| 7 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১০) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

দ্যাট ইজ দাতসি!  


“আচ্ছা মা? ঠাম্মা একটা কুচো চিংড়ির কী যেন রাঁধত? দাদু খেতে খেতে বলত, এটা আর খাবো না। বালিশের পাশে নিয়ে শোবো। খেলেই তো ফুরিয়ে যাবে” হঠাত রাতে মা’কে তলব মিঠির।
“বাটি চচ্চড়ি”। তাই বলে এত রাত্তিরে ঘুম ভাঙালি আমার? জানিস তো আমি ঘুমের ওষুধ খাই রোজ। স্যরি মা। ভুলে যাই। কাল সকালে ফোন করব। নামটা মনে আসছিল না কিছুতেই । পেটে আসছিল, মুখে আসছিল না। মায়ের ফোন রেখেই রাণীয়া কে তলব তার।মিঠি অফিস থেকে ফিরে আজকাল রান্নাঘরে টুকটাক কিছু না কিছু বানায়। রান্না তার কাছে এখন স্ট্রেস বাস্টার। ডেটা সায়েন্টিস্ট সে। অফিসের কাজে মাথাটা মাঝেমাঝে জ্যাম হয়ে যায়। সেইজন্য মাঝেমধ্যেই এখন টুকটাক রান্না তাকে বেশ রিলিফ দিচ্ছে। বাড়ির কাউকে অবিশ্যি এসব কথা লজ্জায় বলেনি মিঠি। সবাই হাসবে, আওয়াজ দেবে। টুনাফিশ ক্রোকে তার এই উত্তরণের মূলে। তারপরে আবার ইউটিউব দেখে চিলি গার্লিক নুডলস, প্রণ বালচাও বানিয়ে তাক লাগিয়েছে সে শৈবাল কে। এমন কী আপিসের লাঞ্চে শৈবাল মহাখুশি এখন মাঝেমধ্যেই বউয়ের হাতের চিকেন মেয়ো স্যান্ডুইচ খেয়ে। প্রথমদিন শুধুই সেদ্ধ চিকেন, মেয়োনিজ, টম্যাটো কেচাপ আর গোল মরিচ গুঁড়ো দিয়ে বানিয়েছিল। শৈবালের মুখে পরিতৃপ্তি দেখে পরের বারে সেই চিকেনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সুইট কর্ণ সেদ্ধ। তিন রঙা বেল পেপার কুচি। কখন এসব করো সুইট হার্ট? গর্বের সঙ্গে শৈবাল বলেছিল মিঠি কে। মিঠি একগাল হেসে  উত্তর দিয়েছিল, কেন? কিছু করব মনে করলেই করা যায়। আমি ভাবলাম ইম্প্রোভাইজ করি একটু। দুজনের লাঞ্চ প্যাক হয়ে যায়।

শৈবাল বলেছিল, আমার আধা ঘরোয়ালী গিন্নী রাণীয়ার ছোঁয়া লেগে আমারি আখেরে  ভালো হল তবে। ফোন করেছিল তক্ষুনি একমাত্র শালী কে।
রাণীয়া বলল, আরে নাহ! কী বলছ তুমি শৈবাল দা? দিস ইজ আমেজিং। দিদি রান্নাঘরে ঢুকছে? মাসীমা, আই মিন তোমার মা’কে জানালে?
শৈবাল বলল, না বাপু। তারপরে যদি কলকাতায় গিয়ে মায়ের হেঁশেলে না ঢোকে তখন আমার চাপ হয়ে যাবে।
বাই দ্যা ওয়ে, যে জন্য ফোন করা সেটায় আসি এবার। সেইবার আমরা ভুটানে বেড়াতে গিয়ে মাশরুমের কী একটা খেয়েছিলাম চিজ দিয়ে? নাম টা মনে আছে তোমার? শৈবাল বলে শালী কে।
সো ফার আই রিমেম্বার দিস ইজ সাম কাইন্ড অফ  “দাতসি” রাণীয়া বলল।
ইয়েস! আই রিকালেক্ট । সামু দাতসি। শৈবাল বলে উঠল। সামু, এমা আর কেয়া দাতসি। তাই না? ঠিক বললাম তো?
কেন খেতে ইচ্ছে করছে বুঝি? এখন তো তোমার ঘরেই মাস্টার শেফ। তাকে অর্ডার করে দাও। বানিয়ে ফেলবে ঠিক। হাতের মুঠোয় গুগল আঙ্কল আর তার ইউটিউব তো আছেই। বাই দ্যা ওয়ে ওটা কেয়া নয় কেওয়া ডাটসি। রাণীয়া হাসতে হাসতে বলে ওঠে জামাইবাবু কে।
শৈবাল কখনও কিছু খেতে চায়না মিঠির কাছে। আবদার করতেও ভয় পেয়ে এসেছে চিরকাল। পাছে বউ আবার তাকে পুরুষতান্ত্রিকতার খোঁচা দেয়। মিঠি অবিশ্যি তেমন করে না ভাবলেও বিদ্রোহ ঘোষণা করার মতোই মেয়ে । হেঁশেল তার বাঘ ছিল যে এদ্দিন ।

কিন্তু আজকাল মিঠির এক একসময় মনে হয় বৈকি। বিশেষ করে একলা থাকলেই ভাবতে বসে… সে কী ঠিক করছে এটা? মানে রান্নাঘরে না ঢুকে? না কী কেনা সব খাবার খেয়ে খেয়ে সে বোরড?


আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-৯) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


আচ্ছা! জামশেদপুরে তাদের বাবা তো তাদের মায়ের কাছে অফিস যাওয়ার আগে বলত, আজ এটা রাঁধো। কাল সেটার বাজার করে আনবো বা আজ এই ডাল টা করো । এসে লাঞ্চে খাবো বা ডিনারে সেই চিকেনটা জমিয়ে রেঁধো। দুটো রুটি বেশী কোরো। কিন্তু শৈবাল কখনও মুখফুটে কিচ্ছুটি বলে না। তার কোনও অনুরোধ, আবদার কিছুই নেই একমাত্র বউয়ের কাছে। সেটা ভেবে নিজের ওপর খুব রাগ হল মিঠির সেই মুহূর্তে। তবে কী এটা শৈবালের বউয়ের প্রতি প্রচ্ছন্ন অভিমান? পাছে সে আবারও শৈবাল কে এপিটোম অফ পেট্রিআর্কি বলে দেগে দেয়! ছিঃ ছিঃ ! এ কী করছে সে শৈবালের সঙ্গে? সেই ভেবেই তার এখন নিয়মিত হেঁশেল অভিযান হচ্ছে না তো? মনে মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল বুঝি মিঠির। না কী রাণীয়া তার রান্নাবান্না নিয়ে গড়গড় করে এত এগিয়ে যাচ্ছে সেটাও একটা প্রচ্ছন্ন কারণ? আবার এই মেয়েরই একসময় কলকাতার শাশুড়িমায়ের কথা ভেবে জেদ চেপে যাচ্ছিল রান্নার বিষয়ে। সে কী তবে ভুল করছিল এদ্দিন?  

মিঠি এইসব দোনামোনায় পড়েছে আজকাল। সারাদিন অফিস মিটিং, প্রজেক্ট সাবমিশন, ক্লায়েন্ট কল এসবের চক্কোরে দম বন্ধ হয়ে আসা কর্পোরেট জীবন। শৈবালেরও একই দশা। মনে মনে ভাবে সে। সেইজন্যই কী তার বোন রাণীয়া সেদেশে সব ভুলে থাকে রান্নাঘর নিয়ে? আগেকার দিনে মেয়েরাও ঘরবন্দী থেকে সব ইনোভেটিভ রান্নাবান্না করে তাক লাগিয়ে দিত? শুধু ভালো থাকার জন্যই? অফিস কলিগরাও তাইজন্যই কী নিত্য নতুন আইটেম বানিয়ে অফিসে নিয়ে আসে? সবাই মিলে শেয়ার করে খাওয়াদাওয়া করে হইচই করে। সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে কেমন যেন আড়ষ্ট, অপাংক্তেয় মনে হয় তার। বিজাতীয় স্পিসিস এর মত।

তার মাঝেই  কেন যে মাঝেমধ্যেই উঁকি দেয় ঠাম্মার হাতের অমৃতসম চিংড়ির বাটিচচ্চড়ির স্বাদ অথবা মায়ের হাতের গোটাসেদ্ধ। মা বা বোন কে ফোন করে এসব আলোচনা করতে ইতস্তত করে মিঠি। ওরা আবার হাসবে। মা বলে বসবে সেই ঠাম্মার কথাগুলো…

“কালে কালে কতই হল, পুলিপিঠের ন্যাজ গজালো”

প্রতিবার মকরসংক্রান্তির দিনে ঠাম্মা আর মা পুলিপিঠে বানাতো। ওদের ঠাম্মা পান খেতে খেতে সারা ঘরময় সুগন্ধি জর্দার গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে বলতেন এই গল্প টা।
ভাবতে ভাবতেই  মা’কে ফোন করেই ফেলে মিঠি। মা, ঠাম্মার সেই পুলিপিঠে বানানোর গল্পটা কী যেন?
মা ভাবেন, এ আবার কী? তাঁর বড় মেয়ের মতিগতি বদলে গেছে তবে? রাতবিরেতে তার কোনদিন বাটিচচ্চড়ি তো কোনদিন পুলিপিঠের কথা মনে পড়ছে এখন। এই নিয়ে সে মেয়েকে আবার কিছু বললে চলবে না। অসম্ভব মুডি এই ধন্যি মেয়ে। দড়াম করে ফোন রেখেই দেবে হয়ত রাগ করে। বড় চাকুরে মেয়ে বলে কথা! অন্যকথায় না গিয়ে মা বললেন,
পুলিপিঠে বানাতে বসে তোদের ঠাম্মা বলতেন তো। সে এক ভয়ানক রিভেঞ্জ নেবার মজার গল্প।  
এক দজ্জাল শাশুড়ি তার নিরীহ বৌমাটিকে অত্যাচার করত। দাপুটে শীতে গাদা গাদা পিঠে বানাতেই হত। একদিকে সংসারের সমস্ত কাজ, তায় আবার একাধিক কাচ্চাবাচ্চা সামলিয়ে নিদারুণ শীতে নিজের পিঠে পিঠে রাঁধার চাপ নিতে হত। বৌটি মুখে প্রতিবাদ করতে পারতনা। এক শীতে সে ঠিক করল দুধ ঘন করে, পাটালী দিয়ে ফুটিয়ে নিয়ে এক জব্বর দুধপুলি বানিয়ে শাশুড়িকে খাইয়েই ছাড়বে। রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘরের আশপাশ থেকে ছোট্ট ছোট্ট দুধসাদা নেংটি ইঁদুর ধরে এনে সেই ফুটন্ত দুধের পায়েসের মধ্যে ফেলে দিল ইঁদুরগুলিকে। অন্ধ শাশুড়িকে শীতের রাতে জামবাটি ভরে সেই দুধপুলি খেতে দিল। শাশুড়ি হাত ডুবিয়ে সেই নরম তুলতুলে পুলি খায় আর ইঁদুরের লেজগুলি ছুঁয়ে বলতে থাকল,
‘ কালে কালে কতই হল, পুলিপিঠের ন্যাজ গজালো ‘ তা তোর আবার সে কথা মনে পড়ল হঠাত?
মিঠি বলে,  না গো মা। হঠাতই  মনে পড়ল। আমি আবার আজকাল প্রায়ই রান্নাঘরে ঢুকছি তো। তাই ভাবলাম তুমি আবার আমাকেই না বলে বসো। বলেই ফেলে সে লজ্জার মাথা খেয়ে।
অনসূয়া তপন বাবুকে গর্বের সঙ্গে বললেন, লক্ষ্মী মেয়ে আমার। আমার মেয়েরা আমার মতোই তো হবে। এ আর নতুন কী? যতই তারা পড়াশুনো করে চাকরিবাকরি করুক না কেন। বুঝলে মেয়ের হয়ত পিঠে বানানোর ইচ্ছে হয়েছে। তাই বুঝি এই ফোন। মেয়েকে মেসেজ করলেন।

তা পিঠে বানাচ্ছিস নাকি?
মিঠি বলল, ক্ষেপে গেছো তুমি? আমার দ্বারা পিঠে? নো ওয়ে। গল্পটা জানার ইচ্ছে হল তাই তুমি ধরে নিলে আমি পিঠে পুলির মত মেসি আর কমপ্লিকেটেড রান্না করব? আমার কিচেন নোংরা করে। আমি পিঠে খেতে রেডি আছি। প্রোভাইডেড যদি কেউ বানিয়ে খাওয়ায়।
মেয়ের গলায় রাগের আভাস পেয়েই মা চুপ ওপ্রান্তে। একটু থেমে বললেন, তাহলে চলে আসিস এবার শীতে। আমার হাতেই নাহয়…
কথা শেষ করতে দেয়না মিঠি। বলে, দেখো না শৈবাল এত্ত বাটন মাশরুম নিয়ে ভর্তি করেছে ফ্রিজ। সেগুলোর একটা গতি করতেই  হবে আজ। এখন রাখছি। ভীষণ খিদে পেয়েছে।
ব্যাঙ্গালোরের হাওয়া গরম দেখে মা ফোন রেখে খুব হাসলেন একা একাই।
নেট ফেট ঘেঁটে কিছু একটা হতে চলেছে তবে সেখানে অথবা ছোটো বোন কে পুছতাছ করে কিছু পেয়েছে হয়ত মাশরুম নিয়ে।  
হ্যাঁ, রাণীয়াই সে যাত্রায় মিঠি কে ফান্ডা দিয়েছে খুব চটজলদি ভুটানিজ ক্যুইজিন  “সামু দাতসি”র ।হ্যাশল ফ্রি, ইজি রেসিপি বলেই বানাতে রাজী আছে মিঠি । আদারওয়াইজ উইকের মধ্যে সে রান্না করার পাত্রী নয়।
সেদিন শৈবাল অফিস থেকে আসার আগেই সারপ্রাইজ দেবে মিঠি। কিছু আগেই  ফিরে এসেছে তাই।

বিয়ের পরেই নতুন জামাই শৈবাল কে নিয়ে দুই বোন বাবা মায়ের সঙ্গে ভুটান বেড়াতে গিয়েই এই মাশরুমের প্রেমে পড়ে যায়। বাবা তার আগে বাজার থেকে এসব আনতেন না কস্মিন কালে। । জামশেদপুরে অনেক বন্ধুবান্ধব বললেও কোনও ইন্টারেস্ট ছিলনা ওদের বাড়ির কারোর। তবে ভুটানে গিয়ে আর ওদের এই মাশরুম রান্নার সহজ রেসিপি দাতসির আবেগের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে ফিরে এসেই রাণীয়া প্রথম শিখেই ফেলেছিল এই স্বাস্থ্যকর রান্নাটি।  
তার কারণটা অবিশ্যি সম্পূর্ণ অন্য। নিরূপায় চার বঙ্গসন্তান সেদেশে প্রোটিনের অভাব বোধ করছিল বুঝি।গরমকালে ওরা যখন ভুটান বেড়াতে গেছিল তখন সেখানে পুজোপার্বণের কারণে সব হোটেলে মাংস নিষিদ্ধ। কোই বাত নেহি। ওরা খুব শাকাহারী খাবার পছন্দ করে। মাশরুম আর চিজ ভালো ওখানে। এমন স্বাস্থ্যকর প্রোটিন নাকি আর হয় না। কাগজ পড়ে ওরা জেনেছে ইতিমধ্যে। সহজপাচ্য এই প্রোটিনে কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়েনা। তবে এখনকার আধুনিকারা সবাই হেলথ কনশাস । তাই হাতেখড়ি হল মাশরুমের সঙ্গে। তবে মাঝেমধ্যেই দুই বোন ভয় পেল অত চীজ খেয়ে মধ্য প্রদেশের স্ফীতির কথা ভেবে। ফাইনালি সব ভুলে গিয়ে উপাদেয় সব মাশরুমের ডিশ অর্ডার করতে শুরু করল।  

একদিন এমা ডাটসি। পরদিন সামু ডাটসি। তারপর দিন কেওয়া ডাটসি। ডাটসি বা দাতসি হল ভুটানে চিজের নাম । ইয়াকের দুধের চিজ। এমা হল বিশেষ ধরণের এক লম্বা লম্বা সবুজ লঙ্কা। হালকা ঝাল অথচ গন্ধ বেশ ভালো। সামু হল মাশরুম। কেওয়া হল আলু। ব্যাস। কব্জি ডুবিয়ে খেতে খেতে ওরা সবাই তখন থান্ডার ড্রাগনের দেশে বিগলিত সেই দাতসি প্রেমে। রোজ রোজ এই চিজি সব সুখাদ্য। স্টিমড রাইস বা চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস বা গার্লিক টোস্টের সঙ্গে জমে যেত। রাণীয়া বলেছিল, মা, দেখেছো? নতুন রান্না শিখতেই হয় নয়ত পিছনে হাঁটতে হয়।

ভুটানের যেখানেই যায় তারা সেখানেই সহজলভ্য মাশরুম আর চিজের এই অনবদ্য রসায়ন। লাঞ্চে, ডিনারে আকুলিবিকুলি তখন ওদের প্রাণ। জুঁইফুল সম ফুরফুরে ভাতের বাগানে কখন আসবে ফুটন্ত গরম গরম দাতসি। বাবা পর্যন্ত বলতেন, কোথায় লাগে মাংস? দিন কয়েক পর ওদের ভুটানিজদের সেই বারব্রত উঠে গেলে হোটেলে মাছ মাংস চালু হল বটে কিন্তু মাছ মাংস থাকলেও সেই দাতসি ওদের পিছু ছাড়েনি সেই ক’দিন ।  
রাণীয়া বলেছিল মা’কে ভুটান ছাড়ার আগেই শিখে নিতে হবে এই দাতসির রেসিপি। নয়ত জীবন বৃথা। সেই নিয়ে মিঠি হেসেছিল বিস্তর। তুই এখানে এসেও? পারিস বটে।
হ্যাঁ, এই ভুটানের পারো শহরে গিয়েই রাণীয়ার দস্তুর মত শেখা হয়েছিল অথেনটিক দাতসির রেসিপি। পারো তে পাহাড়ের নীচে সমতলে আর্চারী ট্যুর্নামেন্ট হচ্ছিল। ধনুর্বিদ্যা ভুটানের জাতীয় স্পোর্টস । এদেশের কলির কর্ণ-অর্জুনেরা হাইটেক ধনুক নিয়ে তীর ছুঁড়ে লক্ষ্যভেদ করছে। এই ধনুক অর্জুনের গান্ডীব নয় বা রামের হরধনু নয়, সফিস্টিকেটেড ধনুক যা ধরতে আমাদের দেশের দোলা ব্যানার্জিও সাবলীল। বাবা বলেছিল, চল্, সবাই দেখে আসি একবার। এমন সৌভাগ্য হবেনা জীবনে। ভুটানে একজন ধনুর্ধর লক্ষ্যভেদে সফল হলে সমগ্র টিম তাকে অভিবাদন জানায় জংখায় গান ধরে আর সঙ্গে আমাদের মাদলের মত সম্মিলিতভাবে তালে তালে নাচে ওরা ।

খেলা চলাকালীন মাঠের ধারে স্থানীয় ভুটানি মহিলা একঝুড়ি গার্ডেন ফ্রেস পিচ তুলে এনে সবেমাত্র বসেছে। কী সস্তা পিচ ওখানে! ন্যুল্ট্রাম দিয়ে মা কিনেই ফেললেন কিছু। মহিলার ছবি নিতে ব্যস্ত হল দুই মেয়ে। পিচওয়ালি বেজায় খুশি হয়ে ওদের দুই বোনের হাতে মুঠো ভরে আরো ক’টি রসালো পিচ উপহার দিল। রাণীয়া উশখুশ করছিল। এবার তার কাছে জেনে নেওয়া দাতসির অথেনটিক রেসিপি। ভুটানের সংসারে আমাদের মাছের ঝোলের মত স্টেপল ফুড। রেড রাইসের সঙ্গে। ফলওয়ালি মাসী হিন্দিতে যা বলল তার অর্থ হল শিটাকে, অয়েস্টার বা বাটন মাশরুম যাই হোক বেসিক রান্নাটা একইরকম। বুঝলে মা? রাণীয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে।
মিঠির কোনও হেলদোল নেই অ্যাজ ইউজ্যুয়াল।  

মুখ ভর্তি বলিরেখায় জর্জরিত পিচওয়ালি মাসী ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর আধা ভুটানিজ ভাষায় নাক কুঁচকে জানিয়েছিল প্রধান উপকরণ ইয়াকের চিজ। আর চাই ঝালে কম অথচ দারুণ গন্ধের সবুজ লঙ্কা হলে যার নাম সেদেশে এমা। রাণীয়া বলল মা, রংবেরঙয়ের ক্যাপসিকাম দিয়েছিল হোটেলে দেখলে? ফিরে গিয়ে সে মহানন্দে বাটন মাশরুম দিয়ে তার মায়ের জামশেদপুরের কিচেনেই বানিয়ে ফেলেছিল। ফলওয়ালি মাসী বলেছিল রিফাইন্ড তেলে বানাতে। রাণীয়া দেখলো মাখন বা অলিভ অয়েলে মিশিয়েও  দারুণ টেস্ট হয়। সত্যিই তো বেচারা মাসী কী করেই বা তার সংসারে আর দামী তেল পাবে?

আগের দিন মিঠি কে হোয়াটস্যাপ করে রাণীয়া জানিয়েছিল দাতসির রেসিপি।
শোন্ দিদি, আগে মাশরুম ভালো করে রানিং ওয়াটারে ধুয়ে নিয়ে জলটা স্ট্রেন করে নিবি। পারলে কিচেন টাওয়েলে ড্রাই করে নিস। খুব জল বেরোয় কিন্তু। তারপর প্যানে টু টি স্পুন অলিভ অয়েল আর ওয়ান টি স্পুন বাটার দিয়ে দু চামচ পেঁয়াজ কুচি । একটু স্টারফ্রাই করে রসুন কুচি দিয়ে গন্ধ বেরুলে মাশরুম গুলো দিয়ে স্টার ফ্রাই করা। ব্যাস! এবার  নুন আর গোলমরিচ ছড়িয়ে সামান্য চিনি। উল্টেপাল্টে আদরে, যত্ন করে এবার জেনারাসলি মনের সুখে চিজ দিবি। আর নাড়বি। হাই হিটে মাশরুম থেকে বেরুনো জলটা মরিয়ে ওপর থেকে নামানোর আগে একটু আলগোছে স্প্রিং অনিয়ন গ্রিনস ছড়াবি। ইচ্ছেমত লাল, সবুজ, হলুদ ক্যাপ্সিকাম কুচি দিয়েও সাজাতে পারিস। ভুটানের সেই হোটেলের মত। বাই দ্যা ওয়ে পারোর হোটেলে এর মধ্যে সুইট কর্ণ ছড়িয়েছিল, মনে আছে? যত ইম্প্রোভাইজ করতে পারবি।
এত  ইজি রান্না এটা? মিঠি বলেছিল বোন কে।
রান্নার ব্যাপারে নিজের মায়ের পেটের বোন কে মিঠির এখন গুরুদেব মনে হয়।

বলাই বাহুল্য সেদিন ব্যাঙ্গালোরে মিঠির কিচেনে জমে গেছিল এই সামু দাতসি। ফুড ফিউশানের গ্লোবালাইজেশনের দৌলতে সার্ভ করবার সময় রেড চিলি ফ্লেক্স ছড়িয়ে দিয়েছিল মিঠি। মানে ইম্প্রোভাইজেশনের আরেক ধাপ উঠে বোন কে ফোনে জানিয়েছিল সে। জানিস? আমার পাল্লায় পড়ে সামু দাতসি এখন ভুটানের ইয়াকের পিঠে চড়ে ভুটান থেকে চায়না, ইটালী সব ঘুরে এসেছে সেদিন । মিঠির এহেন পরিবর্তনে রাণীয়ার খুব হাসি পায়। মা কে মিস করে সে। দিদি কে নিয়ে কত হাসাহাসিই না করত ওরা একসময়। আর সে কি না এখন রান্না করছে নিয়মিত?

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত