| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

ঋত্বিক দেশভাগ ও ৭০

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের বিষয় যে, স্বাধীনতার সত্তর বছর পূর্তি দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি যন্ত্রণার সেই দিনগুলি কীভাবে ভোলা যায়! লক্ষ-কোটি মানুষ স্বজনহারা, গৃহহারা হয়ে পথে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ যেটা স্বদেশ রাত পোহাতেই সেটাই হয়ে গেল বিদেশ-বিভুঁই। ইতিহাসের এই মর্মান্তিক দৃশ্য এই উপমহাদেশের মানুষ দেখেছেন, বিশেষ করে বাংলার এবং পাঞ্জাবের। এক জায়গা থেকে রেলগাড়ি বোঝাই শবদেহ ছুটে গেছে একশো মাইল দূরে। সেখান থেকে আরেকটা রেলগাড়ি এসেছে, তাতেও অগণিত মানুষের কাটা হাত-পা মাথা। এই সব কথা কী করেই বা ভোলা যায়! কেউ-বা বলবেন, কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায়। বেদনায় যখন হৃদয় ভারী তখন অবধারিতভাবেই এসে যায় লেখক-শিল্পীদের কথা। তাঁদের সৃষ্টিকাজে ভাষা পায় আমাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা। আর কী আশ্চর্য এই হেমন্ত ঋতুতেই আশ্চর্য এক ত্রিভুজ নির্মিত হয়েছে। ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যান জীবনানন্দ, দস্তয়েভস্কি একজন নভেম্বরিয়ান আর ৪ নভেম্বর ১৯২৫ জন্ম ঋত্বিককুমার ঘটকের জন্ম।

এতদিনের অভ্যাসে দেশভাগের কথা উঠলে ঋত্বিকের প্রসঙ্গ এসে পড়া আমরা নিজেদের কাজকর্মের অন্তর্গত করেছি। তবে এটাও খুব দুর্ভাগ্যজনক যে, ঋত্বিকের ছবিতে আমরা দেশভাগের মর্মন্তুদ আখ্যান টুকুই খোঁজার চেষ্টা করলাম।

ঋত্বিকের সমসাময়িক আরেক দিকপাল জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (যিনি মেঘে ঢাকা তারা এবং কোমল গান্ধার ছবি দুটির আবহ সংগীত নির্মাণ করেছেন) এই বিষয়ে বলেছেন, দেশভাগ নিয়ে ঋত্বিকের কাজে নস্টালজিয়া আছে, আছে ফিক্সেশন আছে। কিন্তু ওই বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যে আধুনিকতার সংকটকে ঋত্বিক যেভাবে ধরেছে তা অবিস্মরণীয়। ঋত্বিক কী ভেবেছিল, সামাজিক সংগ্রাম, সংঘর্ষ পেরিয়ে কি স্বপ্ন সে দেখতো, নিজের সময়ের চেয়ে কত দূর এগিয়ে সে ভেবেছিল, শুধু ভাবা নয়, আঙ্গিক বিন্যাসে যে বৈপ্লবিক কাণ্ড-কারখানা করেছিল আমরা কী তা আজও ধরতে পেরেছি? এর পরেই জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সেই বিখ্যাত উক্তি, ঋত্বিক ঘটক আধুনিক সময়ে একজন অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ শিল্পী। শুধু ফিল্মমেকার নয়, আমাদের শিল্পভাবনাকে সে কয়েক যোজন এগিয়ে দিয়েছে। তার ছবির মধ্যে আনরিজলভড্ এবং অনুক্ত কতগুলি বিষয়বিন্যাস আছে। সচেতনভাবেই সেগুলো সে ঘটিয়েছে। এগুলো বার বার দেখতে হবে। বার বার বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এই সব প্রতীক বা বিন্যাস অভূতপূর্ব, অভাবনীয় এবং দারুণ বলিষ্ঠ।

মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার এবং সুবর্ণরেখা এই তিনটি ছবিকে প্রধানত দেশভাগ ত্রয়ী বা পার্টিশন ট্রিলজি বলা হয়। তা সত্ত্বেও বলতে হবে, ‘যুক্তি, তক্ক, গপ্পো’ ছবির একটা বড়ো সংকট এখানে যে ছবির প্রধান চরিত্র নীলকণ্ঠ বাগচী একটা প্লেসমেন্ট খুঁজছে। এই প্লেসমেন্টের অর্থ চাকরি বা গতানুগতিক জীবনে সেটলড্ হওয়া নয়, জীবনকে সে দেখতে চাইছে তার প্রশ্নগুলোর মধ্যে দিয়ে। তাঁর শিল্পভাবনার মধ্যে দিয়ে। দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন, পৃথিবীতে চিরদিনই কিছু মানুষ থাকে যারা মিলিয়ন নিয়ে ভাবিত নয়, বরং তাদের প্রশ্নের উত্তরগুলো নিয়ে তাদের যাবতীয় যন্ত্রণা, সমস্ত প্রচেষ্টা। বোম্বাই ছবির বড়ো বড়ো প্রযোজক, স্টার বার বার ছুটে এসেছেন ঋত্বিককুমার ঘটকের কাছে। কিন্তু নিজের শিল্প নিয়ে একচুল বোঝাপড়ার যেতে অনমনীয় মনোভাব দেখিয়েছেন তিনি। সমসময়ের উপেক্ষাকে সহ্য করেছেন। ‘পথের পাঁচালি’র আগেই ‘নাগরিক’ নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু সেন্সর বোর্ডের আপত্তিতে ঠিক সময়ে ছবিটি মুক্তি পায়নি! এসব সত্ত্বেও আজ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ওই কথাটি বার বার বলার সময় এসেছে, আধুনিকতাকে বুঝতে গেলে এই সময়ের সংকটকে বুঝতে গেলে যেসব চিন্তক, শিল্পীদের কাছে বার বার নতজানু হতে হবে, ঋত্বিক তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান।

সংগ্রমী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২৭ অক্টোবর ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত