| 23 অক্টোবর 2024
Categories
নারী

ধর্ষণের পেছনে রহস্য কী (পর্ব-১)

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

মধুমিতা পাণ্ডে যখন ভারতের নয়াদিল্লির তিহার কারগারে সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের উদ্দেশ্যে যান তখন তার বয়স মাত্র ২২। সাল ২০১৩। এর পরের তিনবছর তিনি একশ জন ধর্ষকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। যুক্তরাজ্যের এঙ্গলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা বিভাগের অধীনে তিনি এই প্রকল্পটিতে যুক্ত হন।
২০১৩ সালের এমন একটি সময়ে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, যখন ভারতের সবচেয়ে আলোচিত গণধর্ষণ এবং হত্যার শিকার ‘নির্ভয়া’ নামে পরিচিত নারীকে নিয়ে গোটা ভারত সরগরম। ‘নির্ভয়া’ মামলার বিবরণে বলা আছে – ‘‘মেডিক্যালে অধ্যয়নরত নির্ভয়া তার বন্ধুর সাথে ‘লাইফ অব পাই’ সিনেমাটি দেখে ফিরছিল। পথিমধ্যে সে গণধর্ষণের শিকার হয় এবং ধর্ষকেরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।’’ এরপরও ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো অনুসারে, সাম্প্রতিক ২০১৫ সালেও ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৪,৬৫১ জন নারী।
নারীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও সহিংসতার চলমান সংস্কৃতির প্রতিবাদে ২০১২ সালে হাজার হাজার ভারতীয়কে রাস্তায় নামিয়ে এনেছিলো ‘নির্ভয়া’। একই বছর, জেণ্ডার বিশেষজ্ঞরা জি-২০ দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে ভারতকে । দাবি করা হয়, সৌদি আরবের তুলনায় যেখানে এখনো নারীদের পুরুষ অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানেই চলতে-ফিরতে হয়, ভারত সেই সৌদি আরবের চেয়েও অনিরাপদ!
ওই একই সময়ে লণ্ডনে মাস্টার্সের প্রায় শেষ ক’টা দিন পার করছেন মধুমিতা। নিজের জবানিতেই জানাচ্ছেন, ‘সব ধর্ষকের চিন্তা-ভাবনা একই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু কেন তারা এই কাজটি করে? আমরা তাদের দানব মনে করি, আমরা মনে করি কোনো মানুষের দ্বারা এমন কিছু সম্ভব নয়।’
২০১২ সালের ওই প্রতিবাদটি জাতীয়ভাবে একটি কথোপকথনের দোরগোড়ায় নিয়ে যায়, ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার বিষয়টিকে জোরদার করে তোলে। মধুমিতা পাণ্ডের বেড়ে ওঠা দিল্লিতেই, আর ‘নির্ভয়া’ কান্ডের পর তিনি শহর দিল্লিকে নতুনভাবে জেগে উঠতে দেখলেন। তিনি জানান, ‘আমি ভাবতাম, ওইসব পুরুষরা কেন এই কাজটি করে? কি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যাতে করে সে একজন নারীকে ধর্ষণ করতে উদ্ধুদ্ধ হয়? আমি ভাবতাম, এসবের উৎস কোথায়?’
যা-ই হোক, এর কিছুদিনের মধ্যেই তিহার কারাগারে তার গবেষণাটি শুরু হয়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ তিনি অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত ধর্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন। দণ্ডিত ধর্ষকদের বেশিরভাগই ছিল অশিক্ষিত, শুধুমাত্র কমবয়সী ধর্ষকদের মধ্যে কিছু উচ্চ মাধ্যমিক বা স্নাতক পাশ ধর্ষক পেলেন। অনেকেই আছে যারা তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতেই ঝরে পড়া। পাণ্ডে বলছেন ‘গবেষণা শুরুর আগে আমার ধারণা ছিল যে যাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে তারা একেকটা দানব। কিন্তু আপনি যখন তাদের সাথে কথা বলবেন, বুঝতে পারবেন যে এরা দেখতে অতি সাধারণ পুরুষের মতোই। কেবল তারা যা করেছে তার পেছনের চিন্তার প্রক্রিয়াটি সাধারণ মানুষের চাইতে আলাদা।’
মধুমিতা জানাচ্ছেন, ‘ভারতীয় পরিবারগুলিতে আজও, এমনকি শিক্ষিত পরিবারেও নারীরা প্রায়শই স্রেফ ঐতিহ্যিক ‘বউ’-এর ভূমিকা পালন করে থাকে। অনেক নারী এমনকি তাদের স্বামীদের মূল নাম ব্যবহার করে না। একটি পরীক্ষা হিসাবে, আমি কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মা তোমার বাবাকে কী নামে ডাকে? আমি যে উত্তর পেয়েছি তা এরকম ‘আপনি শুনছেন, ‘শুনুন’, ‘রনিতা বাবা শুনছেন’ ইত্যাদি।
‘পুরুষেরা তাদের পুরুষত্ব সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে ছোটবেলা থেকেই। নারীরাও একইভাবে বিনয়ের ভূষণ পরে থাকে। একই পরিবারে, কোনো এক ধর্ষক পুরুষের প্রতি সেই পরিবারের নারী সদস্যদের মনোভঙ্গি খুবই হতাশাজনক! তারা মনে করে সেই পুরুষটির সাথে এমন অর্ন্তনিহিত কিছু ঘটেছে যার জন্য সে এমন ঘৃণ্য কাজটি করেছে। কিন্তু ওই ধর্ষকটি আমাদের সমাজেরই অংশ এবং সে ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনো প্রাণী নয়।’
পাণ্ডে জানান, কয়েকজন ধর্ষকর কথোপকথন শুনে আমার খুব সাধারণ স্তরের একটি বিশ্বাস জন্মায় যে, তাদের পরিবারেও এমন অনাচার অহরহ ঘটে থাকে এবং এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আবার ধর্ষকদের সাথে কথা বলার পর, আপনি খানিকটা হতাশও বোধ করতে পারেন কারণ ওই সকল পুরুষদের অনেকেরই অনুশোচনাবোধ তীব্র। আপনি যদি নারীও হন তবুও তাদের অনুশোচনার ভারটি আপনি বুঝতে পারবেন। আমিও মাঝেমধ্যে ভুলে যেতাম যে সামনে বসা পুরুষটি একজন নারীকে ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্থ। আমার অভিজ্ঞতাতে বুঝেছি এইসব পুরুষ বুঝতেও পারছে না যে তারা যা করেছে তা ধর্ষণ, বলাৎকার। ‘সম্মতি’ বিষয়টি তারা বুঝতেই পারে না।’
‘তারপর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছি, এটা কি শুধু ওই ব্যক্তি পুরুষের সমস্যা? নাকি সমস্যা পুরুষের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতায়?’
এই উপমহাদেশে, সামাজিক মনোভাব অত্যন্ত রক্ষণশীল। বেশিরভাগ স্কুল পাঠ্যক্রমে যৌন শিক্ষা অনুপস্থিত; সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা মনে করে এহেন শিক্ষা তরুণদের ‘বিপথগামী’ করতে পারে এবং ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে দূরে হটিয়ে দিতে পারে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সামনে লিঙ্গ, যোনী, ধর্ষণ বা সঙ্গমের মতো কথা মুখেও আনবেন না। তাহলে অবদমন থেকে কী করে মুুক্তি মিলবে তরুণ-যুবাদের? মধুমিতার প্রশ্ন।
সাক্ষাৎকার চলাকালে, অনেক ধর্ষকই তার কৃতকর্মটির প্রতি সাফাই গেয়েছে, এহেন কর্মের ন্যায্যতা দিতে চেষ্টা করেছে! এমনকি অনেকে ধর্ষণ-কাণ্ডটিকে অস্বীকার করেছে এই বলে যে, ব্যাপারটা ঘটে গেছে। হাতেগোণা মাত্র তিন-চারজনই বলেছিলেন যে, এটি যেভাবে ঘটেছে তার জন্য আমার অনুতাপ হয়। বাকিরা তাদের কর্মকে ন্যায়পরায়নতা, নিরপেক্ষীকরণ বা ধর্ষিতার কারণেই এমনটি ঘটেছে ইত্যাদি বলে উপায় খুঁজতে চেষ্টা করেছে।
একশো জন ধর্ষকের স্বাক্ষাৎকার গ্রহণের এক পর্যায়ে, ৪৯ বছরের এক ধর্ষক যার বিরুদ্ধে মাত্র পাঁচ বছরের একটি মেয়েশিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিলো, তার বোধোদয় ছিলো অপ্রত্যাশিত। ধর্ষকের জবানী, ‘হ্যাঁ আমার এখন খারাপ লাগছে। আমি তার জীবন ধ্বংস করেছি। এখন সে আর কুমারী নয়, তাই কেউ তাকে বিয়েও করবে না। এখান থেকে ছাড়া পেয়ে আমি তাকে বিয়ে করবো।’ ধর্ষকের এমন প্রতিক্রিয়া জানার পর মধুমিতা এতটাই অস্থির হয়ে পড়েন যে ধর্ষিতা মেয়েটির খোঁজে নেমে পড়েন। একপর্যায়ে খোঁজ পান পরিবারটির। কিন্তু পরিতাপের বিষয় পরিবারটি তখনো জানে না যে মেয়েটির সর্বনাশ ঘটানো ধর্ষকটি এখন কারাগারে!

সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত