| 8 মে 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

মহাকালের সাক্ষী

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comকয়েকদিন যাবৎ তাপমাত্রাটা একটু বেশি। চৈত্র পেরিয়ে বৈশাখের মাঝামাঝিতেও বৃষ্টির দেখা নেই। উত্তপ্ত রোদে কোনোকিছুই আর ভালো লাগছে না। এভাবে চললে মানুষ বাঁচবে কীভাবে? শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে কথাগুলো ভাবতে থাকে সৈয়দ ফিরোজ হোসেন। এই গরমে একটু স্বস্তি পেতে কত না আয়োজন। প্রতিদিন লাচ্ছি, কোল্ডড্রিংস, ঠান্ডা জাতীয় ফল, লেবুর সরবত, ডাবের পানি, খাবারের সঙ্গে শশা, লেবুসহ আরো কত কি! অফিসে, বাসায়, গাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। আর একটু বেশি টাকাওয়ালাদের খবরতো জানাই নেই। না জানি কত আয়োজন করে গরমে একটু স্বস্তি পেতে। সকাল থেকেই কথাগুলো ফিরোজ হোসেনের মাথায় কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। এ নিয়ে নিজের সঙ্গে চলছে কথোপকথন। বার বার হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবে। একই বলে ওঠে- ‘আমাদের ছোট বেলায় তো এত গরম দেখিনি। এত আয়োজনেরও দরকার হয়নি। চৈত্রের শুরুর দিকেই শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বেশি গরম পড়লে নদীতে সাঁতার কাটলেই কোথায় হারিয়ে যেত। এখনতো আধুনিক সব ব্যবস্থাও হার মেনে যাচ্ছে। কিন্তু যারা মাঠে কাজ করেন তাদের কি অবস্থা? এই তপ্ত রোদের চাদর গায়ে জড়িয়ে যারা নিয়মিত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন জীবনের সঙ্গে। তাদের এ যুদ্ধ কেবলই জীবিকার জন্য। ক’জনইবা ভাবে তাদের কথা। আমিইবা ভাবছি কেন? অবশ্যই এর মাঝে আমার কোনো স্বার্থ লুকায়িত আছে?’ আবার উত্তরও উচ্চারণ করেন নিজেই-হ্যাঁ, স্বার্থতো একটু আছেই। এই গরমে কোনো জীবনযোদ্ধাকে নিয়ে কোনো গল্প লেখা যায় কিনা। কারও জীবনের করুণ ইতিহাস তুলে ধরে বাহবা কুড়ানো যায় কিনা।’

 

সৈয়দ ফিরোজ হোসেন একজন জ্ঞান পিপাসু। ছোট বেলা থেকেই, যেখানে দু’টি মানুষের গল্পের আসর দেখছে সেখানেই হাটু গেড়ে হা করে বসে গেছে, ক্ষুধাতুর  দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেছে, নতুন কিছু জানা যায় কিনা, নতুন কিছু শেখা যায় কিনা। অন্য সকল কাজে অলসতা থাকলেও জানার আগ্রহে নেই বিন্দুমাত্র অলসতা। অবশ্য এজন্য বড়দের অনেক গালমন্দ সহ্য করতে হয়েছে। তবুও নতুন কিছু জানার নেশা শেষ হয়নি তার। ছোটবেলা থেকেই একটু একটু লেখার অভ্যাসও রয়েছে। তার লেখার ধরণ ভিন্ন। তিনি মানুষকে শুধু আনন্দ দেবার জন্যই লেখেন না। তার উদ্দেশ্য বাস্তবতা নিয়ে লিখতে হবে। লেখার মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং আমাদের সমাজের ধরণ পরিবর্তন করতে হবে। নতুন তথ্য নিয়ে লেখার জন্য অনেক জায়গায় ভ্রমণ করতে হয় তাকে। ভ্রমণ করতে বেশ ভালোই লাগে। আগের মত করে এখন আর সময় দিতে পারে না ভ্রমণে। চাকরিটা হবার পর থেকে সব কিছুতেই অনিয়মিত হয়ে গেছে সে। তবে সুযোগ পেলেই ভাবে। প্রত্যেক ঘটনার মাঝে তার গল্প খুঁজতে থাকে।  তাইতো এ খরতাপে শ্রমযোদ্ধাদের নিয়ে তার এ ভাবনা।

এবার অনেক আগ্রহ নিয়ে মাদারীপুরের চরমুগরিয়ায় এসেছে সৈয়দ ফিরোজ হোসেন। তার এক বন্ধু একটি অনাথ আশ্রম করেছে, সেই আশ্রমের সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হতে। প্রধানত নতুন কিছু জানার উদ্দেশ্যেই তার এই দীর্ঘ ভ্রমণ। এসে প্রথমে চরমুগরিয়ার পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা নিতে বেরিয়ে পড়লো ঘুরতে। বন্ধু সাগরকে সঙ্গে করেই বের হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে মসজিদ রোড ধরে এগিয়ে যায় দু’জনে। নদীর পারে পরিপাটি বন্দর এলাকা এটি। এখানকার পরিবেশ দেখে বেশ মুগ্ধ ফিরোজ হোসেন। একটু ভিন্নভাবেই যেন সাজানো এখানকার পরিবেশ। রাস্তাগুলোও চমৎকার প্ল্যানিংওয়েতে করা। পূর্ব-পশ্চিম বরাবর পাঁচটি রাস্তা। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর পাঁচটি রাস্তা। সবগুলোই স্ট্রেইট। একেবারে সোজা। উপর থেকে দেখলে মনে হবে একটা দাবার কোর্ট। বন্দরের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া নদীর চড়ে বানরদের দলবেঁধে খেলা করা, প্রাকৃতিক সরলতা, মানুষের সঙ্গে পরিবেশের নিবিড় সম্পর্ক, সব মিলিয়ে এক ভিন্ন অনুভূতি পায় ফিরোজ হোসেন। ঘুরে ঘুরে দেখছে আর একে একে নোট করে নিচ্ছেন সবকিছু। কোথাও কোনো শ্রম যোদ্ধা, বয়স্ক বা ব্যতিক্রম কোনো ব্যক্তির দেখা পেলে জেনে নিচ্ছেন তার জীবন সম্পর্কে। সঙ্গে থাকা ক্যামেরায়ও বন্দী করেছে অনেক ছবি। দিনের ক্লান্তি শেষে আশ্রমে ফিরে যায়।  রাতের খাবার শেষ করে বন্ধু সাগরের থেকে একে একে জেনে নিচ্ছে আশ্রমের সবার পরিচয়। জেনে নিলো (১৩০) একশত ত্রিশ বছর বয়সের আরতি দেবীর সম্পর্কেও। আরতি দেবী অদ্ভূদ এক মানবী। তিনি একমাত্র আশ্রমের মালিক সাগর ফরিদ ব্যতীত অন্য কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। সব সময় একলা বসে কী যেন ভাবতে থাকেন। আশ্রমের সকলেরই একটা আলাদা আগ্রহ রয়েছে এই আরতি দেবী সম্পর্কে। আজও পর্যন্ত কেউ কোন কিছু জানতে পারেনি তার সম্পর্কে- এমনকি আশ্রমের মালিক সাগরও না। তাই ফিরোজ হোসেনেরও কৌতূহল এই আরতি দেবীকে ঘিরে। একশত ত্রিশ বছর বয়স! জীবনে অনেক কিছু দেখছেন তিনি, অনেক কিছুই জানেন। তাকে নিয়ে এবার নতুন কিছু লিখতে হবে, এবার নতুন কিছু উপহার দেয়া যাবে পাঠকদের। ভাবে ফিরোজ। আবার পরক্ষণেই হৃদয় ভার হয়ে ওঠে। অনেক চেষ্টা করেও আরতি দেবীর সঙ্গে একটু কথা বলা সম্ভব হয়নি। সাগরও চেষ্টা করেছে। নিজের লেখক পরিচয় দিয়েও কাজ হয়নি। শুধু নির্বিকার তাকিয়েছে বার কয়েক। যতবারই তাকিয়েছে চোখে চোখ রেখেছে ফিরোজ। চোখের সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে মনের গহীনে। ওই মনে যে হাজার ইতিহাসের বাস তা স্পষ্টই বুঝতে পারে ফিরোজ হোসেন। এজন্যই যত সময় যাচ্ছে ততই এ মানবীর প্রতি আগ্রহ বেড়ে চলছে ফিরোজের। কিভাবে কথা বলা যায়? কোনো উপায়ন্তর খুঁজে পাচ্ছে না। কানো কথাই বলছে না আরতি দেবী। একটু কথা বললে কি এমন ক্ষতি তার? কিছু বলতে চায় না কেন? এর কী এমন রহস্য হতে পারে? তাহলে কি এবার ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হবে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমের কাছে আত্মসমর্পণ করে সে রাতের মতো।

দুই

দীর্ঘ ভ্রমণ ও এসে ঘোরাঘুরিতে খানিকটা ক্লান্ত ছিল হয়ত এজন্য অল্পতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় ফিরোজ হোসেন। ঘুমের ভেতরও যে আরতি দেবীর কথা ভুলতে পারেনি। স্বপ্ন ও বাস্তবতার দোলাচলে যখন সাঁতার কাটছে সেই মুহূর্তে কে যেন ঘরে প্রবেশ করে মনু (ফিরোজ সাহেবের ডাক নাম) বলে ডাকতে ডাকতে। ঘুম ভেঙ্গে যায় ফিরোজের। বুকটার ভেতর ধুক ধুক করছে। চেয়ে দেখেন আরতি দেবী তার সামনে বসে অছেন। ফিরোজ সাহেবের উদ্দেশে বলছেন, ‘কী জানতে চান অপনি? অমার জীবন রহস্য? আগে বলুন আপনার উদ্দেশ্য কী? আপনি কি সমাজটাকে পাল্টাতে চান? তাহলে কি আপনি সমাজের হাল ধরতে পারবেন? তা না পারলেও সমাজের সাক্ষী হয়ে তো থাকতে পারবেন। মহাকালের সাক্ষী। আমি অনেক ভেবে আপনার কাছে এসেছি। এবার আমাকে মুক্তি দিন। শুনুন আমার জীবন রহস্য…

‘আমি জমিদার গোপাল চন্দ্র বসুর একমাত্র কন্যা। আমার বয়স যখন ১০/১২ তখন একবার এক সন্ন্যাসী আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেন।  মহাজ্ঞানের ভাণ্ডার ছিলেন তিনি। আমাকে খুব আদর করতেন। আমি অতি আগ্রহে তার থেকে সব কিছু শুনতাম। জানা-অজানা অনেক ঘটনাই তিনি আমাকে বলতেন হঠাৎ দুর্গা পূজার আগের রাতে তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমার বাবা অত্যাচারি ও অন্যায়কারী জমিদার। আর অন্যায় বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী তোমার বাবারও ধ্বংস হবে। এবং আমি তোমার বাবার ধ্বংসের জন্যই এসেছি। আমি দুর্গা সাধক। মা দুর্গার নির্দেশেই আমি এখানে এসেছি। যা হবে তাও মায়ের আদেশেই হবে। আজ এই রাতেই একমাত্র তুমি ব্যতীত তোমাদের পরিবারের সকলের মৃত্যু ঘটবে, ধ্বংস হয়ে যাবে তোমার বাবার পাপের প্রাচীর। শুধু তোমাকে রেখে যাব মহাকালের সাক্ষী করে। তোমার বাবা অত্যাচারি তাই তার পতন হবে। এখন পৃথিবীতে কেউ অন্যায় করলে পৃথিবীতেই তার বিচার হয়। কিন্ত এমন একটা সময় আসবে যখন অধিকাংশ শাসকই হবে অন্যায়ের পথিক, ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে যাবে গোটা সমাজ, সমাজের সর্বত্র অন্যায়ে ছেঁয়ে যাবে। কিন্তু কারো কোনো পতন দেখা যাবে না। তখন মানুষ পাপের প্রতিযোগিতায় নামবে। অন্যায় করেও অন্যায় মনে করবে না। তখন মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে কিন্তু তারা বুঝবে না। এমন অনেক হাজারো ঘটনা দেখবে অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকবে, সাবধান কাউকে কিছু বলা যাবে না। ক্রমে পৃথিবী তিক্ত হতে থাকবে। পৃথিবীর এ তিক্ততা তোমার সহ্য হবে না তবুও বেঁচে থাকবে মহাকালের সাক্ষী হয়ে, ততদিন পর্যন্ত যতদিন উপযুক্ত কাউকে না পাবে।’

এরপর ভয়াবহ এক দুর্যোগ নেমে আসে আমাদের পরিবারে। তার কথা মতো চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে যায় আমাদের পরিবার। আমি পড়ে রইলাম তিক্ত এ পৃথিবীতে- মহাকালের সাক্ষী হয়ে। চোখের সামনে ঘটল অনেক ঘটনা-অঘটনা। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে নিজের থেকেই চলে যাই পরপারের দেশে। কিন্তু যেতে পারিনি। অনেক খুঁজেছি তাকে। কোথাও পাইনি। আজ সময় হয়েছে। মুক্তি দাও এবার আমায়…’

কোন কথা বলার সুযোগই পাননি ফিরোজ সাহেব। সকালে বিছানায় থাকতেই আরতি দেবীর মৃত্যু সংবাদ শুনে ভয়ে গা শিউরে উঠল তার। বারবার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না, রাতের ঘটনা সত্য না স্বপ্ন। তবে তিনি স্পষ্টই বুঝতে পারলেন গত রাত ছিল মহামূল্যবান সেই দূর্গা পূজার রাত। এরাতে হয়তো তিনি মহামূল্যবান কিছু পেয়েছেন অথবা হারিয়েছেন!

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত