| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: পাখি যখন গান বাঁধেন । সংগ্রামী লাহিড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো। ভারী ঘটারজাঁকজমকের পুজো। মহারাজা রাধাকান্ত দেব নিজে পুজোর আয়োজন করেন। রাজার অঢেল পয়সাদিলদরিয়া মেজাজখরচে কার্পণ্য নেই। মেলা সাহেবমেম নেমন্তন্ন পান। জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে পুজো দেখতে আসেন। তার সঙ্গে হরেক আমোদপ্রমোদ। বাইনাচথিয়েটারবুলবুলির লড়াইকী নেইলাখ লাখ টাকা ওড়ে শোভাবাজারের রাজবাড়ির পুজোয়। সাহেবমেমরা দুশো মজা লুটেহরেক উপঢৌকন নিয়ে বাড়ি ফেরেন।

সবসময় নতুন কিছু করার সুযোগ খুঁজতেন রাজা রাধাকান্ত দেব। একবার মনে হলএই যে ফি বছর পুজোয় তিনি নাচগানের আসর বসাননামী ওস্তাদতবায়েফ গান করেনসবই ঠিক আছে। কিন্তু গানের কথা তো সাহেবমেম বোঝেন নাআসরে বসে তাঁরা ঘাড়টাড় নাড়েন বটেকিন্তু কিছুক্ষণ পরেই উসখুস। বাইনাচ অবশ্য তাঁদের পছন্দের। লাস্যময়ী বাইজিদের পেশোয়াজের চমক আর ওড়নার ঠমক বেশ রসিয়েই উপভোগ করেন তাঁরা। নাঃগান নিয়ে কিছু একটা করতেই হচ্ছে।

খবর পাঠালেন রূপচাঁদকে। পটলডাঙ্গার রূপচাঁদ দাসবাগবাজারে তার আখড়া। আদি নিবাস ছিল উড়িষ্যা। খাসা গান লিখিয়ে। নানারঙেরনানা রসের গান। ভক্তিরসের গানবাউল ও দেহতত্ত্বের সহজিয়া সংগীতপশ্চিমের ধাঁচে টপ্পাসবরকমের গান বাঁধায় সিদ্ধহস্ত। সেবার লিখল কেমন একখানি আগমনী গান,

গো মেনকাঅম্বিকা হের আসিয়ে।

একবার নয়ন প্রকাশিয়ে,

গগনের শশী আসি উদয় তবালয়ে।’

উমা এসেছেন মেনকার ঘরে। সে গান শুনে সব্বার চোখে জল।

উড়িষ্যানন্দন রূপচাঁদের মাথায় বুদ্ধির চাষ। কয়েকটা ছেলেছোকরা জুটিয়ে একখানা পাঁচালির দল গড়েছে। তারা নিজেদের বলে পক্ষী‘ অর্থাৎ পাখি। এক একজন এক এক পাখির ডাক নকল করে। পাখির ভাষায় নাকি কথা বলে তারা। রূপচাঁদের লেখা গান গেয়ে আসর মাতায় পাখির দল। আর গাঁজা টানে ছিলিম ছিলিম। রূপচাঁদ তাদের মধ্যমণি। পক্ষীরাজ। এমনকি নিজের পাল্কিতেও কারিকুরি করে তাকে পাখির খাঁচার আকার দিয়েছে।

রাধাকান্ত দেব নিজের মনেই হাসেন। ছোকরার মাথায় অদ্ভুত সব আইডিয়া গজায়। ওই পারবে।

খাঁচার গাড়িতে চেপে শোভাবাজারে হাজির হল রূপচাঁদ, “ডেকেছেন মহারাজ?”

হ্যাঁতোমাকেই আমার দরকার।

আদেশ করুন।” রূপচাঁদ মাথা নুইয়েছে।

এমন একখানি গান বাঁধতে পারোযা শুনে সায়েবরা খুশি হয়ে যাবে?”

ওঃএই কথাআমি তো ভাবলুম কী না কী!”

কাজটা বড় সহজ নয় রূপচাঁদ। সায়েবরা আমাদের ভাষা বোঝে না।

মহারাজঅধমের পেটে একটুআধটু ইংরিজি বিদ্যে আছে।

তুমি ইংরেজিতে গান লিখবে নাকি?” মহারাজ অবাক!

না না মহারাজআমি গাইব কীর্তন।

আরেএরা কীর্তনের কী বুঝবেগাঁজা টেনে টেনে মাথাটাই গেল নাকি তোমার?”

মহারাজআর যাই বলে গাল দিন না কেনগাঁজা টেনে কথা বলবেন না।” রূপচাঁদ খুবই দুঃখ পেয়েছে। আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। দেখুন কী হয়। আপনি ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিনএবার দুগ্গাপুজোয় পক্ষীদের রাজা রূপচাঁদ গান শোনাবে।

পেন্নাম ঠুকে বিদায় নিল। রাজা চিন্তিত। সায়েব-সুবোর সামনে ব্যাটা মুখ ডোবাবে না তোদেখা যাক!

পুজোয় বসেছে গানের জলসা। আসরে হাজির হল রূপচাঁদ। পিঠে পাখির মত ডানা। খগরাজ বলে পরিচয় দিল নিজের। সভায় সব সায়েবমেমকে আগে বুঝিয়ে দিল তার গানের বৃত্তান্ত।

তোমাদের যে গডআমাদের সেই হল শ্রীকৃষ্ণ। সেই কৃষ্ণের সঙ্গে গোয়ালিনী শ্রীরাধিকার প্রেম হল। তারপর একদিন কৃষ্ণা বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় গিয়ে রাজা হলেন। শ্রীরাধিকা পড়ে রইলেন বৃন্দাবনে। দুঃখের সীমা নাই। লাভার‘ তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন।

সায়েবরা উৎসুক। জমজমাট একখানি প্রেমের কাহিনি।

তারপর?”

“‘লাভারকে ছেড়ে থাকতে না পেরে রাধিকা এক সখীকে পাঠালো মথুরায়কৃষ্ণের কাছে। কিন্তু কৃষ্ণ যে মথুরার রাজারাজার দেখা পাওয়া কি অতই সহজরাজসভার রক্ষীরা গলাধাক্কা দিলে শ্রীরাধিকার দূতীকে। তবে সে মেয়েও জাঁহাবাজ। ছাড়বার পাত্র নয়। গান ধরল,


Let me go ওরে দ্বারী, I visit to বংশীধারী

এসেছি ব্রজ হতে আমি ব্রজের পুরনারী

Beg you doorkeeper let me get, I want to see blockhead

For whom our রাধে date, আমি যে তার search করি

Let me go ওরে দ্বারী, I visit to বংশীধারী।

ও রাধার কেনা servant, এই দ্যাখো দাসখত agreement

এখুনি এ করবো present, আমি ব্রজপুরে লবো ধরি

Let me go ওরে দ্বারী, I visit to বংশীধারী।

Moral character শোনো ওরও butter thief ননী চোর

আর black আর রাখাল poor, চোর মথুরার দণ্ডধারী

Let me go ওরে দ্বারী, I visit to বংশীধারী।

কহে রূপচাঁদ bird’s king, Black nonsense very cunning

আবার flute বাজিয়ে করে sing, মজায়েছে রাইকিশোরী।

ঝিঁঝিটখাম্বাজ রাগে গানটির মজাদার চলন খুব সহজেই শ্রোতার মনোযোগ টেনে নেয়। তার ওপর এমন একখানি খাসা প্রেমকাহিনি। প্রেমিক গডএর বৃত্তান্ত শুনে সায়েবমেমের দল ভারি খুশি। হাততালিতে আসর ফেটে পড়ল। খুব ভালো লেগেছে গান।

রাধাকান্ত দেব খুব খুশি। মান রেখেছে রূপচাঁদ।

পাখির রাজা রূপচাঁদের ছিল অসামান্য প্রতিভা। গান লিখতেনসুর দিতেন, আবার গাইতেনও। বিশেষ করে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গান বাঁধতে তাঁর জুড়ি ছিল না। পক্ষীর সঙ্গে মানুষের জাতিবিচার মিলিয়ে লিখেছিলেন এক মজার গান 

পক্ষীর ওছা কাদাখোঁচাকালোপেঁচা বাহাডুরে,

পাখি আরগিন বঙ্গের কুলীন গুহ পদবী ধরে,

কোকিল বৈদ্য বুদ্ধি হদ্দঠকায় কালো কাকেরে,

নবশাক চক্রবাক নবরঙ্গের নয় জাতি।।

কলকাতা শহরের বর্ণনা অক্ষয় হয়ে আছে তাঁর গানে।

ধন্য ধন্য কলিকাতা শহর।

স্বর্গের জ্যেষ্ঠ সহোদর।

পশ্চিমে জহ্নবীদেবী দক্ষিণে গঙ্গাসাগর।

এখানেই না থেমে আরও একধাপ এগিয়ে স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করলেন শহর কলকাতাকে 

স্বর্গধামে মন্দাকিনীকলকাতাতে সুরধুনী,

নন্দনকানন ইডেনগার্ডেন সম নিছনি,

ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতকলকাতাতে ফিটেন রথ,

পারিজাতকে করে মাত গোলাব সেঁউতি নাগেশ্বর।।

সিন্ধু কাফি রাগে যৎ তালে বাঁধা গান। এখনো শোনা যায় পুরাতনী গানের শিল্পীদের গলায়।

সেকালে নব্য শিক্ষিত বাবুদের রেওয়াজ ছিল ইংরেজির মিশেল দেওয়া বাংলায় কথা বলা। অনেকটা এখনকার মতই আর কী – ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না‘ গোত্রের ব্যাপার। বাংলার আক্ষরিক অনুবাদে অনেকসময় হাস্যকর ইংরেজি শব্দের সৃষ্টি হত। কিন্তু তাতে কীইংরেজি বলতে পারা ছিল শ্লাঘার বিষয়।

বাংলা ইংরেজির মিশেলে রূপচাঁদের গানগুলি এই গোষ্ঠীর বাঙালিকে লক্ষ্য করেই লেখা। শ্রদ্ধেয় রামকুমার চট্টোপাধ্যায় গানগুলি গেয়ে জনপ্রিয় করেছেন। এরকমই আরেকটি গানঅভিনব দোআঁশলা ভাষায় শ্রীরাধার বিলাপ। জংলাগৌড় রাগে একতালে বাঁধলেন।



আমারে fraud করে প্রাণকৃষ্ণ কোথায় গেলি

I am for you very sorry

আমার golden body হল কালি।

My dear dearest(), মধুপুরে গেলে কেষ্ট

বলো এখন how to rest(), শোনো dear বনমালী।

আমারে fraud করে প্রাণকৃষ্ণ কোথায় গেলি।

রাধা জাতে গোয়ালিনী। এ গানের পরের কথাগুলিতে সেই পরিচয় উঠে এসেছে।

আমরা poor creature milky গারেল (girl)

তাদের breastএ মারিলি শেল

Nonsense তোমার নাইকো আক্কেল, Breach of contract করে গেলি

আমারে fraud করে প্রাণকৃষ্ণ কোথায় গেলি ।

শ্রীনন্দের boy young lad, Very crooked, mind hard

কহে R. C. the bird (রূপচাঁদ পক্ষীর পরিচয় দেওয়া হচ্ছে এখানে)

বলি Half English half Bengali…

এই শেষ লাইনেই রূপচাঁদ চাবুকটি মারলেন। ঘরেও নহেপারেও নহে‘ স্বভাব বাঙালীর মজ্জাগত। বাদামী চামড়ার সাহেব হয়ে উঠতে বরাবরের চেষ্টা। বলাই বাহুল্যরূপচাঁদ পাখির চিৎকারচেঁচামেচিতে সাহেবহতেচাওয়া বাঙালির চৈতন্য হয়নি। বরং পাখির দলই একদিন কলকাতার বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পক্ষীরা নিশ্চিহ্নদল উঠে গেছেগাঁজার আড্ডা ভেঙে দিয়েছে কলকাতার মিউনিসিপ্যালিটি। তবে রূপচাঁদের লেখা গানগুলি রয়ে গেছে সবার স্মৃতিতেতাদের অভিনব কথা ও সুরের আবেদন নিয়ে।

 

 

 

[দুটি অডিও গানের কন্ঠ লেখক সংগ্রামী লাহিড়ী]

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত