উৎসব সংখ্যা: শকুন্তলা চৌধুরী’র কবিতা
কলকাতা
কাঁধে ব্যাগ, হাতে পেন, চোখে স্বপ্নরা
পথ খুঁজে নেয়, আর লিখে যায় নাম।…
কলকাতা, মদালসা, ভুলে গেছো বুঝি –
একদিন এ’ শহরে আমিও ছিলাম?
গুণগুণ ধুন তোলা গীটারেতে গান,
উড়েছে শব্দ কত কফির কাপেতে
পারিজাত ফুল ওড়া সেই সন্ধ্যায় –
সুনীল, মৃণাল, রায় আর শাঁওলীতে।
পুজোর নবমী তিথি – ভীড় গমগম
পথ দিয়ে হেঁটে ঐ ফুচকার মোড়,
মাইকে বেজেছে “আমি এক যাযাবর…”
নতুন আলোতে মোড়া স্বপ্নের ঘোর।
কত পথ ঘোরা হল, তবুও সেই
পুরোনো পথের পাশে ঘুম ভাঙে।
শহীদমিনার আর হাওড়াব্রিজ ছুঁয়ে,
সূর্য আজও দেখি পাটে নামে।
পথও থাকেনি থেমে, গেছে এঁকেবেঁকে –
নতুন সঙ্গী নিয়ে জ্বালিয়েছে আলো।
স্বপ্নে, ঘুমের ঘোরে, সব গেছে মিশে –
আজকে তাকিয়ে দেখি ক্যানভাস কালো।
দুই গ্রহে চলে গেছে কবে যেন তারা –
একসাথে বসে যারা লিখেছিল নাম।…
কলকাতা, মদালসা, ভুলে গেছো বুঝি –
একদিন এ’ শহরে আমিও ছিলাম?
নতুন কবিতা
একদিন তুমি তাদের কবিতা লেখো –
যাদের উঠোনে আল্পনা পড়েনা তো,
যাদের দুয়ারে পাল্কি থামে না এসে,
যারা লড়ে, হারে, তবু চলে যায় হেসে।
একদিন সেই গাছেদের কথা বলো –
যাদের শিকড় বন্ধ খাঁচার ফাঁকে,
আলোহাওয়া-হীন আবর্তে এঁকেবেঁকে,
ইঁট কাঠ ফুঁড়ে হঠাৎ আকাশ ছুঁলো।
একদিন তুমি সজাগ দু’চোখ তুলে,
দেহলী পেরিয়ে, বারেক তাকিয়ে দেখো –
অবাক পৃথিবী দু’হাত রাঙিয়ে লালে,
শ্মশানে দাঁড়িয়ে নেচে যায় অবিরত।
একদিন তুমি তোমার কলম হাতে,
সাদা খাতা নিয়ে ঘুমভাঙানিয়া ভোরে,
নেমে এসো পথে সাজানো বাসর ছেড়ে –
নতুন কবিতা লেখো ধুলোকাদা মেখে!
স্বপ্নের রঙ
রঙীন বেলুন বিকিয়ে ঘরেতে ফেরা।
কোভিড নিয়েছে বাবাকে, মায়ের সারা
দিন কেটে যায় ছ’বাড়ী বাসন মেজে।
দিদিটা কেবল বিকেল হলেই সেজে
বসে থাকে ঐ খোলা গলিটার মুখে –
পচাদা’ আসবে সিনেমায় নিয়ে যেতে।
বই, খাতা, পেন মাখছে আশার ধুলো –
রাত কেটে গেলে, যদি ঘরে আসে আলো!
রঙীন আলোর রোশনাই তুলে পথে
আসবে দোসর, রাখবে সে হাত হাতে।…
পণের টাকাটা এখনও হয়নি জমা,
কলেজে পড়ার স্বপ্নও ভাঙা ভাঙা –
পারেনা জমতে ঠিকমতো কিছু আর,
ভেঙে ভেঙে শেষ পয়সা রাখার ভাঁড়।
বাবা চলে গেছে ফুটো নিয়ে এক হার্টে,
দোকান চালিয়ে সাদা-কালো দিন কাটে।
ঝলমলে রঙা ফ্ল্যাটবাড়ী হল শেষ –
টাকা হাতে নিয়ে মালিক নিরুদ্দেশ।
মজুরের কাজে দিয়ে দিল ফের ছুটি –
ঘরে চার পেট…দিতে হবে দু’টো রুটি।
হাজার মাইল পার হয়ে গ্রামে ফেরা –
রুক্ষ্ম-শুষ্ক আলপথে জমে খরা।
জমিটা কবেই দেনাদারদের হাতে…
আলো নেই ঘরে নিকষ কাজল রাতে।
তসরের গায়ে রঙীন নক্সীকাঁথা
সপ্তাহে দু’টো, হাতে শুধু ছ’শো টাকা
ছুঁইয়ে মালিক পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়ী।
হাজারে বিকোবে নতুন স্টাইল শাড়ী
দেশবিদেশের বাবু-বিবিদের ঘরে।
মাটির এই ঘর শুধু গুমরিয়ে মরে।
রঙীন সুতোর গুটলিরা কোণে জমা –
আজকে কালোয় জীবনের কাঁথা বোনা।

জন্ম কলকাতায়, বড় হয়েছেন বি. ই. কলেজ ক্যাম্পাসের প্রফেসরস্ কোয়ার্টারে। পড়াশোনা কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিয়ে এবং তথ্যবিজ্ঞানে পিএইচডি করার সূত্রে বিদেশগমন। কর্মসূত্রে বর্তমানে পরিবারসহ আমেরিকার মিশিগান প্রদেশের বাসিন্দা। ছোট বয়স থেকেই লিখতেন। মধ্যবর্তীকালে বহুদিন বন্ধ থাকলেও, সম্প্রতি কাজের ফাঁকে আবার লেখা শুরু করেছেন।এই চার-পাঁচ বছরেই ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও বাংলাদেশের বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শকুন্তলার কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস — সানন্দা, বাংলালাইভ, বাংলা ওয়ার্ল্ডওয়াইড, সাহিত্যকাফে, বাতায়ন, ইরাবতী, পরবাস, SETU ইত্যাদি তাদের মধ্যে কয়েকটি নাম। শকুন্তলার লেখা কবিতাকে গানের ভিডিও হিসাবে পরিবেশন করেছেন শ্রীকান্ত আচার্য, নচিকেতা চক্রবর্তী, রূপঙ্কর বাগচী, কায়া ব্যাণ্ড। ২০২২-এ প্রকাশিত শকুন্তলার উপন্যাস যাদব–কন্যা পাঠকমহলে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে – সাপ্তাহিক বর্তমান বইটির একটি সমালোচনা প্রকাশ করেছেন ২৯শে জুলাই, ২০২৩ সংখ্যায়। ২০২৩-এর পুজোয় প্রকাশিত হয়েছে শকুন্তলার নতুন সামাজিক উপন্যাস অহল্যার চিঠি – বইয়ের ভূমিকাতে লেখিকা ও তাঁর লেখা নিয়ে শ্রী অশোক বিশ্বনাথন্ একটি সুন্দর আলোচনা করেছেন।