Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,puja 2021 tour travel rumki roydutta

উৎসব সংখ্যা ভ্রমণ: সাদা বালির সৈকত ও যাপনকথা । রুমকি রায় দত্ত

Reading Time: 5 minutes

 

দূর দূর নীল সীমানাযেখানে সবুজ জলরাশি আর মেঘের নীল অভিমানী রূপ মিলেমিশে একাকারআমি সেই তটের গল্প বলব আজ। আমি সেই নীল শাড়ির রূপোলি বালুর পাড়ে দাঁড়িয়ে জীবন দেখার গল্প বলব। জীবনযার অস্তিত্ব আসলে যাপনেই পূর্ণতা পায়। ঘন কালচে নীল জলের গভীরতার দিকে তাকিয়ে জীবনের অস্তিত্ব কী ভীষণভাবে যেন অনুভব হচ্ছিল। গভীর সমুদ্রের বুকে সাদা ফেনার তুফান তুলে জাহাজ এসে দাঁড়াল হ্যাভলক নামক ছোট্ট দ্বীপটিতে। জাহাজের খোল থেকে ডেকে উঠে দাঁড়ালাম। একটা লোহার সিঁড়ি নেমে গেল কংক্রিটের জেটির বুকে। জাহাজ আর জেটির মাঝের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ‘কালাপানি’। এমনই তো নাম ছিল এ সমুদ্রেরযখন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা দীপান্তরের বন্দি হত এ সমুদ্রদ্বীপে। আজ হ্যাভলক ‘স্বরাজদ্বীপ’।

জাহাজের এই প্রথম অভিজ্ঞতা। এই প্রথম জাহাজের ভিতরে বেশ কিছুটা সময় যাপনের গল্পে জুড়ে নিলাম। ছোট্ট জেটি পেরিয়ে বাইরে এসে দেখলামনামলেখা বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির ড্রাইভাররা। নিজের নিজের সামগ্রি বুঝে নেওয়ার মতো,বুঝে নিচ্ছে নিজের নিজের প্যাসেঞ্জার। কিন্তু সে কইআমাদের তো কেউ নিতে আসেনিএকে একে সব গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে আপন আপন গন্তব্যে। এ দ্বীপে কত মানুষ তো এলসবাই কি শুধু ভ্রমণের সখেই এসেছে?


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


ফিরতি পথে জাহাজে উঠবে বলে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন ইটালিয়ান পর্যটক অত্যাধুনিক যন্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ডিসকভারির দৌলতে দেখে বুঝতে পারলাম,এই যন্ত্র দুটি মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করা হয়। মনে অনন্ত জিজ্ঞাসালুকিয়ে রাখতে পারলাম না। ঠিক পারলাম নাতেমনটা নয়চাইলাম না। কেন লুকিয়ে রাখবএ জীবন তো শুধু খোঁজের জন্যই নিবেদিত। যাপনের প্রতিটা মুহূর্ত শুধু খোঁজ। একটু পরেই হয়তো সাদাবালির সৈকতে দাঁড়িয়ে ঝিনুক খুঁজব। যেমনটা অনেক বছর আগে পুরীর সৈকতে খুঁজেছিলাম। সে ছিল আমার প্রথম সমুদ্র দেখা। তবে আমি কোনও দিনই সমুদ্রের প্রেমে পড়িনি। সমুদ্র আমার প্রেমিক নয়বন্ধু। জল ছুঁয়ে অনেক কথা বলা যায়। নোনাজলে চাইলে দুফোঁটা নোনাজল মিশিয়ে দেওয়া যায়। তবে ঐ জল তুলে মোটেও চোখে মাখা যায় না। বাস্তবিকভাবেও নাকাল্পনিক ভাবেও না।

খোঁজই প্রশ্ন করল, ‘ আপনারা কি মাছ ধরেন?’

মানুষ দুটি হাসল,তারপর সামনে উপরনীচ করে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ইয়েস’।

আমি বললাম, ‘সখে মাছ ধরেন?’

তাঁরা বললেন, ‘আমরা বৈজ্ঞানিক। সমুদ্রের জানাঅজানা মাছ ধরেতাদের নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেআবার ছেড়ে দিই মাছগুলিকে’

তাঁরা বললেন, ‘ওষুধ বানানোর কাজে লাগে’।

ওদিকে ততক্ষণে আমাদের গাড়ি চলে এসেছে। ছোট্ট গ্রাম্য জনপদের মধ্য দিয়ে কখন যেন পৌঁছে গেলাম সাদা বালির নির্জন সৈকতের কোলে। হ্যাভলকের ৫ নং সৈকত,উত্তরপূর্ব কোলে বিজয়নগর সমুদ্র সৈকতে। কোল ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের আগামী দেঢ় দিনের আস্তানা “ডলফিন রিসোর্ট”। সরকারি,তাই আগে থেকেই বুকিং করতে হয়। তবে আমাদের আগে বুকিং ছিল না। একদিন আগে আমাদের ড্রাইভার বুকিং করিয়ে রেখেছিল। সুন্দর নির্জনতার মাঝে। তখনও সকাল। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে এলাম জোড়া বাংলোর নীচে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে হবে। যাক ওরামানে কত্তা আর পুত্র। আমি আম কুড়াই। এই ফাল্গুনেও গাছে আম ঝুলছে। পাকা আম চোখের সামনেই টপটপ পড়ল। এমন পরিপাটি সাজানো বাগানের মাঝে আম কুড়ানো এক প্রকার বিলাস সুখ। আমার মতো প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের জন্য সুখ সঞ্চয়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


এমন সুন্দর জায়গার জন্য খুব কম সময় বরাদ্দ করেছি আমরা। স্নান সেরে সঙ্গী পরিবারটির প্রস্তুতির মাঝে অপেক্ষার প্রহর কাটাতে ছেলের হাত ধরে পায়ে পায়ে হেঁটে গেলাম ঐ সাদা বালির কাছাকাছি। এখান থেকে ছোঁয়া যায় নাশুধু দেখা যায়। রিসোর্টের বাউন্ডারির ওপারে উন্মুক্ত সাদাবালির সৈকত রোদ পোহাচ্ছে। বাউন্ডারির ধার ঘেঁষে সারি সারি পাম জাতীয় গাছ মাথা তুলে প্রকৃতির আবাহনে মত্ত। ওদের মাথা ছুঁয়ে কিশোর রৌদ্র প্রেম নিবেদন করছে। হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর। এক অনাবিল,অনন্ত প্রকৃতির মোহাচ্ছন্ন আমি ছেলের হাত ধরে হেঁটে চলেছি। পায়ের তলায় বাঁধানো পথে গাছ আর রোদ্দুরের আলোছায়া নকশা। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। আমাদের ডাক পড়েছে নতুন সৈকতে যেতে হবে। সারাটা দিন ‘রাধানগর’ সৈকতে নির্জনতা খুঁজতে খুঁজতেই কেটে গেল, পেলাম না। সমুদ্রের গর্জন তেমন কানে আসে না এখানে। মানুষের কোলাহলের প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে ধাক্কা মারে বুকে। কল্পনার জাল ছিঁড়ে যায় বারবার। একে তো যাপন বলে না। মন হু হু টানে ঐ সকালের সৈকতের দিকেহোটেল লাগোয়া নির্জন সাদাবালির সৈকত। বেলা থাকতেই ফিরে আসি। পোশাক পরিবর্তন করতেও সময় নষ্ট করি না। পোশাকি বাহারি জুতো ছেড়ে চটিতে পা গলায়। তারপর এক পা, এক পা হাঁটতে হাঁটতে সেই সাদা বালির কাছে। বাউন্ডারি ওয়ালটা বেশ চওড়াআর অনেকটাই উঁচুতবু উঠে বসি তার বুকে, সমুদ্রমুখী হয়ে। হালকা সবুজ মিশানো জলের তরঙ্গ দোলা দিয়ে বারবার ছুঁয়ে যায় সৈকত। যেতে যেতে কিছু বালি, নুড়ি নিয়ে যায় সঙ্গে। আবার যখন সে আসেফিরিয়ে দেয় তাদের। অনতি দূরেই কয়েকটি কালো পাথর স্তূপের মতো জেগে আছে। হঠাৎ নজর আটকায় সেইখানে। একটা কাঁকড়া,কালো কিন্তু দাঁড়ায় হালকা রঙের ছোঁয়া। জলের তরঙ্গে বারবার সরে সরে যায়,আবার উঠে আসে পাথরের উপরে। দাঁড়া দুটো তুলে বিজয়বার্তা ঘোষণা করে। সমুদ্র তখন শান্ত হয়ে যায়। সাদা বালির তট ধরে আরও এগিয়ে যায় দৃষ্টি। কিছু দূরে আরও কিছু পাথুরে স্তূপের উপর একা দাঁড়িয়ে কালো লম্বাগলা সমুদ্রপক্ষী।

কালো পাথরের বুকে মিশিয়ে দিয়েছে নিজেকে। পড়ন্ত রোদের ছিটে তার কালো পালকের রং চকচকে করে তুলেছে। লম্বা লম্বা পায়ে ক্যাটওয়াক করছে মাঝে মাঝে। আমাদের দৃষ্টি নিয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তার। এ সমুদ্রে অতিথি সে নয়আমরাবুঝিয়ে দিচ্ছে যেন। কালো রঙের বাহারে অহংকারী গ্রিবা বারবার নেচে উঠছে। সূর্যাস্ত হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। এখনও না পারলে আর ছোঁয়া যাবে না বালি। অনেক্ষণ ধরে দেখছিলাম, জলের মধ্যেই বেশ অনেকটা দূরে মডেলের মতো দাঁড়িয়ে দুটি গাছ। বাউন্ডারি ওয়ালের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঐ গাছের দিকে এগোলাম। আর তখনই দেখতে পেলাম, সৈকতে নামার পথ আছে। ছোট্ট একটা গেট খুলে নেমে পড়লাম বালিতে। পায়ের পাতা ডুবিয়ে পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। একটা মরা গাছের ডাল ছবির মতো শুয়ে আছে। তার গায়েকোটরে সচল সামুদ্রিক প্রাণীকুলের উপস্থিতি লক্ষ করতেই এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে উঠল মন। ছোটো ছোটো জীবন্ত শঙ্খ, ঝিনুক আপন ছন্দে হেঁটে চলেছে। নখ দিয়ে বালি সরাতে সরাতে হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর। দূরে একটা ছোট্ট জাহাজের লাল রঙের পাল দেখা যাচ্ছে। সবুজ সমুদ্রের বুকে ছবির মতো লাগছে যেন। এই সৈকত সমুদ্রের ভীষণ কাছে। বড়ো বড়ো গাছের ডাল ঝুলে পড়েছে পাড়ের উপর। এই অপার সৌন্দর্য আকন্ঠ পান করতে করতে হঠাৎ দেখলাম, যে গাছদুটি এতক্ষণ অল্প জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়েছিলতারা যেন গভীর জলে নেমে গিয়েছে। সমুদ্রে জোয়ার আসছে। জল বাড়ছে। দ্রুত ফিরতে হবে। ওদিকে ধীরে ধীরে কালো রাত্রিও নেমে আসছে চাদরের মতো। উঠে এলাম বাউন্ডারির ভিতরে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলামযে পথে পা ফেলে হেঁটে এলাম, ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল জলের তলে। তখনই কেমন যেন তেষ্টা পেল। সাতটা বেজে গিয়েছে। চা পানের সময় হয়েছে। কিন্তু,রেস্টুরেন্টে গিয়ে চা পেলাম নাপাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। সাড়ে’ছটার পর নো চা।

ততক্ষণে আলোআঁধারিতে জেগে উঠেছে পুরো রিসোর্টের এলাকা। বিভিন্ন ধরনের কটেজ আছে এখানে। বাংলোর মতোও আছে। এদিক ওদিকের রাস্তা গুলিয়ে পথ হারালাম। গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে রাতের টানটান বিছানা লোভ দেখাতে লাগল।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


একটা প্রশান্তির নিদ্রা শেষে,নির্মল সকাল। আবার ছুটে গেলাম সেই সমুদ্র পাড়ে। যতটুকু আছিলুটে নিতে হবে। গতদিন যে পথে সৈকতে হেঁটেছিলামসকালে উলটো দিকে হাঁটলাম। ধীরে ধীরে উঠে আসছে সূর্যটা,আর সোনা বৃষ্টি হচ্ছে যেন। বালির গায়ে গলানো সোনার ঢল। নুড়িকাঁকড়বালির দানা গুলো সেই সোনা মেখে আকৃতি পাচ্ছে যেন। একটা নারকেল গাছ হালকা নুয়ে আছে বালির দিকেবিপরীতে ছায়া পড়েছে বালির গায়ে। অপূর্বঅপূর্ববলে চিৎকার করলেও এ অপার উন্মুক্ত প্রকৃতির রূপ অক্ষরে বোঝানো যাবে না। আলবিদা বলতে একদম ভালো লাগে না। বলব না,বরং এখানে দাঁড়িয়েই প্ল্যানিংটা সেরে নিলাম…আবার আসব ফিরে/এই সাদা বালির তীরেকাটাব এক অন্য যাপন।

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>