রথ চলেছে ধীরে মানুষের ভিড়ে
আমার জন্ম সিঁথির ইজ্জত কলোনীতে। দোতলা একটা সাদামাটা বাড়ি, চারটে ফ্ল্যাট তাতে। তখনো সত্যিকারের আজকের মত ফ্ল্যাট কনসেপ্ট আসেনি।ফলে চারটে পরিবার যৌথপরিবারের মতই একটা বাড়িতে বাস করতাম।আমরা থাকতাম এক তলায়, ঢুকেই প্রথম ঘরটায়। একটা ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘর, তারপাশের ঘরে কোনোরকমে একটা চৌকি আর বাবার চেয়ার রাখা।
বিছানা জুড়ে আমাদের শৈশব। তখনো বুঝিনি আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেককে রথ টানতে হয় ।একটা রথ কেনা হত।রথের সাইজ আমাদের মাথা ছাড়িয়ে, সেই রথ সাজাতে বসত আমাদের দেখভাল করা তুলসীদি, পাশের ঘরের কালু , দোতলার চন্দনদা।
মা আর পাশের ঘরের কাকিমা, যাকে কিনা কোনোদিন জানতামই না পাশের বাড়ির বলে, রথ কিনে আনতেন দমদম থেকে।সঙ্গে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা । আর কিছু রঙ বেরঙের মার্বেল পেপার। চন্দনদা পাতাবাহার গাছের পাতা আর ডাল কেটে রথের চার দিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিত।তুলসীদি আর কালু সারাবছর মারপিট ঝগড়া করলেও এই দিন আমাদের রথ দেখে যাতে পাড়ার সকলে মুগ্ধ হয় তার জন্য জান লাগিয়ে দিত।
কাগজ কেটে নানা ডিজাইন করে সেগুলো আটকানো হত রথের গায়ে। ভেতরে ছোটো ছোটো কাঁসার থালায় মিষ্টি, গ্লাসে জল।যা একটু বাদেই পরে গিয়ে রথ ভেজাত।
প্রথম প্রথম জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রাকে বাঁধা হত না।কিন্তু দড়ি একটু টানলেই এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় তাঁরা পরে গিয়ে কখনো নাক কখনো কপাল ফাটিয়ে ফেলতেন।
স্বয়ং ঠাকুরের মাথা নাক বিপর্যস্ত, এ কী ধর্মে সয়! অগত্যা পাতলা সুতো দিয়ে বাঁধা পরল তিনভাই বোন।আর এই বিষয়টা আমার খুব মজা লাগত।কারণ মা আমি ভীষণ দুষ্টু ছিলাম বলে মাঝে মধ্যেই হাত দুটো বেঁধে দিত জানলার গ্রিলের সঙ্গে ।আর বলত, হাত পা ভেঙে বসে থাকবি এত দৌড় ঝাপ করলে।সত্যি কপাল আমার ফেটে ছিল খাট থেকে বারবার লাফ মেরে নিচে নামা আর ওঠার দৌলতে।আরও কত কী যে আঘাত, সারা শরীরে কালসিটে, যা কখনোই মেলাতো না।আর ঝুম আমার মেজবোন, আমার দুষ্টুমি আড়াল করার চেষ্টা চালাতো অহরহ।যা হোক, আমি যে একাই দুষ্টুমি করে হাত পা বাঁধা থাকি, তাই না, ঠাকুরকেও বাঁধা হচ্ছে একই যুক্তিতে , এই বিষয়টা স্বান্তনা ও আনন্দ দুটোই দিত।
সারা পাড়ার রথ একসঙ্গে বেরত।জানি না কেউ সেই সময়টা বলে দিত কিনা! অথচ মনে পড়ে একটা নির্দিষ্ট সময়েই সবার রথ একসঙ্গে পথে নামত। কাঁসর ঘন্টা মন্দিরা বাজাতে বাজাতে সারা পাড়া ঘুরত রথ। তারপর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে সেগুলো সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করানো হত। তখন বড়ড়া বাচ্চাদের হাতে মিষ্টি , পাপড়, গুজিয়া, আর রংবেরং এর চিনির মঠ তুলে দিত।সেগুলো খেয়ে আবার রথ চলত বাড়ির দিকে।এখন নিজের ঘরে নয়, পাশের ঘরে থাকবে তারা।সেটাই এখন তার মামার বাড়ি ।উল্টো রথে আবার ফিরবে নিজের বাড়ি ।
রথের পরদিন পাশের বাড়ির দিদার সঙ্গে যেতাম বড়ানগরে রথের মেলা দেখতে।সেখানে দিদার মেয়ে মেজ পিসির বাড়ি ।তাদের দুই মেয়ে , মন্তাদি বেশ খানিকটা বড়, সবসময় গম্ভীর থেকে নিজেকে বড় বোঝাত, আর মৌদি একটু বড় হলেও ছিল আমাদের বন্ধু।তাদের সঙ্গে মেলা ঘুরতাম, পাপড়, ঘুগনি খেয়ে নাগরদোলা চড়ে , রাতে পিসির রান্না করা খিচুড়ি পায়েস আলুভাজা আরো অনেক কিছু অল্প মুখে দিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন ইজ্জত কলনী নিঝুম।
বাবা বলতেন, জগন্নাথের রথ আসলে আমাদের এই মানব শরীর। তাঁর রথ তৈরি হয় ২০৬ টি কাঠ দিয়ে। মানুষের শরীরেও ২০৬টি হাড়। রথের ১৬টা চাকা আমাদের পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, ৫ কর্মেন্দ্রিয় আর ছটি রিপুর প্রতীক। রথের রশি হল মন। বুদ্ধি হল রথের সারথী। আর ঈশ্বর স্বয়ং এই দেহ রথের রথী। যখন সব কিছু হাতের বাইরে তখন তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন আমাদের। আসলে আমরা তাঁর হাতের পুতুল।
এত জটিল ভারী ভারী কথা তখন মাথায় ঢুকতো না। কিন্তু রথ টানা আর তাতে তিনি ভাই বোনের বসে থাকা- এই আনন্দটাই মন উৎফুল্ল করে রাখত।
একটা রথের দিনেই আমরা আমাদের সিঁথির ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে উঠে এলাম। শুরু হল আরেকটা জীবন। রথের চাকা টানতে টানতে ক্রমে বড় হয়ে গেলাম।
এখন রথ টানি মনে মনে, যে রথ থেকে একদিন ভোরে নেমে এসে যমদূত টেনে নিয়ে গেছিল (শ্বশুর মশাই) বাবাকে, সেদিন থেকেই ভোরাই-এরও রথ টানা সাঙ্গ হয়ে গেছিল, সেই রথ টানি একা একা, রথের মাঝখানে বসে আমার বাবাও এখন অনেক দূরে . . ধরতে পারি না। কেবল মন বলে জগন্নাথ, মন বলে চলো রথ অনেক দূরে…। দেখি রথ চলেছে ধীরে মানুষের ভিড়ে।

কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক