকে রক্ত প্রান্তরে।কাঁপা স্বরে রৌদ্রের চমককে কোতল করে বরাহের দল।পাখিরা শিউলির সৌরভে লিখে গেছে বিস্তর শ্লেষ,অভিমান।নকল সুখ বিস্মিত কৌতুকে ফুটে আছে নীরবতা ঘেরা আমাদের জীবনের এই সন্ধ্যামণি গাছে।

 

 

 

 

 

বর্ষামঙ্গল

উড়ে উড়ে চলে জলপাতরেখা,অশ্রুবর্ষণের দিন কাঠবেড়ালির চোখে লেগে থাকা মৌরিফুলের পেলব জ্যোৎস্নার ঘ্রাণে এ শরীর ভেঙে যায় বারবার গোপন আঁধারে জেনেসিস ছেঁড়াচিঠি আকাশ প্লাবনে–বাবার বসার টেবিল-কেদারা হারিয়ে গেছে সিন্ধুসারসের স্বপ্নিল দল।হৃদয়ের ছবি আঁকা মোমজ লতাপাতা,বিষাদজলে ভেসে থাকে কুমারীর মুখ–সংজ্ঞাহীন ভাবনার ভোরগুলো নিজস্ব তরিকায় সেজে ওঠে ছৌ-এর মুখোশ পরে সেইখানে মুক্তির বালুচরে ঠোঁট তুলে বসে আছে একাকী ডাহুক;সংবেদী পুষ্পরাগ।মুর্শিদের মতো তুলে ধরি একতারা –মায়া প্রান্তরে স্নায়ু গহ্বরে আবহমান গল্প পোড়ে…অনেকদিন কেউ আসেনি সেখানে…ঘুমের পাতায় ঝুঁকে থাকে পান্থপাদপ।পোড়ো বাড়ির চিলেছাদে ভিজছে রত্নাকর।টিলায় শরীর দুলিয়ে বসছে ভ্রমর।গদ্য পাগলের দিনলিপিগুলো রামায়ণী কথামুখ সরিৎ চাঁদের আলো।

বৃষ্টির দেবতারা ছেড়ে যায় স্নেহছাপ পালে পালে মেঘ এসে জমে তোমার জানলায়–হামাগুড়ি দেওয়া থুথ্থুরে মাকড়শার সিলিয়ারী চলনরীতি।স্পর্শকের টানে তোমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে ইলিয়াড। শব্দের রাশ ঠেলে ধরে আছো সেইখানে গ্রন্থকুটিরে এক অদ্ভুত  তপস্বিনী  আলো।প্রাণে-অপ্রাণে খুলে যাচ্ছে নিষিদ্ধ জলঝারি।মইয়ে চড়ে আকাশে উঠে গেছে অলীক জাদুকর।রঙচঙে পুতুলের তন্ময় নীলাভ চোখ বন্ধ কোচিং ক্লাসের ফাঁকে।তুমি যেন সেই দ্বীপান্তরে রবিনসন ক্রুশো।আমার গল্পদাদুর মিথ চায়ের কাপে জলতরঙ্গের টুংটাং ধ্বনি তৈরি করে এক অচিন শূন্যতার মায়া।নিয়তির ছায়া সরে গেলে জীবনটা নিটোল মুক্ত উড়োজাহাজ।সব দস্তখত সেরে রেখে না ফেরার দলে ভিড়ে যায় কেউ কেউ,তাদের সে আত্মঘাতী স্বর চেনা ফড়িংয়ের ভালোবাসার দ্বন্দ্বসমাস।সমস্ত বৃদ্ধাশ্রম অপেক্ষা করছে এক পরাজিত পিতার জন্য যেখানে ধূসর অক্ষর ছাই হয়ে  মিশে যায় ম্যাজিকের পর।কোনো অপরিচিত কঙ্কাল পড়ে থাকে খাতার উপর।প্রলুব্ধ সন্ধ্যায় থেমে যায় সবুজ নক্ষত্রনাচ।আমার অ-সুখ স্মৃতিকে আমি খুঁটে খাই দিনদর্পণে।তুমি আমার কাঠবেড়ালি– ছন্দ হয়ে অমোঘ বাঁশি তানে বেজে চলেছো বহুক্ষণ।তোমার বিছানায় অজস্র পাখিদের ঘর-গেরস্থালি।অতীতের গর্ভ থেকে সুদূর সময় সরণিতে ভেসে আসছে রশিদ খানের মেঘমল্লার।এইমাত্র যেন দিদা পানের বাটা খুলে পান মুখে পুরলো।এখানেও তো মাঝেমাঝে নেমে আসে তুষার যুগ…ফিলামেল পাখির গান অস্পষ্ট করে তোলে চেতনার অন্তরীপটুকু।দ্যাখো,তোমায় রং-নাম্বারে ডায়েল করেছি অনেকবার।আমি এখন ঘাতকের মোহে হত্যাকরি–বীজভ্রূণ,রূপদর্শী প্রজাপতিদের।ব্যাঙের গর্ত খুঁড়ে তুলে আনি– ‘একটা মরা ব্যাঙ…’-মহাস্থবির জাতকের গল্প পড়ি প্রতিদিন পাগলের পোশাক পরে–সিনে বায়োস্কোপের সেইসব যোগ-বিয়োগ দিন খোয়া গেছে আমাদের খেয়ালখুশির খাতা থেকে,ভেঙে পড়েছে চাঁদের পেখম,পিসেমশাইয়ের অকেজো পুরাতনী রেডিওটা আর বাজে না চৌদিকে–পড়ন্ত দুপুরে খাটের মাঝে দাদু এখনো তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে যেন ভাদ্রের বাদলা আকাশকে দেখে নিচ্ছে অনন্ত বিস্ময়ে।নারকেল গাছের পাতাগুলো আজ আন্দোলিত কয়েকটা সংখ্যামাত্র।দেরাজের মধ্যে রাখা মামাদের সেইসব নষ্টগদ্য হৃদয়ে তরঙ্গ তোলা কঠিন কুঠার।অক্ষয় মালঞ্চের বাংলা ব্যাকরণের পাতা খেয়ে গেছে বল্মীক সন্তানেরা…ছেঁড়া মাদুরের উপর খসে পড়ছে পলেস্তরা।অন্ধকার পথ বেয়ে নেমে যাওয়া হাড়-হিম সুড়ঙ্গের সিঁড়ি বিশু জ্যাঠার ঘর।চিলেকোঠায় ভাই-বোনের ওম–ফুল আউর কাঁটে –শাহরুখ-সালমনি আত্মরতির স্বর্গসুখ…এক একটা ইভপ্রোভাইজ খতরনাক দিন।ভাঁড়ার ঘরে সহস্র নুড়ি-পাথর উটপাখির ডিম হয়ে অলৌকিক সূত্র খুঁজছে।ঠাকুমার আমের কাসুন্দি;সজনে ফুলের আচার বৈভবময় ঢোল ঢোল চাল।চাবি দেওয়া লোহার সিন্দুকে বাক্স-প্যাঁটরায় রাখা শ্রীধরের গয়না…নাদির শাহের ময়ূরসিংহাসন অসংখ্য দলিল-দস্তাবেজ আহমমক্তার জগৎতারিণী দেবী,কেদারনাথ মিত্তির যেন ইতিহাসের মুষলপর্ব।কাঁচের জারে রাখা জিম করবেট মার্কা পো-ঠাকুরদার শিকার করে আনা ব্যাঘ্রচর্বি।তা দিয়েই দিদার বাতের ওষুধ বাতলাচ্ছে সেজোগিন্নি।বিড়ি ফুঁকতে, ফুঁকতে মামুদার মৎস্য অভিযানের হাজার এক গুলতাপ্পি।আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি হরিণের শিং বেয়ে চণ্ডীমণ্ডপের মাথায় উঠে যাচ্ছে রহস্য-রোমাঞ্চ…কতশত অন্ধকূপ হত্যা।ইস্টার্ণ কোলিয়ারির কালোপয়সা–খেতে আসছে মুদ্রারাক্ষস।কৈশোরের মুক্তাঞ্চল রাহবাহাদুর বরদাপ্রসাদ অমর রহে…ঘোড় ব্যবসায়ী শশিভূষণ বাবুবৃত্তান্ত…বর্ষার জলে চিকচিক করে ফোর্ট উইলিয়মের ঘাস।

এ মহাসংক্রমে আজ আর আসে না ডাকপিয়ন ।তবু রামগিরি থেকে অলকায় বিরহী যক্ষের হাতে হাতে উড়ে চলে বর্ষার চিঠি।বুকে মোচড় দেয় রাষ্ট্রিক ক্ষয়দৃশ্যে।সানাইয়ের জাদুকর বিসমিল্লা খানের রেওয়াজের ঘরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে জল্লাদের দল।ঘুমহীন চোখে শুধু জেগে থাকে শোকব্যথা। কবীরের দোঁহাকোষও যেন আজ মৃত।

হয়ত দ্রুত রঙচটা আকাশটা সারিয়ে বুনো হাঁসের মতো বাচ্ছারা আবার খেলবে বর্ষামঙ্গলের জলে…

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত