রিভিউ

Reading Time: 2 minutes
তনুজার মুখখানা বিবর্ণ হয়েছিল শুকনো তেজ পাতার মতো। আজকাল কিছুতেই মন বসে না। সারাদিন নির্ভার বসে থাকা, টিভিতে চোখ রেখে আর কতক্ষণ! বাড়ির ফটো ফ্রেমে স্বামীর মুখখানাও টানে না আজকাল। বয়স বাড়লে আবেগে পরিমিতি পায় নাকি শেষ নিঃশ্বাসের আগেই ইহলোক-পরলোক সবাই কেমন মায়া ত্যাগ করে চলে যায়। বাহাত্তরে এসে যারা কাছের মানুষ বাস্তব জীবনে কোথায় তাদের কেন্দ্র বিন্দু সত্যি বুঝে ওঠা দায়। ঔষধ পত্থের উপর নির্ভরতা বাড়ে। ইদানীং অম্বলে পেট ঢোল হলে; দুটো গ্যাসের ঔষধ সেবন করে নেয়। হাড়ের ব্যথা বাড়লে- একা একা কোঁকড়ায় শামুকের মতো। জীবনের শেষ প্রান্তে মানুষের জীবন বোধ করি এমনই নিঃসঙ্গ কেটে যায়। না, এভাবেই বা কাটবে কেন? মধুমিতা এলে মনটা বেশ চনমনে হয়ে ওঠে প্রফুল্ল লাগে তাঁর। মধুমিতা পেশায় নার্স। তনুজার দেখভালের জন্য ছেলেমেয়েরা ওকে পার্ট টাইম রেখে দিয়েছে। ও এলে কর্মস্হলের গল্প শোনায় হাসপাতালের রুগী ডাক্তারদের কত্ত রকম গল্প যে ওর কাছে তার ইয়ত্তা নাই। হাসপাতালের বেডে বসে কে কীভাবে জীবনের হিসেব মেলায় তা না বললে জানা হতো না তনুজার। আনন্দ-বেদনা-হতাশার না-না কাহিনিতে ওদের জীবনের গল্পে গল্পে মধুমিতার কথায় তুলির রঙ ছড়ায়। হাসপাতালে এলে সবাই নতুন করে নাকি ভুল-ত্রুটি রিভিউ করতে চায়। বড্ড আপসোস শুরু করার সুযোগ থাকে না আর শেষ বেলায়।
মধুমিতার সাথে একটা ঘটনায় ফিরি- সে দিন তুমুল বৃষ্টি তনুজার দেহে ব্যথানাশক একটা সুঁই ফুটোবে মধুমিতা (ইঞ্জেকশনকে তনুজার ভাষায় সুঁই সম্বোধন করা হয়) সপ্তাহে যে দিন সুঁই ফুটোনো হয় ঐ দিন তনুজাকে একটু বেশি সময় দেয় মধুমিতা, তারপর শুরু করে গালগপ্প। একদিকে বৃষ্টি অঝোরে ঝরছে, আরেকদিকে মধুমিতার আষাঢ়ে গল্প- ‘আর বলো না দিদা বৃষ্টি হলে মানুষের কী যে হয়! হাসপাতালে বুড়োরা বেডে পটি করবেই প্রকৃতির সাথে এ কেমন নিয়ম কে বলতে পারে? যে দিন বৃষ্টি হবে হাসপাতালে শুকনো চাদরের সংকট বাড়বেই। চাদর ভিজলেই আমাদের বকা শুনতে হয়। আজ যারা ডিউটি করবে টের পাবে! ভাগ্য ভালো আমার ডিউটি নেই এই বেলায়।
– কি সব আবোল তাবোল বকছিস। যা, তা।
– তুমি আবার এই কাজ করো বসো না!
মিতার মুখ টিপে হাসি পায়।
তনুজা ক্ষেপে যায়। বলে তোকে আর কাল থেকে আসতে হবে না! আমি নতুন নার্স রাখবো। ‘মধুমিতা দিগুণ উৎসাহে তনুজাকে ক্ষেপায়। এ নিয়ে কিন্তু পাঁচবার বিদায় হলাম। আর যেন ডাক না পাই। তাহলে আজকেই ফাইনাল। তনুজা চোখ রাঙায়। আজ শেষ গল্পটা শোনাই।
মাস ছয়েক আগের ঘটনা। হাসপাতালে এক রুগী ১২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রবেশ দ্বারের তিন নম্বর বেডে এডমিট হলো। দেখি ভিজিটিং আওয়ারে লোকে-লোকারণ্য। সেই সপ্তায় আমার ডিউটি ছিল ঐ ওয়ার্ডে। প্রথম দিন কোন মতে লোকজন সামলালাম। রুগী বেশ বয়স্ক মানুষ। তাকে দেখার জন্য লোক আসছেই। বানের ঢলের মতো কিছুতেই থামানো যায় না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে নিয়ে তৎপর হয়ে উঠলো তাদের ধারণা নিশ্চিত কোন গণ্যমাণ্য লোক। লোকজন কমে যাওয়ার পর তাঁর মুখে জানতে পারলাম উনি খুবই সাধারণ একজন ছাপোষা লোক। এতো লোক দেখে জানতে চাইলাম এরা করা? আপনার বংশ কী খুব বড়? বললো না এদের বেশিরভাগই তাদের বিপদেআপদে কোন না কোন সময় আমাকে পাশে পেয়েছে। আমি কারো বিপদ শুনলে ছুটে যেতাম। আজ আমি হাসপাতালে ওরা হয়ত শুনতে পেয়ে চলে এসেছে। আমি সত্যি বিব্রত, শেষ বয়সে অন্য রুগীদের সমস্যা করলাম। মজার ব্যাপার কী জান! উনি মারা যাওয়ার পর জানলাম সে নিঃসন্তান। একজন নিঃসন্তান মানুষের জন্য এতো মানুষ কাঁদতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। হাসপাতাল মানেই জীবন মৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখতে হয়। এর এক দিন বাদে আরেক রুগীর মৃত্যু হয়েছিল। তার ছিল দুই সন্তান কেউ আসেনি কেন আসেনি জানি না! হাসপাতালের বেডে জীবনটা সবাই রিভিউ করতে চায়।
তনুজা উদাস তাকিয়ে থেকে বলে মধু কথা দে আমার জীবন-মৃত্যুর গল্প কোথাও করবি না। তার আগে কথা দিন, আমার চাকরিটা… তনুজা হাসতে হাসতে বলে আচ্ছা রিভিউ করলাম।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>