| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক রাজনীতি সময়ের ডায়েরি

যুক্তিচিন্তা-দশম পর্ব : বাবরি চুল রেখে তুমি কী জাসদ হতে চাও?

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

.

ছোটবেলায় আমার এখনকার মতো টাক ছিল না; ঘন, কালো, সিল্কি চুল ছিল। কপাল ঢাকা, ঘাড় উপচানো চুল খুব ভাল লাগত। বাতাসে চুল উড়িয়ে হাঁটতে একটা দারুণ অনুভূতি হত। কিন্তু কৈশোরে একটু বড় চুল রাখার জন্য কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি!

নাপিত নিলুদা’র দুই হাঁটুর মধ্যে আটকে থাকা মাথায় যখন ক্যাচ ক্যাচ করে কাঁচি চলত, তখন পাশে বসা একাধিক প্রতিবেশী মুরুব্বি “আরও ছোট করে দে, বাটিছাঁট দিয়ে দে, পোলা মাইনষের এত বড় চুলের কাম কী” বলে নির্দেশনা দিতে থাকতেন। আমি গ্রামের ভালো ছেলে, চুপচাপ বসে থেকে চুল হারানোর বেদনা সয়ে যাওয়াছাড়া কিছুই করার থাকত না। ‘আমার চুল, আমার অধিকার’ বলে কেশাধিকার রক্ষার কল্পনাও আমাদের মাথায় আসত না।

কিশোরকেশবৈরি সমাজের নিয়ন্ত্রণের ফাঁক গলে তারপরও বড় চুল রাখতাম। এ নিয়ে কথাও শুন‌তে হত। তখন এইট বা নাইনে পড়ি, এক প্রতিবেশী কাকা বললেন, এত বড় চুল রাখছ ক্যা? তুমি জাসদ কর? বড় হয়ে গুণ্ডা হবা? কাকার যুক্তি ছিল, যেসব ছেলে ছোটবেলায় বাবরি চুল রাখে তারা বখে যায়, জাসদ করে, গুণ্ডামি করে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

মাথা নিচু করে চুপ থাকা ছাড়া সেদিন আমার আর কিছুই করার ছিল না। কিন্তু নিচু মাথায় তো আর চিন্তা করতে অসুবিধা নেই। জাসদের তেজি তেজি যুবকদের আমার আসলেই ভাল লাগত। ছোটবেলা থেকেই আমি রাজনীতি এবং লেখালেখি করার কথা ভাবতাম। কিন্তু জাসদ করার কথা কখনোই ভাবিনি। চুল বড় রাখলেই আমি জাসদ করব, জাসদ করলেই গুণ্ডা হয়ে যাব—কাকার এই বক্তব্য আমার ভাল লাগেনি সেদিন এবং চুল পড়ে মাথা পরিস্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি চুল বড়ই রেখেছি।

জাসদ না করে পরবর্তীতে আমি বাসদ করেছি, গুণ্ডামি না করে গুণ্ডাদের অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু তার সাথে চুল বড় রাখার কোন যৌক্তিক কোনও সম্পর্ক আবিস্কার করতে পারিনি।

সম্প্রতি টিকটক সেলিব্রিটি অফু বাই এর লম্বা রঙিন চুল নিয়ে মানুষের সমালোচনা বা মাঝে মাঝে পুলিশ বা প্রশাসনের কিছু মানুষের কিশোরদের চুল কাটা নিয়ে উৎসাহী উদ্যোগ দেখে আমার সেই কাকার কথা মনে পড়ে। তাদের সবার ব্যাখ্যাই মোটামুটি একইরকম।

আ.

প্রায় একযুগ আগে সরকার ‘নারীনীতি’র খসড়া করলে দেশের আলেমদের এক‌টি বড় অংশ এবং বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন ‘নারীনীতি’ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। খসড়া ‘নারীনীতি’তে নারীর সমানাধিকার, বিশেষত সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার নিয়ে কিছু কথা ছিল, যাকে আন্দোলকারীরা ‘ইসলামবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এটাকে ইসলামের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে প্রস্তাবিত ‘নারীনীতি’ প্রতিরোধে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। তারা সতর্ক করে দেন যে, এই ‘নারীনীতি’ বাস্তবায়ন হলে দেশে ইসলামক ধ্বংস হয়ে যাবে।

সত্তরের নির্বাচনে ‘নৌকায় ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে’ বা ‘দেশে ইসলাম থাকবে না’—এরকম প্রচারণা শোনা গেছে।

ই.

গত দুই দশকে দেশে ইসলামী চরমপন্থী পরিচয়ে কিছু সংগঠন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায়। কয়েক বছর আগে, বিশেষ করে হলি আর্টিজান হামলার আগে পর্যন্ত এসব জঙ্গি সংগঠনে বা কর্মকাণ্ডে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মূল ভূমিকা রাখছে বলে ধারণা করা হত। সে সময় কেউ কেউ জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কওমী মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ বলে মতামত ব্যক্ত করেন। তাদের যুক্তি ছিল, কওমী মাদ্রাসাগুলিতে জঙ্গিবাদের চাষ হয়। এসব মাদ্রাসা চালু থাকা মানেই জঙ্গিবাদের অনিবার্য বিস্তার। একজন কিশোর কওমী মাদ্রাসায় পড়ছে, ধর্মীয় বিধান কঠোরভাবে মেনে চলছে মানেই সে জঙ্গিবাদে যুক্ত হচ্ছে—এরকমও মনে করতেন অনেকে।

পরবর্তীতে অবশ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম বা বিদেশে শিক্ষিত তরুণদের এসব সংগঠনে যুক্ত হওয়ার তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর মাদ্রাসা বন্ধের দাবি স্তিমিত হয়ে আসে।

ঈ.

পুকুরের ধার থেকে পিছলে পানিতে পড়ার যে খেলা গ্রামের কিশোররা খেলে, শহরের পার্কে স্টিলের পাতে পিছলে নিচে পড়ার খেলার তেমনই ব্যবস্থা আছে। এখানে যে একবার পিছলে নামা শুরু করবে পানিতে বা নিচে তাকে পড়তেই হবে। উপরের যুক্তিগুলোও ঠিক একইরকম।

ছেলেরা বড় চুল রাখলে বেয়াদব হবে এবং পর্যায়ক্রমে পড়াশোনা না করা, বখে যাওয়া, ‘খারাপ’ সঙ্গ বা সংগঠন করা এবং শেষ পর্যন্ত গুণ্ডামী করা তার অনিবার্য পরিণতি হবে অথবা ‘নারীনীতি’তে নারীর সমানাধিকারের কথা থাকলে দেশে ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে অথবা কোন কিশোর কওমী মাদ্রাসায় গেলে শেষ পর্যন্ত সে জঙ্গি হবে—এরকম যুক্তিকাঠামো আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে যদিও ছেলেদের বড় চুলের সাথে গুণ্ডামি, নারীর অধিকারের সাথে ইসলাম ধ্বংস হওয়াবা কওমী মাদ্রাসায় পড়ার সাথে জঙ্গি হওয়ার অনিবার্য যোগসূত্র নেই। ফলে এই ধরনের যুক্তিকাঠামোকে যুক্তি না বলে ছদ্মযুক্তি বলাই সঙ্গত।

উ.

এক‌টি ঘটনা থেকে পরবর্তীতে যৌক্তিকভাবে সম্পর্কযুক্ত নয় এমন কিছু ঘটনা ঘটবে বলে ধরে নেওয়ার এই ছদ্মযুক্তিকে ইংরেজিতে বলে Slippery Slope Fallacy, বাংলায় বলা যায় ‘জুজুর ভয়ের ছদ্মযুক্তি’। পিচ্ছিল পুকুরপাড় বা স্টিলের পাত বেয়ে নিচে পড়ার মতো অনিবার্য পতনকে এক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে ছদ্মযুক্তিটির এরকম নাম হয়েছে।

 

আগের পর্বগুলো ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত