| 26 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: খিচুড়ি না মেনেমান । সংগ্রামী লাহিড়ী 

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

সেবার অগাস্ট মাসের শেষ উইকএন্ডে আমেরিকার দক্ষিণদিক থেকে ধেয়ে আসা সাইক্লোন বেশ শোরগোল তুলে দিল। এমনিতেই অগাস্ট থেকে অক্টোবর হারিকেন সিজন। গরমের চোটে আটলান্টিক সমুদ্রের জল তেতে ওঠে। কে না জানে যে সমুদ্রের গরম জলই হারিকেন, সাইক্লোনের জ্বালানি! সেবার গরমটাও পড়েছিল বটে! বাড়িতে বাড়িতে এসি ফেল মেরে যাচ্ছে। তার সঙ্গে এসে জুটল ‘এল নিনো’র কারিকুরি।  দুয়ে মিলে তৈরী হল একেবারে দু-দুটো শক্তিশালী ঝড়, পাশাপাশি। একসঙ্গে এসে আছড়ে পড়বে আটলান্টিকের তীরে। আর তাতেই জন্ম নেবে ‘বম্ব সাইক্লোন!’ বোমার মতোই নাকি তা ফেটে গিয়ে বৃষ্টির পাহাড় ঢালবে। ফ্ল্যাশ ফ্লাড, মানে হড়কা বান নেমে আসবে যত্রতত্র।

ক্ষণে ক্ষণে সেই যমজ ঝড়ের  প্রকৃতি বদলাচ্ছে, গতিপথ বদলাচ্ছে। হাওয়া আপিসের কর্তারা চূড়ান্ত দোলাচলে। কী যে প্রেডিকশন করবেন, ঠিক বুঝে পাচ্ছেন না। একবার বলেন “দুদিন টানা বৃষ্টি, আশি মাইল স্পিডে ঝড়”, পরক্ষনেই “না না তিন দিন, সত্তর মাইল!” একই সঙ্গে বলতে ভুলছেন না, “subjected to change”, তার সোজা মানে হল, ‘আমি যা বলি, তাতে বিশ্বাস কোরো না।’ জনগণ ধন্দে পড়েছে। নিউ জার্সির গভর্নর কী করবেন ভেবে না পেয়ে রাজ্য জুড়ে ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করে দিলেন। থাকুক সবাই বাড়ি বসে। ওরকম মারাত্মক হাওয়া আর বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানো মানেই তো অ্যাক্সিডেন্ট! দুটো ট্রাফিক লাইটের মধ্যে হাফ ডজন গাড়ি স্কিড করে যাবে। উদ্ধার করতে পুলিশকে দৌড়োতে হবে। তারাই বা আর কত পারে? তাদেরও তো বাড়িঘর, বালবাচ্চা আছে, না কি? উইকএন্ড হয়ে বরং একটু সুবিধে হয়েছে। কাজের দিন নয় যখন, থাকুক সবাই বাড়িতে।

সাইক্লোন এসে আছড়ে পড়ার ঠিক আগে আগে শ্যামদার ফোন এল। স্ক্রিনে তাঁর নাম দেখে একটু চমকেই গিয়েছিলাম। বড্ড টালমাটাল সময় পেরিয়ে এলেন বর্ষীয়ান মানুষটি। জীবনসমুদ্রের সাইক্লোন। তার ধাক্কায় তরী টলোমলো। তবুও হাল ছাড়েননি, শক্ত হাতে স্টিয়ারিংটি ধরে থেকেছেন। কালের নিয়মেই একসময় থেমে গেছে ঝড়, নৌকা এসে ভিড়েছে তীরে। তবু সব কিছু তো আর আগের মতো নেই! আমরা, মানে তাঁর কাছের মানুষরা তা জানি, তাঁর প্রাইভেসিকে সম্মান করি। তাই হঠাৎ করে তাঁর ফোন দেখে একটু অবাক।

ভরাট, পরিচিত গলার ডাক ভেসে এল, “উইকএন্ড ক্যাম্পিং করবে না কি?”

“সে কী? এই বোমা সাইক্লোনের মাঝে ক্যাম্পিং?” আমি হাঁ।

“হ্যাঁ, আমার বাড়িতে। শোয়ার জন্যে ঘর পাবে, সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ। আর টার্কিশ কুইজিনের রান্না। আমি রাঁধব।”

“টার্কিশ খাবার? ধুস! এমন বৃষ্টিতে ঘরবন্দী থাকলে খিচুড়ি খেতে হয়। খিচুড়ি আর পাঁপরভাজা।” আমি প্রত্যয়ী।

কান দিলেন না।

“মেনেমান (menemen) খেয়েছ? এসো, খাওয়াব। জানালার ধারটিতে বসে বৃষ্টি পড়া দেখতে দেখতে গরমাগরম মেনেমান টেস্ট করবে। রাঁধুনি এই শ্যাম শর্মা!”

ফোন রেখে দিলেন। বরাবরই কম কথার মানুষ, এখন তো আরোই নিভৃতের বাসিন্দা।

এবার আমি দোলাচলে। শ্যামদার রাজপ্রাসাদ-তুল্য বাসস্থানটি নির্জন জঙ্গলের ধার ঘেঁষে, রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে। যতদূর চোখ যায় উঁচুনিচু ঢেউ খেলানো সবুজ ঘাসের মাঠ। সার বাঁধা পাইনগাছ সুইজারল্যান্ডের নিসর্গকে মনে করায়। বম্ব সাইক্লোন ব্যাপারটা যতই বিপজ্জনক হোক না কেন, তার দৃশ্যপটটি কিন্তু অসাধারণ। ঘাসের গালিচা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সবুজতর। সারি বাঁধা ওক আর মেপল নুইয়ে দিয়েছে ডাল, মাটি ছুঁতে চায় যেন।  কাঠবিড়ালিগুলো সব্বাই হাওয়া। গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। একলা রবিন পাখি ভিজে টুপটুপ ঘাসে একমনে পোকা খোঁজে। মেঘ নেমে আসে উঁচুনিচু জমির ঢালে। ধারাবৃষ্টির ম্যাজিক টাচে নিউ জার্সি যেন চেরাপুঞ্জী। শ্যামদার বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডের বৃষ্টিসৌন্দর্য দেখা হয়নি কোনওদিন। তাছাড়া অন্তরালেই থাকেন এখন বেশিরভাগ সময়, সেই একান্ত নিভৃতযাপনের সময় ভাগ করে নিতে চাইছেন – এও বড় কম কথা নয়। রাজি হয়ে গেলাম।

ভাগ্যের কলকাঠিতে আরেক বন্ধুও জুটে গেল সেখানে। শ্যামদাই ডেকেডুকে এনেছেন। উইকএন্ডে সে বেচারির ফ্লাইট নেওয়ার ছিল। বোমা সাইক্লোনের দাপটে এয়ারপোর্টের সব টাইমটেবিল ঘেঁটে ঘ! বিকেল পাঁচটার ফ্লাইট পিছিয়ে পিছিয়ে সন্ধ্যে সাতটা হল। তারও অবশ্য কোনো গ্যারান্টি নেই, মুহূর্তে মুহূর্তে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বদলে বদলে যাচ্ছে।

“বাড়ি বসে চিন্তা করে তো লাভ নেই, চলে এসো। ফ্লাইট ছাড়ার আগে তোমায় এয়ারপোর্টে ছেড়ে আসব। ততক্ষন খাওয়াদাওয়া করো, জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখ।”

এমন আশ্বাস পেয়ে সেও শ্যামদার বাড়িতে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। আপাতত গুছিয়ে বসে অপেক্ষায় আছে, কখন কী দৈববাণী আসে এয়ারলাইন্স থেকে!

খিচুড়ি প্রত্যাশী আমি এবং দুরুদুরু-বুক বন্ধুটিকে রান্নাঘরে হাই চেয়ারে বসিয়ে শ্যামদা শুরু করলেন সবজি কাটতে। মেনেমান রান্নার জোগাড়। ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল। দুলতে দুলতে নামছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, জলের আলপনা আঁকছে মাটিতে, পাইনগাছের ডালে। সেদিকে তাকিয়ে আমি উদাস। কানে এল শ্যামদার গলা, “সেবার আমি আর তোমাদের রীনাদি টার্কি বেড়াতে গেছি। দেশটার মাঝমধ্যিখানে একটা শহর, ‘কাপাডোকিয়া’ (Cappadocia)। সেখানে উপত্যকার চারদিকে ঘিরে আছে পাহাড়। কোটি কোটি বছর ধরে পাহাড়ের পাথর ক্ষয়ে অপূর্ব ভাস্কর্য তৈরী হয়েছে।”

“গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মত?” কৌতূহল আমার।

“অনেকটা তাই। অপার্থিব সৌন্দর্য। মনে হয় যেন চেনা পৃথিবী নয়, অন্য কোনো গ্রহ। পাহাড়ের গায়ে প্রাকৃতিক গুহা, সে গুহাতেই তৈরী হয়েছে পাঁচ বা তারও বেশি তারা-ওয়ালা হোটেল। ট্যুরিস্টরা ভিড় করে। গুহা-হোটেলে থাকে আর হট এয়ার বেলুনে চড়ে জায়গাটা ঘুরে দেখে। আমাদেরও সেরকমই প্ল্যান।”

কথা বলতে বলতেই দেখছি নিখুঁতভাবে কাটা মাশরুম, কুচিকুচি টমেটো, মিহি করে কুচোনো রসুন বাটিতে বাটিতে গোছ করছেন। এবার বার করলেন লাল-সবুজ বেল পেপার, স্প্যানিশ লংকা হ্যালোপিনো। সমান মাপের ছোটো ছোটো টুকরোয় কাটছেন আর বলে চলেছেন,

“সেই গুহা-হোটেলের ব্রেকফাস্টে খাইয়েছিল মেনেমান। বিশেষ ধরণের এক মোটা চাটুতে রান্না করে সেই চাটুশুদ্ধুই ধরে দিল টেবিলে। সিজলারের মত। সে খেয়ে তো আমরা মুগ্ধ। রীনার উৎসাহ বরাবরই বেশি। চলল রাঁধুনির সঙ্গে আলাপ জমাতে। কেমন করে মেনেমান তৈরী করে, জেনে নেবে।”     

“তাই নাকি? রীনাদি শিখে নিয়েছিল?”

“রাঁধুনির ভাঙা ভাঙা ইংরেজির বেড়া টপকে দিব্যি ভাব জমিয়ে নিল। রান্নাও শেখা হল। নিউ জার্সিতে ফিরে কয়েকবার করেওছে। রবিবারের ‘ব্রাঞ্চ’ আইটেম হিসেবে দিব্যি জমে যেত। ছেলেরাও খুশি।”

পেঁয়াজ বার করেছেন এবার। বাইরে প্রবল হাওয়ার দাপট। সাদা ধোঁয়ার মত বৃষ্টিকণা দিগ্বিদিকে উড়ছে। গাছগুলো পাগলের মত মাথা দোলাচ্ছে, ডালগুলো বুঝি ভেঙে পড়বে! সাইক্লোনিক কন্ডিশন। সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পেঁয়াজ কাটায় মন দিলেন,     

“মেনেমান খাবারটা নিয়ে লক্ষ টাকার একটি প্রশ্ন আছে। খাদ্যরসিকরা এ নিয়ে বহুদিন ধরে তর্কবিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন।”

“কী?” দুজনেই বসে বসে তাঁর ছুরির নিপুণ কাজ দেখছি আর গল্প শুনছি।      

“প্রশ্নটা হল, অথেন্টিক মেনেমান তৈরী করতে তুমি পেঁয়াজ দেবে, কি দেবে না? যুগ যুগ ধরে এ নিয়ে রসিক বোদ্ধারা লড়ে গেছেন। কেউ বলেন, ‘লাঞ্চে মেনেমান খেলে পেঁয়াজ দিলেও দিতে পার, কিন্তু ব্রেকফাস্টে খেলে কভি নেহি!'”

“বলেন কী? এ তো পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতই দুরূহ ব্যাপার! তা আপনি কোন দলে?”

“আরে দূর, পেঁয়াজ ছাড়া এ রান্না খোলে কখনো? আমি তো রসুনও দিই। রীনাও দিত, পেঁয়াজ, রসুন দুটোই।”

প্যানে এবার অলিভ অয়েল চেপেছে। তার ওপর পড়ছে সব উপকরণ। দরাজ হাতে চিজ ছড়ালেন। কিছুক্ষণ রান্না হল। চিজ গলতে শুরু করেছে। ছড়িয়ে দিলেন চিলি ফ্লেক্স, মোটা গুঁড়োর শুকনো লংকা। এবার ডিমের পালা। আস্ত ডিম ভেঙে ঢেলে দিচ্ছেন গলে যাওয়া চিজের ওপর। ডিমের সাদা অংশ জমে যাচ্ছে। কুসুমটি রয়েছে তুলতুলে নরম, ভিজে।

“সবার ভাগে দুটো করে ডিম।” ঘোষণা করলেন।

টোস্টার-আভেনে ব্রেড চেপেছে। সাওয়ার ডো ব্রেড। প্লেটে প্লেটে সাজিয়ে দিচ্ছেন মেনেমান। গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেন। একচামচ মুখে দিয়ে দেখি অপূর্ব স্বাদ।

“ভালো হত যদি প্যানে সবজিগুলো একটু চেপে চেপে থেঁতলে দিতে পারতাম। ক্রাশড মাশরুম, বেল পেপারের আরো বেশি স্বাদ।”

“করলেন না কেন?” আমাদের জিজ্ঞাসা।

“রীনার একটা কাঠের গোল চাকতির মত সরঞ্জাম ছিল। প্যানের ওপর চেপে চেপে রুটি ফোলাত, পরোটা ভাজত, সবজি আধা থেঁতো করে দিত। কোথায় যে রেখে গেল, কে জানে! তাড়াহুড়োয় বলেও গেল না। সময় তো বেশি ছিল না! ওই যে, ওই দেখ, ছবিটায়…”

আঙুল দিয়ে ফ্রিজের দিকে দেখালেন। ফ্রিজের মসৃণ স্টিলের গায়ে রীনাদি। চশমা পরা মুখটি সামান্য নিচু। কিচেন টেবিলে বসে একমনে কী যেন একটা করছেন। পাশে রাখা সেই কাঠের গোল চাকতি। মুখে আলতো হাসি, প্রশ্রয়ের, স্নেহের, দুষ্টুমির।

দুরারোগ্য ব্রেন ক্যান্সারের সঙ্গে টানা দুবছরের লড়াই। হাসিটি কিন্তু বদলায়নি। ঠোঁটের কোণে লেগে থেকেছে শেষ দিনটি পর্যন্ত।     

আমরা চুপ। নিঃশব্দে তাকিয়ে আছি। বাইরে আকাশভাঙা বৃষ্টি নেমেছে। দৃষ্টি চলে না। ফ্রেঞ্চ ডোরের কাচ ঝাপসা। ছবির থেকে চোখ সরিয়ে সেদিকে একবার তাকালেন শ্যামদা। তারপরই ঘোষণা করলেন, “রাত্তিরে তাহলে খিচুড়ি, আর পাঁপরভাজা। কেমন?”

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত