অপ্রত্যাশিত প্ল্যান থেকে জন্ম নেয়া একটি নভেলা। তৃষ্ণা বসাকের ভাবনা।
সেদিন কয়েকজন সৃষ্টিশীল মানুষ আড্ডা দিচ্ছিলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, আড্ডার শেষে একটি সবুজ রুমালের দেখা মিললো। একটি রুমাল কে বিড়াল করে দেবার জাদু তো প্রবাদের মত। এখানেও হলো তাই হঠাৎ পাওয়া সবুজ রুমাল টি পেয়েই সব ওলটপালট হয়ে গেল একদল সৃষ্টিশীল মানুষের ভাবনায়।জাদুর মতোই কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ফেলে যাওয়া এক টুকরো রুমাল হয়ে গেলো ১২-ইয়ারি নভেলা ‘সবজে রুমাল রহস্য’।
পরপর লিখবেন ১২ জন। প্রথম পর্ব লিখলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় এবং শেষ করবেন তৃষ্ণা বসাক। মধ্যে থাকবেন ১০ জন যথাক্রমেঃ
সোনালি, তপশ্রী পাল, ব্রততী সেন দাস, নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত, নন্দিনী সেনগুপ্ত, শ্যামলী আচার্য, কৃষ্ণা রায়, ইন্দ্রনীল বক্সী, সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ দাস। আজ থাকছে ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের লেখা রহস্য নভেলার প্রথম পর্ব।
পর্ব -১
-আচ্ছা কোনো মানে হয়? আজকালকার ছেলেমেয়েরা নিজেদের জিনিস পত্রের কোনো খেয়ালই রাখেনা। সুচন্দ্রার শাশুড়ি ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলেন। ক্যালাস সব। মেয়েগুলোই এমন হয়। এটা তো লেডিজ রুমাল দেখছি। রঙখানি বেশ। ক্যাঁটক্যাঁটে সবুজ নয়। আবার এমব্রয়ডারি করে মনোগ্রাম করা। কি রুচিসম্মত! এমনটি এখানে পাওয়া গেলে আমাকে এনে দিও তো একটা। কত শখ করে কিনেছিল সে! অথচ রাখতে পারেনা। এই হচ্ছে আজকের প্রজন্ম। কোনও যত্ন নেই জিনিষে।
– সামান্য একটা রুমাল, বাবা রে বাবা। আপনি পারেন বটে, তিল কে তাল করতে। ছাড়ুন তো মা। ও আমি দেখা হলে দিয়ে দেবখন তাকে।
– বলি বুঝবে কি করে কার এটা?
– ও আমি বুঝে নেব ঠিক। আপনি প্লিজ মাথা ঘামাবেন না মা।
– ও বৌদি? কার উরমাল গো?
সে বাড়ির কাজের মাসী রুমাল কে আবার উরমাল বলে। তাকে দোখনে বলে খ্যাপান সুচন্দ্রার শাশুড়ি। কদিন আগেই আন্না পুজোর ছুটি চাওয়াতে একহাত নিয়েছেন শাশুড়ি মা। দোখনে বা দক্ষিণের সুন্দরবন সাইডের লোকেরা নাকি “র” উচ্চারণ করতে শেখেনা কিম্বা পারেই না। এই নিয়ে একদিন বিস্তর আর অ্যান্ড ডি হয়ে গেছে এবাড়িতে। মুখের অভ্যন্তরের ত্রুটি নাকি ইচ্ছাকৃত ভুল অথবা শিখবেনা বলেই তারা র বলে আসছে না জন্ম জন্মান্তর ধরে? শেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে সে যাত্রায় সুচন্দ্রা নিজের হাতেই বিচারের মানদন্ড তুলে নিয়েছিল সেদিন। ইতি টেনেছিল এহেন আলোচনার।
– তাতে কিই বা আসে যায় মা? আমাদের কাজ নিয়ে কথা।
সেদিন সন্ধেয় সুচন্দ্রার ড্রইংরুম আলো করে জড়ো হয়েছিল ফেসবুকের বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। তারাও চলে গেল আর বাড়িতে শুরু হয়ে গেল তুমুল রুমাল উপাখ্যান।
– আচ্ছা, রোমালখানায় কি মোনোগ্রাম আছে বলতো?
সুচন্দ্রার হাজব্যান্ড বাড়ি ফিরে বললেন। তিনি আবার রুমাল কে চিরকাল রোমাল বলেই কাটিয়ে দিলেন।ততক্ষণে সে রুমাল ধুয়ে কেচে সুচন্দ্রা চোখের আড়াল করে ফেলেছে। কিন্তু সে নিজেও ভুলতে পারছেনা ঘরময় সেই গন্ধটা। হ্যাঁ সেটা নির্ঘাত রুমালেরই গন্ধ ছিল।
– তুমিও ঠিক তোমার মায়ের মত। গোয়েন্দাগিরি না করলে ভাত হজম হয়না তোমাদের। সুচন্দ্রা বলল।
– আহা! বোঝোনা কেন? পুজোর পর তিনি এসেছিলেন নতুন রোমাল খানা নিয়ে। হারিয়ে ফেলে কি মনখারাপটাই না হবে তার, সেটা ভাবছনা একবার?শখের জিনিষ বলে কথা।
– আরে বাবা, যার হারিয়েছে সে চুপ। সেদিন দেখামাত্রই যারা যারা এসেছিল তাদের হোয়াটস্যাপে জিগেস করেছিলাম। সবাই নিরুদ্বিগ্ন, নিরুত্তাপ। তোমাদের এই হয়েছে এক। যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়াপড়শীর ঘুম নেই।
সবাই আড়াল হতে সুচন্দ্রার স্বামী বউকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, মনে আছে আমাদের সেই রোমাল কাহিনী?
-হ্যাঁ মশাই। “বুকের মধ্যে গন্ধ রোমাল নিয়ে, দাঁড়িয়েছিলে বাসস্ট্যন্ডে গিয়ে” মনে আবার নেই? যা কাব্যির ঘটা ছিল আমার হবু বরের! সুচন্দ্রা হেসে ওঠে। যাক! তবু ভালো। আমার বন্ধু তার রুমালটা ফেলে গেল বলে বহুদিনের থিতোনো প্রেমটা উথলে উঠল।
– আরে যা বলছিলাম। রোমালের মোনোগ্রামটা কি ছিল যেন বলছিলে তুমি?
এন.এম। তাই তো? কে এসেছিল ঐ নামে তোমার বন্ধুরা? তাহলেই তো প্রব্লেম সল্ভড।
সুচন্দ্রা বলল,
– তুমি কি জানোনা? আমি কাল অনেক ভেবেছি মশাই এই নিয়ে। মেলা ফ্যাচফ্যাচানি বন্ধ কর এই রুমাল নিয়ে। আমি সিক অ্যান্ড টায়ার্ড এই রুমাল নিয়ে। নামের আদ্যক্ষর কারোর অমন নেই। একজন এসেছিল নন্দিতা কিন্তু তার পদবী রায়।
– আচ্ছা উল্টোটাও তো হতে পারে?
– মানে ম দিয়ে নাম আর ন দিয়ে পদবী? এক ঝটকায় ফোন খুলে হোয়াটস্যাপ দেখে শিওর হয়ে নেয় সুচন্দ্রা।
নাহ্! মীনাক্ষী আছে বটে কিন্তু সে মুখার্জী।
– তবে? কি হতে পারে?
– নাও এবার এক ঝটকায় শ্মশানে নিয়ে গিয়ে ফেলে দাও। এন এম মানেই নমো তে…কারেন্ট হট টপিক তো তিনিই।
মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে সুচন্দ্রার স্বামী বললেন,
– হে হে বেঁড়ে বলেছ। যার যা কিছু সবেতেই উনি । মানে আমাদের নমোই কারণ, নমোই ফল।
– শোনো, আমি জানিনা, জানতে চাইও না। সামান্য একটা রুমাল নিয়ে… তবে জানো কেমন যেন মাথা ঝিমঝিম করা গন্ধ লেপটে আছে ঐ রুমালটায়। ঠিক যেন ছাতিম ফুলের মত। সেটা ভুলতে পারছিনা কিছুতেই।
– একবার চোখের দেখা যদি দেখতে পেতাম… আচ্ছা মেল না ফিমেল পারফিউমের গন্ধ? জোভান মাস্ক না আফটার শেভের মত? মাইল্ড না স্ট্রং ?
– উফফ বাবা রে! আমি গন্ধ বিশারদ নই । তা বলতে পারব না। কেচে তুলে রেখেছি। অন্যের জিনিষ। দেখা হলে দিতে হবে।
সেদিন রাতে ডিনার সেরে ঘরে যেতেই আবারো এসে পড়ল আজব সেই রুমাল প্রসঙ্গ। বেডরুমের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকল রুমালের অচেনা গন্ধটা। অবশেষে ব্যাগের মধ্যে রেখে দেওয়া রুমালখানি সুচন্দ্রা বের করে ফেলল।
– তার মানে তুমিও বেশ দ্বিধাগ্রস্ত এই রুমাল নিয়ে, কি বল গোয়েন্দাগিন্নী ? মুখে যতই বল ভাল্লাগছেনা আসলে খুব কিউরিয়াস তুমিও।
– মোটেও না, তুমি মাথা খেয়ে নিচ্ছ তাই। ব্যাগের মধ্যে রেখেছি কারণ বন্ধুদের দেখা হলে দিয়ে দেব তাই।
প্রায় ছিনিয়েই নিলেন রুমালখানা তিনি সুচন্দ্রার হাত থেকে। ব্রিলিয়ান্ট কালার এন্ড টেক্সচার। এ দিশী প্রডাক্ট হতেই পারেনা। তোমার কোন বন্ধু কবে বিদেশ থেকে ফিরেছে বলতো?
– জানিনা, জানতেও চাইনা। তাহলে তুমি তোমার জিম্মায় রেখে দিলে কিন্তু। আমার কাস্টডিতে রইল না ঐ সবুজ রুমাল।
– আরে! কোণায় এটা কি লেখা? এটা তো কোনো মোনোগ্রাম নয়।
– কই দেখি? সেদিন আমি যে দেখলাম…সুচন্দ্রা বলে
– ভুল দেখেছ, মনে হচ্ছে মিশরের হায়ারোগ্লিফিক লিপি শ্যাটিনের ওপর মেশিনে এমবস করা ।
– ও হ্যাঁ, তাইতো। সেদিন তাড়াহুড়োয় ভুল দেখেছি তবে। সেদিন এক ঝটকায় দেখে তেমনি মনে হয়েছিল।
সুচন্দ্রার ইন্টারেস্টের লেখচিত্রটি যেন হঠাত করেই উত্তুঙ্গে ওঠে এবার। মনে মনে ভাবে সে। ছিল রুমাল, হয়ে গেল রহস্য।
রুমালটি কে ভালো করে পরীক্ষা করছিলেন সুচন্দ্রার স্বামী।
– না, না মিশরের নয় এটা আমাদের হরপ্পার চিহ্ন মনে হচ্ছে। দ্যাখ দ্যাখ, পুরো রুমালের চার কোণা বর্ডার জুড়ে এমন সেলাই করা। কি সব লিপি এগুলো?
– মানে সিন্ধুসভ্যতার ব্রাহ্মী লিপি বলছ? আমি দেখি ভালো করে।
– হ্যাঁ, তুমি তো হিস্ট্রির লোক । ভালো বুঝবে।
– কিন্তু সে তো পড়াই যায় নি এখনো। আমাদের এক স্যার বলতেন ওটা সিন্ধু সভ্যতা নয়। সরস্বতী সভ্যতা। কারণ সরস্বতী আরও অনেক বড় নদী যার তীরে গড়ে উঠেছিল এটা। স্ক্রিপ্ট টা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।
– কিন্তু কথা হল এমন এক রুমাল কে পেল আর কোথা থেকে পেল?
– আরে ডিজিটাল যুগে ডিজাইন প্রিন্ট করতে কতক্ষণ? তারপর মেশিনে সেলাই।
– তা অবিশ্যি ঠিক । চায়নার মালে বাজার ছেয়ে গেছে। ওরা কপি আর পেস্ট করতে ওস্তাদ।
– তবে চায়নার তোয়ালে তে জল শোষে না কিন্তু । অসহ্য, বিরক্তিকর টাওয়েল। সেই সেবারে কিনলাম না গড়িয়াহাট থেকে একটা? কিন্তু এই রুমাল টা বেশ দামী কটনের। ধুতে গিয়েই বুঝলাম গো।
– গুড অবজারভেশন।
– কিন্তু সেটা আমাদের বাড়িতে কে নিয়ে এল সেটাই এই মুহূর্তে মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন।
-তবে তোমায় একটা কথা বলতে ভুলে যাচ্ছি বারেবারে। এই রুমাল খানা হাতে পাওয়ার পর থেকে কেমন সব অদ্ভূত কান্ড ঘটছে বাড়িতে একের পর এক।
-মানে? আগে বলবে তো?
-না, তেমন কিছু নয় তবে আবার ফেলে দেবার মতোও নয় কিন্তু। তুমি সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকো…কাজের কথা বলতেই রাত ফুরোয়। মাথাতেও আসেনি। এখন ভাবছি এসব।
– যেমন?
-দেখ আমার ফোনে রোজ দুপুরে একটা মিসড কল আসে। ট্রু কলার দিয়ে দেখছি স্প্যাম নাম্বার। তাই ধরিনা আমি।
– এক নাম্বার থেকে রোজ ফোন আসছে?
-হ্যাঁ গো
-তা ধরলেই তো পারো একবার। দেখোই না কি বলছে ও প্রান্তের মানুষটা।
-তুমি যে স্প্যাম কল এড়িয়ে যেতে বল?
– সময় বিশেষে ধরতে হবে বৈকি। ভয় পেলে চলবে? তেমন হলে পুলিশের সাইবার সেলে জানাতে হবে। কোত্থেকে এমন অচেনা ফোন আসছে আর সে কিই বা বলতে চাইছে।
– তা ঠিক।
শোনো কাল তাহলে তুমি যখন বাড়ি তে আছো তখন সেই ফোনটা এলে আমি ধরব। না তুমি ধরবে?
– না না ওরা তোমাকে ফোন করেছে যখন তুমিই ধরবে। আমি কেন? শুনে নাও অ্যাটলিস্ট কি বলতে চাইছে।
কি আশ্চর্য! সেজেগুজে রইল বসে সুচন্দ্রা আর তাপসবাবু। কিন্তু কোনো ফোন আসেনি সেদিন সেই স্প্যাম কলারের। ছুটির দিন পেরিয়ে ব্যাস্ততার উইক শুরু হতেই আবার দুপুরে ঠিক এক সময়ে সুচন্দ্রার ফোনটা বেজে উঠল। তার মানে কলার জানে তাপস আজ বাড়ি থাকবে না, তাই ফোন করল? অথবা সেদিন সেই কলারের ছুটি ছিল হয়তবা। তবে ফোনের তো আর ছুটি ছিলনা। সুচন্দ্রা ফোনটা ধরল না রোজদিনের মত। আর থেমে যেতেই সে ঐ নম্বরে ফোন ঘোরাল। স্প্যাম কলার প্রস্তুত থাকবে না। কি বলে সেটাই দেখবে সুচন্দ্রা। কিন্তু সেই নম্বরে ফোন যায়না। কারণ ইনকামিং হয় না জানালো ফোন কোম্পানি। অর্থাত একমুখী ফোন লোকটার। শুধুই আউটগোয়িং ফেসিলিটি সেই নম্বরের।
পরদিন সুচন্দ্রা ফোনটা ধরেই ফেলে। কিন্তু কোনো লাভ হল না। ওপার থেকে যে পুরুষ কন্ঠ শোনা গেল তা দুর্বোধ্য ভাষায়। কি যে করে এই ফোন কোম্পানিগুলো! নাম্বার গুলো নেয় নিয়ে অন্যকাজে লাগায়। জ্বালাতন। কত প্রডাক্টের প্রোমোশান হয়। সেলসম্যান দুচার পয়সা কমিশন পায় প্রতি নাম্বারে ফোন ঘুরিয়ে। সমবেদনা জানায় সুচন্দ্রা মনে মনে।
সেদিন তাপস বাড়ি ফিরতেই সুচন্দ্রা জানালো।
তাপস বলল,
-বাই দ্যা ওয়ে ঐ রোমাল বাড়িতে আসার পর থেকে আর কি কি ঘটনা ঘটেছে জানালে না যে।
-রুমালটা ঠিক সেদিনই বাড়িতে এসেছিল কিনা সন্দেহ আছে। আমার বন্ধুরা আসার আগেই হয়ত অন্য কেউ রেখে দিয়ে গেছে কিম্বা ফেলে রেখে গেছে।
-তাও হতে পারে অবিশ্যি।
-জানো? মনে পড়ে গেল সেই ঠগীদের কথা। রুমাল না কি যেন কাপড় গলায় পেঁচিয়ে ওরা মানুষকে মেরে ফেলত? হ্যাঁগো তেমন কারোর দুরভিসন্ধি নেই তো? ভয় করে আজকাল। যা দিনকাল পড়েছে।
-আবার ভালোটাও ভাবো একবার। তাপস বললেন। সেই সিকিমে আমরা কোন একটা মনাস্ট্রিতে গেছিলাম। সেখানে একটা বিশাল রুমাল কিনলে তুমি মনে পড়ে? ওরা সেটাকে সেক্রেড রুমাল বলে। যে কোনো শুভ কাজে গেলে সেই রুমাল কে সঙ্গে রাখলে কার্যসিদ্ধি হবেই, বলেছিল না?
-হ্যাঁ, ওদের সব সেক্রেড চিহ্ন আঁকা রুমালে। তবে সেটা নিয়ে গিয়ে সেবার তোমার ছেলের স্কুল এডমিশন বরং আটকে গেছিল। সেটাও মনে আছে। তারপর থেকে আর নিই নি কোনোদিন। তুলে রেখে দিয়েছি জন্মের মত আলমারীর এক কোণে। টুবুর লটারীতে নাম ওঠেনি ক্যালকাটা বয়েজের ক্লাস ওয়ানের এডমিশনে। তাই আমার এসবে আর বিশ্বাস হয় না মোটে।
-রোমাল কিন্তু সাঙ্ঘাতিক জানো তো?
-মানে?
-চোখমুখের ময়লা সাফ করতে বা কান্নার জল মুছতে আবিষ্কৃত হয়েছিল। তাই রোমাল কাউকে গিফট করতে নেই। দুঃখ ডেকে আনে। তায় আবার অচেনা রুমাল।
-বাবা এসব শুনলে আমার এক্ষুনি ঐ রুমাল কে বিদায় করতে ইচ্ছে করছে। কিসে কি হয় কে জানে বাবা।
তবে সেদিন মায়ের বহুদিনের লিটিগেটেড মামলাটার কিন্তু নিষ্পত্তির খবর পেয়েছি আমরা। ঐ সবুজ রুমালটা বাড়িতে আসার পরেই।
-হ্যাঁ অবশেষে আমাদের পুরনো বাড়ির ভাড়াটে উঠে যাচ্ছে। আমরা জিতেছি ফাইনালি। এটা নিঃসন্দেহে একটা গুড নিউজ।
-আচ্ছা টুবুর জব অফার টা কবে পেল বলতো?
-মনে পড়ছে না ঠিক তবে রুমাল আসার আগে সেটা।
-আহা! রুমাল টা হয়ত কেউ অনেকদিন আগেই রেখে গেছে আমাদের বাড়িতে। তারপর থেকেই একটার পর একটা সুখবর আসছে বাড়িতে। ডু নট বি সো নেগেটিভ সুচন্দ্রা।
-মিনিমাম তিনটে পয়েন্টে গ্রাফ টানতে হয় শুনেছি। মোটে দুটো হল সবে।
-আচ্ছা, দ্যাট রিমাইন্ডস মি। হরিয়ানা থেকে সেই ছেলেদুটো গতবার শীতের আগে এসেছিল না? কি সব শীতের জামাকাপড় বিক্রি করতে? ওরা ফেলে রেখে যায়নি তো রোমাল টা?
-উরিব্বাস্! কি সাঙ্ঘাতিক কোরিলেশন! সিন্ধুসভ্যতা…ব্রাহ্মীলিপি খোদিত রুমাল আর ফাইনালি হরিয়ানা…আমাদের রাখীগারি..হ্যাঁ, সেই ছেলেদুটো এসেছিল রাখীগারি থেকে।
– আমি ভাই হিস্ট্রিতে বরাবর কাঁচা ছিলাম। ভাগ্যিস ইতিহাস বিশারদ বউ এনেছিলাম।
– থামো তো। সব ভুলে মেরে দিয়েছি এখন।
-তার মানে হরিয়ানার ছেলেদুটই ভুলে ফেলে গেছিল তবে। আমাদের আবাসনে প্রচুর গরম জামাকাপড় বিক্রি হবার আনন্দে।
– দাঁড়াও। আমাদের ওপরের ডাঃ মিত্র কে ডাকি একবার। উনি তো ইতিহাসের অধ্যাপক। যদি কিছু আইডিয়া দেন। সুচন্দ্রার চোখ চকচক করে ওঠে রুমাল রহস্যে যদি কেউ আলো ফেলেন সেই আশায়।
অধ্যাপক মিত্র এলেন পরদিন সন্ধেয়। চা পর্বের পর সবুজ রুমালের সেই লিপিগুলি দেখামাত্রই তিনি চমকে উঠলেন। কোথায় পেলেন এই রুমাল? কে দিল আপনাদের… এইসব আলাপচারিতার শেষে তিনি যা বললেন তা এরকম।
“আমরা ছোট থেকে শুনে আসছি হরপ্পা ও মহেঞ্জোদরো তে সিন্ধুসভ্যতার চিহ্ন দেখা যায়। কিন্তু এই সভ্যতার বিস্তার সিন্ধুনদের বহু দূর অবধি ছিল। সেই যুগের সবচেয়ে বেশী এবং বৃহত চিহ্নগুলো খুঁজে পাওয়া যায় রাজস্থানের কালীবঙ্গান আর হরিয়ানার রাখিগারিতে। গুজরাটের লোথাল আর ধোলাবীরাতেও তো কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় জানেন তো? কিন্তু এই সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল বেদে উল্লিখিত সরস্বতী নদী যেটি জিওলজিক্যাল কারণে জমির উত্থানের ফলে হারিয়ে যায় এবং যার পুরনো জলপথ এখন দেখা যায় ঘাগগর বা হাকরা নদীর দুকল জুড়ে। সরস্বতীর জল যমুনা ও শতদ্রুতে ঘুরে যাবার ফলে সেটি শুকিয়ে যায় এবং সেটি এখন শীর্ণকায় অবস্থায় ঘাগগর নামে পরিচিত। এই শুকনো নদীপথের আশেপাশেই ছড়িয়ে আছে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার নিদর্শন ”
-হ্যাঁ, আমিও বলছিলাম ওনাকে সেদিন। আমাদের ইউনিভার্সিটিতেও হিস্ট্রির স্যার এমনটাই বলতেন। আপনি চিনবেন হয়ত। ডাঃ ত্রিদিবেশ সান্যাল।
-আরে! আমি তো ওনারই ছাত্র। স্যার কিছুদিন আগেই মারা গেলেন। সিন্ধুনদের তীরে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা কে উনি সরস্বতী সভ্যতা বলতেন।
কিন্তু ডাঃ মিত্র, এই রুমালের এই আঁকিবুঁকির সঙ্গে সিন্ধুলিপির কি কোন যোগসূত্র পাচ্ছেন আপনি?
– আরে এই লিপি থেকেই তো ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে আমাদের বাংলালিপি। সিন্ধুলিপি বিবর্তন থেকেই ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভব হয়। ভারতবর্ষের প্রাচীনতম ও বহুল প্রচলিত লিপি ছিল একসময় । কখন উদ্ভব হয়েছিল এ লিপির, তা সঠিক জানা যায়নি এখনো। এ লিপির নাম ঠিক কি কারণে ব্রাহ্মীলিপি হল, তাও সঠিকভাবে বলা যায় না। কারো মতে ব্রহ্মা থেকে প্রাপ্ত বলে এ লিপির নাম ব্রাহ্মী। আবার কেউ বলেন প্রাচীন ব্রাহ্মণদের লিপি তাই এমন নাম।
জেমস প্রিন্সেপ মানে যার নামে আমাদের গঙ্গার ধারে প্রিন্সেপ ঘাট তিনি একজন ব্রিটিশ পন্ডিত ছিলেন। প্রিন্সেপ ব্রাহ্মী পাঠোদ্ধার করতে পেরেছিলেন । আর এই ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্টের সূত্র ধরেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাচীন লিপিসমূহের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়।
পরের অংশ আগামী শনিবার…
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।