| 16 মার্চ 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: লজ্জা । সায়মা আরজু

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

 

 (১)


বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে  থাকতে থাকতে আর ভাল লাগছিল না মোহসিনের।  ফেব্রুয়ারি মাস কিন্তু সূর্যের তেজ দেখে মনে হচ্ছে  মে মাসের ভর দুপুর। এই রুটে এমনিতেই বাস কম,  তার উপরে আজ থেকে নাকি আবার সিএনজি ষ্টেশনগুলোতে ধর্মঘট। যে দু একটা বাস গত চল্লিশ মিনিটে  আসলো তার কোনটাতে তিল পরিমান ফাঁকা নেই, তবে মোহসিনের তেমন কোনও তাড়া নেই।বেলা পড়লে তার মত তাগড়া পুরুষের হেঁটে  চার – পাঁচ কিলোমিটার যাওয়া  কোনো ব্যাপার না, কেবল রোদটাই সমস্যা।

মোহসিনের পেশায় ইলেক্ট্রিশিয়ান হলেও, সে একজন শখের খেলোয়াড়। রোদে, বৃষ্টিতে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে দেবার মত অভ্যেস তার আছে। সিজনএ লোকাল ফুটবল  টীমগুলোতে তার যে  পরিমান ডাক পরে তা মন্দ না তবে বছরের বেশীরভাগ সময়ে তেমন কোনও খেলাধুলা  হয়না। কোভিডের পরপরই সে  অনেক কষ্টে একটা ফুটবল একাডেমী দাঁড় করিয়েছিলো বটে কিন্তু সেখানেও তেমন সুবিধা হয়নি। একেতো মাঠের ভাড়া  বেড়ে গিয়েছে তার উপরে আজকালকার ছেলেরা নাকি পড়াশুনার চাপে প্রাইভেট টিচার আর কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে দৌড়াতে খেলাধুলার  সময় পায় না, তো তার একাডেমি টিকবে কিভাবে? মোহসিন এবার আর দাঁড়িয়ে না থেকে রাস্তা পার হয়ে হাঁটতে শুরু করে।


নিলাঞ্জনা হোটেল হাতের ডানে রেখে গলিটা ধরে হেঁটে এগুতে থাকে মোহসিন।গলিটা ক্রমশঃ সরু হতে হতে ফের খানিকটা প্রশস্ত হয়ে স্কুলটার পিছনের গেটের সাথে মিশেছে। স্কুলের গেটে উপরে লেখা “শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়,  স্থাপিত – ১৯৭৬ সাল”। সচারচর এই এলাকায়  আসা হয়না মোহসিনের, শেষ কবে  এসেছে সেটাও ঠাহর করতে পারে না , হবে দশ – বারো বৎসর বা তারও বেশী। আজকের আসাটাও খানিকটা কাকতালীয়।  ছোট বোন মঞ্জরীকে গত সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল ,  একটা জটিল অপারেশন করাতে হবে। যে বয়সী মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা যোগাড় করার কথা, তার  চিকিৎসার জন্য টাকা যোগান দিতে গিয়ে মোহসিনের  হিমশিম অবস্থা। তার উপরে ডাক্তার অপারেশনের কথা বলেছে। এদিকে মা বৃদ্ধ মানুষ তার রোগ বালাই লেগেই থাকে। বাবাও মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। স্থাবর সম্পত্তি বলতে  দেড় কাঠার একটুকরো জমির উপরে একটা সেমি পাকা তিন কামড়ার মাথা গোঁজার ঠাঁই  রেখে গেছেন। মফস্বল শহরের একজন  ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে মোহসিনের কি বা আয়   রোজগার! এই দু্র্দিনের বাজারে এমতবস্থায় সবদিক থেকে রীতিমত চোখে সর্ষেফুল দেখছে সে। কোনো দিক দিশা না পেয়ে বন্ধু আসাদের শরনাপন্ন হয়েছিলো কিছু টাকা ধারের আশায়। আসাদ আশ্বাস দিয়েছে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দিবে। অবশ্য নিজের পকেটের টাকা না, ঐ যে কি সব গ্রুপ ট্রুপ করে না লোকে আজকাল, সেখানে আপিল করলে যা মেলে আর কি। কত পাওয়া যেতে পারে?  দশ হাজার, বিশ হাজার, ঐ যা মেলে সেটা কম না বেশী তা ভাবার অবস্হায় নেই মোহসিন। আজকাল কে বা কার জন্য পকেট উল্টো করে টাকা ঢালবে?

আসাদের সাথে দেখা করার কথা ছিলো সকাল এগারোটায়। এখন বাজে বেলা দেড়টা। আসাদের বাবার একটা সিলভারের হাড়ি পাতিলের দোকান আছে সদর রোডে। এখন অবশ্য ওই দোকানে ইন্ডিয়া, চায়না থেকে আমদানি করা ননস্টিক হাড়ি, ইলেক্ট্রিক চুলা, চামচ, বাটি আরও কত কি বিক্রি হয়! গতদিন এসে মোহসিন একটা প্লাস্টিকের ঝাড়ু দেখেছিল ঐ দোকানে,  আসাদের দোকানের কর্মচারী বেলালের কাছে সে শুনেছে সেই ঝাড়ুও নাকি চায়না থেকে আমদানি করা! আজকাল মানুষের কত কি যে দরকার হয় আল্লাহ মালুম! আসাদের দোকানে গিয়ে মোহসিন ইতোমধ্যে একবার ঘুরে এসেছে। সেখানে বসে ফোন করলে আসাদ ঘুম জড়ানো কন্ঠে জবাব দেয়,” দোস্ত ঘুমাইতেছি। ওই দেড়টার দিকে আয়…  হাতে কাজ কাম আছে কোনও?  না থাকলে দোকানে বয়… চা চু খা।” অবশ্য বেলাল বললো আড়াইটার- তিনটার আগে আসাদ দোকানে আসবেনা। আসাদের সকাল হয় নাকি বেলা বারোটায়। মানুষের হাতে কাঁচা পয়সা থাকলে সূর্যও তার হুকুম মানে।

মোহসিনের দেখলো তার  মত আরও দু – চারজন আসাদের খোঁজে যারা এসেছিল তাদের  সবাইকে বেলাল জবাব দিয়েছে,  “লাঞ্চের পরে আইসেন”। মোহসিন যদিও ভাবছিলো অপেক্ষা করবে কিন্তু আসাদের দোকানে কিছুক্ষন বসে থেকে তার আর ভালো লাগছিলোনা । মনে মনে একটা  অস্বস্থি দানা বেঁধে উঠছিল, আসাদ শেষ পর্যন্ত কিছু দিবে তো,  নাকি পুরো সময়টা অযথাই নষ্ট হচ্ছে। অবশ্য মোহসিনের হাতে তেমন কোনও অপশন ও নেই।তাছাড়া সকালে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। পকেটে যা আছে তা দিয়ে রুটি কলা হতে পারে তবে নিশ্চিত ভাত হবে না। দুপুরে মোহসিনের আবার ভাত না হলে চলে না। রুচি তো আর মানুষের অভাব বোঝে না, না?


যা বলছিলাম আর  কি, অনেকটা  গন্তব্যহীন ভাবে মোহসিন  আজ এদিকে এসেছে ।  স্কুলের গেটটা খোলা পেয়ে ভিতরে ঢুকে পরলো সে । এই স্কুল থেকেই সে দুই দুই বার এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে  পাশ করতে না পেরে পড়ালেখার  মুখে ছাই দিয়ে আর এমুখো হয়নি।প্রথমবারেরটা ছিলো স্রেফ দুর্ঘটনা। মোহসিনের সিট ছিলো আসাদের পিছনের বেঞ্চে। বুককিপিং পরীক্ষার দিন মেজিট্রেট হল পরিদর্শনে এলে মোহসিনের সিটের নীচে একটুকরো কাগজ পেয়েছিলেন, কাগজের গায়ে লেখা দেখে মোহসিনের চিনতে কষ্ট হয়নি যে লেখাটা আসাদের। বহিস্কার হয়ে যাবার সময় সে বার বার মেজিষ্ট্রটকে বলেছে, “লেখাটা আমর নয়,মিলিয়ে দেখেন, স্যার”, উনি শোনেন নি। পরের বার পড়ালেখা করার ইচ্ছেটাই ছিলো না তেমন, আর সে এমন কোনোও আহামরি ভালো ছাত্রও  ছিলো না।পরে পলিটেকনিকে ভর্তি হয়ে ইলক্ট্রিক মেকানিকের কাজটা শিখেছে।

 

স্কুলের গেট পার হয়েই মাঠ, মাঠের এক কোনায় শহীদ মিনার। শহীদ মিনারে পাশ ঘেঁষে একটা পুকুর। পুকুর থাকায় জায়গাটা তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা। পুকুরটির কোনও বাঁধানো  ঘাট টাট নেই। কয়েকটা নারকেল গাছ পরপর ফেলে কোনও রকম একটা ঘাট তৈরি করা হয়েছে। একটু দুরে একটা টিউবওয়েল। টিউবওয়েলটার পানি একটা সরু নালার মধ্য দিয়ে  পুকুরে পড়ছে।

 

 
(২)


আজ ফেব্রুয়ারীর চব্বিশ তারিখ। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে দেয়া ফুলগুলো বেদির উপরে নেতিয়ে পরে আছ। বেদির উপরে ছায়া সমেত একফালি জায়গা বের করে ফুলটুল সরিয়ে চিৎ. হয়ে শুয়ে পড়ে মোহসিন । মাঠের একপাশে কতগুলো বাচ্চা খেলছে, এ ওর পিছনে ছুটছে আবার এ ওর গায়ে হেসে ঢলে পরছে, আবার সবাই মিলে ছুটছে। কি খেলা হতে পারে, বৌচি, গোল্লাছুট, সাতচাঁড়া? যাই হোক এ নিয়ে মোহসিনের ভাবতে ইচ্ছে করছেনা এখন। আকাশে কয়েকটা উড়ন্ত চিল তাকে ঘিরে বার বার চক্কর দিচ্ছে, “কি জানি আবার মরা মানুষ ভাবছে না তো চিল গুলো আমাকে?” বেশ শব্দ করেই হেসে ওঠে মোহসিন। হাসির শব্দে বাচ্চাগুলো তার দিকে চকিতে ফিরে তাকিয়ে আবার খেলায় মত্ত হয়। বাচ্চাগুলোকে দেখতে দেখতে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন স্মৃতি জড়ো হয় তার মনের আকাশে। মোহসিনের মনে পড়ে এই স্কুলের প্রাইমারি শাখায় তখন পড়তো সে৷ কোন ক্লাশে হবে? এই হয়তো থ্রি বা ফোর। তাদের ক্লাসে একটা মেয়ে ছিলো সবার থেকে আলাদা, একটু বড়, মাথা ভরা কোঁকরানো চুল, পরিপাটি দুই বেনী করে আসতো। দীপ্তি নাম ছিলো ওর। নীলাঞ্জনা হোটেলটা পার হয়ে বিএ ডি সি’র দিকে যেতে হাতের বা’দিকে ছোট্ট একটা লন্ড্রির দোকান ছিলো ওর বাবার। দু-একবার দীপ্তির খোঁজে মোহসিন গিয়েছিলো ঐ দোকানে। তবে যতবারই গিয়েছে ততবারই দীপ্তির বাবাকে ঘাড়গুঁজে একমনে কাপড় আয়রন করতেই দেখেছে।দীপ্তির কথা জিজ্ঞেস করলেই উল্টো জিজ্ঞেস করতো,”কি নাম তোমার, বাবু?” তারপর একটু সময় নিয়ে বলতো “দীপ্তি মাসির বাড়ি গেছে।” দীপ্তির মধ্যে কেমন দিদি দিদি ভাব ছিলো। মোহসিনের বেশ লাগতো সেটা।দীপ্তির পাশে যেদিন বসার সুযোগ পেতো মোহসিন সেদিন নিজেকে বেশ সাহসী মনে হত। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন দীপ্তি  স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলো। কেউ কেউ বলতো দীপ্তির বিয়ে হয়ে গেছে,  আবার কেউ কেউ  বলতো ডাক্তার স্যার পড়া নেবার সময় দীপ্তির গায়ে বাজে ভাবে হাত দিয়েছিলো বলে সে আর স্কুলে আসেনি।ডাক্তার স্যার কে দেখলে মনে হত একটা হ্যাঙ্গারে হলদে ঘিয়া কালারের পাঞ্জাবি ঝুলে আছে। মোহসিনের আফসোস হয় ঐ হ্যাঙ্গার  মার্কা লোকটার জন্য শেষমেষ দীপ্তির পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেল!  ডাক্তার স্যার যে কাউকে যেকোনও দোষে কঠিন শাস্তি দিতেন। হাতের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে পেন্সিল ঢুকিয়ে জোরে চাপ দিয়ে ধরতেন। আহ্ কি ব্যাথা, কি ব্যাথা! মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠে মোহসিন।ডাক্তার স্যারের রগওঠা হাতের হলদেটে শক্ত নখগুলো দেখলে ছোটবেলায় যতটা ভয়ে কুঁকরে যেত  মোহসিন আজ ততটা ঘেন্নায় গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো তার। পাশের টিউবওয়েল থেকে হাত মুখ ধুয়ে কিছুটা পানি খেয়ে আবার বেদিটার উপরে বসলো সে।


ইতিমধ্যে মোহসিন যেখানে বসে ছিলো সেখানে রোদ সরে এসেছে।  সে আর একটু ডান পাশে সরে বসে সূর্যের তাপ থেকে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করে।  প্রাইমরি স্কুল ভবনটির জানালাগুরো খোলা। এতটা দুর থেকে ভিতরে কি হচ্ছে তা বোঝা না গেলেও কোন রুমটা কোন ক্লাশ হতে পারে তা মনে মনে হিসেব করে নেয় সে।  একেবারে ওপাশের রাস্তার দেয়াল ঘেঁষে কৃষ্ণচুড়া গাছটার নীচে যে রুমটা সেটা হেড স্যারের রুম। হেডস্যারের রুমে সচারাচর যাওয়া হতো না মোহসিনের, সাধারনতঃ ক্লাশ ক্যাপটেনরা নাম ডাকার খাতা, ডাস্টার,  চক আনতে যাওয়ার সুযোগ পেত। তবে একবার কি কারনে যেন হেড স্যারের কাছ থেকে মোহসিন একটা বই উপহার পেয়েছিল। ছোট্ট চটি বইটার  মলাটের  ওপরে আব্রাহাম লিঙ্কনের সাদাকালো একটা ছবির উপরে কালো মোটা অক্ষরে লেখা ছিল “ছোটদের আব্রাহাম লিঙ্কন”। বেশ রাগি রাগি চেহারার আব্রাহাম লিঙ্কন আর  হেড স্যারের সাথে মিল খুঁজে পেত মোহসিন।  কি যেন নাম ছিলো হেড স্যারের? সিরাজ… সিরাজ তারপরে কি? ইসলাম, শিকদার নাকি মোল্লা! নাহ কিছুতেই নামের পরের অংশটুকু মনে পরছেনা। স্যার একবার ক্লাশে বলে ছিলো স্কুলেরই কোনও এক পুরানো ছাত্রীর কথা। মেয়েটার স্তনক্যান্সার হয়েছিলো। স্যার বলছিলেন, ” তার স্তন্য কেটে ফেলা হয়েছে, ডাক্তারের সামনে স্তন্য বের করে দেখাতে হয়েছে, কি লজ্জা! কি অনাচার!! কি লজ্জা!  কি লজ্জা!!” তখন মোহসিন বিষয়টা বুঝতে না পারলেও এখন বেশ বুঝতে এতে লজ্জার কিছু নেই। জীবনের থেকে কি লজ্জা বড়!!

মোহসিনের,  মঞ্জরির কথা মনে পড়ে যায়।অসুস্থ বোনটার শুকনো, ভীত মুখটা মনে করে সেখানেও বিন্দু মাত্র লজ্জার কারন খুঁজে পেলনা মোহসিন। “নাহ্ স্যারের সাথে এটা নিয়ে  কথা বলতে হবে, জিজ্ঞেস করতে হবে কি লজ্জা, কেনই বা লজ্জা।” মোহসিন  উঠে পায়ে স্যান্ডেল গলাতে গলাতে গেটের দিকে তাকায়। স্যারের বাসা আশে পাশেই কোথাও ছিলো। একটা ছোট্ট টিনের দোতালা ঘড় সামনে বাঁশের বেড়া দেয়া একটা বাসা। একটা পুকুর ছিলো কাছেধারে। মোহসীন পুরো এলাকাটা দুই বার চক্কর দিলো কিন্তু সিরাজ স্যারের বাসা কোনটা ঠিক চিনে উঠতে পারলো না। এ ক’বছরে এ এলাকায় বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কাঠের বাড়িঘর এখন এলাকা থেকে একরকম উঠে গেছে বললেই চলে তার বদলে জায়গায় নিয়েছে  বিশাল সব অট্টালিকা। “কাছে ধারে কোনও মুদির দোকান পাওয়া গেলে হতো। এই হয়েছে এক জ্বালা। আগে পাড়ার মধ্যেই লন্ড্রি, মুদির দোকান, টেইলার্স পাওয়া যেত। মুদির দোকানদারের কাছে এলাকার হাঁড়ির খবর থাকত।  আর এখন এলাকা যত অভিজাত হচ্ছে  হাতের কাছে কিচ্ছুটি নেই!  অবশ্য ঐ যে অনলাইন!! তাতে কি হয়েছে, হয়েছে টা কি?  সবাই সবাইকে দুরে ঠেলে দিয়েছে, কেউ কাউকে চিনছেনা। সেটাই বা বলি কি করে… আসাদ যে টাকা দিবে বলেছিলো…  মানে যাদের কাছ থেকে টাকাটা আসবে ওরা ক’জন আমায় চেনে?” মোহসিন মাথা চুলকায়।


(৩)


স্কুল গেটের কাছেই বয়সী একটা  রেইন ট্রির নীচে একট ভ্যানে মাঝারি আকৃতির একটি হাড়ি থেকে কিছু একটা বিক্রি করছে এক মহিলা। মোহসিনের পেটের খিদেটা আবার মোচর দিয়ে  উঠলো। বেশ ক’জন পথচারী,  রিক্সাওয়ালা ভীড় জমিয়েছে ভ্যানের আশেপাশে।  কেউ খাচ্ছে, কেউবা খাবার অপেক্ষায়। মোহসিন তাদের কাছে গিয়ে দেখলো ভ্যানে খিচুড়ি বিক্রি হচ্ছে। মোহসিনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে জানে তার পকেটে দুটো  বিশ টাকার নোট আর একটা পাঁচ টাকার কয়েন আছে। খিচুড়ির দাম কত হতে পারে,  মোহসিন নিজেকই প্রশ্ন করে। তাকে  দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খিচুড়িওয়ালী জিজ্ঞেস করে,  ” ভাইজান কি দিমু? ডিম, ভর্তা না মুরগী? ” মোহসিন প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ায় মহিলা বলতে থাকে, ” ভর্তা খিচুড়ি বিশ টাকা, ডিম খিচুড়ি পঁয়ত্রিশ টাকা, আর মাংস খিচুড়ি একশো টাকা, কোনডা দিমু কন?” মোহসিনের শরীর বেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস বয়ে যায়। মনে মনে খুশি হলেও মুখে বলে,” নাহ্ বেশী খাবনা, ভর্তাই দেন।” খিচুড়ি ওয়ালি তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে খিচুড়ির প্লেট এগিয়ে দেয়।

সামনেই পৌরসভা নির্বাচন।  পুরো শহর জুড়ে বেশ জোরেসোরে ক্যাম্পেইন চলছে। একটা মিছিল আসছে দেখে পথচারীরা রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। মোহসিন শেষ লোকমা মুখে পুরে কোনও মতে হাত ধুয়ে তাদের অনুসরন করে।একটা কম বয়সি ছেলে কোথা থেকে একটা জগ হাতে নিয়ে  দৌড়ে এসে জোরে চিৎকার করে মিছিলের স্লোগানে সামিল হয়, “তোমার আমার মার্কা, জগ মার্কা। ভোট দিন ভোট দিন , জগ মার্কায় ভোট দিন । আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই। প্রশাসনের কালো হাত, ভেঙ্গে দাও, গুড়িয়ে দাও…” ইত্যাদি।  মিছিল সরে গেলে মোহসিনের দিকে তাকিয়ে ছেলেটি বলে, ” কাইলকা আমাগো পাড়ায় জগ দিছে, ফ্রি। ” মোহসিন প্রশ্ন করে, -তুমি এ দিকে থাক?
– হ
– কে মারা গেলো?
ছেলেটি চোখ বড় বড় করে বলে,
– আফনে জানেন না? প্যাপারে আইলো, কাইলকা টিভিতে দেহাইলো। জগ মার্কার মিছিলে কাইল গুলি হইছে। এক্কারে মিছিলে ঢুইক্কা গুলি করছে।

মোহসিনের জন্য খবরের কাগজ কিনে পড়া বিলাসিতা।  তাও কয়েক বৎসর আগে যখন সে চাকুরী করার স্বপ্ন দেখতো তখন পাড়ার মসজিদের পাশের দেয়ালে সর্বসাধারণের জন্য আঠা দিয়ে  সেঁটে  দেয়া  “সাপ্তাহিক চাকুরির খবর” আর “চাকুরী বাকরি” নামের দুটি পত্রিকা লাইনে দাঁড়িয়ে  সপ্তাহে অন্তত দু-তিন ঘন্টা ধরে পড়তো। কিছুদিন ধরে অবশ্য পাড়ার মজনু ভাইয়ের মুদির দোকানে দাঁড়িয়ে বাসায় ফেরার পথে  টিভি নিউজ দেখে। কালও দেখেছে,কিন্তু এ খবরটা চোখ এড়িয়ে গেল কেমন করে? মজনু ভাইয়ের দোকানে সবসময় টিভি খোলা থাকে। ইদানীং বেশ  কয়েকটি চ্যানেল চব্বিশঘন্টা খবর দেখায়। মজনু ভাইয়ের পছন্দ চ্যানেল টুয়েন্টিফোর।মজনুভাইয়ের চোখ সবসময় টিভির পর্দায়। এমনকি সদাই-পাতি প্যাকেট করার সময়ও তার  একচোখ টিভির পর্দায়। মজনুভাই তার কাস্টমারদের সাথে অপ্রয়োজনীয় তেমন কোনও কথা বলেন না তবে সেরকম  কোনও সিরিয়াস ব্যাপার হলে দেশ ও জাতীর ভবিষ্যৎ নিয়ে তার নাতিদীর্ঘ বক্তব্য থাকে। তা মজনুভাইওতো কাল কিছু বললো না। হয়তো  গত তিন-চার মাসে দোকানে কিছু বাকী পড়ায় মজনুভাই তাকে অন্যচোখে দেখছে। কোভিডের পরে মানুষের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে মোহসিন, তার মধ্যে চোখের মাথা খেয়ে  চেনা মানুষকে দুরে ঠেলে দেয়ার প্রবনতা অন্যতম। এই মজনুভাই যখন কিনা দোকানের পজিশন নিতে পারছিলো না তখন মোহসিনের বাবা স্থানীয় কাউন্সিলরকে বলে গতি করে দিয়েছিল।যাইহোক, হাতি ফাঁন্দে পরলে চামচিকাও লাথি মারে, কথাটা তাহলে সত্য। মোহসিন দেখলো রাস্তার পাশে লোকজন দেখে একজন মুচি তার বাক্স পেটরা খুলে বসেছে। কয়েকজন কাস্টমারও জুটে গেছে এর মধ্যে। মোহসিন আর ছেলেটার কথোপকথন শুনে মুচি একটা স্যান্ডেলে জোড়া লাগাতে লাগাতে উপরে না তাকিয়েই  বললো,” এদেশে মাইনষের জীবন বড় সস্তা, কারনে অকারনে মানুষ মারে, মানুষ মরে।”

মোহসিন এবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো-
– আচ্ছা এই পাশের প্রাইমারি স্কুলের হেড স্যার,  সিরাজ স্যারের বাসা কই বলতে পারবা?
– ও সিরাজ নানা, উনির বাসাতো সামনের লেনে।  চলেন দেখাইয়া দেই।

মোহসিন  ছেলেটির পিছন পিছন আগায়। চলতে চলতেই ছেলেটা জানায় তার নাম বাহার, এই স্কুলে ক্লাশ সেভেন  পড়ে। কাছাকাছি আসলে সেই টিনের বাড়িটি চিনতে মোটেও বেগ পেতে হয়না মোহসিনের। তবে সময়ের সাথে বাড়িটিও পুরানো হয়েছে,  সামনের বাঁশের বেড়া বলতে কয়েকটা বাঁশের খুঁটি। বুনো ঘাস আর আগাছায় ভরে আছে বাগানটা। এককোনে একটা বাঁশের মাঁচান কোনওমতে  জাপটে ধরে টিনের চাল ছুঁই ছুঁই করছে একটা চালকুমড়ার লতা।

মোহসিন  বারান্দায় একটা চৌকির উপরে আধশোয়া অবস্থায় সিরাজ স্যারকে দেখে সালাম দেয়। বাহার, মোহসিনকে দেখিয়ে সিরাজ স্যারকে বললো, নানা আফনের লগে দেহা করবার  আইছে। ” তারপর মোহসিনের উদ্দেশ্য বলে,” ওনার স্মৃতি নাই, কিচ্ছু  মনে রাখতে পারেনা। কথাও বলে না আইজকাইল”। সিরাজ স্যার মোহসিনের দিকে নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থাকে। মোহসিন গিয়ে সিরাজ স্যারের পাশে কিছুক্ষণ বসে, সময় নেয়। তারপর স্যারের একটা হাত দু’হাতে ধরে বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করে, “স্যার সেইদিন যে বলেছিলেন লজ্জা, বড় লজ্জা, কার লজ্জা, স্যার?” মোহসিন টের পায় তার হাতের মধ্যে সিরাজ স্যারের হাতটা মৃদু কেঁপে ওঠে। মোহসিন স্যারের হাতটা আরও একটু চাপ দিয়ে ধরে।

(৪)

মঞ্জরীর শরীরটা আজ বিশেষ ভালো না। ডাক্তারের কাছে নতুন করে কিছু বলার মত এখনও কোনও ব্যবস্থা হয়নি। সেদিন আসাদের সাথে দেখা হলো না। আজও দুইবার ফোন করেছে মোহসিন , ফোনে রিং বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। এখন একটাই উপায় মামা বাড়িতে তার মা’র যতটুকু পাওনা দাওনা আছে সেটা দাবী করা। কিন্তু সেটার জন্য যে সময় দরকার সেটাও হাতে নেই। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলো মহসিন।  এরমধ্যে মা দুইবার এসে ভাত খাবার জন্য ডেকে গেছে। মোহসিন খাবার টেবিলে গিয়ে দেখলো ঢেড়শ ভাজি, আর পাতলা ডাল রান্না হয়েছে। খেতে বসতে বসতেই আসাদের ফোন এল।
– দোস্ত বল
– শোন কাল বিকালে একবার দোকানে আয়। চাইরটার মইধ্যে আইস। আমার আবার ক্যানভাসে যাওন লাগব ছোড কাক্কুর লগে। কিছু টাকা আইছে এই ধর সব মিলাইয়া লাখ খানেক।
– আলহামদুলিল্লাহ
– তয় খরচা আছে কিছু। ধর বিকাশ ক্যাশ আউট করন লাগব। তারপর পোলাপাইন মঞ্জরিরে দেখতে হাসপাতালে যাইবো হের যাতায়াত,  তারপর ধর তাগরে নাস্তা পানি খাওয়ান লাগবো, আর  এরে ওরে ফোন করতেইতো আমার পকেট খালি হইয়া গেল।  কালকেও পাঁচ’শ টাকা ফোনে ভরছি তোরে ফোন করুম দেহি টাকা নাই, আবার রিচার্জ করছি, বোঝ অবস্থা। এইসব খরচ বাদ দিয়া তোর হাতে চল্রিশ হাজারের মত দিতে পারুম। ডাক্তার কত লাগবো কইছিলো য্যান?
– অপারেশনের জন্য পঞ্চাশ।  তারপরে ওষুধ পাতি আছে
– সবতো আর একজায়গায় পাবিনা না? অন্যভাবে কিছু চেষ্টা কর।
– আর দশ – পনেরো হাজার যোগাড় হয় কিনা দেখ দোস্ত। তুইতো অনেক করলি,  আরেকটু দেখ
– শোন কাইলকা আয় আপাতত যেইডা পাইতাছোছ লইয়া যা।রাখলাম
ফোন কেটে গেলে ভাতের প্লেটে মন দেয় মোহসিন। মাকে জানায় কিছু টাকার ব্যবস্হা হয়েছে আসাদের মাধ্যমে। মা দু’হাত তুলে আসাদের জন্য দোয়া  করে। মোহসিনের আসাদের আচরনে খানিকটা রাগ হলেও পরক্ষণেই সে রাগ মিলিয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে  তার জন্য আসাদই একমাত্র ভরসা। কি করতে পরতো সে,  আসাদের থেকেও কম টাকা দিলে। আর তাছাড়া আসাদ তাকে টাকার পরিমান না জানালে সে হয়তো টাকার পরিমান সম্পর্কে  কিছুই জানতে পারতো না।

(৫)

আজ শুক্রবার, স্কুল বন্ধ। স্কুলের মাঠে আজ  ছেলেপেলেদের ভীড় একটু বেশী বলে মনে হল মোহসিনের। আজও আসাদের দোকান থেকে ঘুরে এদিকে এসেছে সে। এ ক’দিনে শহীদমিনারের বেদিটা তার পছন্দের  জায়গা হয়ে উঠেছে। আসাদ আজ যা বললো সেটাও মেনে না নেয়া ছাড়া কিই বা করার ছিলো তার। আসাদ বললো টাকাটা  মোহসিনের হাতে না ওরা হসপিটালে বিল হিসেবই দিতে চায়। হসপিটালে ওদের নাকি পরিচিত লোকজন আছে তো তাদের মাধ্যমে কিছু চার্জ যদি কমানো টমানো যায় আরকি। তবে মোহসিনের মনে হচ্ছে আসাদ হয়তো মোহসিনের কাছ থেকে কিছু গোপন করছে। কি এমন গোপন করতে পারে,  নিজেকে কয়েকবার প্রশ্ন করে সে কিন্তু অনেক ভেবেও এর কোনো কুল কিনারা করতে পারে না। মোহসিন শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে খেলার  মাঠের দিকে, হয়তো  তার ছোট বেলার দিকে। সে স্পষ্ট দেখতে পায় কয়েকটা দশ-বার বছরের ছেলে মিলে রঙ্গিন কাগজ কেটে ঘুড়ি বানাচ্ছে,  সুতোয়  মাঞ্জা দিচ্ছে, নাটাইতে সুতো পেঁচাচ্ছে। দু’দিন বাদে স্কুলে মেলা, সেখানে এগুলো বিক্রি হবে। মোহসিনের  চোখের সামনে একটার পর একটা দৃশ্যপট ভেসে উঠতে লাগলো। মোহসিন দেখলো ঘুড়ি,  নাটাই বিক্রির টাকা সবার মধ্যে বাটোয়ারা করছে একটি লাল হাফপ্যান্ট পরা ছেলে। ছেলেটির  মাথা ভর্তি কোকড়া চুলগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশী বড় হওয়ায় অন্যদের তুলনায় তাকে খানিকটা লম্বা মনে হচ্ছে।  সবার হাতে দশ টাকা গুঁজে দিয়ে  ছেলেটি নিজের পকেটে বিশ টাকা ঢুকালো। সবাই হৈ হৈ করে উঠলে ছেলেটি  হাত নাড়িয়ে তাদের কিছু বোঝাতে যায়। হটাৎ ই ছেলেটি দৌড়ানো শুরু করে। বাকিরাও ধর ধর  বলে তার পিছনে ছুটতে থাকে।  মোহসিন মনে করার চেষ্টা করে ছেলেটা কে?  আসাদ, নাকি মামুন নাকি বাদল? মোহসিন শুনতে পায় হৈ হৈ আওয়াজটা ক্রমশ তার কাছে এগিয়ে আসছে। আওয়াজটা স্পষ্ট হলে  শ্লোগানের মত শোনায়। মোহসিনের খেয়াল হয়  রাস্তা দিয়ে একটা মিছিল  যাচ্ছে। খেলা ফেলে  কয়েকটি  বাচ্চা মিছিল দেখতে গেটের দিকে ছোটে। মোহসিনও পায়ে পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে যায়। বড়গেটের পেট বরাবর  পকেট গেটে মাথা ঢুকাতেই মোহসিনের  মনে পড়লো ঐ লাল হাফপ্যান্ট পরা ছেলটি আসাদ।

(৬)

মোহসিন কি একটা  ভাবতে ভাবতে সিরাজ স্যারের বাসার দিকে আগায়। রেইনট্রিটার নীচে আজ খিচুড়িওয়ালিকে দেখা গেলনা আজ। খানিকটা দুরে একটা ভ্যানে কিছু একটা ভাজছে একটা লোক। চিংড়ির মাথা ভাজা হতে পারে, অথবা কুঁচো চিংড়ি দিয়ে ডালের বড়া। বাতাসে চিংড়ির ঘ্রানে আন্দাজ করলো মোহসিন।  এমন সময় উল্টো দিক থেকে একটা সাইকেল রিক্সা এসে মোহসিনের গতি রোধ করল। রিক্সা থেকে লাফিয়ে নামলো  বাদল।
– কিরে মোহসিন  কেমন আছিস?
– এইতো যাচ্ছে
– মঞ্জরি অসুস্থ শুনলাম। কোন স্টেজ?
– হ্যাঁ অপারেশন লাগবে।
– ক্যান্সার ডায়াগনোসিস হইছে কোথায়?
ক্যান্সার কথাটি শোনার পর মোহসিনের  পায়ের নীচের মাটি সরে গেল। বাদলকে কিছু বুঝতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো
– কই শুনলি?
– আসাদের পোস্ট দেখলাম ফেইসবুক এ।
– ও আচ্ছা।  পোস্ট টা আছে,  একটু দেখাবি?
– তুই দেখস নাই।  দাড়া দেখাইতেছি।
আসাদ লিখেছে, ” বন্ধুর জন্য বন্ধু, বন্ধুর বিপদে সহায় বন্ধু। বন্ধু মোহসিনের ছোটবোন  মরন ব্যাধিতে আক্রান্ত।চিকিৎসার জন্য বিপুল অঙ্কের টাকার প্রয়েজন বন্ধুরা যে যা যেভাবে পার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও। বিকাশ নম্বর : ০১৬৫৬৫৬। “
বাদল জিজ্ঞেস করলো,
– টাকা পয়সা কেমন যোগাড় হইছে?
– হইছে আর কি। আসাদ দেখতাছে ব্যাপারটা।
– আসাদ দেখতাছে? বান্দরের হাতে রুটি ভাগ করার দায়িত্ব পড়ছে! খাইছে! একটু বুইঝা লইছ।

বাদলকে বিদায় দিয়ে মোহসিন উল্টোদিকে আবার আসাদের দোকানের দিকে হাঁটা শুরু করে। বাদলের কথায় মনের মধ্যে একটা খচখচানি শুরু হয়। মঞ্জরীর ক্যানসার হয়েছে এটাতো মিথ্যা কথা, অন্যের কাছ থেকে টাকা সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা হচ্ছে এতেই মরমে মরে যাচ্ছে সে তার উপরে আবার মিথ্যা বলে টাকা নেয়া ঠিক হবে? আসাদকে দোকানেই পাওয়া গেল। মোহসিন দু’একটা একথা সেকথা বলে তারপরে মোহসিন প্রসঙ্গে আসে।

– তুই সবাইকে বলছিস মঞ্জুরির ক্যান্সার?
– না ঠিক ক্যান্সার বলি নাই একটু প্যাচাইয়া কইছি আর কি। ক্যান কি হইছে?
– কিছু না তয় বোনটা অসুস্হ। এই কথা বলা ঠিক হইলো?
– আরে কইছি বইলাই লোকজন টাকা দিতাছে। তোর দরকার টাকা, এত্ত চিন্তা করনের সময়  আছে?
– তুই না কইলি কারা হসপিটালে দেখতে আসবো।
– হ, আসবো তো। তুই কাইল পরশুর মধ্যে অ্যাডমিশন লইয়া ফালা।
– ওরা জানবে না?
একটা ফিচেল হাসি দিয়ে  আসাদ বলে,
– আরে লোকজন ফিট করা আছে হাসপাতালে। আর অপারেশনতো হইতেছেই। হুদাই চিন্তা করতাছোস।বাসায় যা।হাতে মেলা কাজ কাম। অপারেশনের ডেট নিয়া জানাইস।


(৭)

আজও বেশ গরম। এত গরমে বৃষ্টি কেন হচ্ছেনা কে জানে? প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু মোহসিনের বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। আসাদের কাছ থেকে টাকাটা নিতে মন সায় দিচ্ছে না, হাজার হোক একটা মিথ্যে বলে টাকাটা যোগাড় করা হচ্ছে, কিন্তু না নিবে সেটারই বা উপায় কি?  আসাদ উদ্দেশ্যহীনবাবে হাঁটতে হাঁটতে সিরাজ স্যারের বাসার সামনে হাজির হয়। স্যারের বাসার সামনে বাহারের সাথে দেখা হয়। বাহারের হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে কিছু সবজি। বাইরের থেকেই কাঁচা কলা, মূলা, আর শিম দেখা যাচ্ছে। হাতের সব্জির দিকে ইঙ্গিত করে বাহার বললো, ” আমগোর বাগানের। আম্মায় নানীর জন্য পাঠাইলো। নানার বাসায় যাইবেন তো?  চলেন।” মোহসিন মাথা একটু কাত করে বটে তবে তার জন্য বাহার অপেক্ষা না করে হাঁটতে থাকে। মোহসিন তাকে পিছন পিছন অনুসরণ করে ঘড়ে ঢুকে স্যারের পাশ বসে হাত দুটো স্পর্শ করতেই স্যরের মুখে হাসির রেখা দেখা যায়। মোহসিন স্যারের পাশে বসে থাকে। মনের মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরে ঘুরে পাক খায়, ঘূর্ণির মত ঝড় তোলে। ফিসফিস করে স্যারকে জিজ্ঞেস করে, ” কার লজ্জা স্যার? আমার বোনটার?  আমার? আমি তার চিকিৎসা করাতে পারছি না। একটু বলবেন স্যার?” সিরাজ স্যারের চোখ দুটি আগের থেকে ঘোলাটে মনে হয় মোহসিনের কাছে, আরও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে স্যারকে। মোহসিনের চোখ জ্বালা করতে শুরু করে, চোখের সামনে আসাদের মুখটা ভেসে ওঠে। আসাদের হাসিটা এখন আর সরল মনে হয় না, বড্ড বেশী দাঁতাল মনে হয়। মাথার মধ্যে চিনচিনে একটা যন্ত্রণা টের পায়। স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে, ” একটা প্রশ্ন, স্যার। ধরেন এইটাই শেষ প্রশ্ন। টাকাটা আমি ফেরত দিব স্যার, কিন্ত এইটা কি অন্যায় হইতেছে, স্যার? অন্যায়টা কি আমার? আসাদ যা করতেছে, করছে। আমারে উপকার করার উছিলায় আমারে প্যাঁচাইলো কেন, স্যার? এইটা কি বাটপারি, স্যার? লজ্জা, এ যে বড় লজ্জা,  স্যার।” বা’ হাতে চোখ মুছে মোহসিন  বের হয়ে আসে  রাস্তায়।  একটা সাইকেল রিক্সায় করে মাইক বাজিয়ে ইলেকশনের ক্যাম্পেইন করছে দুটি ছেলে। ওদের একজন  মোহসিনের  হাতে একটা  লিফলেট  দেয়, মোহসিন হাঁটার গতি না থামিয়েই লিফলেটটি হাতে নেয়। “ভাইজান,  যাইতাছেনগা, নানী চা খাইয়া  যাইতে কইলো…।” পিছন থেকে বাহারের ডাক শুনে একমুহূর্ত থমকে দাঁড়ায় মোহসিন। তারপর  পিছনে না তাকিয়ে  সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। পাশেই কোনোও বাড়িতে গান বাজছে, ” আমার সোনার বাংলা,  আমি তোমায় ভালোবাসি, জন্ম দিয়েছো মাগো, তাই তোমায় ভালোবাসি।” মোহসিন জোড়ে জোড়ে নিজেকে শুনিয়ে গানের কথাগুলো আওড়ায়। প্রানপনে চেষ্টা করে সবকিছু ভুলে থাকতে। বাসস্ট্যান্ডের পথটা আজ অনেকটাই দীর্ঘ মনে হয়।  লজ্জাকে বহন করা যে খুব কস্টের!!




error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত