সেই সব স্মৃতিরা
ফোনটা রিং করে উঠতেই তড়িঘড়ি ধরে ফেলল সৃজা। নীতীশের ফোন। সেলফোনটা সাইলেন্ট মোডে করে রাখতে ভুলেই গিয়েছিল,রোজই রাতে শোওয়ার আগে করে রাখে, অথচ আজ! আজকের দিনটাই যেন উল্টোপাল্টা। যা যা ঠিকঠাক হবে ভেবেছিল তা তো হলই না তার উপর সব কিছুই বেঠিক হয়ে গেল।
-হ্যালো
নীতীশের গলা শুনে চটক ভাঙল ওর
-হুঁ
-ঘুমোওনি?
-না।
-কষ্ট পাচ্ছ?
নীতীশের কথায় অবাক হল সৃজা।
-কষ্ট তো তোমার পাওয়ার কথা নীতীশ।
-পাচ্ছি তো
-অ্যাম সরি,অ্যাম অ্যাশেমড কিভাবে যে!
-সৃজা, আমি বাবাইয়ের কথায় কিছু মনে করিনি বিশ্বাস করো।
-নীতিশ!
সৃজার রাজ্যের বিস্ময় ঝরে পড়ল
-বাবাই ঘুমিয়েছে?
প্রসঙ্গ বদলাল নীতীশ।
-অনেকক্ষণ।
-কান্নাকাটি করেছে আর?
সৃজা চোখ মুছল।
-তুমি চলে যাওয়ার পরও কেঁদেই যাচ্ছিল।
-বকোনি তো?
সৃজা নিরুত্তর থাকল,
-সৃজা?
-হুঁ
-বকলে কেন?
-এতটা রুড বিহেভ করল তোমার সাথে…বকব না?
-ওর মনের কথাটা পড়ে দেখেছ একবার?
সৃজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
-জানি,বড্ড পজেসিভ আমাকে নিয়ে।
নীতীশ হাসল,
-সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
-হয়তো।
-হয়তো নয় সৃজা। সেটাই স্বাভাবিক। আমি কষ্ট পাচ্ছি অন্য কারণে।
সৃজা অবাক হল,
-কি?
-বাবাই এর মনে ‘বাবা’ শব্দটার সাথে এত তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে,ওর এত ভালো বন্ধু হয়েও বুঝিনি কেন বলতো?
সৃজা থমকাল,
-আমিই জানাইনি,এতটা লজ্জার কথা।
-এই আমাকে ভালোবাসো?
নীতীশ প্রশ্নটা করেই থমকাল। সৃজার যে এটা বড় স্পর্শকাতর জায়গা।
-বাসি না তাহলে?
সৃজা বলল।
-আমি ওভাবে বলতে চাইনি সোনা। তোমার জীবনসঙ্গী হওয়ার যোগ্য যখন ভেবেছ,তোমার সুখের সাথে সাথে দুঃখের ভাগটাও আমার নেওয়া উচিৎ…তাই না?
-ঐ ঘটনাগুলোর ছাপ আমার জীবন থেকে মুছেই ফেলেছিলাম নীতীশ। ঐ সব কালো দিনগুলোকে পিছনে ফেলে জীবনে অনেক এগিয়ে গেছি আমি। আবার নতুন করে বাঁচতে চাইছিলাম বাবাই আর তোমাকে ঘিরে।
-এখন আর চাও না?
নীতিশ বাজিয়ে দেখতে চাইল।
-চাই কিন্তু, আচ্ছা বলতো আমার সন্তানের নিষ্পাপ মস্তিস্কে এই ঘটনাগুলো যে এত ছাপ ফেলেছে,মা হয়ে আমিই তো তা এতদিন বুঝিনি।
-শিশুর মস্তিস্ক মাটির ডেলার মতো হয় সৃজা। যা দেখে,তার তো একটা ছাপ থাকেই।
-ঐটুকু বয়সে দেখা ঘটনাও?
-ঘটনার বীভৎসতার মাত্রাটাও তো তুমি ভাববে…আমার ভাবতেই অবাক লাগছে সৃজা, তোমার মত মেয়ে এত সব সহ্য করেছিল?
সৃজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
-পরিস্থিতি বলতে পারো। বাবা-মা পছন্দ করে পাত্র বেছে বিয়ে দিয়েছিলেন। ওদের সম্মানের কথাটা ভাবতাম। মফস্বল শহরে চট করে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বছর পাঁচেক আগে এতটা সহজ ছিল না…তার উপর বাবাই হওয়াতে ওর দেখাশোনা করার অজুহাত দেখিয়ে ওরা স্কুলের চাকরিটাও ছাড়িয়ে দিয়েছিল। বাবাইকে নিয়ে বাপের বাড়িতে উঠলেও যে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবো তার কোন আশ্বাসও ছিল না। বাবা রিটায়ার্ড…ভাইও দরের চাকরি করত না।
-থাক সেসব কথা। তুমি যে ঐ নরক থেকে শেষমেশ বেরিয়ে এসে আজ এতটা সফল হয়েছ…সেটাই বা কি কম কথা?
-আমাকে যে করতেই হত নীতীশ। নিজে বাঁচতে গেলে ছেলেকে বাঁচাতে গেলে এছাড়া তো পথ ছিল না। আজ বাবাইএর মুখে শুনলেই তো।
নীতিশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল,
-ওই স্কাউন্ড্রেলটাকে পেলে মেরেই ফেলতাম আমি।
হঠাৎ করেই বলল নীতিশ। সৃজা থমকাল। নীতিশ তো খুবই ঠাণ্ডা মাথার লোক। কখনোই তো রাগে না। তাও!
-কাম ডাউন। আমি ওদেরকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছি নীতীশ।
-আমি যে ভুলতে পারছি না সৃজা।
-এতো ভালোবাসো আমায়?
নীতীশ হাসল,
-হ্যাঁ, সে তো বাসিই। তার সাথে সাথে বাবাইকেও খুব ভালোবেসে ফেলেছি যে!
-জানি। নীতিশ ও যদি আমাদের সম্পর্কটাকে মেনে না নেয়।
নীতিশ সৃজাকে থামিয়ে দিল,
-আই আন্ডারস্ট্যান্ড। আমি কখনো জোর করব না সৃজা। আই ক্যান অ্যাশিওর ইউ। আমি চিন্তিত ছেলেটার মনে ওই তিক্ততার ছাপ যেন সারাজীবন চেপে বসে না থাকে। ও সবে সাড়ে সাত,তাই না সৃজা? ওর পার্সোনালিটির গড়নটাই যেন ওর শৈশবের ওই ঘটনা গুলোর জন্য আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে অন্যরকম না হয়ে যায়। ওকে স্বাভাবিক একটা শৈশব দিতে হবে। বাকি সব ছেলেমেয়েদের মতো একটা ফ্যামিলির ছায়া ওর দরকার। সৃজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
-আমি বুঝি নীতিশ। সিঙ্গেল প্যারেন্ট হিসাবে একটা বাচ্চা বড় করা একদমই সোজা নয় নয়। ওর মা হিসাবে আমিও চাই ও আর সব্বাইকার মতো বাবার ভালোবাসা পাক। কিন্তু ও যদি একান্তই।
-আমি তোমার সাথে একমত সৃজা। জোর করে কোন সম্পর্ক ওর উপর চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী আমিও নই। তুমি আর বাবাই দুজনেই সমান গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য।
-কি করবে তাহলে? আজকের ঘটনার পর ওর আর তোমার বন্ধুত্বের উপরেও প্রশ্নচিহ্ন পড়ে গেল যে।
নীতীশ চোখ মুছল।
-জানি। কেউ ওর বাবা হলে মা’কে আবার কষ্ট দেবে। এই ভয়টা ওর মনে এতটাই গভীর যে আমাকে হয়তো আর সহ্যই করতে পারবে না। তবুও…
সৃজা অবাক হল,
-তবুও কি নীতীশ?
-চেষ্টা তো করতেই হবে আমাকে…তাই না? ওর বিশ্বাস,আস্থা,ভালোবাসা আবার নতুন করে জিততে হবে আমাকে।
-এত ব্যস্ততার মধ্যে কি করে পারবে।
-ট্রাষ্ট মি সৃজা। আমি পারব,শুধু ছেলেটাকে তুমি বকো না। আমাকে নিয়ে জোর জবরদস্তি করো না। মোটের উপর আমাকে ওর উপর বাবা হিসাবে চাপিয়ে দিও না। ও যদি আমাকে না মানে,বন্ধু হিসাবেও কথা না বলে তুমি ইন্টারফেয়ার করো না। আমি ওকে ঠিক মানিয়ে নেব। জানো, এখন হয়তো আমি বুঝি বাবাই আর পাঁচটা বাচ্চার মতো উজ্জ্বল নয় কেন আগে ভাবতাম একটু বেশিই হয়তো ম্যাচিওরড ও তাই হয়তো সবসময় বই আর আঁকা এখন বুঝি ও হয়তো একটু বেশিই ইনসিকিওরড্। তাই এত কম মেশে বেছে বেছে বন্ধুত্ব করে কম কথা বলে।
সৃজা হাসল,কষ্টের হাসি,
-আমার সাথে তো রাজ্যের কথা ওর। অথচ ওই কথাগুলো আমাকেও কখনো বলেনি। মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন।
-তোমাকে খুব ভালোবাসে তোমার ছেলে।
সৃজা কিছু বলল না। নীতীশই আবার বলল,
-আমাকেও একদিন খুব ভালবাসবে। দেখো, তোমার ছেলেকে আমাদের ছেলে বলব আজ থেকে মানবও তাই।
সৃজা চোখ মুছল।
-আমি সত্যিই খুব লাকি যে আই হ্যাভ ইউ ইন মাই লাইফ।
-ট্রাষ্ট মি,না?
-ইয়া,মানুষ চিনতে আমার ভুল হয়না নীতীশ,পাঁচটা দীর্ঘ বছর তো তিনি তোমায় বিশ্বাস করা যায় কিনা বুঝব না?
-ফাইভ লং ইয়ারস্ না? আমি তোমায় প্রথম দেখা থেকেই পছন্দ করি,জানো?
-বলোনি তো জানব কি করে?
-আই অ্যাম আ শাই গাই সৃজা ইউ নো।
-আই ডু। আমার অতীত আছে জেনেও এত ভালোবাসো আমায়।
-তোমার অতীত সম্পর্কে আমরা আলোচনা করব না। এটা বোধহয় আগে থেকেই ঠিক করা ছিল,তাই না?
-আজ যখন অতীতের আসল চেহারাটা জানলে তাও তোমার কিছু এসে যায় না?
নীতীশ ফোনে সৃজাকে চুমু খেল,
-এসে যায় সোনা। আজ থেকে আরো বেশি ভালোবাসি তোমায়। বেশি সম্মান করি।
-আমার পাশে থাকবে তো নীতীশ?
-মরে না গেলে থাকব।
-নীতীশ!
-সরি,সৃজা শুয়ে পড় এবার।
-কাল রায়পুর যাচ্ছ?
-হুঁ, চারদিন পর ফিরব।
-মিস ইউ।
-যেতে তো হবেই,সাইটের কাজ।
-জানি।
-ভেবেছিলাম আজকেই রেজিস্ট্রির নোটিশটা দিয়ে যাবো।
-আমিও তাই চেয়েছিলাম।
-ছাড়ো। এত কথা বললাম আমার বাবাই জেগে যায়নি তো?
সৃজা হাসল,
-না জাগেনি।
-একটা কথা বলব?
-বলো।
-কাল অফিসে যেও না। বাবাইএর সাথে কাটাও। তোমাকে হারাবার ভয়ে তোমার সাথেও রুড বিহেভ করবে হয়তো। অনেক রাগও দেখাতে পারে। মাথা গরম করবে না। ছেলেটার সামনে এক্সাম। মনে রেখো। স্বাভাবিক ব্যবহার করো,কেমন? আমার জন্য ওর মা যে ওর থেকে দূরে চলে যায়নি সেটা ওকে বুঝিও।
-আচ্ছা।
-রাখছি,কেমন?
-আচ্ছা,গুডনাইট।
-গুডনাইট।
ফোনটা রেখে দিলেও ঘুম আসছিল না কিছুতেই। সৃজা চোখ বুজলেই দুঃস্বপ্নের মতো ঐ ঘটনাগুলো ভেসে উঠছিল। এই পাঁচবছরেও অনেকবার ওরা স্বপ্নে হানা দিয়েছে। যতদিন যাচ্ছিল তত দুঃস্বপ্নগুলোর হানা দেওয়ার মাত্রা কমে আসছিল। আর আস্তে আস্তে স্মৃতিগুলোও ধূসর হয়ে উঠছিল। সারাটাদিন কাজের এত চাপ থাকে সৃজার,আজকাল তো বিছানায় শুলেই ঘুম চলে আসে। শরীরে মনে এতটাই ক্লান্ত থাকে ও। আজকেও অনেক ধকল গেছে তবুও আজকে হানাদাররা বিগত জন্মের ঘটনার মতো মলিন ছিল না। বরং টাটকা তাজা সৃজা যেন চোখ বুজলেই আবারও সেই নরকের মধ্যে চলে যাচ্ছে। সেইসব যন্ত্রণা আবার অনুভব করছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেইসব পুরনো ক্ষতগুলো আবার টাটকা তাজা হয়ে উঠেছে।অবিশ্রান্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে সেখান থেকে। মনের সেই পুরনো গ্লানি অপমানবোধগুলোও অক্সিজেন পেয়েছে আবার। আবারও ডিপ্রেশনে চলে যাবে না তো সৃজা? আগেরবার তো অনেক কষ্টে বাবাইএর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ডিপ্রেশনের অন্ধকার থেকে বার করে এনেছিল। সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে নিজেকে আর নিজের সন্তানকে নতুন জীবন দিয়েছে সৃজা…অনেক পরিশ্রমে,অনেক চেষ্টায়। আজ ওর এই নতুন জীবনে ঐ ঘটনাগুলো অবাঞ্ছিত। ওদের ন্যূনতম ছাপও সৃজার নিজে হাতে গড়া সুন্দর সংসারে নেই। আজ অবধি এই ভেবে তৃপ্ত হত সৃজা। কিন্তু আজ যে সৃজার অতীত আবারও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আর নিজের কালোছায়ায় সৃজার ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে নেওয়া সুপরিকল্পিত ভবিষ্যৎএর পথকে গ্রহণাচ্ছন্ন করে তুলেছে। অতীতের লড়াইএ জিতে গেছে ও একা হাতে নিজের সন্তানকে সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ দিয়েছে। এই বড়াইটা সৃজাকে একটু অহংকারীই করে তুলেছিল। সাম্প্রতিককালে বাড়িতে ফোন করা,বাবা মা’র খোঁজ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছিল ও। তার উপর নীতিশের ভালোবাসার ভরসাকে পাশে পেয়ে ডানা মেলে নতুন জীবনের রঙিন স্বপ্নের দিকে প্রজাপতির মতো উড়তে শুরু করেছিল। নীতিশ পাশে থাকলে আর কারোর সাথে সম্পর্ক রাখারও প্রয়োজন হবে না। এটাই কি ভাবছিল ও? জন্মগত সম্পর্কগুলোও অবহেলা করতে শুরু করে দিয়েছিল ও। বাবা মা’কে কষ্ট দিয়ে ওদের অক্ষমতা, দুর্বলতা সৃজার প্রয়োজনে সৃজাকে পরিপূর্ণ সমর্থন দিতে পারার মেরুদণ্ডহীনতাকে শান্তি দিতে চেয়েছিল ও। নিজের অতীতের মাশুল অন্যকে শস্তি দিয়ে চোকাতে চেয়েছিল যেন। অথচ কি মস্ত বড় ভুলটাই না করেছিল। অতীতের ছায়ারা সবচেয়ে প্রিয় সম্পদকেই যে আপাদমস্তক গ্রাস করে রেখেছে।এটাই বোঝেনি এতদিন। ছায়ার সাথে লড়াই এ হয়তো কেউ কখনোই জিততে পারে না,সৃজার আত্মগর্ব আজ ধূলিধূসরিত,নিজেকে তো বটেই নিজের সন্তানকেও ঐ দমবন্ধ করা স্মৃতির ভার থেকে মুক্ত করে উঠতে পারেনি সৃজা। বাবাইএর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত ভেবেছিল ও। অথচ ওর মনে নরক যন্ত্রণার দগদগে ঘা আজও একইরকম গভীর। আর রক্তাক্ত বুঝতেইপারেনিসৃজা।নিজেকে ছেলের প্রিয় বন্ধু বলে মানে সৃজা। দাবীও করে তাই।অথচ ছেলের মনের মত এত বড় কষ্টটাই ওর অজানা! এই ও সফল মা? নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল সৃজার। ওর ভালোবাসায় এইটুকু জোরও নেই যা ওর নিষ্পাপ সন্তানকে সব ভুলিয়ে দিতে পারে? নীতীশ তো ঠিকই বলছিল। বাবাইএর চারিত্রিক গঠনটাই সাফার করবে এই জন্য। নীতীশকে ওর দরকার। ভীষণভাবেই দরকার। যতটা যা নিজের জন্য দরকার তার থেকে অ.নেক অনেক বেশি করে বাবাইএর জন্য দরকার এই কথাটা ভেবেই তো নীতীশের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল সৃজা। নীতীশকে ভালোবাসে ও। নীতীশের ভালোবাসাকে সম্মান করে। নীতীশের ব্যবহার,মার্জিত রুচি,চলমান সব কিছুই সেই আদর্শ পুরুষকে খুঁজে পেয়েছে সৃজা যাকে সারাটা জীবন হয়তো খুঁজে এসেছে ও। নীতীশআকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী। অথচ সেই বাইরের চটকে সৃজা ভোলেনি। এত গুলো বছর ধরে নীতীশের ভালোবাসার নিরুচ্চার উত্তাপকে অনুভব করেছে ও। নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখেছে। নীতীশ সৃজার সমবয়সী। এই বয়সেই এত প্রতিষ্ঠিত ফার্মের চিফ ইঞ্জিনিয়ার,অ্যালিজেবল ব্যাচেলার। বাবা মা কেউ নেই ওর ঐ প্রসঙ্গে নীতীশ খুব একটা আলোচনা করে চায় না। হয়তো নীতীশেরও একটা অতীত আছে। ছোট থেকেই বোর্ডিংএ মানুষ। সেলফ্ মেইড ম্যান,নীতীশের কাছে শুরু থেকেই এটা স্পষ্ট ছিল যে সৃজা ডাইভোর্সড্। সিঙ্গল মাদার নীতীশ আর সৃজার বন্ধুত্বের শুরুতেই এই সত্যিগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছিল সৃজা। নীতীশের অনুভূতিগুলোকে বাড়তে দিতে চায়নি ও। কোন সম্পর্কে আর নতুন করে জড়াতে চায়নি। নীতীশের বন্ধুত্বকে তাও এড়াতে পারেনি। আর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছিল সৃজার অতীতটা নীতীশের কাছে একেবারেই গুরুত্বহীন। এত বছরে একবারও ডিভোর্সের কারণ জানতে চায়নি নীতীশ। সৃজা আর নীতীশ বর্তমান নিয়েই কথা বলত তাই। সৃজাকে নিজের অতীতটাকে ভুলে যেতে নীতীশের সাহচর্য্যই সাহায্য করেছিল বলা যায়। বছর ছয়েক আগে নীতীশ সৃজাকে মনের কথা বলেছিল। সৃজা তখনো নিঃসংশয় ছিল না। সময় চেয়ে নিয়েছিল তাই। সময় দিয়ে কার্পন্য করেনি নীতীশ। এই দুবছরে বাবাইএর কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল নীতীশ। সৃজার দ্বিধায় কারণটা বুঝতে ভুল করেনি ও। সৃজাকে অবাক করে দিয়েই এত কম সময়ে ছেলের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল নীতীশ। এতটাই যে সৃজা নীতীশের কাছে বাবাইকে রেখে নিশ্চিন্তে কাজে যেতে পারত। বড্ড চুপচাপ ছেলে ওর। সহজে কারোর সাথে মেশে না। অথচ নীতীশ আঙ্কলকে বেশ ভালোইবাসে ও। এর কৃতিত্বটা নীতীশেরই প্রাপ্য। ওর সাথে ওর মতো করে মেশে নীতীশ। রাজ্যের বই কিনে দেয়…সেগুলো পড়ে ছেলের যত রাজ্যের প্রশ্ন হয় সবকটার উত্তর দেয়। ঘুরতে যেতে একদম চাইত না যে ছেলে নীতীশের জন্য এখন ড্রাইভে যেতে,বাইরে যেতে,একটু আধটু ভিড়ের মধ্যে যেতে আপত্তি করে না। এবার পূজোতেও ঘুরতে বেড়িয়েছিল তিনজনে। বাবাই পাড়ার পূজোর আর দাদুর বাড়ির পাড়ার পূজোর বাইরে কিছু দেখেনি কখনো। বাড়িতে মামা মামী ভাইএর সাথে কখনোই বেড়াতে বা ঠাকুর দেখতে পাঠাতে পারেনি সৃজা। মা না গেলে ও কোথাও যাবে না। অথচ এবার নবমীতে সৃজা না বেড়োলেও নীতীশের সাথে দিব্যি বেড়িয়েছিল বাবাই। নাগরদোলা চড়িয়ে এনেছিল নীতীশ। সৃজা তো শুনে আকাশ থেকে পড়েছিল। যে ছেলে বিকালে সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলতে যেতে চায় না সে মেলায় বেড়িয়েছে,নাগরদোলা চেপেছে,মজা করেছে ভাবতেই অবাক হয়েছিল সৃজা। নীতীশকে পেয়েও বাবাই যে ওর শৈশবকে এতটা উপভোগ করছে,এই সত্যিটা বুঝতে বাকি ছিল না ওর। সৃজাও তো নতুন করে বাঁচছিল আবার। সম্পর্কটাকে নাম দেওয়ার সময় এসেছে। নীতীশকে বলেছিল কথাটা। নীতীশ খুব খুশি হয়েছিল,বাবাইকে বলতে বলেছিল ও। সৃজা বলেছিল দুজনে একসাথে বলবে। সেই বলার দিনটা আজ ছিল। বাবাই এর প্রতিক্রিয়ায় চমকে গেছিল দুজনেই। থরথর করে কাঁপছিল ছেলেটা। কথা আটকে যাচ্ছিল কাঁদছিল খুব হিস্টিরিয়া গ্রস্থ রোগীর মত বারবার বলছিল, “বাবা চাইনা আমার কেউ আমার বাবা নয় বাবা খুব খারাপ হয় বাবা হলেই তুমি আমার মা’কে কষ্ট দেবে আমি জানি মা তুমি ওকে চলে যেতে বলো” নীতীশ অবাক হয়ে গিয়েছিল,
-আমি তোর মা’কে কষ্ট দেব কেন?
-আমি জানি।
-কি জানিস?
সৃজার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল।
-বাবা মা’কে মারে,সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয় একবার সাঁড়াশী দিয়ে জিভ টেনে ধরেছিল মা কিছু করতে পারে না-কিছু না খুব কষ্ট পায় তখন কাঁদে ।
নীতীশ অবাক চোখে সৃজার দিকে তাকিয়েছিল। সৃজা চোখ নামিয়েছিল।
-বাবাই
-আমি সব দেখেছি। তুমিও ওরকমই করবে। আমি জানি।
নীতীশ বাবাইকে কাছে টানতে গিয়েছিল,কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বোঝাবে ভেবেছিল।
-ছোঁবে না আমাকে। সরে যাও।
নীতীশের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। সৃজা বাবাইকে থামাতে চেয়েছিল।
-বাবাই, কাকে কি বলছ?
-মা, ওকে চলে যেতে বল। ঐ লোকটা আমার বাবা হবে না বলো আগে।
নীতীশ হাঁটু গেড়ে বাবাইএর সামনে বসেছিল।
-সবাই কি একরকম হয়, বাবাই? তুমি তো আমায় চেন। নীতিশ আঙ্কল তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি কেন তোমার মা’কে কষ্ট দেব?
-আমি জানি না। তুমি চলে যাও।
নীতীশ কথাটার গুরুত্ব বুঝেছিল। উঠে পড়েছিল,
-আচ্ছা চলে যাচ্ছি। আমাকে ছাড়তে চলো।
-একাই যেতে পারবে।
নীতীশ সৃজার দিকে তাকিয়েছিল,
-চলি।
-আচ্ছা
সৃজার কিছু বলার ছিল না। নীতিশ চলে যেতেই বাবাই মাকে আঁকড়ে ধরেছিল। ঝরঝর করে কেঁদে যাচ্ছিল প্রথমে। সৃজা আদর করে থামিয়েছিল। তাও ফুঁপিয়েই যাচ্ছিল। একটু রেগে গিয়েছিল সৃজা। মাথার মধ্যে সব ওলটপালট হচ্ছিল। একটু বকাবকি করতে হয়েছিল। শান্ত হয়েই বাবাই প্রথম প্রশ করেছিল,
-মা নীতিশ আঙ্কল বাবা হবে না তো?
সৃজার প্রচণ্ড কষ্ট হলেও ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
-না তুমি না চাইলে হবে না।
-মা
-হুঁ
-পড়াবে না?
-না,অনেক কাঁদলে,খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়।
-আচ্ছা।
সৃজা চোখ মুছছিল,
-মা তুমি কাঁদছ?
-উঁহু,চোখে কিছু পড়েছিল।
-তোমাকে আমি একটুও কষ্ট পেতে দেব না।
সৃজা এত কষ্টের মধ্যেও ছেলের ভালোবাসা দেখে খুশি হয়েছিল একটু।
-ঠিক আছে।
বাবাই এখন পাশে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ছেলের কাছে আর একটু এগিয়ে গেল সৃজা। ছেলেটা ঐটুকু বয়সে যা যা দেখেছে সব মনে আছে! তাই মা’কে কোথাও যেতে দিতে চায় না। মা’কে নিয়ে ওর এত ভয়! মা’কে খুব ভালোবাসে পাগলটা। মা’কে কেউ কখনো কষ্ট দিক চায় না। অথচ ঐটুকু মন কি করে বুঝবে নীতীশকে দূরে সরিয়ে দিতে ওর মা’র মনে কতটা কষ্ট হচ্ছে? বুঝবে কি কোনদিন? না বুঝলেও কিই বা করার আছে সৃজার। নীতীশকে বাবাইএর অমতে বিয়ে করলে ছেলেটার গোটা জীবনের উপর এর খারাপ প্রভাব পড়বে। কি চেয়েছিল সৃজা,আর কি হল? নীতীশের স্নেহ ভালোবাসা আশ্রয় বাবাই যাতে সবসময় পায় সৃজার তাই তো একান্ত কাম্য ছিল। বদলে বাবাইএর মনে নীতীশের জন্যও ঘৃণার বীজ বপন হয়ে গেল না তো আজ থেকেই? সেদিন ম্যাগাজিনে পড়ছিল যারা ছোটো বেলায় নিজের মা’কে বাবাদের হাতে অত্যাচারিত হতে দেখে সেইসব ছেলেরা বড় হয়ে স্ত্রীকে অত্যাচার করার প্রবণতা বেশি হয়। বাবাই-ও কি ও যে অতিরিক্ত শান্ত…বাধ্য…মুখচোরা…একটু টিমিড্,…এগুলোও কি ঐ ভয়ালো স্মৃতিগুলোর জন্যই? বাবা আর মা…দুজনকেই একজন সন্তানদের বিকাশে আবশ্যক। বাবার বদলে বাবাই তো জঘন্য কতগুলো স্মৃতি উপহার পেয়েছে। এই স্মৃতির তাড়না থেকে নিজের সন্তানের শৈশবকে কি করে বাঁচাবে সৃজা? নীতীশই হয়তো ঠিক। একমাত্র বাবার ভালবাসাই ওকে স্বাভাবিক করে তুলতে পারে। নীতিশ বেটা করে দেখতে চায়। বাবাই কি সেই সুযোগটাও ওকে দেবে? বাবাই পাশ ফিরল। ঘুমের ঘোরে। মাকে জড়িয়ে ধরল। সৃজা ছেলেকে আদর করল একটু। ঘুমোবার চেষ্টা করতে হবে এবার কাল বাবাইকে বোঝাতে হবে…নিজের মত করে…
ঘুম ভেঙ্গেই অবাক হয়ে গেল অভিমন্যু,সৃজার বাবাই। মা কোথায়? কটা বাজে? এমা…সাতটা বেজে গেছে তো…আজ স্যাটারডে…স্কুল নেই…তাও সাতটার আগে না উঠলে মা বকে। কাল রাতে পড়াশোনা হয়নি। মা’তো একটুক্ষণ পরেই অফিস চলে যাবে। তাহলে? উঠে পড়ল অভিমন্যু খাট থেকে নামতে যাবে…মা ঘরে এল,
-মর্নিং মা…
-মর্নিং বাবাই-ঘুম ভাঙল?
-সরি…দেরি হয়ে গেল।
মা হাসল,
-ইটস ওকে। ফ্রেশ হয়ে নাও। ব্রেকফাস্ট করে পড়তে বসবে।
মা হাসল…মা রাগ করে নেই তাহলে? কাল রাতে নীতীশ আঙ্কেলর সাথে অতটা বাজে ব্যবহার করল বাবাই…তাও…বাঃ রে…মা তো বোঝে…বাবাই মা’কে কত ভালোবাসে। বাবাই তো মা’র জন্যই বাবা চায় না। নীতীশ আঙ্কেল বাবা হলেই ঐ লোকটার মতো হয়ে যাবে। মা’কে কষ্ট পেতে দেখে বাবাই আগে কিছু করতে পারত না। কিন্তু এখন তো ও বড় হয়েছে। মা’কে জেনেশুনে কষ্ট পেতে দেবে কেন? নীতীশ আঙ্কল খুব কষ্ট পেয়েছে কাল। আঙ্কল তো বাবাইএর বেস্টফ্রেন্ড। আঙ্কল খুব রাগ করেছে নিশ্চয়। আর আসবে না এখানে। অবশ্য না এলেই ভালো। বাবাইএর কষ্ট হবে…কিন্তু মা তো কষ্ট পাবে না।
-কি ভাবছিস?
মা’র কথায় চমকাল অভিমন্যু।
-কিছু না তো…
-কাল রাতের কথা ভাবছিস…তাই না?
সৃজা ছেলের পাশে বসল,
-মা…তুমি আমাকে বকবে?
সৃজা ছেলের গায়ে ভরসার হাত রাখল,
-বকব কেন?-
-না মানে…আঙ্কলকে ওরকম বললাম…
সৃজা ছেলের চোখের দিকে তাকাল,
-অন্যায় করেছ,বোঝ তো?
-আঙ্কলকে আমি ওরকম বলতে চাইনি। আমি আঙ্কলকে খারাপ বলব কেন? আঙ্কল বাবা হতে চাইল যে…
-বাবারা খুব খারাপ,না?
অভিমন্যু দুচোখ ভরা জল নিয়ে তাকাল মা’র দিকে,
-বাবাই…না…কাঁদছ কেন? ঐসব পুরোনো কথা ভেবে এখনো ভয় আর কষ্ট পাও কেন? আমরা তো ঐ বাজে জায়গা,বাজে লোকদের থেকে অ…নেক দূরে চলে এসেছি। ওরা চাইলেও এখন তোমার মা’কে কোন কষ্ট দিতে পারবে না।
-সত্যি?
সৃজা ছেলেকে কোলে নিল,
-একদম। হ্যাঁ রে…তোর অত ছোটবেলার কথা মনে আছে?
-স…ব,ওরা সবাই তোমাকে খুব কষ্ট দিত। বাবা…ঠাম্মা…দাদু…সবসময় বকত…ঠাম্মা বাবা ফিরলেই সব মিথ্যা মিথ্যা বলত তোমার নামে…তারপর…
আবারও কেঁদে ফেলল অভিমন্যু।
-না কাঁদে না…আমি তো এই জন্য ওদের ছেড়ে তোকে নিয়ে এখানে চলে এসেছি বাবাই। হ্যাঁ রে…এতটা কষ্ট মনের মধ্যে রেখে দিয়েছিলি এতদিন? মা’কে বলতে পারিসনি? আমি তো ভাবতাম তুই ওসব কথা ভুলেই গেছিস।
-ভুলিনি তো,ভাবলেই খুব কষ্ট হয়। তোমাকে ঐ জন্যই কোথাও যেতে দিই না। দাদুর ঐ জন্যই যেতে চাই না। ওখানে ওদেরও বাড়ি তো…
সৃজার বুকটা গর্বে ভরে উঠল,
-সোনা…বাবা…আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ বাবাই। টোটালি সেফ। ওরা আমার সাথে আর ঝামেলায় যাবে না। আমাদের লিগ্যাল ডাইভোর্স হয়ে গেছে। ওদের সাথে আমাদের আর কোন সম্পর্ক নেই,বুঝলে?
অভিমন্যু মাথা নাড়ল।
-ওসব ভুলে যাও। দেখ তোমার সব বন্ধুদেরই তো বাবা আছে। সবার বাবা কি খারাপ হয়? ওসব ভেবে কষ্ট পেও না।
-সবার থাক,মা…আমার বাবা চাই না। বাবা এসে তোমাকে যদি কষ্ট দেয়…
সৃজা বুঝল এই ভয়টা এত সহজে যাবে না। কথা বাড়াল না আর,
-পুরনো কথা ভুলে যাবে তো?
-হুঁ…
-প্রমিস?
অভিমন্যু মা’কে জড়িয়ে ধরল,
-প্রমিস…
-আঙ্কল তোমার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে কাল। সরি বলবে তো?
অভিমন্যু চোখ মুছল,
-বলব,আঙ্কল তো আমার বেস্টফ্রেন্ড,আঙ্কল যদি বলে বাবা হবে না তাহলে আঙ্কলকে খুব ভালবাসব। যদি তাও কথা না শোনে তাহলে আঙ্কলের আর এখানে আসতে হবে না,
-বাবাই!
চমকে উঠল সৃজা,
-এরকম বলে না…
-আমার মা’কে আমি খুব ভালোবাসি,বাবার দরকার নেই…
আবারও সেই একই কথা,
-ফ্রেশ হয়ে এসো,
তিক্ত সৃজা বলল,
অভিমন্যু চলে গেল সৃজার কষ্টটা কমল কি? ছেলের মনের কষ্টটা অ…নেক কমাতে পেরেছে হয়তো…পুরোপুরি কমবে না কখনো। নীতীশকে কি বলবে? নীতিশ ওকে ছাড়া থাকতে পারবে না। বাবাইএর জন্য এই অনুরোধটা করে দেখবে নীতীশকে? সৃজার কি নীতিশকে এতটা ভালোবেসে ওকে ছাড়া থাকতে পারবে? কষ্ট হলেও…পারতে হবে। বাবাইএর জন্য।
-মা…
সৃজা তাকাল।
-অফিস যাবে না?
-না।
অভিমন্যু অবাক হল,
-কেন? মাসি এসে গেছে তো…
সৃজা ছেলেকে কাছে ডাকল, কোলে নিল তারপর
-এমনিই যাবো না
-মন খারাপ?
সৃজা চমকাল,
-অল্প অল্প।
-কার জন্য?
-তোর জন্য।
সত্যিটা বলল না সৃজা,
-কেন?
-তুই যে এত কষ্ট পাচ্ছিস ও সব উল্টোপাল্টা ভেবে…তাই।
অভিমন্যু খুশি হল খুব,
-আঙ্কলের জন্য কষ্ট পাচ্ছ ভাবলাম…।
সৃজা ছেলেকে আদর করল,
-না,আসলে তোর সাথে থাকতে খুব মন করছে…তাই অফিস যাইনি।
-সত্যি?
-হুঁ।
-কি মজা…।
-মা বাড়ি থাকলে খুব মজা,না?
-হ্যাঁ খু…ব মজা।
-মা…আজ তুমি আর আমি খুব গল্প করব,কেমন?
সৃজা হাসল,
-তা বেশ,হ্যাঁ রে…আজ চল্ কোথাও ঘুরতে যাই,যাবি?
-বিকালে?
-হুঁ,ড্রাইভে,তুই আর আমি।
-আচ্ছা।
সৃজার মোবাইলটা বেজে উঠল। নীতীশ…
-হ্যালো…।
-মর্নিং…।
-মর্নিং,কোথায়?
-বেরিয়ে পড়েছি। অন মাই ওয়ে।
-ড্রাইভ করছ?
-না,না ড্রাইভার আছে। আমার ছেলে কি করছে সৃজা?
সৃজার মনটা ভরে গেল,
-বাবাই পড়ছে।
অভিমন্যু অবাক হল। নীতীশ আঙ্কল বাবাই এর কথা তাও মনে করছে? বাবাই যে এত বাজে বাজে কথা বলল?
-আমার ছেলে কান্নাকাটি করেনি তো?
-সকালে কাঁদছিল পুরনো সব কথা মনে করে। আমি বুঝিয়ে বলেছি। আর ওসব ভাববে না…প্রমিস করেছে আমায়।
-বাঃ…বেশ। আজ মা অফিস যাবে না খুব খুশি নিশ্চয়?
-খুব।
-ওকে দাও একবার।
চমকাল সৃজা,
-আর ইউ শিওর?
-ইয়া।
সৃজা ছেলেকে ফোনটা দিল
-কথা বলো।
অভিমন্যু চমকে উঠল। ভয় পাচ্ছিল ও। আঙ্কল খুব রেগে আছে নিশ্চয়,
-হ্যালো।
-বাবাই…মন কেমন এখন?
-ওকে। তুমি রাগ করেছ?
-কই না তো? আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের উপর আমি রাগ করব,কেন? তবে একটু অভিমান করেছি।
-অভিমান?
-হুঁ। আমার বাবাইএর মনের সব কথা আমি জানি ভাবতাম। কাল দেখলাম কত কথাই তো জানি না…।
-আঙ্কল…আমি তোমাকে অত বাজে করে বলতে চাইনি। তুমি যদি বলো বাবা হবে না…তাহলে আমি তোমাকে খুব ভালবাসব”
নীতীশ হাসল,
-তুই যতদিন না চাস্ হব না।
-তুমি রায়পুর যাচ্ছ?
-হ্যাঁ। মঙ্গলবার ফিরব। ফিরেই বাবাইএর কাছে যাবো। কেমন?
-হুঁ।
-তোর জন্য কি আনব,বল?
-তুমি যা আনবে সেটাই তো বেস্ট গিফট।
সৃজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দুজনের কথাবার্তাগুলো আগের মতোই হচ্ছে।
-মা বাড়িতে…না?
-হ্যাঁ।
-মন দিয়ে পড়ছ তো?
-হ্যাঁ।
-এক্সাম সামনে…তাই তো?
-হ্যাঁ।
-পড়ো তাহলে। তোর মা’কে দে।
সৃজা ফোনটা নিল।
-খুশি তো?
নীতীশ প্রশ্ন করল,
-তুমি পাশে থাকলে আমি কষ্ট পেতে পারি?
অভিমন্যু অবাক হল। নীতিশ আঙ্কল পাশে থাকলে মা কষ্ট পাবেই না।
-জানি। আমি আছি তো। সৃজা…ওকে পুরনো কথাগুলো ভোলাবার চেষ্টা করতে হবে…আমাদের দুজনকেই। ধৈর্য ধরো।
ওকে…ছাড়ছি তাহলে।
-বাই।
ফোন রাখল সৃজা। ছেলের অবাক হওয়া চোখ দেখে থমকাল একটু।
-কি রে…কি ভাবছিস?
-মা তুমি নীতিশ আঙ্কলকে ভালোবাসো না?
সৃজা নিজের সাড়ে সাত বছরের সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে কি উত্তর দেবে বুঝে পেল না।
-আঙ্কল বাবা হলে তোমাকে কাট দেবে মা…ঠিক জানো?
সৃজা ছেলের নিষ্পাপ মুখে দুটো চুমু খেল।
-আঙ্কল আমার অ…নেক দিনের বন্ধু…আমি ওকে বিশ্বাস করি আশা করি ও ঐ সব বাজে লোকেদের মতো হবে না।
-আঙ্কল পাশে থাকলে তুমি কষ্ট পাবেই না?
-উঁহু,একদম পাবো না। কেন না আমি জানি নীতীশ তোকে আর আমাকে দুজনকেই খুব ভালোবাসে। সেইজন্যই তো আমি চাই ও তোর বাবা হোক। তাহলে আমি অনেক নিশিন্তে থাকতে পারব। জানিস বাবাই আঙ্কলের সাথে তুই যখন মন খুলে হাসিস,মজা করিস,ঘুরতে যাস…তখন আমার মনে হয় সবারই বড় হওয়ার জন্য বাবার খুব দরকার। আমি একা হাতে সব কিছু করতে পারি না যে,তোর যে এত বড় একটা কষ্ট আছে আমি তো জানতেই পারিনি। এই ভয় এই কষ্টটা তোকে মন খুলে বাঁচতে দেয় না…আজ বুঝি আমি। মা’কে খুব ভালোবাসিস…মা’কে নিয়ে তুই খুব পজেসিভ…তুই না চাইলে আমি কাউকে আমাদের জীবনে নিয়ে আসব না। কিন্তু বাবা নিয়ে তোর মনের এই কষ্টটা কাটানো খুব দরকার। সব বাবা খারাপ হয় না সোনা। নীতীশ আঙ্কলও খুব ভালো বাবা হবে…আমি জানি। তুই-ও তো ওর সাথে খুব খুশিই থাকিস। তবে তুই চাইলে তবেই হবে বাবাই…না চাইলে নয়।
-মা…একটা কথা বলি?
সৃজার ছেলের এটা একটা স্বভাব। মা যতই বন্ধু হোক…মা’কে সব কথা বলার আগে অনুমতি নিয়ে তবে বলে,
-বল্…
-নীতীশ আঙ্কল যদি আঙ্কল হয়েই আমাদের সাথে থাকে,হবে না?”
সৃজা হেসে ফেলল,
-উঁহু,আঙ্কল হলে এখন যেমন আছে সেভাবে থাকতে পারবে। তোমার সাথে থাকতে পারবে কি করে?
-আঙ্কল থাকলে ভালো হয়,তাই মা?
সৃজা বোঝাল,
-হ্যাঁ,মা’কে একা হাতে অফিস করা,বাজার করা,বাবাইকে পড়ানো…এত কিছু করতে হয় না। মা’র কষ্টটা কম হয়,মা কাজে বাইরে গেলেও বাবাইএর জন্য সর্বক্ষণের চিন্তাটা থাকে না। বাবাইএর মনটাও ভালো থাকবে,তাই না? তার উপর আঙ্কল বাবা হলে যে গল্পগুলো রোজ শেষ না করেই চলে যেতে হয়…সেগুলোও শেষ হয়,যখন তখন ড্রাইভে যাওয়া যায়। রাতবিরেতে বাইরে বেরোনো যায়…যেটা মা আর ছোট্ট বাবাই পারে না। মা’র শরীর খারাপ করলে বাবাই কত্ত কষ্ট পায়…বাবা থাকলে সেইসময় বাবা বাবাইকে কষ্ট পেতে দেবেই না…ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনবে…বাবাইকে হেল্পলেসের মতো হয়ে থাকতে হাবে না।
অভিমন্যু অবাক চোখে শুনছিল মা’র কথা।
-বাবা থাকলে অতকিছু হয়?
-হয়তো,অভিমন্যু মুখার্জ্জীকে যখন কেউ বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে, বাকি বন্ধুদের বাবাদের মতো অভিমন্যুর বাবা নেই কেন ভেবে কষ্ট হয় না?
-কষ্ট…হবে কেন? জানি তো জানি…আমার বাবা ভালো ছিল না। তাই নেই। আমি সেটাই বালি সবাইকে,বাবা ভালো লোক না তাই মা আলাদা থাকে। আর এতে আমি আর মা ভালো আছি। আর জানো মা…আমার তো বাবার দরকার একটু মনে হয় না…এতদিনে একটাবারের জন্যও তুমি আমাকে বুঝতেই দাওনি বাবা থাকলেও এত কিছু হয়,মা…আমার বাবা থাকলেও এত কিছু হত…কই না তো? সৃজা থমকাল,
-তোর বাবা…মানে…?
-অরিজিৎ মুখার্জ্জী…।
সৃজা বুকের মধ্যেকার কষ্টটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠল,
-বাবাই…ঐ লোকটাকে বাবা বলার কোন প্রয়োজন নেই। ও যোগ্য নয়,বুঝলে?
কঠিন গলায় বলল সৃজা,অভিমন্যুর মুখটা ছোট্ট হয়ে গেল মা রেগে গেছে। মা কি কষ্ট পেয়েছে? বাবাই ঐ লোকটাকে বাবা বলল বলে…অথচ ফাদারস নেমের জায়গায় তো অরিজিৎ মুখার্জ্জীই লিখতে হয়। তখন তো মা কিছু বলে না? লিখলে দোষ নেই,বললেই দোষ? নাকি মা নীতিশ আঙ্কলকে বাবা করতে চায় বলে অন্য কাউকে বাবা বললেও রেগে যাচ্ছে? অভিমন্যু চোখ নামাল। সৃজা বুঝল ছেলে ভয় পেয়েছে। এবার মুখে তালা দিয়ে দেবে। ছেলের মাথায় আদরের হাত রাখল।
-এই পাগল…যে মা’কে এত কষ্ট দেয়…সেকি বাবা বলার যোগ্য? সে যদি থাকত আমাদের সাথে তাহলে আজও কষ্টই দিয়ে যেত। মা আর বাবাইকে খুশি দিতে পারত কি?
অভিমন্যু মাথা নাড়ল। না বাচক।
-তাহলে বাবার নাম লিখি যে…।
সৃজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল
-আর কোন উপায় নেই…তাই।
-মা…আমি বাবার দরকার বুঝি না যে…নীতীশ আঙ্কল বাবা হলে এত্তকিছু ভালো হবে…সত্যি?
সৃজা বুঝল দোষটা ওরই। ছেলেকে একমুহূর্তের জন্যও বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি এতদিন। আর অভাবটা বুঝবেই বা কি করে? বাবা তো ওর কাছে বিভীষিকা ছিল। সে না থাকায় দুঃখিত হওয়া বা কষ্ট পাওয়ার থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার অনুভূতিই তো প্রবলতর হওয়া উচিৎ। বাবার প্রতি কোন ভালোবাসাই যেখানে নেই সেখানে হঠাৎ করে বাবার প্রয়োজনীয়তা ওকে দিয়ে অনুভব করানো হয়তো সম্ভব নয়। মা’র খুশির জন্য বাবাকে প্রয়োজন…এই সত্যিটাও বোঝার বয়স সৃজার ছেলের হয়নি। নীতীশ পারবে বলছে…হি হ্যাজ টাফ ডেইজ অ্যাহেড অফ হিস
-সত্যি সত্যিই হবে
মিষ্টি করে হেসে বলল সৃজা।
-তোমার শরীর খারাপ হলে তো নীতিশ আঙ্কল এমনিই আসে।
-তা আসে। কিন্তু তখন কতদূর থেকে রাতবিরেতে কষ্ট করে আসতে হয়না…আচ্ছা…থাক,ওসব কথা…তুই বাবার দরকার বুঝলে তবেই বাবা আসবে,কেমন?
অভিমন্যু হাসল,
-আচ্ছা,মা…বাবা না এলে তোমার কষ্ট হবে…তাই না?
সৃজা ছেলের হাতে হাতে রাখল,
-তা একটু হবে।
-আমি তো আছি…।
সৃজা বুঝল ইস্যুটা এবার মান-অভিমানের দিকে বাঁক নিচ্ছে। বাবাইএর মা’কে ছাড়া অন্য কাউকে দরকার নেই…তা হলে মা’র বাবাইকে ছাড়া অন্য কাউকে দরকার কেন?
-তুই আছিস,বলেই তো বেঁচে আছি বাবাই। ওখানে অত কষ্টের মধ্যে ছিলাম। তুই আছিস বলেই তো বাঁচার ইচ্ছেটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। তোর ভালোবাসার টান না থাকলে কবে মরেই যেত তোর মা।
সৃজা কাঁদছিল। অভিমন্যু মাকে জড়িয়ে ধরল।
-আমার তোকে ছাড়া আর কাউকে দরকার নেই সোনা।
অভিমন্যু অবাক চোখে মা’র দিকে তাকাল
-সত্যি?
-হ্যাঁ। তোর নীতশ আঙ্কেলকেও না।
-তাহলে আঙ্কেলকে বাবা করতে চাইলে যে?
সৃজা চোখ মুছল,
-আঙ্কল তোর বাবা হতে চায় যে।
-আঙ্কল চায়?
-হুঁ।
-কেন?
-আঙ্কেল তো তোর বেস্ট ফ্রেন্ড,তুই জানিস।
ছেলেকে কথার ভোলাতে চাইল সৃজা।
-সব্বার বাবা আছে,তোর নেই…বলে তোর কষ্ট হয়…এমন কথা আঙ্কলকে বলেছিস হয়তো…।
অভিমন্যু একটু ভাবল,
-কই না তো…।
-তাহলে তোকে খুব ভালোবাসে তাই তোর সাথে সাথে সবসময় থাকতে চায় বলে…।
অভিমন্যুর চোখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল,
-তাই হবে মা। আঙ্কল আমায় খুব ভালোবাসে,বলো?
-তা না হলে কালকের পরেও আজ ফোন করে প্রথমেই তোর কথা জানতে চায়?
অভিমন্যু মার বুকে মুখ গুঁজল।
-হুঁ,আঙ্কল খুব ভালো।
সৃজা প্রসঙ্গ আর বাড়াতে চাইল না। ছেলের মনে অসংখ্য প্রশ্ন জমেছে। সৃজা একা সেসবের উত্তর দিতে পারবে না। মা-বাবার স্বাভাবিক সম্পর্কটাকেই অভিমন্যু বোঝে না। ভাঙা সংসারের ফল হওয়ার জন্য সম্পর্কের কদর্য্যতাকেই চিনতে শিখেছে। সম্পর্কের মাধুর্য্য নয়। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের পক্ষে অভিমন্যুর মানসিকতার জটগুলো ভবিষ্যৎএ অন্তরায় হয়ে উঠবে না তো? পরিবারের স্বাভাবিক উষ্ণতা থেকে বঞ্চিত বিচ্ছিন্ন শৈশব ওকে পরিবার বিমুখ করে তুলবে না তো? নীতীশকে পাশে না পেলে সৃজা ছেলেকে সেই উষ্ণতা দেবে কি করে? আবার নীতীশকে বেশি প্রাধান্য দিলে ছেলের অভিমান ঈর্ষার বদলে যায় যদি? সৃজার সাথে অভিমন্যুর সম্পর্কের যদি কোন অবনতি হয়…যার জন্য সব ছেড়েছে তাকে কি করে কষ্ট দেবে সৃজা…”বাবাই…সোনা আমার…পড়তে হবে যে এবার…”
-হ্যাঁ মা…।
-পড়া তৈরি তো সব…।
-একটু দেখে নেব?
-আচ্ছা…নে,আমি মাসির কাজটা দেখে আসি একটু?
-হ্যাঁ।
ড্রাইভে বেরিয়ে মাকে অ…নেক গল্প শোনাচ্ছিল অভিমন্যু। সৃজা মন দিয়ে শুনছিল। অভিমন্যু মা আর আঙ্কল ছাড়া অন্য কারোর সাথে এরকম ভাবে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে পারে না। ওর সারাদিনের গল্পগুলোকে তাই সৃজা আর নীতীশ দুজনেই খুব মন দিয়ে আর গুরুত্ব সহকারে শোনে,
-মা…।
-বল…।
-একটা জিনিস,চাইব?
সৃজা অবাক হল। ওর ছেলে কোন জিনিস নিজের মুখে চাইছে! কক্ষনো তো চায় না,সৃজা খুব বেশি খুশি হল,
-অফকোর্স।
-একটা ক্যাডবেরী কিনে দেবে?
সৃজা হেসে ফেলল, ছেলের চাওয়াটাও খুব ছোট্ট,
-কেন দেব না? আমার সোনা চাইছে যখন…দিতে তো হবেই।
-আঙ্কল যেটা আনে সেটা কিন্তু…
নীতিশ যেদিনই আসে বাবাইএর জন্য ক্যাডবেরী আনে। নামটা তো সৃজা জানে না।
-ক্যাডবেরীর নামটা জানিস তো?
-হ্যাঁ…ডেয়ারী মিল্ক ফ্রুট অ্যান্ড নাটস্…।
-তুমি জানো না?
-উঁহু,ঘাড় নাড়ল সৃজা। একটা কর্নফেকশনারীর সামনে গাড়ি দাঁড় করাল,
-চল,…কিনে আনি।
গাড়ির দরজাটা খুলতে খুলতে বলল সৃজা।
কর্নফেকশনারীর ভেতরে ঢুকেই চমকে উঠল সৃজা। অরিজিৎ…এখানে…ইস! অরিজিৎ তো এই অঞ্চলেই অফিসে কাজ করত। ছেলের দিকে আড়চোখে তাকাল সৃজা। ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। মা’র হাতটা জোরে চেপে ধরেছে।
-বাবাই…ডোন্ট পে এনি অ্যাটেনশন টু হিম।
চাপা গলায় বলল সৃজা। নিজের মনের মধ্যে তখন উথালপাতাল করছে। পুরনো সব বীভৎস স্মৃতিগুলো ফ্ল্যাশব্যাকের মতো পরপর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এই জঘন্য লোকটা দিনের পর দিন সৃজাকে অত্যাচার করেছে…বাড়ি থেকে পণ আনার জন্য বারবার বাধ্য করেছে…এমনকি প্রায় রাতে ড্রিঙ্ক করে ফিরে সৃজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে ভোগ করেছে। সৃজার সন্তানও এরকম একটা রাতেরই ফল। ভালোবাসার ফল না হলেও নিজের অংশকে উপেক্ষা কখনো করেনি সৃজা। আর করবেও না কখনো,জানুয়ারীর শেষের দিকেও দরদর করে ঘামছে সৃজা। বুকটাও ধড়ফড় করছে যেন। অথচ দুর্বল হওয়া যাবে না। ভয় পেলে চলবে কই করে। এই লোকটার কবল থেকে নিজেকে চিরকালের মতো মুক্ত করে ফেলেছে যখন…তখন ওর সামনে…ছেলের সামনে নিজেকে দুর্বল হতে দেবে না। ছেলের ভয়টাকেও এভাবেই কাটাতে হবে।
-ক্যাডবেরী ডেয়ারি মিল্ক ফ্রুট অ্যান্ড নাটস্ প্লিজ, সৃজা বলল,
-মিডিয়াম ওয়ান ম্যাম?
-নো…ডু ইউ হ্যাভ লার্জ ওয়ান?
-ইয়া…
-গিভ মি দ্যাট…।
সেলস্ম্যান প্যাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
-সৃজা…
চমকে উঠল সৃজা। নিজের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল বুঝতে পারল বেশ।
অরিজিৎ…
-বাবাই…এত্ত বড় হয়ে গেছে?
সৃজা নিরুত্তর থাকল,
-বাবাই…চিনতে পারছিস? পারবিই বা কি করে…শেষ দেখেছিল হয়তো চার বছর আগে।
অরিজিৎ হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল,
-আয়…
অভিমন্যু মা’কে জড়িয়ে ধরল। অরিজিৎ সৃজাকে অবাক করে দিয়ে চোখ মুছল,
-ভয় পাচ্ছে…না?
স্বগতোক্তির মত শোনাল কথাটা।
-সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
সৃজা কঠিন হল।
-তাই তো। বাপ হয়ে নিজের ছেলেকে কষ্ট ছাড়া আর কি-ই বা দিতে পেরেছি?
অরিজিৎ এর স্বীকারোক্তিতে মা আর ছেলে দুজনেই সোজা হয়ে দাঁড়াল।
-সৃজা…তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার অধিকারটুকুও হয়তো হারিয়ে ফেলেছি…তবুও আই অ্যাম সরি ফর এভরিথং।
-তোমার অপরাধের কোন ক্ষমা হয় না অরিজিৎ। প্লিজ ডোন্ট ক্রিয়েট আ সিন্ হিয়ার। বাবাই আর জীবনে তোমার কোন অস্তিত্ব নেই। তাই তোমার ক্ষমা চাওয়া,না চাওয়ায় কোন কিছুই যায় বা আসে না আমার।
অরিজিৎ মাথা নীচু করল,
-জানি,যাদের প্ররোচনায় তোমার সাথে দিনের পর দিন অন্যায় করেছি সেই দুজনের কেউই আজ বেঁচে নেই। নিজের স্ত্রী নিজের সন্তান থেকেও আজ আমি একদম একা। প্রতিটা দিন ফাঁকা ঘরে একা বসে নিজের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করছি। হয়তো আমার এটাই প্রাপ্য। তোমার সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছা করত…তোমার অফিসের ঠিকানা…বাড়ির ঠিকানা…ফোন নাম্বার সব জোগাড় করেছি। সাহস করে উঠতে পারিনি। আজ যখন দেখা হয়েই গেল…আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও সৃজা। ক্ষমার যোগ্য হওয়ার জন্য যদি আমাকে কিছু করতে হয়…আমি রাজি। এই অন্যায়ের বোঝা নিয়ে আমি আর বাঁচতে পারছি না।
-ম্যাডাম…হিয়ার ইজ ইওর প্যাকেট…
বিলটা মেটাল সৃজা।
-অভিনয়টা ভালোই শিখেছ দেখছি। এটা নতুন আমার কাছে।
অরিজিৎ অবাক চোখে তাকাল।
-আমি অভিনয় করছি না সৃজা। তোমার কাছে আমার অন্য কোন চাওয়া পাওয়া নেই। শুধু ক্ষমাটুকু চাই। যাতে অন্তত শান্তিতে মরতে পারি।
অরিজিৎএর কথাগুলোকে বড্ড অচেনা মনে হল সৃজার। এই মানুষটার মুখে এইরকম কথা কখনো শোনেনি ও। একটু থমকাল সৃজা। সত্যিই কি বদলেছে অরিজিৎ? নাকি এটা নতুন কোন চাল? অরিজিৎএর চোখের দিকে তাকাল সৃজা। সত্যিই চোখদুটো লাল হয়ে আছে। অনুতপ্ত কি ও? সৃজার মন তা বিশ্বাস করতে চাইছে না।
-বাবাই চলো। সৃজা বলল,
-সৃজা…এক সেকেন্ড…। অরিজিৎ বলল,
-আমার কার্ডটা রাখো,ফোন নাম্বারটা বদলেছি। যদি কখনো মনে কর ক্ষমা করতে পেরেছ এই নাম্বারে ফোন করে দিও।
কার্ডটা বাড়িয়ে দিল অরিজিৎ। সৃজা কার্ডটা ফেরাতে পারল না।
-অভিমন্যু মুখার্জ্জী…ইউ আর আ গ্রোন আপ বয় নাও। টেক কেয়ার অফ ইওর মা। ভয় পেও না…আমি তোমার মা’কে আর কখনো কষ্ট দেব না। আই প্রমিস্ ইউ দ্যাট। তোমাকেও কখনো তোমার বাবার জন্য কষ্ট পেতে হবে না। সৃজা চলি…ট্রেনের সময় হয়ে এল। বাবাই চলি…।
যেতে উদ্যত হল অরিজিৎ। কি ভেবে থমকাল আবার,
-সৃজা…তুমি জীবনে সঠিক রাস্তাটা বেছে নিয়েছিলে সেদিন। আমি তোমার জন্য খুব খুশি। কোন রাগ,ক্ষোভ,মান-অভিমান নেই আমার। আমি তোমার যোগ্যই ছিলাম না। অথচ আমার একটা জিনিস তোমাকে আমার সাথে সবসময় জুড়ে রাখবে। বাবাইএর বাবা আমি। দেখো ও যেন মানুষ হয়। পড়াশোনায় ভালো হয়েছে খুব…শুনেছিলাম একবার…।
-কে বলেছিল? সৃজা অবাক হল,
-তোমার ভাই কাকে একটা বলছিল যেন…আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম…খুব গর্ববোধ হয়েছিল সেদিন। আমার ছেলে পড়াশোনাকে আমার মতোই হয়েছে…শুনলে কারই না ভালো লাগে…।
-তোমার ছেলে নয় অরিজিৎ। তুমি ভুল করছ।
অরিজিৎ হাসল,
-আচ্ছা…তাই হল,আমাদের ছেলে…আমার গর্বটা যেন বজায় থাকে। মন দিয়ে পড়বে। চলি রে। অরিজিৎ চলে গেল, সৃজা ছেলের দিকে তাকাল,আর অবাক হল সাথে সাথেই। ছেলেটা কাঁদছে যে…তড়িঘড়ি ছেলেকে কোলে নিয়ে গাড়িতে তুলল সৃজা। নিজেও বসল।
-বাবাই…ভয় পেয়ো না। ইওর মা ইজ স্ট্রং এনাফ টু ফেস্ হিম। অরিজিৎ আর কিছু করবে না।
-মা…
-হ্যাঁ বাবা?
-আমাদের সব ঠিকানা যে জানে…।
চমকে উঠল সৃজা।
-তুমি না থাকার সময় যদি আসে…।
সৃজা ছেলেকে জড়িয়ে ধরল, “ভয় পেয়ো না। আসবে না। বলল শুনলে না?”
-যদি…
-আচ্ছা…যদি নিয়ে ভাবলে চলে? বাড়ি চলো এবার।
##
রাতে বাবাইএর জ্বর এল। ভয়েই জ্বরটা এসেছে। সৃজার নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল। জ্বর মাপল এক্ষুনি। একশো দুই। রাত এগারোটা বাজে। ডাক্তার ডাকবে…এত রাতে…জ্বরের ওষুধ দিল সৃজা। ছেলে একটুক্ষণ আগেও উল্টোপাল্টা কথা বলছিল,
“মা…আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো…” বা “মা তুমিও পালাও…বাবা আসছে” অভিমন্যুর আয়া অনেকদিনের পুরোনো। বাবাইএর এমন অবস্থা দেখে তারও হাত পা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সৃজা জলপটি দিয়ে দিয়ে জ্বরটা কমিয়েছে একটু। এত ভয় পায় বাবাই? তাহলে সৃজা যদি ঐ বাড়ি ছেড়ে না আসত ছেলে তো এতদিনে বাঁচতই না। ছেলের পাশে আধশোয়া হল সৃজা। ফোনটা ভাইব্রেট করল। নীতীশ…
-হ্যালো…।
-সৃজা…এনিথিং রং?
-হুঁ,ছেলের খুব জ্বর।
-গলা শুনেই বুঝেছি। কত?
-একশো দুই ছিল আধঘণ্টা আগে। ওষুধ আর জলপটিতে কমেছে এখন
-জ্বর এল কি করে…ঠাণ্ডা লাগিয়েছে নাকি?
-নাঃ…,ভয়ে জ্বর এসেছে।
-ভয়ে?
নীতিশ অবাক হল।
-মানে?
-অরিজিৎএর সাথে দেখা হয়েছিল আজ।
-হোয়াট?
বিকালের ঘটনাটা বলল সৃজা,
-এতটা ভয় পায়…ও। মাই গড…।
-জানো…বাবার দরকার ঐ জন্যই বোঝে না ও। বাবা শব্দটাই এত ভয়ালো যে…।
-ভয়টাকে কাটাতেই হবে সৃজা।
-জানি,তবে ভয় হয় ছেলে আমাকে যদি ভুল বোঝে…যদি ভাবে ও থাকতেও মা’র অন্য কাউকে দরকার কেন? নীতীশ হাসল,
-দরকারটা ওর সৃজা। ওর মায়ের যতটা না দরকার তার থেকে অনেক বেশি করে হি নিডস,হিজ ড্যাডি। উল্টোপাল্টা বকছে না তো আর?
-না…।
-আমি কালকে ফিরছি।
সৃজা অবাক হল,
-কাজ?
-কাজ অনেক করেছি। মাই সন নিডস্ মি নাও…।
-যা ভালো বোঝো…।
-তুমি ঠিক আছো তো?
-হুঁ।
-বি ব্রেভ বেবি। আমি আসছি।
ফোন রেখে দিল সৃজা। ছেলের গায়ে হাত রাখল,জ্বরটা কম এখন।
-মা…। অস্ফুটে বলল অভিমন্যু।
-হুঁ।
-খাবো…।
এটা ছেলের জ্বরের বায়না। জানে সৃজা। ছোট্ট থেকেই যে ক’বার জ্বর হয়েছে অভিমন্যুর ওটা চাই। সৃজা আপত্তি করল না আজ। ব্লাউজের হুকগুলো খুলল,
-নে…
অভিমন্যু মা’কে জড়িয়ে ধরল। সৃজার মমতা সৃজাকে বাধ্য করল ছেলেকে আরো আদর করতে,বাবাইএর আঘ্রাণ নিল সৃজা। একেবারেই সৃজার মতো গন্ধ ওর গায়ের। অরিজিৎএর মন ভালো থাকলে ছেলের গায়ের গন্ধ মনপ্রাণ ভরে নিত। ছেলেকে খুবই ভালবাসত ও। সৃজা ছেলের অযত্ন করেছে…এটা ছিল অরিজিৎএর মায়ের নালিশের বড় জায়গা। ছেলের অযত্নে বড্ড রেগে যেত অরিজিৎ,ছেলের জ্বর এলে পাগল হয়ে যেত। অভিমন্যু সারারাত মা’কে ছাড়ত না। অরিজিৎও সারারাত জেগে ছেলেকে কখনো আদর করত…কখনো জলপটি করত…দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৃজা। অরিজিৎ যদি এটা জানে যে ওর ভয়েই ওর ছেলের জ্বর এসেছে? কি করবে ও?
-বাবাই…জ্বর কমে গেছে তো…এবার ছাড়…মা শোবে একটু।
ছেলের কানে কানে বলল সৃজা,অভিমন্যু ছেড়ে দিল। ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নিল সৃজা। ছেলেকে ঐ ভয় ঐসব কষ্টের হাত থেকে আজও বার করে আনতে পারেনি ও। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৃজা। চোখ বুজল। ঘুমিয়ে পড়ল সাথে সাথেই।
সকালে চোখ খুলেই অবাক হয়ে গেল অভিমন্যু।
-আঙ্কল…তুমি…
নীতিশ অভিমন্যুর কপালে স্নেহভরা হাত রাখল।
-শরীর কেমন…বাবাই?
-ভালো।
-ভালো? কাল রাতেই একশো দুই জ্বর…মায়ের কাঁদোকাঁদো অবস্থা…আর সকালে চোখ খুলেই শরীর ভালো?
অভিমন্যু লজ্জা পেল,
-মা কোথায়?
-মা ও ঘরে আছে। সারারাত জেগেছিল। আমি এসেই তাই অন্য ঘরে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিছুতেই যাচ্ছিল না। আমি বললাম আমি তো আছি…।
অভিমন্যু অবাক হল। মা তাহলে ঠিকই বলেছিল। আঙ্কল এখানে থাকলে ওর মা’র ধকল অ…নেক কমে যাবে।
-তুমি কাজে গেছিলে যে?
নীতিশ আঙ্কল অভিমন্যুকে আদর করল,
-হুঁ। কিন্তু যেই শুনলাম বাবাইএর শরীর খারাপ…চলে এলাম। কাজ তো বাবাইএর থেকে ইম্পরট্যান্ট নয়…তাই না?
অভিমন্যু অবাক চোখে তাকাল,
-এত্ত ভালোবাসো?
-কেন…মনে হয় বাসি না?
-আমার সাথে এইজন্যই সবসময় থাকতে চাও?
অভিমন্যুর কথায় মিষ্টি করে হাসল নীতীশ।
-হুঁ। সেইজন্যই তো। নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডকে ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না। অভিমন্যু উঠে বসতে গেল। নীতিশ ওকে থামিয়ে দিল। নিজে ওর লেপের মধ্যে ঢুকে ওকে কোলে বসিয়ে নিল। -আচ্ছা…তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বলে এখানে থাকতে পারো না?
নীতিশ অভিমন্যুর কথার মানেটা বুঝতে পারল,
-তাহলে তো ভালোই হতো। কিন্তু তার তো উপায় নেই।
অভিমন্যু চুপ করে থাকল।
-কি ভাবছিস?
-কিছু না।
-ভয় করছে না তো আর…?
নীতিশ নিজের দুহাতের মধ্যে বাবাইকে জড়িয়ে ধরে বলল।
-তুমি জানো?
-হুঁ…জানি। মা বলেছে।
-মা ভয় পেতে মানা করেছিল। তাও…শুধু মনে হচ্ছিল যদি এখানেও চলে আসে। মা না থাকলে আমাকে,কি আমি না থাকলে মা’কে কষ্ট দেয়। আর মাকে কষ্ট দিলে আমি কি করে ঠেকাব? আমি তো ছোট্ট।
নীতীশ অভিমন্যুকে থামিয়ে দিল।
-কেউ আসতে পারবে না। আমি আছি তো। কেউ এলেও আমার বাবাইকে আর বাবাইএর মা’কে আমি প্রটেক্ট করব…।
-সত্যি?
-প্রমিস। নাও মাই সন হ্যাজ টু মেক আ প্রমিস…।
-কি?
-আর একদম ঐ লোকটার কথা ভাববে না,ভয় পাবেনা। কি?
অভিমন্যু ঘাড় নাড়ল,
-আচ্ছা।
-বড় হয়ে গেছ তো এখন। আর বয়েজ ডোন্ট ফাস,টু মাচ।
-ছেলেদের ভয় পেতে নেই?
একদম না। আমার মতো স্ট্রং হতে হয়। আর আমার বাবাই তো আমারই মত।
অভিমন্যু হাসল,
-হুঁ। বড় হয়ে আমি তোমার মতো হবো।
নীতীশ খুশি হল খুব।
-বাঃ বেশ।
-কাল বেড়াতে গিয়ে তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল।
-মিসড্ মি?
-হুঁ।
-আই আলসো মিসড্ ইউ।
-আঙ্কল একটা কথা বলি?
-হ্যাঁ সোনা…বল।
-তুমি শুধু আমাকেই ভালোবাসো…মা’কে ভালোবাসো না?
নীতিশ থমকাল,
-মাকেও বাসি,তবে বাবাইকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
অভিমন্যুর চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নীতিশ শান্তি পেল, “তোকে এত ভালোবাসি যে বাবা হয়ে তোকে সারাজীবন পাশে থেকে ভালবাসতে চাই।
অভিমন্যু থমকাল,
-বাবারা সবাই ভালোই হয়…না?
-তোর তো সব ফ্রেন্ডের বাবা আছে। তারা খারাপ? আর তুই তো আমাকে চিনিস। আমি তোকে এখনই এত ভালোবাসি…বাবা হলে কত বাসব?
-তুমি বাবা হলে মা’র কষ্ট কমে যাবে…না?
-হুঁ…কমবে। বাবাইএর জন্য সব চিন্তা একা করতে হবে না। দুজনে মিলে করব যে।
-তোমার বাবা কেমন ছিল?
নীতীশ থমকাল,
-কেন?
-এমনি।
নীতীশ দম নিল। সত্যিটা বাবাইকে বলা যাবে না। ও বড্ড ছোট। মিথ্যাই বা…
-আমার বাবা…ভালোই ছিল।
-তোমার মা?
-মা-ও ভালো ছিল।
-ওরা আমার মা’কে কষ্ট দেবে না তো? ওরা যদি আমার ঠাম্মা দাদু হয়…।
নীতীশ হেসে ফেলল এবার।
-হাসছ?
-ওরা কষ্ট দেবে কি করে? ওরা যে অ…নেকদিন আগেই ভগবানের কাছে চলে গেছে।
-ও…তাহলে আর কেউ মা’কে দাদুর বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলবে না।
নীতীশ শিউরে উঠল। পণের জন্য চাপাচাপি করার কথাটাও ছেলেটা জানে?
-না…বাবাই,তোমার মা এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী,স্বাধীন মহিলা। শি ইজ ইন্ডিপেন্ডেন্ট। তাকে কেউ চাইলেও ওরকম করতে পারবে না। এইজন্যই মেয়েদের লেখাপড়া আর নিজের পায়ে দাঁড়ানো খুব দরকার।
অভিমন্যু বুঝল,
-আঙ্কল…তুমি ড্রিঙ্ক করো রাত্রে?
নীতিশ এবার বুঝল ওর ইন্টারভিউ চলছে,
-উহুঁ।
-বাবাই…।
সৃজার গলা পেয়ে দুজনেই তাকাল।
-মা…মর্নিং…
-মর্নিং…নীতীশ জ্বরটা…?
-নেই। আমার ছেলে একদম ঠিক আছে। দিব্যি গল্প করছে।
অভিমন্যু থমকাল। বাবা কাল বলছিল আমার ছেলে। আজ আঙ্কলও…
-তোমার ছেলে তোমার কাছে আছে…তাই তো নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারলাম।
মা বাবাইকে আঙ্কলের ছেলে বলল। অথচ বাবাকে…তাহলে মা মনে মনে আঙ্কলকে বাবাইএর বাবা করেই ফেলেছে।
-রাতে একটুক্ষণের জন্যও মা’কে ছাড়েনি” নীতিশ অবাক হল…
-ছাড়েনি…মানে…ঘুমচ্ছিল না?
সৃজা ছেলেকে আদর করল,
-জ্বর হলেই বাবাই…
মা বলে দিচ্ছে যে…আঙ্কল কি ভাববে…
-মা বলো না…।
নীতীশ মা আর ছেলের কথা শুনে বুঝল বিষয়টা কি,
-তাই বাবাই? এত্ত বড় ছেলে…।
-মা! বলে দিলে!
-রাগ করছিস কেন? আমাকে তো সব জানতেই হবে। তোর বাবা ছাড়া এসব আর কে জানবে?
-ইস্ তুমি জানবে কি করে? আমি আর মা তো এই ঘরে থাকব…।
নীতীশ হেসে ফেলল,
-বাবা ঐ ঘরে থাকবে। এটাই যদি তোর শর্ত হয় তাও আমি রাজি।
নীতিশ সৃজার দিকে তাকিয়ে বলল।
-আমি ওসব বলেছি নাকি?
-এই তো বললি মা আর তুই এখানে থাকবি। তার মানে আমাকে অন্য ঘরে থাকতে দিতে তোর আপত্তি নেই।
-ঐ ঘরে কেন থাকবে? এই ঘরে আমার পাশে না থাকলে প্রটেক্ট করবে কি করে?
সৃজা আর নীতীশ দুজনেই চমকে উঠল।
-তার জন্য যে বাবা হতেই হবে বাবাই…।
অভিমন্যু নীতীশকে জড়িয়ে ধরল
-হবে
নীতিশ ছেলের মুখটা তুলে ধরল
-সত্যি?
-হুঁ।
নীতীশ অনেক করে আদর করল। অভিমন্যু চোখ মুছল তারপর। সৃজা নীতিশের হাত ধরল। মৃদু চাপ দিল।
-এত্ত খুশি?
-পরশু রাত থেকে একটুও ঘুমোতে পারিনি সৃজা। বাবাইকে ঐসব ভয়গুলো আর কষ্টগুলো থেকে মুক্তি দেবই আমি…দেখো…নিজে জীবনে যা পাইনি ওকে দেব সৃজা,আমার বাবা-মা সম্পর্কে আমি তোমাকে কখনো কিছু বলিনি। আজ বলতে হবে আমাকে। আমার বাবা একজন ড্রাঙ্কার্ডছিলেন। হি কিলড্ মাই মম্। এন্ড ওয়াজ কনভিক্টেড ফর লাইফ ইম্প্রিজনমেন্ট। ঐ খুনের মুখ্য সাক্ষী ছিলাম আমি।
-নীতীশ!
সৃজার লোম খাঁড়া হয়ে গিয়েছিল।
-ইয়া। নিজের চোখের সামনে আমার মা’কে মরতে দেখেছি আমি। ঐ ফ্ল্যাশব্যাকস্গুলো অনেক বড় পর্যন্ত হন্ট করেছে আমায়। চাপা একটা কষ্ট কুরেকুরে খায় আমাকে। কাউকে বলতে পর্যন্ত পারি না। বছর আটেক বয়স তখন আমার। মা’কে বাঁচাতে না পারার গ্লানি আমাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। বাবাইকে,তোমাকে ভালোবেসে ঘর বাঁধব ঠিক করলাম…তোমার মধ্যেও যেন আমার মা’কে খুঁজে পেতাম আমি। মা-ও বড্ড পালাতে চাইত…আলাদা হয়ে বাঁচতে চাইত। কিন্তু আমার মা যে তোমার মতো শিক্ষিত ছিল না। মা যা পারেনি তা তুমি পেরেছ। ভেবে সম্মান করতাম তোমাকে। অথচ বাবাইএর মুখ থেকে যখন ঐ অত্যাচারের কথাগুলো শুনলাম আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তখন থেকেই আমার কাছে তোমাদের জীবনে শামিল হওয়াটা আরো জরুরী হয়ে গেল। সৃজা…আমাকে সব জেনে খুনীর ছেলে ভেবে দূরে সরিয়ে দেবে না তো? আমি যে তোমাদের ছাড়া বাঁচব না। বাবাইকে আমার সবটুকু ভালোবাসা দেব আমি…।
নীতীশ দরদর করে ঘামছিল,অভিমন্যু আর সৃজা বাক্যহীন হয়ে গিয়েছিল।
-আমার অতীতের ভারমুক্ত আমি। এবার তোমার যা বলবে…।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীতীশ,
-তবে একটা প্রমিস্ করতে পারি…তোমার আর আমাদের ছেলের কোন ক্ষতি হতে দেব না। বাবার ভালোবাসা না পেয়ে বড় হওয়াটা বড্ড কঠিন। আমি করেছি কষ্টটা…ওকে করতে দেব না
অভিমন্যু মা’র দিকে তাকাল। সৃজার ধুকপুকানি বেড়ে গেল। বাবাই কি বলবে কে জানে?
-মা একটা কথা বলব? সৃজা দমবন্ধ করল,
-বল্…?
-বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি বাবাকে বলো আর যেন না কষ্ট পায়। আমরা দুজনেই আছি তো…।
নীতীশ অভিমন্যুকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
-সৃজা…?
-হুঁ…
-বিশ্বাস করবে তো?
-আই ট্রাস্ট ইউ মোর দ্যান মাইসেল্ফ। তোমার অতীত নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই আমার। আমি জানি ইউ উইল বি আ গুড ফাদার অ্যান্ড হাজব্যন্ড। কারণ ইউ আর দ্যা বেস্ট সন্। তোমার মা’কে তুমি খুব ভালবাসো নীতীশ। এমনকিছু কখনোই করবে না যাতে উনি কষ্ট পান।
-মা…।
নীতীশ আর সৃজা দুজনেই তাকাল, “কি রে?”
-ফাদারস্ নেমটা এবার থেকে নীতীশ চ্যাটার্জ্জী লেখা যাবে তো?
নীতীশ আর সৃজা দুজনেই হেসে ফেলল,
-আলবাৎ যাবে। তাই না সৃজা? কালকে রেজিস্ট্রির নোটিশটা দিয়ে দিই?
-আচ্ছা।
-তোমার বাবা মা’কে জানাবে না?
-জানাব,আজকেই ফোন করব। আর একটা ফোনও করব…অরিজিৎকে…।
নীতীশ চমকাল,
-কেন?
-ওকে ক্ষমা করে দিতে চাই আমি।
-ক্ষমা! সৃজা…।
-ও অনুতপ্ত নীতীশ। একাকীত্বের যন্ত্রণা ভোগ করছে প্রতিটা মুহূর্তে। ওকে ক্ষমা করে আমার মনের বোঝাটা আমি নামিয়ে দিতে চাই। ওর শাস্তি ও পেয়েই গেছে…তাই না?
-যা ভালো বোঝ…।
-একটা কথা বলি?
-ছেলের মত করলে যে। বলো…।
-তোমার বাবাকে ক্ষমা করে দাও নীতিশ!
-মানে?
-উনি সাজা পেয়েছেন তো। তুমি এখনও ওনাকে ঘৃণা করে যে কষ্ট পেয়ে চলেছ তাতে তোমার মায়ের আত্মার শাস্তি হচ্ছে কি?
নীতীশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
-হয়তো তুমিই ঠিক সৃজা।
-হয়তো না…এটাই ঠিক। নতুন করে শুরু করি না…সবাই মিলে…আর একবার…” নীতিশ ঘাড় নাড়ল। ও করবে।
-বাবা…
-হ্যাঁ বাবা?
-আজ বেড়াতে নিয়ে যাবে তো?
সৃজা অবাক হল,
-জ্বর নেমেছে একটুক্ষণ হল…এর মধ্যে বেড়ানো!
-আর তো জ্বর আসবেই না। বাবা আছে তো। জ্বর আমাকে ছুঁতেই পারবে না
নীতিশ ছেলের মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিল,
-সৃজা…ছেলে আজ নিজে থেকে বেড়াতে যেতে চাইছে,দেখেছ?
-তোমাদের বাপ-ছেলের ব্যাপার। তোমরা বোঝ।
-মা তুমি যাবে তো…?
-মা যাবেই তো। সৃজা…যাবে তো?
নীতিশের হাত ধরল সৃজা,
-তুমি যেখানে বলবে সেখানেই যাবো নীতিশ।
অভিমন্যু মা’কে এত খুশি কখনো দেখেনি,
-বাবা…আমি তোমায় খুব ভালোবাসি।
-জানি তো,তোর বাবাও তোকে খুব ভালোবাসে।
নীতিশ ছেলেকে চুমু খেয়ে বলল,সৃজা চোখ বুজল। স্বপ্নটা যেন কখনো না ভাঙে।

BMOH,Santipur,Diabetician,Chief editor,Domka Hawa,writer,social activitist