Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Science and religion

ধর্ম যখন বিজ্ঞানকে ভয় পায় । আনসারি তৌফিক

Reading Time: 5 minutes

কোপার্নিকাস তার শেষ জীবনে ‘দ্য রিভলিউশনিব্যস’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। কিন্তু জনসম্মুখে বইটি প্রকাশ করতে সাহস করেননি। কারণ তখন ইতালির পরিস্থিতি নতুন কোনো তত্ত্ব প্রচারের অনুকূলে ছিল না। কোপার্নিকাস মারা গেলে বইটির জায়গা হয় গীর্জা ও শহরের বিভিন্ন লাইব্রেরীতে। তেমনই একটি গীর্জার পাদ্রী ছিলেন জিওর্দানো ব্রুনো নামের এক যুবক। একদিন গীর্জার লাইব্রেরীতে বই ঘাঁটতে গিয়ে সে খুজে পেল কোপার্নিকাসের সেই বইটি। যার সারা গায়ে ধুলো-ময়লা মাখা। ব্রুনো বইটি পেয়েই নিয়ে চলে গেলেন তার কক্ষে। বই পড়তে পড়তে তিনি বুঝতে পারলেন, এতদিন যা সত্য হিসেবে ছিল কোপার্নিকাস সেটাকে মিথ্যা বলছেন। সবাই জানে, পৃথিবী স্থির। সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। অথচ কোপার্নিকাস বলছেন, সূর্য নয় বরং পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘুরে। শুধু বলা নয়, রীতিমতো গাণিতিক ভাবে প্রমাণও করে রেখেছেন তিনি। জিওর্দানো ব্রুনো এই নতুন সত্যটি উপলব্ধি করে স্থির থাকতে পারলেন না। গীর্জায় তার ঘনিষ্ট একজনের সাথে ব্যাপারটি আলোচনা করলেন।

কিন্তু সেই লোকটি ছিল প্রচন্ড ভীতু। সে সোজা গিয়ে বলল পোপকে। বাধলো মহাফ্যাসাদ! পোপের নির্দেশে ব্রুনোকে গীর্জা থেকে বহিষ্কার এবং ইতালি থেকে বিতাড়িত করা হয়। দেশছাড়া হয়ে ব্রুনো পালিয়ে বেড়াতে লাগলো সুইজার‌ল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশে। তবে নতুন মত নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতাও করতে লাগলেন। এদিকে পোপ নিযুক্ত ইতালির নীতি-শাসক দল (ইনক্যুইজিশন) ব্রুনোকে শাস্তির মুখোমুখি করতে যাবতীয় চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তারা গিয়োভান্নি নামে ইতালির অভিজাত পরিবারের এক যুবককে দিয়ে ব্রুনোর কাছে পত্র পাঠালেন। পত্রে বলা হলো, তিনি ব্রুনোর ছাত্রত্ব গ্রহণ করতে আগ্রহী। ইতালিতে প্রয়োজনে সমস্ত প্রকার নিরাপত্তা দেওয়া হবে তাকে। দেশছাড়া ব্রুনো এতে প্রলুব্ধ হয়ে গোপনে ইতালির ভেনিসে আসলেন। এসে নতুন ছাত্রকে জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা দিতে থাকেন। এরই মধ্যে একদিন পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী পোপের ইনক্যুইজিশন দল ব্রুনোর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। বন্দি করা হলো বিজ্ঞানীকে। সেদিন ছিল ১৫৯২ সালে ২৩ মে। জিওর্দানো ব্রুনোর বয়স তখন মাত্র চুয়াল্লিশ। তাকে সীসার ছাদ দেওয়া একটি ঘরে বন্দি করা হয়। যা গ্রীষ্মকালে আগুনের মতো গরম ও শীতকালে বরফের মতো ঠান্ডায় পরিণত হতো। প্রতিনিয়তই তাকে প্রলুব্ধ করা হতো যাতে তিনি প্রকাশ্যে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চান। কিন্তু ব্রুনো সেইসব অনুরোধ ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দিতেন।

দীর্ঘ আট বছর চলে এই বন্দিত্ব ও নির্যাতন। অবশেষে একদিন সিদ্ধান্ত হলো, এই ‘পাপী’ ও ‘অপবিত্র’ ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে বাইবেলের ‘পবিত্রতা’ রক্ষা ও প্রায়শ্চিত্ত নিশ্চিত করতে হবে। ১৬০০ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসের এক শীতের দিনে ব্রুনোকে বাইরে নিয়ে আসা হয়। একটি খুঁটির সাথে শক্ত করে বাধা হয় তাকে। চারপাশে শত শত কৌতূহলী জনতা। পোপের পক্ষ হতে তাকে শেষবারের মতো সমস্ত দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলা হলো। ব্রুনো তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। তখন তাকে চূড়ান্তভাবে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। আগুন লাগানো হলো ব্রুনোর শরীরে। দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো তার হাত, পা, মুখ ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আগুনের চারদিকে গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে খুব তৃপ্তির সাথে তার মৃত্যুকে উপভোগ করছিলো জনতা। আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার আজন্ম লোভ সামলিয়ে এভাবেই বীরের মতো উত্তম পুরুষ হয়ে বিদায় নিলেন জিওর্দানো ব্রুনো।

ব্রুনোর এমন ভয়াবহ মৃত্যুর পর ইতালিতে কোপার্নিকাসের (পৃথিবী ঘূর্ণায়মান) মতবাদ প্রায় নিষিদ্ধই হয়ে এল। কোপার্নিকাস ও পরবর্তীতে ব্রুনোর প্রচেষ্টায় জ্যোতির্বিদ্যার যে সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল, ব্রুনোর হত্যাকান্ডের পর তখন সেই আশার প্রদীপটাও নিভে এল। সে সময় ইতালির পিসা শহরে বেড়ে উঠছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি নামের এক যুবক। ইতিমধ্যে টেলিস্কোপের বিভিন্ন মডেল বানিয়ে যিনি ইতালিতে রীতিমতো তুমুল জনপ্রিয়। প্রথম দিকে তিনি টলেমির (পৃথিবী স্থির) মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে এক পর্যায়ে তিনিও কোপার্নিকাসের (সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে) মতবাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী হয়ে উঠেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে বলার মতো সাহস তিনি পাচ্ছিলেন না। আরেক বিজ্ঞানী কেপলারকে তাই চিঠিতে মনের কথা লিখে জানিয়েছিলেন। গ্যালিলিও লিখেছেন- ‘আমি বহুদিন থেকেই কোপার্নিকাসের মতে বিশ্বাসী। বহু প্রমাণও পেয়েছি। কিন্তু প্রকাশ করতে সাহস হয় না। জগতে মূর্খের সংখ্যা এতো বেশি যে, প্রায় সব লোকই কোপার্নিকাসকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে। খুব কম লোকই তাকে অনুধাবন করে। আমি আশঙ্কা করছি, এমন কিছু লিখতে গেলে আমাকেও হয়তে ঐরুপ ঠাট্টা বিদ্রুপ করবে।’

১৬১২ সালে এক পাদ্রী গ্যালিলিওকে উপদেশ দিতে চাইলে তিনি পাদ্রীকে পাল্টা চিঠিতে লেখেন- ‘বাইবেল মানুষকে শিক্ষা দিতে চেয়েছে কিভাবে স্বর্গে যাওয়া যায়, কিন্তু শিক্ষা দেয়নি স্বর্গ কিভাবে চালিত হয়।’ এমন বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখে পাদ্রী সোজা গিয়ে পোপকে জানালো ব্যাপারটা। পোপ তার ‘নীতি শাসক দল’ (ইনক্যুইজিশন) নিযুক্ত করলেন গ্যালিলিওকে জবাবদিহিতা করার জন্য। ১৬১৬ সালের দিকে পোপের তরফ হতে গ্যালিলিওকে বলা হলো, তার সমস্ত মত ভুল বলে ঘোষণা করতে। সেইসাথে সমস্ত রচনা নিষিদ্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েরঅধ্যাপনা ছেড়ে দিতে। গ্যালিলিও নতমস্তকে সব মেনে নিলেন। কিন্তু অন্তর্গোপনে সত্য প্রকাশের এক অপ্রতিরোধ্য তাড়না খেলা করছিল তার মনে। নিষিদ্ধ হবার ১৬ বছর পর ১৬৩২ সালে তিনি সত্য প্রকাশের দুর্নিবার দায়বদ্ধতা থেকে প্রকাশ করলেন ‘এ ডিসকাসন অন দি টু প্রিন্সিপাল ল’জ অব দি ইউনিভার্স’ নামক জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ। ব্যাপারটি পোপকে জানালে তিনি শর্ত দেন, বই লিখছেন সমস্যা নেই। তবে ভূমিকায় অবশ্যই লিখতে হবে বইটির সবকিছুই ‘কোপার্নিকাসের মতো অনুমান মাত্র। প্রমাণিত নয়।’ গ্যালিলিও তাই লিখলেন। বইটির রচনাপ্রবাহ ছিল গল্পের মতন, যেখানে তিনিটি চরিত্র ছিল। একজন কোপার্নিকাসের মতে বিশ্বাসী, অন্যজন কোপার্নিকাস বিরোধী, আর তৃতীয়জন ছিল নিরপেক্ষ শ্রোতা। গ্যালিলিওর লেখার ভাষা ছিল অত্যন্ত সুমধুর। খুব সহজেই ইতালিতে বইটি জনপ্রিয় হয়ে যায় সাধারণ জনগণের মাঝে।

কিন্তু এর মাঝেই কিছু পাঠক অভিযোগ করলো, বইয়ের কোপার্নিকাস বিরোধী চরিত্রটি নাকি পোপেরই ব্যঙ্গাত্বক রুপ। আর যায় কোথায়! আলোড়ন সৃষ্টি হলো সমগ্র ইতালিতে। ১৬ বছর আগের নির্দেশ অমান্য করায় অবিলম্বে রোমে ডেকে পাঠানো হলো তাকে। পোপের নির্দেশ শুনে গ্যালিলিও যেন মাটিতে পা রাখলেন। একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখলেন, সম্ভাব্য ঘটনা খুবই ভয়াবহতার লক্ষণ। ব্রুনোর মতো তাকেও হয়তো পুড়িয়ে মারা হতে পারে। গ্যালিলিওর বয়স তখন সত্তর। আদেশ অমান্য করবার সাহসটুকুও তিনি পেলেন না। তখন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে কার্ডিনাল বারবেরিনির কাছে আবেদন করলেন যাতে রোমে যাওয়া থেকে তাকে রেহাই দেওয়া হয়। আবেদন অগ্রাহ্য করা হলো। উপরন্তু রোম থেকে বলা হলো- যদি দেখা যায় তিনি গুরুতর অসুস্থ নন, তাহলে তাকে শেকলে বেধে টেনে নিয়ে আসা হবে! বাধ্য হয়ে বৃদ্ধ গ্যালিলিও অতিকষ্টে রোমে আসলেন। প্রথমদিন পোপের আদালতে তার জবানবন্দি নেওয়া হয়। তাছাড়া তিনজন জ্যোতির্বিদকে গ্যালিলিওর বইটি দেওয়া হয়েছিল পরীক্ষা করে দেখার জন্য। পরের দিন যথারীতি বিচারকার্য শুরু হলে প্রথমেই প্রশ্ন-উত্তরের পর্ব চললো-

– আজ থেকে ১৬ বছর আগে ১৬১৬ সালে আপনাকে কি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল মনে আছে?
– হ্যা, আমার মনে আছে। আমাকে বলা হয়েছিল, ‘কোপার্নিকাসের মতবাদকে সমর্থন করা হয়’ এমন তত্ত্ব প্রচার বন্ধ করা।
– কিন্তু আপনি একটি বই লিখেছেন। তাতে আপনি সেই নির্দেশ মানেননি।
– হ্যা, আমি স্বীকার করছি আমার ভুল হয়েছে। বইটি আমি আবারো পড়েছি। মনে হয়েছে, কিছু ভুল থেকে গেছে। জোয়ার ভাঁটা ও সৌরকলঙ্ক সম্পর্কে কিছু কথা আছে। তা বোধহয় ভুল।
– আর পৃথিবীর গতি সম্পর্কে?
– এ নিয়ে যা লিখেছিলাম সেটা আর এখন আমি বিশ্বাস করি না। আমাকে সময় দিলে আমি এ ব্যাপারে কিছু লিখতে পারি।
সেদিনকার মতো বিচারকার্য মুলতবি ঘোষিত হয়। গ্যালিলিওকে আগের মতোই গৃহবন্দি করে রাখা হলো রোমে।তার কিছুদিন পর ১৬৩৩ সালের ১০ মে। বেশ কয়েকদিন বিরতির পর সেদিন শেষবারের মতো বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো গ্যালিলিওকে। সভার লোকজন দেখতে পেল তার চেহারায় হতাশার ছাপ। সারা শরীরে ক্লান্তি রেখা স্পষ্ট। বোঝাই যায়, শারীরিক না হোক এতদিন অন্তত মানসিক নির্যাতনের মধ্যেই ছিলেন তিনি। শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব-

– কতদিন ধরে আপনি বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবী ঘোরে?
– অনেকদিন থেকেই। সূর্য ঘোরে ও পৃথিবী ঘোরে এ দুই মতই বিচারের যোগ্য। তবে চার্চ যখন ‘পৃথিবী ঘোরে’ এই মতকে সমর্থন করে না, তখন আমিও তা বিশ্বাস করি না। পুরোনো মতই মানি। ১৬১৬ সালের পর থেকে আমি আর কোপার্নিকাসের মত মানি না।
– মিথ্যা বলছেন। আপনি এরপরেও মেনেছেন।
– না।
– তবে আপনার বইতে যা লেখা আছে পড়ছি, শুনুন।
[বইয়ের ‘সূর্য ও পৃথিবী’ অংশটি পড়ে শোনানো হলো]
গ্যালিলিও বললেন- আমি একথা লিখলেও এখন আর বিশ্বাস করি না।সভাস্থল জুড়ে রাজ্যের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কোপার্নিকাসের অনুসারী জ্যোতির্বিদরা এক মুহুর্তেই যেন বাকশক্তিহীন হয়ে গেলেন। নিজের কান ও চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তারা। গ্যালিলিও কী কারনে সেইদিন এমন স্বীকারোক্তি দিলেন তা আজো ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়। যাইহোক, গ্যালিলিওর জন্য শাস্তি ঘোষিত হলো। ব্রুনোর মতো ভয়াবহ কঠিন কিছু নয়, ভুল (?) স্বীকার করে নেওয়ায় কিছুটা লঘু শাস্তিই জুটলো তার কপালে। চার্চ রায় দিলো, ‘গ্যালিলিওকে অনির্দিষ্টকালের জন্য গৃহবন্দি থাকতে হবে এবং পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে তিন দিন করে বাইবেলের সাতটি শ্লোক প্রতি সপ্তাহে উচ্চারণ করতে হবে।’

গ্যালিলিও নতমস্তকে সমস্ত রায় শুনলেন এবং বিচারসভা ত্যাগ করার সময় মৃদুস্বরে বিড়বিড় করে বললেন, তবুও পৃথিবী ঘুরবে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>