| 26 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা অনুবাদ: ডিটেকটিভ । কুল শইকীয়া

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার বিজেতা কুল শইকীয়ার ১৯৫৯ সনে অসমের রঙ্গিয়ায় জন্ম হয়। দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণির স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ভারতীয় পুলিশ সেবা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।১৯৯৮ সনে মুনীন বরকটকী পুরস্কার লাভ করেন।গল্প ছাড়াও তিনি কবিতা,প্রবন্ধ এবং নাটকও রচনা করেন।‘তীর্থ ডেকার নিরুদ্দেশর পিছর চোয়া’,’আখরাত মই আরু অন্যান্য’,’গ্রহান্তর’,’হোস্টেলের এলার্ম ঘড়ি’বিখ্যাত গল্প সংকলন। প্রেসিডেন্ট পুলিশ এওয়ার্ড, ২০০০ সনে কথা পুরস্কার,২০১৫ সনে সাহিত্য অকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বর্তমানে অসম সাহিত্য সভার সভাপতি।


হিমাংশু এবং সামনের মানুষটির মাঝখানের দূরত্ব কয়েক হাত। সাধারণ পরিস্থিতিতে এতটুকু ব্যবধান মানুষটার পেছনে পেছনে আসতে থাকা হিমাংশুর উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চয় একটা ধারণা দিত, কিন্তু এখন সেই ধরনের সম্ভাবনা নাই করে দেওয়া হয়েছে– তার সন্তর্পনে এগিয়ে যাবার কায়দা, নিঃশব্দ পদক্ষেপের বুদ্ধি মানুষটিকে কোনো ধরনের সর্তকতা অবলম্বনে বাধ্য করেনি– অতএব তিনি বেফিকির বেপরোয়া ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছেন, একবারও মনে এই ধরনের ভাব আসতে দেননি যে তাকে অনুসরণ করছে পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ – না নিঃশ্বাসের শব্দ তার নাগাল পায় না, হা- বুকের ভেতরে ধক ধক করে আওয়াজ করছে হিমাংশুর কর্তব্য পরায়ণ হৃদপিণ্ড,তার মনে হল অন্য কোনো শব্দ কোথাও থেকে তার কানে আসছে না, বিশেষভাবে বানিয়ে নেওয়া জুতোর গোড়ালি মসৃণভাবে নিঃশব্দে মাটি স্পর্শ করছে, শুকনো ডাল পাতা এখনই কোথাও পড়ে নেই যে মড়মড় করে সেই সব কিছু অনাকাঙ্খিত শব্দের সৃষ্টি করবে, শিশির পড়ছে না  যে গাছের পাতা থেকে তা ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ঝড়ে পড়বে– কিন্তু তার হৃদপিন্ডের আওয়াজ কিছুটা জোরে হচ্ছে– ধপ ধপ, কিন্তু সেইসব তার বুকের ভেতরে কোথাও রিক্ত গহ্বরে মিলিয়ে যাচ্ছে, তাই তার উপস্থিতি কোনো অপ্রয়োজনীয়  শব্দের সৃষ্টি করছে বলে তার মনে হচ্ছে না, বাতাস হয়তো তার দেহের ঘ্রাণ বয়ে নিয়ে যেতে পারত এবং সামনের মানুষটি তার থেকে আভাস পেয়ে যেত, কেউ থাকে অনুসরণ করছে – কিন্তু সেরকম কোনো সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে বাতাসের মৃদু স্রোত উল্টো দিকে বইছে, ব্যাপারটা তাকে সন্তোষ দান করল, সে চোখের বিশেষ চশমা একবার ছুঁয়ে দেখল, কী অপূর্ব কৌশলে নির্মিত হয়েছে যে সে চশমা দিয়ে সামনের ব্যাক্তিটির একটা ছায়া- অবয়ব দেখতে সমর্থ হয়েছে, ঈষৎ সবুজ হলুদ রঙের সংমিশ্রণের আলো মানুষটির অবস্থিতি তার চোখের সামনে তুলে ধরেছে, অথচ সেই জানে যে চারপাশে ঘুপচি অন্ধকার, অন্ধকারের গাঢ় স্তর ঘিরে রেখেছে চারপাশ, যার ফলে মানুষটা কোনো মতেই তাকে চিনতে পারেনি, এমনকি ওদের দু’জনের মধ্যে ব্যবধান কমে গিয়ে কয়েক ইঞ্চি হয়ে পড়লেও তার উপস্থিতি মানুষটার নজরে আসবে না, হঠাৎ কোথাও বাদুড়ের আওয়াজ, ঝিল্লির কোলাহল বন্ধ হয়ে গেল, তবু মানুষটা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল না, আর তার গতি স্তব্ধ হল না, তার মনে হল সে কী এক অপ্রয়োজনীয় টার্গেটের পেছন পেছন অনুসরণ করছে– এভাবে অনেক ক্ষেত্রে ভুল লক্ষ্যের পেছনে ধাবিত হওয়ার অজস্র অভিজ্ঞতার কথা ডিটেকটিভের জীবনে দেখা যায়, হয়তো তারই এভাবে কিছু ভুল হতে পারে, সে থামল। কিছুক্ষণ পরে কথাগুলি গোড়া থেকে ভাবার চেষ্টা করল– ইনিই কি সেই মানুষ যাকে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে,  সে নিশ্চিত কাজটুকু তাঁর  দ্বারা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, না হলেও সে সন্দেহযুক্ত মানুষগুলির নামের তালিকা থেকে কিছু নাম এভাবে কর্তন করে যেতে হবে, তারপর যে সমস্ত ব্যক্তি থেকে যাবে তাদের ওপরে তার সন্দেহ ঘনীভূত করতে হবে, এটাই এলিমিনেশন পদ্ধতি, কিছু নাম তাকে পদ্ধতিগতভাবে মুছে যেতে হবে – মানুষটা দাঁড়াল, দাঁড়ানোর কোনো যুক্তি ছিল না, কী কারণে তার গতি রুদ্ধ হল, মনের পরিকল্পনা বদলে গেল নাকি, না তার নিঃশব্দ পদসঞ্চালনও তাঁর মনে এনে দিয়েছে সন্দেহ শঙ্কার ধারণা–’কী করা  যায়?’

তপন কাঁধে হাত রাখল। হিমাংশুর মনে পড়া একটা ডিটেকটিভ কাহিনির কল্পনাটুকুতে হঠাৎ তোলপাড় লাগল এবং সে বুঝতে পারল যে তপন তার  কাছে এসে পড়েছে।’

‘কী বা করা যায়?’– কথাটা হিমাংশুর মনের নিঃসহায় ভাবটা হয়তো খারাপ ধরনে প্রকট করে তুলল যার ফলে তপনকে বলতে হল যে ওদের জন্য এখন কৌশল  নির্ণয়ের সময়, তোর জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন, বুদ্ধির প্রয়োজন হবে।

তপন তর পাশের টুলটাতে বসল, সেও কথাগুলি এত সহজ হবে যেন ভাবেনি, তথাপি এক নতুন উত্তেজনার আসায় তার মনে এসে পড়েছে চঞ্চলতা, বললঃ’ প্রথমে আমাদের রণকৌশল ঠিক করতে হবে–’

হিমাংশুর মুখ থেকে কোনো কথা বের হল না।

‘তুইতো বেশ বড় বড় ডিটেকটিভ গল্প পড়ার ভাষণ দিচ্ছিলি,কী ছিল– হা, শার্লক হোমস, রহস্য সিরিজ আর ও কত কী, সঙ্গে তোর সিনেমাগুলির হিসেব তো আছেই, সায়েন্স ফিকশনটা বাদই দিলাম টিভি সিনেমা এসব মালমশলা গুলি –– সমস্ত কাজে লাগিয়ে কিছু একটা করে দেখাতে হবে ‘–

নিজের অজান্তেই হিমাংশুর রাগ হলঃ’ এইসব সিনেমা-টিনেমা কোথায় আসল কাজ করতে পারা যায় না। মেনে নিলাম, আমি অনেক গল্প কাহিনি পড়েছি, সেগুলির এক একটি নিজের পটভূমি রয়েছে, কাহিনীর মেলানোর জন্য এটা ওটা জোড়াতালি দিয়ে কাজটা শেষ করেছে, হত্যাকারী খুঁজে পেয়েছে, চোর -দাগাবাজ ধরেছে, বড় বড় কেসের আসামি খুঁজে পেয়েছে– সেই সব বইয়ের কথা, গল্পের প্লট কেবল– কিন্তু আসল জীবনে, আমাদের ডেইলি লাইফ প্রকৃতপক্ষে ঘটে যাওয়া কথা এটা আসামি খুঁজে বের করা  কথা কি ?’

তপন বুঝতে পারল তার কিছু রাগ হয়েছে, হিমাংশু বেশি না খেপানোই  ভালো, কিসের ত্রুটি হল সে হাজারিকা সার্ক এর সমস্ত কথাগুলি জানিয়ে দিয়ে তপনের জন্য আনতে পারে গালিগালাজ তিরস্কারের উপহার। অতএব তপন হাতে নিয়ে থাকার নোট বইটাতে কলমে দ্বারা অনর্থক কিছু আকি বুকিত লেগে পড়ল হিমাংশুকে কাজে লাগিয়ে দিতে পারার বুদ্ধি একটা ভেবে দেখাটাই তার কাছে এখন মুখ‍্য হয়ে পড়ল–

তপন জানতে পারল যে সমস্ত আঁকিবুকিসে শূন্য অর্থে আরম্ভ করেছিল, সেগুলিতে এখন কিছু অর্থ এসে পড়েছে, যে বড় কক্ষে ঢুকে স্কুলের মধ্যম শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা বিরতির সময় খেলাধুলো করে, দাবা-ক‍্যারম, লুডু আদির খেলায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে সেই কক্ষটির  এক রেখাচিত্র সে ইতিমধ্যে এঁকে ফেলেছে এবং এর কোনখানে দুটি টুলের ওপরে সে এবং হিমাংশু বসে এক বড় রহস্য ভেদ করার দায়িত্বে নিয়োজিত হয়ে পড়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা তপন রেখাচিত্রে দেখিয়ে ফেলল– হা, ঠিক এই জায়গাটিতে ওরা দুজন এখন বসে আছে ,ওদের পূব দিকে দুটো আয়নার আলমারি, সেখানে  খেলাধুলোর নানা রকম সামগ্রী রাখা আছে, আলমারি দুটোর ভেতরের জিনিস গুলির দিকে সে মাথা তুলে তাকাল– সেখানে কিছু পুতুল, গাড়ি-মোটর, চারটে ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট, ভাঙ্গা শাটল ,কয়েকটি কক, স্কুলের নাম লেখা স্তুপ করে রাখা কিছু কাপড়, পাশেই একটি পতাকা– এই সব স্কুলের বার্ষিক সভায় ব্যবহৃত হয়, তারপরে সারা বছরের জন্য খেলার রুমটির ভেতরে সেই সমস্ত ঢুকে পড়ে, আলমারি দুটোর ভেতরে প্রবন্ধ সেই সব গুছিয়ে রাখে, আর ডেকা স‍্যার  তালা মেরে দেওয়ার পরে কার ও সাধ্য নেই আলমাড়ি খুলে কেউ ব্যানার কয়েকটি বা পতাকাটা ছুঁয়ে দেখতে পারে। হয়তো মাঝে মধ্যে প্রবালদা কখনও কখনও সেই সব বের করে রোদে দিতে পারে,– হ্যাঁ, এরকম হয়তো ঘটে গেল ডেকা স‍্যারের হাত থেকে বন্ধের দিনে প্রবাল চাবির গোছা নাল, বলল আজ বন্ধের দিন, রুমটা আজকে একটু পরিষ্কার করা ভালো হবে, চারপাশে চিকা-চিকা গন্ধ এখানে সেখানে মাকড়সার  জাল, ভেঙ্গে ফেলল কুমোরের চাক ভেন্টিলেটরের ভাঙ্গা আয়নার ঝুল  ছাড়ালো , ফাটা কাপড় দিয়ে আলমারির আয়না পরিষ্কার করল , এখানে সেখানে পড়ে থাকা পুতুল খেলনা , চাবি দিলে চলতে শুরু করা পুতুল রোবোটটা– আর সেই মুহূর্তে বাইরে কোথাও কানে তালা লাগিয়ে ট্রাকের চাকা ফেটে গেল, ভূমিকম্পের কম্পন এল, প্রবালদার হাত থেকে রোবটটা খসে পড়ল–ঠং–

তপনের মুখ থেকে বেরিয়ে এল– হাঁ,।

‘ নতুন  কোনো ক্লু নাকি?’

হিমাংশু তার মুখের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নে তপন প্রকৃতিস্থ হল, সে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘামের কণা মোছার  চেষ্টা করল, আর বুঝতে পারল যে কল্পনায় তৈরি করা কাহিনিটা এরকম মুহূর্তে হিমাংশুকে না বলাই ভালো হবে, অতএব সে কেবল  বলে গেল,’ বিশেষ কিছু নয়–?’

হিমাংশুর মুখ থেকে উথলে উঠতে  চাওয়া রংটা নাই হয়ে গেল। সে বেড়ায় ঝুলে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকাল, দাগ লাগা আয়নার  মধ্য দিয়ে এসে পড়ল সময়ের আভাস–

‘ আরও বেশি সময় এভাবে ভেবেচিন্তে বসে থাকার সময় কোথায়, কিছু একটা প্ল‍্যান ?’

‘ও’ বলে সায় দিল  তপন।

তার বন্ধুরা এ রকম উত্তরে ক্ষুন্ন হয়ে বলল হিমাংশু ,

‘যে কাজ পারব না বলে মনে হয় সেটা না নেওয়াই ভালো–’

এই ধরনের পান্ডিত্যপূর্ণ উপদেশের বর্ষণে তপনের চট করে রাগ হয়ে গেল, সেই তর্জনী দেখিয়ে হিমাংশুকে বলল’ কাজটা করার নামে প্রথম হাত তুলেছিল কে?’

বন্ধুর শব্দহীন উত্তর তপনকে সংকটে ফেলল। সে দীর্ঘ হাতের জামার  ভেতরে লুকিয়ে রাখা হিমাংশুর নিঃসার হাতের দিকে তাকাল, গলার কাছ থেকে হাতের ছোট ছোট আঙ্গুলগুলির ডগা পর্যন্ত তার করুণ চোখ বুলিয়ে গেল আর শেষে পাকা মেঝের ফাটল ধরা স্থান টুকুতে আবদ্ধ হয়ে থাকা কাগজের টুকরো গুলিতে তার দৃষ্টি সমর্থিত করল এবং সে বলল, ‘সরি, কিছু মনে করিস না, কিছু একটা বলতে চাইলে অন্য কিছু একটা বের হয়…’

হিমাংশুর মুখের ক্ষীণ হাসি তপনকে আশ্বাস দিল যে সে কি ধরনের কথায় সম্প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এটা কোন নতুন কথা নয়, তার মনে পড়া দিন থেকে সে এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আসছে, সুযোগ পেলেই মানুষ তার পোলিও রোগের আক্রমণে অসাড় করে ফেলা বাঁ- হাতটাকে অকেজো করে ফেলেছে, তার অসহায়তার অজুহাত নিয়ে হাসছে, অথচ সে কোনোমতেই মূঢ়  মানুষের এই ধরনের নিষ্ঠুরতায় নিজেকে নিঃস্ব বলে ভাবে নি তার মনোবলের   সীমা কেবল অসীমের দিকে ধাবিত হয়েছে, সে নিয়মিত স্কুলে এসেছে ক্লাস সেভেনের ছেলেদের সঙ্গে সে সমানে এগিয়ে গিয়েছে, খেলেছে, লাফিয়েছে, একহাতে ক্রিকেট ব‍্যাট  ঘুরিয়েছে, দৌড়েছে কেউ স্তব্ধ করে দিতে পারেনি তার দুর্বার গতি কেবল সে শুধু চেয়েছি মানুষ তার ঝুলে থাকা ক্ষীণাকৃতির হাতটিকে তার দেহের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে ভাবুক। এখন সুখের কথা যে সহপাঠীরা তাকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখে না সে কখনো শিক্ষকের কাছ থেকে পায়নি সেই ধরনের করুণা জাগানো দৃষ্টি –

‘কাজটা দিয়েছে যখন করতে না পারলে খুব বড় কথা হবে–’

হিমাংশু পকেট থেকে বের করে তপনের দিকে একটি চিউংগাম এগিয়ে দিল, তপন হলদে রঙের জিনিসটা হাতে নিল, খোসা ছাড়ালো এবং মুখের ভিতর ছুঁড়ে দিল– স্কুলের ভেতর এই সমস্ত খাওয়া নিষেধ,নয়না  দিদিমণি ,পংকজ স্যারের চো এই পরবর্তীতে পড়ে থাকা বিভিন্ন জিনিসগুলি খে পড়লে যে কোনো শাস্তি তাদের মধ্যে এসে পড়তে পারে, কিন্তু এখন সেই সবের ভয় নেই, আমরা দুজন এখন পড়ার ঘরে নেই, হাঁ, কিছুক্ষণ পরই ক্লাসের বাকি ছেলেরা ওদের সামনে আসবে, একজন একজন করে ওদের হিমাংশু-তপন প্রশ্ন করবে, ঠিক কোনো পুলিশের অনুসন্ধানকারী অফিসারের মতো ওরা দুজন জিজ্ঞেস করবে বিভিন্ন কথা, যাকে ক্রাইম থ্রিলারের ভাষায় ওরা বলবে’ইন্টারোগেশন’, তারপর ওরা দুজনেই পরীক্ষা করবে এই বড় ঘর থেকে পড়ে থাকায় জিনিসগুলি, সন্তর্পনে খুঁজবে আবশ্যকীয় ক্লু, বা ঘটনার সম্ভেদ দিতে পারা সন্ধানে তারা ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খুঁজে দেখবে কীভাবে কে করল ঘটনাটা, আফটার অল, সমস্ত অপরাধীরাই রেখে দিয়ে যায় কিছু ক্লু বা পদচিহ্ন–

‘বসেই থাকবি নাকি? কিছু একটা আরম্ভ করে দিই, কি বলিস?’

চুইংগাম  চর্বণে ব্যস্ত হিমাংশু মুখ থেকে কোন উত্তর এল না। তপনের দেহ-মনে দেখা গেল চাঞ্চল্য, সামনের ওয়াল পকেট শব্দ তাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে যে ওদের হাতে বেশি সময় নেই, একটা পিরিওডের সীমিত সময়ের ভেতরে ওদের সমাধান করতে হবে রহস্যটা, খুঁজে বের করতে হবে কার ইচ্ছায় ঘটে গেল কাজটা, বা হতে পারে কারও অসাবধানী হাতের নির্মম স্পর্শে সংঘটিত হল দুর্ঘটনাটি, খেলার মাঝখানের উত্তেজনায়  কেউ হয়তো ভুলে গেল যে সমস্ত জিনিসকে, সমস্ত যন্ত্র- খেলনা, পুতুলকে এক সীমিত প্রকারের আঘাত নেবার জন্যই নির্মাণ করা হয়েছে, যেভাবে সমস্ত জীব এক নির্দিষ্ট টেনশন, স্ট্রেচের ঊর্ধ্বে যেতে পারে না কারণ প্রত্যেকের একটি সেবা আছে শারীরিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে এবং সেভাবেই সে গুলোকে সৃষ্টি করা হয়েছে-

ধ্বংস করব বলে করিনি, হয়তো এক দুর্ঘটনা,হয়তো খেলার স্ফুর্তিতে ভেবে ফেলা‌ কথাটা তপন একই সারিতে  বলে শেষ করব বলে ভেবে ও থেমে  গেল, কারণ ইতিমধ্যেই হিমাংশু তার প্রারম্ভিক অভিযানে লেগে পড়ল। এখন তপন থেকে কিছু দূরে এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে থাকা বিভিন্ন সামগ্রী গুলির মধ্যে হিমাংশু পা ফেলছে, তার স্কুলের ইউনিফর্মের জুতোর চাপে  বিশৃংখল ভাবে থাকা জিনিসগুলি না ভাঙ্গার জন্য হিমাংশুকে সন্তর্পনে পা ফেলতে দেখে তপনের ও  নিজের মনে এক শিহরণ এসে পড়ল, সে ভাবল এই মুহূর্তে তার একটা সাহেবি স্টাইলের টুপির প্রয়োজন ছিল, সঙ্গে চোখে কালো চশমা, হাতে একটা ব্যাগ, ব‍্যাগের ভেতরে ডঞ একজন ডিটেকটিভ নিয়ে বেড়ানো উন্নত সাজ-সরঞ্জাম, একজোড়া প্লাস্টিকের হাতমোজা, একটা হ‍্যান্ডেল যুক্ত ম্যাগনিফাইং আয়না যার সাহায্যে সে চুল , রংবেরঙের অপরিচিত পদার্থের টুকরো, হাতের অক্ষর বা যেকোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস ভালো করে দেখা যায়, বলিউড তো পারে, এটাই আমি চেয়েছিলাম, কারণ এই সমস্ত সামগ্রী প্রমাণ করে দিতে পারে পুরো ষড়যন্ত্রটা, অপরাধী আসল কাহিনিটা, কে কখন কীভাবে এই জায়গায় একত্রিত হয়ে কল্পনা করেছিল একটা অপরাধ সংগঠিত করার, প্রতিটি কথাই নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছিল, প্রত্যেকটি কাজই, আর তারপরে, ওরা একত্রিত হয়ে– হ‍্যাঁ, আর সেই ব্যাগের ভেতরে থাকা উচিত ছোট একটি ফর সেপ, কিছু তুলো, একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রুমাল,–– সে তাতে গিলে নিতে পারে হয়তো একটি ধারালো ছুরি, বা পিস্তলের গুলি, কারণ সেভাবেই সে দেখেছে একজন ডিটেকটিভ অপরাধে ব্যবহৃত সামগ্রীসমূহ সাবধানে তুলে নেয়, শুয়ে পড়েছে এর ফলে সেগুলিতে লেগে থাকা ঘাম, রক্তের দাগ বা আঙুলের ছাপের চিহ্ণ সঠিক হয়ে থাকে– হ্যাঁ কিছু সেফটিপিন, রাবার ব্যান্ড, ছোট ছোট দুটি বোতল , আঙ্গুলের ছাপ তুলতে পারা কয়েক ধরনের সামগ্রী –

তপনের মনটা ভালো হয়ে গেল, সে হিমাংশুর দিকে এগিয়ে যেতে তাঁর অককককজ মনে হল যে এই সময়ে নিজেকে ডিটেকটিভ বলে প্রতিপন্ন করার জন্য তার গলায় একটা ক্যামেরা ঝুলে থাকা উচিত ছিল, হয়তো প্যান্টের পকেটে ছোট্ট একটা পিস্তল জাতীয় কিছু একটা–

ঢং ঢং করে স্কুলের ঘন্টা বাজল, ওরা বুঝতে পারল একটা পিরিয়ড  শেষ হল।

‘হাজরিকা স‍্যার বোধহয়  এখনই বেরিয়ে আসবে’

‘এখনই কিছু একটা করা ভালো।’– তপনের এই কথাটা হয়তো হিমাংশুর কানে ভালো করে গেল না, কারণ ইতিমধ্যে একটা ক্লাস শেষ হওয়ার হৈ–হাল্লা চারপাশ থেকে ছিটকে এসে তাদের ঘরটা কাঁপিয়ে তুলল।

‘আমাদের ক্লাসের ছেলেরা বাদে সেই সময়ে এই ঘরে তো আর কেউ ছিল না, সবারই ক্লাস চলছিল, প্রত্যেকেই নিজের নিজের শ্রেণি কোঠায় ব্যস্ত ছিল–’

হিমাংশুর মুখে কথাটা শুনে তপনের মনে একটা নতুন উদ্যম এল, তার মনে হল ইতিমধ্যেই হিমাংশু আরম্ভ করে দিয়েছে অনুসন্ধানের প্রথম পদক্ষেপ – হ্যাঁ ঠিক সেই সময়ে কে কে এই ঘরে উপস্থিত ছিল, অন্য কোনো অনাহুত ব্যক্তি ওদের অজ্ঞাতে এখানে ঢুকে পড়েছিল কিনা যে সবার অজান্তে সংঘটিত করে গেল একটি বড় অপরাধ –হ্যাঁ বড় অপরাধই, কারণ এই খেলার রুমের ভেতরে থাকা সমস্ত আসবাব সামগ্রীর ভেতরে ‘চুমো’নামে এই খেলনা রোবটটার দাম সবচেয়ে বেশি ,অত্যাধুনিক কারিগরিবিদ্যায়  নির্মিত, এটা চাবি দিলেই হেঁটে যেতে পারে,হাত বাড়িয়ে দিয়ে যার তার সঙ্গে করমর্দন করতে পারে, দুইহাতে সে ছুঁড়ে দিতে পারে বাস্কেটবল, ক্রিকেট বল –

‘আমাদের প্রথম খুঁজে বের করতে হবে উৎপাত করা ছেলে গুলির  নাম, মানে আমাদের ক্লাসের কোন কোন ছেলেকে আমরা উদ্ধত স্বভাবের বলে –’

হিমাংশুর কথাটা তপন  শেষ হতে দিল নাঃ’ সেটা কি বড় কথা– পুলক এক নম্বর, তার পুরো চালচলন স্বভাব-চরিত্র তুই দেখেছিস, অনবরত হইচই করে থাকার মতলব তার, তাতে  আবার তার দম যে সে নাকি  কুংফু ট্রেনিং নিচ্ছে ,লাগ বললেই সে আমাদের মতো ছেলের হাত পা ভেঙ্গে–ওঃ আঃ চুঃচাঃ গুলি তো আছেই, সঙ্গে হাতে পায়ের টানাটানি– আমার মতে পুলক–’

‘একটা নামকে নিয়ে আমরা ডিটেকটিভগিরি করতে পারিনা প্রথম কথা হলো কিছু নাম আমাদের বের করে দিতে হবে যার ওপরে সন্দেহের ভাব–’

‘বিনয়। হাঃ হাঃ– তাকেও পুলকের সঙ্গে রাখতে পারি, কী বলিস?’

হিমাংশুর থেকে কোন উত্তর এল না, তপন সুখী হল না, কারণ বিনয়ের ওপরে তার রাগ বহুদিনের, অনুজের জ্যামিতি বক্স সে লুকিয়ে রেখে মিছামিছি নন্দিনী দিদির গালি খাইয়েছে তপনকে।

‘বিনয় এক নম্বর ধূর্ত। আমি ভাবি পুলকের সঙ্গে–’

হিমাংশু থেকে কোন ধরনের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তপন কিছুটা ক্ষুণ্ণ হল, তথাপি তার মুখে এই অসন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ না করাটাই ভালো বলে ভাবল, কারন সে অনেকবার রহস্যের বইয়ে পড়েছে যে একজন ডিটেকটিভকে হতে  হবে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে, সে কোন ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপরে ভোর করে নিজের বৃত্তি চালানোটা অন্য এক অপরাধ–

‘আমরা খুব বেশি এই রুমে পঁয়ত্রিশ/চল্লিশ মিনিট ছিলাম কারণ আগের পিরিয়ডটা শেষ হওয়ার পরে এখন এসে পৌঁছাতে পাঁচ মিনিটের মতো লেগে যায়, অবশ্য দৌড়াদৌড়ি করে এসে–’

‘সেইজন্যই পুলক এবং বিনয়ের নাম আমরা ভাবতে পারি, মনে কর, আমরা সব ছাত্র এখানে ঢোকার আগে পড়া দুটো ক্লাস থেকে দৌড় দিয়েছে, যে ধরনের উৎপাত  সৃষ্টি করার প্রবণতা, এটা সম্ভব বলেই মনে হচ্ছে, বাকিরা এসে পড়ার আগে আরম্ভ করে দিল দুজনেই নিজের কুংফু ক্যারাটে,আঃ উঃ তার পরে কে পায়, রোবটের সঙ্গে কে প্রথম খেলবে সেই নিয়ে লাগাল এক হুলুস্থুল, সাইড কিক- ব্যাক কিকের মতো মার্শাল কলা প্রদর্শন, ঠুংঠাং করে গড়িয়ে পড়ল রোবট, ব্যাচেলর পক্ষে অসম্ভব হল এরকম এক অত্যাচার সহ্য করাটা, আর ভেঙে গেল তার ডান হাত এবং আমরা সবাই, ক্লাসের বাকি ছেলেরা এখানে ঢুকলাম, খেলার মনোযোগে জানতেই পারলাম না কীভাবে কী হল, কে কী খেলল, কে কখন রোবটের হাত ভাঙল, আর আবিষ্কার হল যে এত দামি পুতুল একটা ইতিমধ্যেই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। হেড স্যারের কানে পড়ল গোপনে গড়িয়ে যাওয়া এই খবর এবং সশরীরে লাল চোখে স্যারের আবির্ভাব বললেন – এখনই খুঁজে বের করতে হবে কে এই কাজ করেছে তোরা নিজে প্রথম খুঁজে দেখ, দোষী কে, না হলে হাজারিকা স‍্যার বিচার করবে, আর তখন তোদের প্রত্যেকের হাতগুলি বাঁচাতে হবে– অতএব নন্দিনী দিদিমণি তোকে ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে পেতে দিল মেইন ডিটেকটিভ, তুই আমাকে বেছে নিলি তোর এসিস্ট্যান্ট– আমরা এখন বাইরে থেকে আনা সেই খবরটা কে নষ্ট করেছে সেই অপরাধীকে খুঁজে বের করতে হবে তার জন্য আমাদের ডিটেকটিভ বইয়ের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে সঙ্গে কমনসেন্স সাধারণ বুদ্ধি না হলে পুরো ক্লাস তাকি হাজারিকার সারের বিচার এবং শাস্তির সামনে দাঁড়াতে হবে’– এত কথা সে কেন এভাবে বলে ফেলল তপন নিজেই বুঝতে পারল না।

‘তোর পুরো বর্ণনাটাই  কোনো বইয়ের রহস্যঘন অধ্যায়ঃ বলে মনে হল–’

হিমাংশুর কথায় তপন কিছুটা লজ্জিত হল, সে জানে হিমাংশু তার তুলনায় জ্ঞান-বুদ্ধির মাপকাঠিতে অনেক ওপরে, তবু তাঁর দীর্ঘ বিবরণ হিমাংশু মন দিয়ে শোনায় তার মনে একটা  সন্তুষ্টির ভাব এল।

ঘরটার দরজার বাইরে থেকে কেউ ঠেলে  খুলে দেওয়া ওরা বুঝতে পারল। ভেতরে  পুলক চলে এল।

‘কেন এলি?’

তপনের মুখে এই ধরনের এক দাদাগিরির উষ্মা থাকা প্রশ্নে হিমাংশু কিছুটা অবাক হল, সে পরিবেশটা ঠান্ডা করার মতলবে পুলক কে বোঝালো যে ক্লাস্টার কয়েকজন ছাত্র কে একসঙ্গে কথাগুলি জিজ্ঞেস করবে আর হাজারিকা স্যার রুমটিতে  কে কে আসবে নির্ধারণ করবে–

‘জেরা করবি, হ্যাঁ ?’

পুলকের কণ্ঠস্বরে এক প্রত্যাখ্যানের ভাব ছিটকে আসা যেন মনে হলো তপনের ।

‘বড় ডিটেকটিভ গিরি  জানিস !’

অভাবনীয়ভাবে বিনয় কখন ও এসে পুলকের মনোবল বাড়িয়ে দিল তপন হিমাংশু বুঝতেই পারল না। দুজনেরই  মনে এল পুলকের যুযুৎসু ছবি, তপন বললঃ’ কে দুষ্টমি করেছে, কে দোষী– আমরা বের করতে না পারলে সমগ্র ক্লাস টা কে ভুগতে হবে–’

তপনের বোঝানোতে পুলকের চেহারায় বিশেষ পরিবর্তন এল যেন দেখা গেল না। তার মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটি ইতিমধ্যে পকেট থেকে বাইরে নির্গত হল, হিমাংশুকে বেফিকির ধারণায় দেখা গেল ভাঙ্গাচোড়া বস্তু গুলির মধ্যে ব্যস্ততায়, বিনয় তুলে নিল ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেট–

‘জিনিস ভাঙবেই, খেললে নষ্ট হবেই, আর এই সমস্ত তৈরি করা হয়েছে এক সীমিত আয়ুর জন্য ,বিনয়ের তত্ত্বপূর্ণ কথায় পুলকের মুখে আরও সন্তুষ্টির রং দেখা গেল।

‘কী খেলা দেখছিস যা ভাঙবে না, নষ্ট হবে না, পুলক বিনয়ের সুর প্রতিধ্বনিত করল এবং বলল, ‘মানুষই মরে ধ্বংস হয়’

কথাটাতে তপন এক ধরনের দীর্ঘশ্বাস অনুভব করল, পুলকের পিতার গত বছর মৃত্যু হওয়াটা তার মনে আছে। কাগজের নাড়ু একটা  ব্যাডমিন্টনের  র‍্যাকেট দিয়ে আঘাত করে পাঠাল বিনয়, সামনের ঘুর্নায়মান ফ্যানে টং করে আওয়াজ করে গুলির মতো গতিতে কাগজের নাড়ুটা ছিটকে পড়ল।

সারা পিরিয়ডটা আমরা ক‍্যারাম খেললাম, প্রীতি কোথায় কে কী করছে, তার আমরা কি জানি–’ পুলকের কণ্ঠস্বরে কিছু সহজ সুর।

‘রাসুলরা দাবা খেলে উঠে এদিকেই আসছিল, তার এমনিতেও এই ফালতু খেলা গুলিতে  ইন্টারেস্ট – এই পুতুলের গাড়ি চালানো চাবিদিয়া রোবট চালানো এই ধরণের বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের ক্ষেত্রেই তার ইন্টারেস্ট, আমাদের জন্য বক্সিং, কুংফু, ক্রিকেটের স্পিন এসব–’

বিনয়ের কপালে এখনও সজীব হয়ে থাকা ঘা-এর দিকে তপনের চোখ গেল,দুদিন আগে বারান্দা দিয়ে নামতে গিয়ে সে পড়ে গিয়েছিল।

‘আমাদের মধ্যেই কেউ হয়তো রোবটের হাতটা ভেঙ্গেছে’—

হিমাংশুর কথায় পুলক লাফিয়ে উঠল,বলল ,খুঁজে বের করে দে কে করেছে,তোরা দুজন নাকি খুব বড় ডিটেকটিভ-‘

তপন বুঝতে পারল ওদের ক্রাইম থ্রিলার পড়ার সখ সম্পর্কে পুলক উপহাস করছে,কারণ টিফিনের সময়ে তপনদের দলে এই ধরণের কথাই বলে,ষ্টক হলম সিন্ড্রোম,অপহরণের কাহিনি ,বিশ্ববিখ্যাত ব্যাঙ্ক ডাকাতি,মার্ডার মিষ্ট্রি,সায়েন্স ফিকশন এমনই ক্তকিছু-যেখানে রয়েছে উৎকণ্ঠা,সংশয়,স্ফুর্তি,উত্তেজনা—

‘রাতুলকে জিজ্ঞেস করে দেখ-‘

বিনয়ের দিকে দূর থেকে মাথা তুলে তাকাল হিমাংশু এবং বলল’এরকম একটা নাম বললে হবে না,আমাদের প্রমাণ চাই,তথ্য চাই,সায়েন্টিফিক ক্লু চাই,সব কথা হাওয়ায় বলা যায় না—‘

স্পষ্ট দেখা গেল পুলকের মুখে কিছু একটা কর্কশ শব্দ এসে পড়ল,এবং মুখ থেকে শব্দটা বের করে না দেওয়া পর্যন্ত ভেতরে রেখে সে বড় কষ্ট পেল।

‘তোদের সঙ্গে আর কে কে ছিল—মনে কর তোরা যখন ক্যারম খেলে শেষ করলি—‘

তপনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার সুরটা পুলককে নিশ্চিতভাবে অসন্তুষ্ট করল,’পুলিশের মতো জেরা করবি না-’

তার হাতদুটি পুনরায় মুষ্টিবদ্ধ দেখে তপন কিছুটা সন্ত্রস্ত হল,কারণ তার কণ্ঠস্বরে আগের সেই দৃঢ়তা শোনা গেল না—‘আমরা প্রত্যেকেই পুরো কথাগুলি ভেবে দেখলে সমাধান বের হবে,  না হলে একে অপরকে–’

‘রাতুল এবং প্রকাশকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পার, ওরা দুজনেই একটু কেয়ারলেস ধরনের, কাজকর্মে শৃঙ্খলা নেই, সহজ কথায় উৎপাত কারী, যা মনে হল–’

পুলকের মেজাজটা একটু ঠান্ডা হয়েছে বলে মনে হল। হিমাংশুর কাছে এটা কোনো নতুন তথ্য নয়, প্রকাশের সঙ্গে পুলকের ঝগড়া পুরোনো ক্রিকেটে এলবিডব্লিউ আউট দেওয়াকে নিয়ে, ওরা আজও একমত হতে পারেনি।

খোলা দরজা দিয়ে দৌড়ে ভেতরে চলে এল  ইনামুল–

‘ডেকেছে’

‘কে?’

‘স্যার।’

‘কাজই হয়নি, এখনই ডাকলে হবে না–’

তপনের উত্তরের জন্য ইনামুল অপেক্ষা করল না, সে কেবল নিজের মাথায় হাত চাপড়ে  আগের গতিতেই বেরিয়ে গেল, আর তার সংকেত থেকে বাকিদের বুঝতে কঠিন হলো না যে হাজারিকার স্যারের টাক মাথায় এখন গরম।

‘আন্দাজে কিছু একটা নাম বলে দে গিয়ে–’

বিনয়ের তাচ্ছিল্য তপনকে ক্ষুন্ন  করল, হিমাংশু কাছে চলে এল, বললঃ’ কাজই আরম্ভ করতে পারা গেল না, এখন–’

ইতিমধ্যে বিনয়ী এবং পূলক উপহাসের সুরে হা হা করে হেসে উঠেছে–

‘ঠিকই আছে, পুরো ক্লাসটা ফাঁসবে, আমাদের কী, হাজরিকা স্যার  সবাইকে–’ বিনয় পুলকের হাসি-ঠাট্টা তপনের কথাটা শেষ করতে দিল না। ওরা দুজন বাইরে বেরিয়ে গেল।

ওদের দিকে তাকিয়ে থাকা তপনের কাঁধ চাপড়ে হিমাংশু বললঃ বল–’

দুজনেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরের ক্লাস রুমের দিকে ধাবিত  হল।

‘শোন, আসলে আমি জানি কে করেছে–’

তপন  অপেক্ষা করল, সিডিটা হইহল্লা করে ছেলেরা উপর নিচ করতে লাগল।

‘ক্রাইম থ্রিলার পড়ে অপরাধী বের করা যায় না–’ তপন হিমাংশুর কানে কিছু জোর করে চিৎকার করল।

‘আমিই ভেঙ্গেছি  রোবটার হাত–’

তপন সিঁড়ির ওপরে একা হয়ে রইল, কোনো দুজন তাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেল।

‘আজ এতদিন ধরে রোবটটার  চালচলন আমার কাছে হয়ে পড়েছিল এক প্রত‍্যাহ্বান। ব্যাটারিচালিত একটা মেশিন সূইচে প্রাণপেয়ে উঠেছে, হাসছে, নাচছে, দুইহাতে হেণ্ডশেক করছে, ভলিবল তুলে নিচ্ছে, আঙ্গুলের ইশারায় সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, সুরের ছন্দে বাহু কাঁপাচ্ছে–’

হিমাংশু তপনকে বাঁ হাতে খামচে ধরল, তার শরীরের কম্পন প্রবাহিত হল তপনের দেহে, সে বলে গেল–’ দেখ, এটা হাত, মনে নেই আমি কবে এটা নাড়াতে পেরেছিলাম, বনানী কবে এটা আমার কথামতো নাড়াচাড়া করেছিল, আমার মনে যখন গান আসে, ভাবি দুই হাতে আমিও কিছু একটা করি–’

ইতিমধ্যে ছেলেরা ক্লাসে প্রবেশ করেছে–

‘ক্লাসে চল’– তখন তাকে জোর করে সামনের দিকে ঠেলে দিল।

‘একটা মেশিনের হাত আমাকে বিদ্রূপ করে, হট নাচ আমাকে উপহাস করে, তার হাতের মুদ্রা আমাকে বিদ্রুপ করে–’

এখন হিমাংশু এবং তপনের সামনে হাজরিকা স্যার, ক্লাসের বাকি ছেলেদের মুখে এক কৌতহলের চাহনি।

‘আমি জানি, তোরা খুঁজে বের করতে পারলি না, এখন সবাই শাস্তির  জন্য রেডি হ–’

তপন  বসে থাকা বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল,’ খুঁজে বের করেছি স্যার।’

হাজরিকা স্যারের  টাক মাথার ঘামে  পড়েছে জানালা দিয়ে আসা বিকেলের রোদ।

‘আমিই করেছিলাম কাজটা, খেলার সময় কিছু একটার আগে ক্রিকেটের ব্যাট দিয়ে কুপিয়ে ভেঙ্গে দিলাম রোবটার হাতটা –’

তপনের কথায় ছড়িয়ে পড়ল একটা অজানা গুমগুম ধ্বনি ।

তপন এসবে কান দিল না, সে কেবল তিন  সারি পেছনে বসে থাকা হিমাংশুর মুখের দিকে তাকাল, সে হিমাংশুর চোখের কোনে জমে থাকা কয়েক ফোঁটা জল লক্ষ‍্য করল, আর তার মনে হল হিমাংশু যেন অসাড় হাতটা তোলার চেষ্টা করে তাকে কিছু একটা বলছে–

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত