| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক রাজনীতি সময়ের ডায়েরি

যুক্তিচিন্তা-ষষ্ঠ পর্ব: তোমার দাড়ি কই মিয়া?

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

প্রাইমারি স্কুলের একটা কথা মনে হলে এখনও একটু লজ্জা লাগে, মনও খারাপ হয়। তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। প্রথম সাময়িক পরীক্ষার শেষ দিন। লেখা শেষ হয়ে গেছে। বেঞ্চে পাশে বসা সহপাঠী ছেলেটি দেখি খাতার ফাঁকা থেকে যাওয়া পাতা ছিঁড়ে নিচ্ছে। পাতা ছিঁড়ছ কেন জানতে চাইলে সে বলল, খাতা ফেরত দেওয়ার সময় আপারা পাতা কেটে রাখে। খাতা কিনতে টাকা লাগে না? টাকা কী গাঙ্গে ভাইসা আহে? শেষ বাক্যটি হুবহু এই ছিল। আমি ভেবে দেখলাম, সে ঠিকই বলেছে, টাকা তো গাঙ্গে ভেসে আসে না! উল্লেখ্য, আমরা পরীক্ষার আগে সাদা খাতা জমা দিতাম এবং প্রায়শই খাতা ফেরত দেওয়ার সময় সাদা পাতা কাটা থাকত। 

আমি অন্যদের তুলনায় একটু কম বয়সে স্কুলে যেতে শুরু করি। তাছাড়া বাস্তববুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞান সম্ভবত আমার কিছুটা কম ছিল। সহপাঠীর বক্তব্য আমার কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য মনে হয় এবং আমি খাতার শেষের খালি থাকা পাতাটি কেটে নেই। এরপর আমি আরেকটি অর্ধেক সাদা থাকা পাতার অর্ধেক কেটে নিয়ে বেশ একটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছি এরকম অনুভূতিসহ মেজো আপার কাছে খাতা জমা দেই। তিনিই এই বিষয় পড়াতেন।

আমি পরীক্ষার কক্ষ থেকে বেরুনোর সময় শুনতে পাই মেজো আপা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বড় আপাকে আমার কেটে নেওয়া পাতার অংশ দেখিয়ে বলছেন, দেখেন, কীভাবে খাতার পাতা কেটেছে! আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখার কাগজ কেনার টাকা আমার নাই? ওর খাতার পাতা কেটে রাখব? কী ছোটলোকের মতো কাজ! এটুকু বলেও আপার রাগ কমে না, তিনি বলতে থাকেন, বড় বংশের ছেলে হলে কী হবে, ওর মা যে ছোট বংশের, এজন্যই ছেলে এরকম হয়েছে! আমি কান পেতে সব কথা শুনি। শুন‌ে আমার কান দিয়ে গরম বাস্প বের হতে থাকে। আমি আমার ছোট্ট বুকের ধুকপুকানি শুনতে পাই।

নিজের কাজের জন্য এতটা লজ্জা এবং অপমানের শিকার আমাকে জীবনে আর কখনোই হতে হয়নি। আমি বাড়ি আসতে আসতে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকি।

আমি বুঝতে পারি, ওভাবে খাতার কাগজ কেটে নেওয়া আমার ঠিক হয়নি। এজন্য আমার লজ্জা লাগে। আমি এই মুখ স্কুলে কীভাবে দেখাব ভেবে পাই না। এরপর মনে আসে আমার মায়ের বংশ তুলে অপমান করার কথা। আমার খুব আত্মসম্মানে লাগে। ছোটবেলা থেকে খুব ভাল ছাত্র বা বুদ্ধিমান না হলেও আমি খুব সংবেদনশীল এবং আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ছিলাম। আমি অপরাধবোধের লজ্জা এবং অপমানিত হওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজতে থাকি। আপার উপর একটা প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছাও হয়। এবং বাড়ি আসার আগেই আমি একটা বুদ্ধি বের করে ফেলি।

বাড়ি ফিরে বাবাকে বলি, আমি আর অলোয়া স্কুলে যাব না। ভারই স্কুলে পড়ব। বাবা কারণ জানতে চাইলে বলি, আমার একা একা স্কুলে যেতে ভাল লাগে না। দিদিরা তখন ভারই হাইস্কুলে যায়, ওদের সাথে আমি ভারই প্রাইমারিতে যাব। বাবা আমার ইচ্ছা মেনে নেন। ছোটদের কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার অভ্যাস বাবার ছিল। আমি ভারই স্কুলে যেতে শুরু করি।

আমার স্কুল ছাড়ার খবর পেয়ে হেডস্যার বাসায় চলে আসেন। বাবাকে অনেক বুঝিয়ে আমাকে অলোয়া স্কুলে ফেরাতে রাজি করেন। প্রয়োজনে তারাই এসে আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবেন বললে বাবার আর আপত্তি করার সুযোগ থাকে না। আমি আবার আগের স্কুলেই ফিরি। উল্লেখ্য, বাবা স্কুলে নানাভাবে সহায়তা করতেন। এছাড়া স্কুলের সকল শিক্ষকই আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আপার ওইদিনের আচরণ ক্ষুব্ধতা থেকে এবং সেটি মাত্র একদিনের আচরণ, ওনার থেকে পাওয়া স্নেহের অভিজ্ঞতা তাতে এতটুকুও ম্লান হয় না। 

আমার একটা ভুল আচরণকে ধরিয়ে না দিয়ে বা সংশোধন করার জন্য সহায়তা না করে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা এবং সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে আমার মাকে হেয় করার বিষয়টি আমাকে অনেকদিন ভাবিয়েছে, বহুদিন ভুগিয়েছে।

আরেকটু বড় হওয়ার পর আমি খেয়াল করলাম, মানুষ অন্যের সাথে কোনওভাবে পেরে না উঠলে এ ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণ করে তাকে থামাতে চেষ্টা করে, হারাতে চেষ্টা করে। অপ্রাস‌ঙ্গিক কোনও অপমানজনক তথ্য, মিথ্যা অভিযোগ, চরিত্রহনন করা বা শরীর, বংশ, লিঙ্গ, পেশা, ধর্ম, অঞ্চল, শিক্ষা, সম্পর্ক ইত্যাদির ভিত্তিতে ব্যক্তিকে আক্রমণ করার মাধ্যমে তাকে থামিয়ে দেওয়া বা পরাজিত করা হয়। 

গ্রামে বেড়ে ওঠার কারণে ঝগড়া দেখার বিস্তর অভিজ্ঞতা আমার আছে। মুরগির ধান খাওয়া, বাচ্চার খামচি দেওয়া, লাউয়ের তরকারিতে বাড়তি লবণ বা জাল দলিল করে জমি দখল-ঝগড়ার মূল বিষয় যাই হোক না কেন, তা শুধুমাত্র ঝগড়ার শুরুতেই অবদান রাখতে পারে। মুহূর্তেই জাত, বংশ, শরীরের সাইজ থেকে ছলকে ছলকে উভয় পক্ষের অসঙ্গত যৌন সম্পর্কের ইতিহাসে গিয়ে কণ্ঠযুদ্ধ তীব্র বেগে পাক খেতে থাকে। বিষয়বস্তু হারিয়ে গিয়ে ব্যক্তির ইজ্জতকে যেকোনও মূল্যে পাংচার করে দেওয়াই তখন মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়, যদি না এক পক্ষের পিটিয়ে হালুয়া টাইট করার তাগদ থাকে। 

সমাজে, রাজনীতিতে এ ধরনের চর্চা প্রতিনিয়তই দেখা যায়। এ ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণ কখনও প্রতিপক্ষকে অসম্মানিত করার জন্য করা হয়, কখনও অসম্মানিত করার মাধ্যমে তার কোন কথা, কাজ বা যুক্তিকে পরাজিত করার কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।

লালসালু উপন্যাসের বিখ্যাত উক্তি “তোমার দাড়ি কই মিয়া?” এর এক‌টি ভাল উদাহরণ। এখানে তরুণের উদ্যোগের সমালোচনা না করে ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে তার শিক্ষা বিস্তারের যুক্তিকে পরাস্ত করা হয়।

সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের অভিযোগ করলে তাকে ভারতে চলে যাবার পরামর্শ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়টির অপব্যবহারের সমালোচনা করলে পাকিস্তানের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা, কোন নারী যৌন নির্যাতনের বিচার দাবি করলে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা থেকে শুরু করে যুক্তি বা প্রশ্নকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য ঘরের মেধ্য “তুমি আমার চেয়ে বেশি বোঝ? চুপ থাক, বেয়াদপ!”-এরকম চর্চার অসংখ্য নজির খুঁজে পাওয়া যাবে, যেখানে কথার জবাব না দিয়ে ব্যক্তিকে হেয় করা হচ্ছে। 

কোন যুক্তিকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে পরাজিত বা মোকাবেলা না করে অপ্রাস‌ঙ্গিকভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার মাধ্যমে তাকে হারানোর চেষ্টা করার এই কৌশলকে ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক ছদ্মযুক্তি বলে। অর্থাৎ এখানে বক্তব্য নয়, ব্যক্তিকে আক্রমণ করে বক্তব্য খারিজ করার চেষ্টা করা হয়। 

আজকের রাজনীতির ময়দান বা ফেসবুকে ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে যুক্তিকে কোনঠাসা করার এই ছদ্মযুক্তির মহামারী দেখে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে এটি এই বঙ্গদেশের কোন সাম্প্রতিক আবিষ্কার। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ল্যাটিন ভাষায় যুক্তিকে পরাজিত করার এই অপকৌশলকে বলা হত Ad hominen, যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায় against the man, যাকে আজ আমরা বলছি ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক ছদ্মযুক্তি।

 

 

আগের পর্বগুলো ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত