“সূর্য দীঘল বাড়ি” : সমাজবাস্তবতার নিরীখে (শেষ পর্ব)

Reading Time: 15 minutes

গত পর্বের পরে…

 

প্রথম দৃশ্যে আমরা দেখি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু স্টক চিত্র- পর্দা জুড়ে বোমা বিস্ফোরিত, পড়ে আছে সারি সারি- না মানুষের মৃতদেহ নয়- চালের বস্তা। মন-কেড়ে-নেওয়া কাট্। যুদ্ধ, খাদ্য ও দুর্ভিক্ষের মধ্যেকার সম্পর্ক যে কত কাছাকাছি- আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতায় আমরা তা জানি। এত ব্যঞ্জনাময় একটা জাম্প-কাট্ খুব কম দেখেছি ছবিতে। এই প্রসঙ্গেই এসে পড়ে আরেকটি জাম্প-কাটের কথা। খুরশীদ মোল্লার ফুড কমিটির অফিসের সামনে চাল-প্রত্যাশী জনতার ভীড়। ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি, দুটি শিশু পড়ে যায়। উপরে পড়ে আরো কিছু মানুষ। কাট্/ বিশাল যান্ত্রিক চাল কল। ধান সেদ্ধ হচ্ছে। লম্বা চিমনী থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া। কালো ধোঁয়া ঢেকে ফেলছে শ্বেতশুভ্র আকাশ।…. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ….. কনসেনট্রেশন ক্যাম্প….. লম্বা চিমনী….. কালো ধোঁয়া….. আউসভিৎস….. মেরুদন্ড-শিরশির-করা এক অবচেতন অনুভূতি ! এ দু’টি জাম্প-কাটের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম, কারণ, পূর্ব-বাংলার সামন্ততান্ত্রিক গ্রাম্যজীবনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কর্তৃক এক ধাক্কাতেই পুঁজিবাদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়াও ছিল এক ধরণের জাম্প-কাট্— এক বিশাল ঐতিহাসিক উল্লম্ফন।

ছেলে দাঁড়ায় চালের লাইনে, মা কাজ করে ধানকলে বা সস্তার জেলা ময়মনসিংহ থেকে চাল এনে রেল-টিকিট ফাঁকি দিয়ে বিক্রি করে নারায়ণগঞ্জের ‘সাহেবদের’ বাসায়। চাল এখানে শুধু আহার্য নয়, জীবিকারও সংস্থান। অবশ্য আকাল-পীড়িত জনগণের জন্যে চাল কি আরো বেশি কিছু নয়? মনে পড়ে “অশনি সংকেত”-য়ের ছুটকীর সামনে বাড়িয়ে ধরা একমুঠো চালের কথা। চালের বদলে যৌবন, চালের বদলে মূল্যবোধ, চালের বদলে জীবন বা আর একটু ঘুরিয়ে বললে চালই প্রতীক- জীবনের।

সামন্তবাদেও রয়েছে শ্রম বেচার সমস্যা; “কার্তিক মাসের আকালের সময় কাজ পাইবি কই?” কিন্তু নতুন অর্থনৈতিক সম্পর্কে শ্রম বেচাকেনায় বড় বেশি নগদ বিকিকিনি। হাসু শ্রম বেচতে যায় ঠিকেদারের কাছে, ঠিকেদার নেয় না, নিলেও নেয় তার নিজের সুবিধাজনক শর্তে। সামন্তপ্রভুর বদলে ঠিকেদারী প্রভু। ধানের বদলে নগদ পয়সা। ভূমিদাসত্ব থেকে শ্রমদাসত্ব। শ্রম বেচতে আসা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাদের লাইনে খোয়া ভাঙ্গার কাজে হাসু টিপসই দেয় মহাজনের কাছে। ঠিকেদার, নগদ পয়সা আর টিপসই- এ এক নতুন যুগ, লালুর মায়ের হাতের সিগারেটে যে নতুন যুগের মূল্যবোধকে প্রতিভাত করতে চলচ্চিত্রকারদ্বয় পরিশ্রমী।

আগেই বলেছি পূর্ববঙ্গের পুঁজিবাদের ধাত্রী ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানীরা এসে গিয়েছিল চট্টগ্রামের দোরগোড়ায়। বোমা পড়ল কলকাতায়। “সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি/ বোম ফেলেছে জাপানী/ বোমার আগায় কেউটে সাপ/ ব্রিটিশ বলে বাপ-রে-বাপ”। তো বাপ-রে-বাপ বলা ব্রিটিশ পূর্ববঙ্গকে অরক্ষিত রেখেই সরে পড়তে চেয়েছিল। কলকাতা ছিল তাদের মাথাব্যথা। আর অভাগা পূর্ববঙ্গের জন্যে ছিল ‘পোড়ামাটি নীতি’। ধ্বংস হোল সব বড় নৌকা, যানবাহন। অনিবার্যভাবে এলো তাই— মন্বন্তর। ১৯৪৩ সালের সেই মহামন্বন্তরে পূর্ববঙ্গের সরল কৃষাণ-কৃষাণীর “মা এট্টু ফ্যান দাও” বলে কলকাতার পথে পথে আছড়ে পড়ার সে ট্্রাজেডি আমাদের ইতিহাসের সবচে’ মর্মান্তিক এক আলেখ্য। পুঁজিবাদ আসছে। এল চল্লিশ লক্ষ মানুষের লাশের উপর পা ফেলে ফেলে। এত বড় মৃত্যুযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব একটা দেখা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এদেশের মানুষ যোগ দেয়নি বটে, কিন্তু যুদ্ধের করাল গ্রাসে এত বড় আত্মবলি একমাত্র রুশ দেশের জনগণ (যারা দু’ কোটি মানুষ হারিয়েছিল ) ছাড়া আর কারো চেয়ে তো কম ছিল না। ধাপে ধাপে এগিয়ে আসা এই মন্বন্তরকে তুলে ধরা হয়েছে জয়নুল আবেদীনের রেখাচিত্র ও হাড়সর্বস্ব মানুষদের স্থিরচিত্রের মাধ্যমে। একজন সমালোচক গদারের ছবিকে বলেছেন কোলাজ চলচ্চিত্র। রেখাচিত্র, স্থিরচিত্র, ফটোগ্রাফি, প্রামাণ্যচিত্র ও সিনেমা ভেরিতের সংমিশ্রণে “সুর্য দীঘল বাড়ি” -র প্রথম কয়েকটি দৃশ্যও এক ধরণের কোলোজ চলচ্চিত্র।

তবে দুঃখ ইতিহাসের যুপকাষ্ঠে এত বড় বলিদানের পরেও এদেশে আসেনি কাক্সিক্ষত শিল্প-বিপ্লব বরং পাকিস্তান নামক নতুন কৃত্রিম রাষ্ট্রযন্ত্রটির মাধ্যমে শুরু হো’ল আমলা-মুৎসুদ্দী পুঁজির এক অসুস্থ বিকাশ। শুরু হো’ল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় কর্তৃক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে খেদিয়ে তাদের ধন-সম্পত্তি, বসতবাটি, জমি-জিরাত লুটেপুটে খাওয়ার এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।

আমাদের সমাজজীবনে আধুনিক সভ্যতার সব চেয়ে দৃষ্টগ্রাহ্য প্রতীকটি কি? যদি একটি মাত্র বস্তুর নাম বেছে নিতে হয়, তা’হলে বলব- রেলগাড়ি। মার্কসেরও দৃষ্টি এড়ায়নি তা “ঞযব ঋঁ:ঁৎব জবংঁষঃং ড়ভ ইৎরঃরংয জঁষব রহ ওহফরধ” -তে লিখেছিলেন; “The Future Results of British Rule in India” -‡Z wj‡LwQ‡jb; ÒThe railway system will become in India truely the forerunner of modern industry  …….. Modern industry, resulting from the railway system, will dissolve the hereditary division of labour upon which rest, the Indian castes, those decisive impediments to indian progress and Indian power“। আসলেই গতি, যন্ত্র ও ধোঁয়া নিয়ে রেলগাড়ির মত অন্য কিছুই যন্ত্রসভ্যতার এত খাঁটি প্রতীক হতে পারে না। তাই সামন্তবাদ থেকে ধনতন্ত্রে উত্তরণের এই যুগসন্ধিক্ষণের ভারতবর্ষের তিনজন সেরা সেলুলয়েড শিল্পী— সত্যজিৎ, ঋত্বিক বা মৃণাল সেনে— বারে বারেই এসেছে রেলগাড়ি। অপু-ট্রিলজিতে অপুর বিকাশের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের বিকাশ ও অবক্ষয়ের যে বিশাল ক্যানভ্যাস, যেখানে গ্রাম্য জীবন থেকে নাগরিক জীবনের বিকাশের ব্যাপারটি আনা হয়েছে মহাকাব্যিক ক্যানভাসে, সেখানে ট্রিলজীটির এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হচ্ছে রেলগাড়ি। সাদা কাশবনে অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখার সেই অনন্য দৃশ্যটি থেকে শুরু করে ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’- য়ে ফ্রেমে ও সাউন্ডট্রাকে রেলগাড়ির পৌনঃপুনিক উপস্থিত এতই দৃষ্টিগ্রাহ্য যে মারী সিটন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলেও চোখ এড়াতে পারে না। ‘ভুবন সোম’-য়ে মৃণাল সেন বা ঋত্বিক ঘটকেও এসেছে রেলগাড়ি। সচেতনভাবেই। মনে করুন “কোমল গান্ধার”-য়ের সেই বিশেষ শট্টি। পড়ে রয়েছে সমান্তরাল রেললাইন। যে লাইনে এখন গাড়ি চলে না, যে লাইন গেছে পূর্ববঙ্গে, ঋত্বিকের ফেলে আসা হৃদয়- নিংড়ানো সেই স্মৃতিমেদুর পূর্ববঙ্গে !

রেলগাড়ীর সচেতন প্রতীকি ব্যবহারে “সুর্য দীঘল বাড়ি”-র চলচ্চিত্রকাররাও বৈচিত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। জয়গুন ট্রেনে চেপে চাল কিনে আনে, হাসু স্টেশনে মোট বয়— রেলগাড়ি  এদের জীবিকার অঙ্গ। এছাড়াও রয়েছে রেলগাড়ীতে জয়গুনের বিনা টিকিটে ভ্রমণ, পুলিশের তাড়নার দৃশ্য, ÔNightmailÕ -য়ের চিঠির বস্তার মত চালের বস্তা ফেলার শট, রেলের যন্ত্রাংশ দেখানোর কিছু প্রতীকী শট  বা ‘পাকিস্তান বড়ি’ বিক্রির দৃশ্যটিতে রেল কামরায় বিতর্করত দুই যাত্রীর মুখের গড়ন তুলে ধরতে ক্যামেরায় ট্রেনের ‘জার্ক’- য়ের ব্যবহার— আসলেই বারে বারে, ফিরে ফিরে ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ -তে রেলগাড়ি এসেছে—এসেছে একটা leit-motif -য়ের মতো।

শেক্সপীয়ার সম্পর্কে কথাটি বলেছিলেন আয়ান কট যে, শেক্সপীয়ারের কৃতিত্বটা এখানেই যে ষোড়শ শতকীয় ব্রিটেনের সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের ওই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে, ধনতন্ত্রের ওই ঊষালগ্নেই, পুঁজিবাদী চক্রের অন্তিম পর্যায় পর্যন্ত ওঁর দৃষ্টি ছিল প্রসারিত। আর সেই কারণেই অর্থ -সম্পর্কভিত্তিক সমাজে মানুষে মানুষে সম্পর্ক যে শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে “দি মার্চেন্ট অব ভেনিস” বা “টিমন অব এথেন্স” -য়ে তিনি তা ভাল করেই এঁকে দিয়ে গেছেন। যে কোনো বড় শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে যে, তা নিজের কালের ইতিহাসে দাঁড়িয়েই দিকনির্দেশ করতে পারে ভবিষ্যৎ ইতিহাসের ধারাকে। “সূর্য দীঘল বাড়ি”- র প্রেক্ষিত চল্লিশ দশক অর্থাৎ পূর্ববঙ্গে ধনতন্ত্রের ঊষালগ্নের সময়কালটা হলেও ধনতন্ত্রের পরিণতির দিকেও চলচ্চিত্রকাররা ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। আর এ বিষয়ে যে চরিত্রটি সবচে’ বেশি মনোযোগের দাবি রাখে সে হচ্ছে হাসু। জয়গুনের শীতল সহ্যশক্তির সমান্তরালে গড়ে উঠেছে হাসুর প্রতিবাদী ক্রমবিকাশ। কী ভাবে ধাপে ধাপে গ্রামবাংলার  সহজ সরল সুঠাম ছেলেটি ক্রমশঃ জীবনযুদ্ধে পোড়-খাওয়া একজন শ্রমজীবী যুবক হয়ে উঠেছিল , তার জন্য বহু মন্তাজেরই উদাহরণ টানা যায়। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার ফ্লাশব্যাক দৃশ্যে দেখি বালক হাসু করিম বক্সের হাত কামড়ে দিচ্ছে, কারখানায় চাকুরী চাওয়াতে বা ঠিকেদারের কাছে ন্যায্য মজুরির দাবিতে হাসু ক্রমশঃই হয়ে উঠতে থাকে সোচ্চার। শৈশব থেকেই হাসু প্রয়োগবাদী। ডিমগুলো বাচ্চা ফোটানোর চেয়ে ভেজে খাওয়াতেই তার বেশি আগ্রহ। ডিম চারটি জুম্মাঘরে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ওগুলো বাজারে বেচে ভাইবোনদের জন্যে কিছু কেনাকাটাকেই সে মনে করে বুদ্ধিমানের কাজ। জয়গুন কুসংস্কারমুক্তা, কাসুর অসুখে ফকিরের বদলে ডাক্তার সে-ই আনায়। কিন্তু কুসংস্কারের বিরুদ্ধে হাসুর অবস্থান আরো একটু প্রতিবাদী। জোবেদালী ফকিরের জ্বীন-ভূতের গালগল্পের বিরুদ্ধে হাসুর প্রতিবাদ; “জ্বীনের বাসা তো আমাগো কিছু হয় নাই, আমরা তো এখানেই আছি”; কিম্বা নিশুতি রাতে ঘরের চালে ছায়ামূর্তির ঢিল পড়লে বালক হাসুই বেরিয়ে এসে অকম্পিত স্বরে জানতে চায়; “কেডা? কেডা চাক্কা মারে?” পরিপার্শ্ব সম্পর্কে এই মুক্তদৃষ্টি , এ শুধু একটি শ্রমভিত্তিক কর্মঠ মনের পক্ষেই সম্ভব। আর হাসুর জীবনটা তো আগাগোড়াই দাঁড়িয়ে আছে শ্রমের উপরে। লেদু প্রশ্ন করে হাসুকে; “গ্রামের কামে খাটুনি কেমন বুঝতাছস?” হাসুর সাফ জবাব; “শহরের কামেও খাটুনি কম নাই।” বয়োজ্যেষ্ঠ লেদুর জীবনের অভিজ্ঞতা আরো বেশি। সহজভাবে সে তাদের জীবনের মূল সত্যটি তুলে ধরে; “বেবাক কামেই খাটুনি। খাটুনি ছাড়া কাম নাই, আর কাম ছাড়া— ভাতও নাই।”

আর একটি সামাজিক সমস্যা চলচ্চিত্রকাররা বলিষ্ঠভাবে এনেছেন। তা হচ্ছে— শিশুশ্রম। হাসু ও তার সহকর্মীরা, বা ধানকলে কর্মরত বালকদের মাধ্যমে, আমাদের সমাজের এই পাপটিকেও তুলে ধরা হয়েছে দক্ষতার সাথে।

হাসুর উপস্থাপনার ব্যাপারে, চলচ্চিত্রকাররা কিছুটা ফিউচারিস্ট। হাসু ভবিষ্যতের মানুষ। হাসু ও কারখানা, হাসু ও মেশিন, হাসু ও রেলগাড়ি, হাসু ও যন্ত্রের কলকজা, হাসুকে বরাববরই উপস্থিত করা হয়েছে যন্ত্র ও আধুনিক সভ্যতার প্রেক্ষিতে। এদিক থেকে হাসু ও রেলইঞ্জিনের দৌড় প্রতিযোগিতার মন্তাজ শট্টি গভীর অর্থবহ। জীবনে হাসুর একটাই স্বপ্ন— কারখানার শ্রমিক হবে সে। চাকুরী নেই শুনে অন্যান্যরা লাইন ছেড়ে চলে যেতে থাকলেও হাসুর উদগ্রীব প্রশ্ন; “কবে লোক নেবেন আপনারা? কবে ?” বোঝা যায় হাসু একদিন কারখানার শ্রমিক হবেই। বৃদ্ধ দারোয়ানটিও যেন তাকে চিনে ফেলে। আনেক সহানুভূতির স্বরে এবার তাই শুধু ওকেই বলে; “দু’তিন মাস পরে খোঁজ নিস।” হাসু হবে সেই জায়মান শ্রেণীর একজন যারা একদিন হবে এই নব্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গোরখোদক। ধরা যাক ঐ টপশট্টির কথা। ক্যামেরা উপর থেকে দেখছে লোহার শিকের ভিতর দিয়ে ইঁট মাথায় উঠে আসছে হাসু। অন্ধকার থেকে আলোর পথে ধাপেধাপে উঠে আসছে পিঞ্জরাবদ্ধ শ্রম। বাড়ি তৈরিতে মাথায় “মুকুট” পরা হাসু ও তার সঙ্গী কিশোর-শ্রমিকদের মনে হয় যেন রাজপুত্র যারা এক দিন বন্দী-ভবিষ্যৎকে উদ্ধার করবে মুনাফা নামক ডাইনীর হাত থেকে। যথার্থ ক্যামেরা কোণের মাধ্যমে চমৎকার কম্পোজিশন সৃষ্ট করার আনোয়ার হোসেনের দক্ষতার বিশেষ প্রমাণ এই গোটা সিকোয়েন্সের শট্গুলি।

একটা ফ্রেমে দেখা যায় হাসুর মুখ, মাথার উপর রেলের সিগনাল ও অদূরে বুভুক্ষ এক ছিন্নমূল পরিবার। হাসু দেখছে। মন্তাজটি অর্থবহ। হাসু দেখে, দেখছে সব কিছুই। শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের এই শোষণের হিসাব নিকাশ এক দিন সে কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে। জয়গুন পারেনি, কিন্তু হাসুরা পারবে গদু প্রধানদের ধ্বংস করতে। ইতিহাস শেখায় সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসের ক্ষেত্রে কত বড় ভূমিকাই না নিতে পারে শহরের শ্রমজীবী শ্রেণী। স্তেপের দোর্দন্তপ্রতাপ সামন্তপ্রভুদের পরাজিত করতে, ‘মুজিক’দের মুক্ত করতে, পেট্রগাদের শ্রমিকেরাই লাল করেছিল একদিন স্তেপের কালো মাটি।

হাসুর চরিত্রায়নে পরিচালকেরা গভীর শ্রেণী-চেতনার স্বাক্ষর রেখেছেন। হাসু ও নম্বরী কুলিদের মধ্যেকার সূক্ষ্ম শ্রেণী-দ্বন্দ্ব চিত্রণে (‘কি রে প্যাসেঞ্জারের চড় কেমন লাগে’?) পরিচালকরা দেখিয়েছেন প্রলেতারিয়েত ও লুম্পেন-প্রলেতারিয়েতদের মধ্যেকার সূক্ষ¥ পেশাদারী অন্তর্দ্বন্দ্বটাও।

আমাদের প্রলেতারিয়েতদের এক পা’ এখনও গাঁয়ে। হাসু তার উদাহরণ। অবশ্য ইতিহাসের অনিবার্যতায় গাঁয়ের বাস তুলে এক দিন তাদের শহরমুখী হতেই হবে। যখন তারা গ্রামে এসেছিল তখন ক্ষুদ্র মিছিলটির সামনে ছিল জয়গুন। ফেরার পথে মিছিলের সবার সামনে— হাসু। হাসু ভবিষ্যতের পথিকৃত। শুধু পরিবারটি নয়— শ্রেণীটির, সমাজের, গোটা জনগোষ্ঠীর।

আরেকটি যে ব্যাপারে চলচ্চিত্রকাররা গভীর সমাজচেতনার পরিচয় রেখেছেন, তা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সূক্ষ্ম শ্রেণী বিশ্লেষণ। কী ভাবে দুই মধ্যবিত্তের অসম বিকাশকে লেজে খেলাল ব্রিটিশ, ঘটল নারকীয় সব দাঙ্গা, হো’ল বাংলা-বিভাগ ও দেশত্যাগের ট্রাজেডি, ইতিহাসের সচেতন পাঠকমাত্রেই তা জানেন। যাদের ‘আপত্তি’ মেটাতে জয়গুন কখনো শাক, কখনো ময়মনসিংহের বিরই চাল এনে দিত, সেই তুলসী-উঠোন, সেই শাঁখা-সিঁদুরের স্বচ্ছল হিন্দু মধ্যবিত্ত গৃহবধূ, সেই গোটা শ্রেণীটি আজ পূর্ববঙ্গ থেকে উৎপাটিত হয়েছে, যে অমানবিক ট্রাজেডির যন্ত্রণাময় প্রকাশ— ঋত্বিক। তবে পুরো ব্যাপারটির স্মৃতিমেদুর আবেগময়তার দিকটি বাদ দিলে থেকে যায় যে সার শ্রেণী-সত্যটি, তা প্রকাশেও চলচ্চিত্রকারদ্বয়ের ইতিহাসচেতনা তীক্ষè। ধূতি-লুঙ্গি দাড়ি-টিঁকির বিরোধ যতই থাকুক না কেন, এক জায়গায় মিল ছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় মধ্যবিত্তের, আর তা হচ্ছে, পূর্ব-বাংলার জলে-কাদায় মাখানো সহজ-সরল গ্রামীণ কৃষক সমাজকে ঠকানো ও শোষণ। তাই চালের চরম সংকটের সময়, যখন বাইরে দেখি বুভুক্ষু জনতার লাইন, তখন ‘মানীর মান না রেখে’ পারা যায় না বলে প্রাক্তন জমিদার ভবানীশঙ্করের নাতির অন্নপ্রাশনের জন্যে দু’বস্তা চাল লোকচক্ষুর আড়ালে ঠিকই পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তানের নব্য-শাসকেরা। শোষকে-শোষকে মিল চিরন্তন। জাত নেই ওদের। ‘পালঙ্ক’-য়ের মকবুলেরও ছিল একই উপলব্ধি; “পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলমান সব এক হইয়া গেছে, মকবুলের দুধ আর কেউ কিনবে না”। রাষ্ট্র নামক শোষণযন্ত্রটি কেমন করে মসৃণভাবে চালাতে হয়, পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর মুসলমান শাসকশ্রেণী তখনও তা’ শিখে উঠতে পারেনি। তাই পুরনো কালের শোষক অর্থাৎ হিন্দু মধ্যবিত্তের যোগ্যতায় তারা ছিল ক্ষুব্ধ ও ঈর্ষান্বিত। পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও শুনতে পাই ওদের ক্ষোভ; “….কোর্ট-কাছারি ওগো হাতে, পাকিস্তান হইয়াও শান্তি নাই।” অবশ্য মুনাফার কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন চোরাচালান বা কালোবাজারী, এসবে তখনও রয়েছে পারস্পরিক যোগসাজশ। খুরশিদ মোল্লার ফুড কমিটির অফিসে শুনি রহস্যময় আলাপ; “নারায়ণগঞ্জে চাল আসেনি………চাল ধরে রাখতে হবে….গোপালকে খবর দিও।”

               

বাজার-গঞ্জ জায়গা। তাই কাঠের আড়তে আলোচনারত গদু প্রধান, খলিল মাতবর ও কাঠ-ব্যবসায়ীর আলোচনাতে স্বাভাবিকভাবেই আসে রাজনীতি; “জিন্না সাব তো অন্য জাতেরে খারাপ কয় নাই” বলে খলিল মাতবর। কিন্তু গদু প্রধানের চিন্তা বয় আরো মোটা খাতে। জয়গুনের শরীরের বাঁকেই তার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ। ফলে জিন্ন্াহ, পাকিস্তান বা হিন্দু-মুসলমান বিরোধ এসব ব্যাপার তার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যা’ গুরুত্বপূর্ণ তা হোল; “হেই মিয়া, শুনলাম জব্বর মুনশীর বিবি নাকি আবার করিম বক্সের ঘরে গেছিল।” গদু আগাপাশতলা সামন্ত। দৃষ্টি ওর নিজ গাঁও-গঞ্জের বাইরে প্রসারিত হয় না কখনো। পাকিস্তান সৃষ্টিতে এরা ছিল জুনিয়ার পার্টনার। আর আমলা-মুৎসুদ্দী পুঁজিনির্ভর শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত শহুরে মুসলমান মধ্যবিত্তই ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির মূল চালিকা শক্তি। আর এই পাকিস্তান সৃষ্টি প্রসঙ্গেই চলচ্চিত্রকারদ্বয় এমন কিছু সূক্ষ¥ ও সাহসী রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছেন যা গোটা ছবিটাতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

               

কৃমির বড়ির নাম ‘পাকিস্তান বড়ি’— সর্বরোগহরণকারী ধন্বন্তরী। মূল গায়েন বোম্বের এক ব্যারিস্টার— নাম মহম্মদ আলী জিন্নাহ; আর দোহার পূর্ববঙ্গের পেট মোটা, মাথামোটা, চোঙ্গা-ফুঁকা মুসলীম লীগ নেতা ও পাতিনেতার দল। কথাটি প্রচলিত আছে বেশ যে “The most Anglicized Indian politician” জিন্ন্াহ্ ও তাঁর টাইপরাইটার এনেছিল পাকিস্তান। এ কথা ঠিক যে জিন্নাহ্র ক্ষুরবুদ্ধি ‘পাকিস্তান’ নামক এক বায়বীয় ধারণাকে দিতে পেরেছিল বাস্তবতা, কিন্তু তবুও কথাটি আংশিক সত্য, পূর্ণ সত্য নয়। যেমন সত্য নয় পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্তের চরম সাংস্কৃতিক ও আত্মিক অবক্ষয় দেখে কেউ কেউ যাকে তুলনা করেছেন ঝাঁক বেঁধে আত্মহত্যা করার মত। যেমনটি মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করে ডলফিন। কথাটি মানতে পারিনি। কারণ ব্যক্তিগতভাবে কোনো মানুষ কখনো আবেগ, অনুভূতি বা বিষয়ীগত (subjective) কারণ দ্বারা চালিত হতে পারে বটে, কিন্তু গোটা একটা শ্রেণী যখন কোনো লক্ষ্যের প্রতি প্রচন্ডভাবে ধাবিত হয়, তখন বুঝতে হবে তার পিছনে রয়েছে কোনো নিগূঢ় শ্রেণীস্বার্থ। পাকিস্তান হলে চাকুরী-বাকুরী, ব্যবসায়-বাণিজ্য, কোর্ট-কাছারীর প্রতিযোগিতা থেকে হিন্দু মধ্যবিত্ত অপসৃত হবে, চিচিং ফাঁকের মতে খুলে যাবে বিকাশের অবারিত দ্বার, এই শ্রেণীস্বার্থবোধই জায়মান মুসলমান মধ্যবিত্তকে লালায়িত করেছিল, উদ্বুদ্ধ করেছিল পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে। অন্যথায় জিন্ন্াহ্র ব্রিটিশ-দালালী, আদমজী-ইস্পাহানীর লগ্নিপুঁজি, পূর্ব-বাংলার চোঙ্গা-ফুঁকা মুসীলম লীগ নেতাদের গলাবাজী, কোনো কিছুই সৃষ্টি করতে পারত না পাকিস্তান। আজকের ধানমন্ডি, গুলশান, টয়োটা-মিৎসুবিসি শোভিত ঢাকা নগরী দেখেও কি বোঝা যায় না, কেন ১৯৪৭ সালে উদীয়মান মুসলমান মধ্যবিত্ত চেয়েছিল পাকিস্তান? যদিও এতখানি আশা করেনি তারা বা ছিল না প্রাপ্তির এত সুস্পষ্ট ধারণা, তবুও সরাসরি ধানক্ষেত-থেকে-ধানমন্ডিতে-উত্তরণ, হাতে পাচনের বদলে নিজস্ব প্রাইভেট গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল, এ সম্ভাবনা কি অবচেতনায় করেনি অনুপ্রাণিত? তবে যেহেতু শাসকেরা হয় চতুর, তাই সহজেই নিজেদের চিন্তুা-চাওয়াকে পরিণত করতে পারে গোটা জাতির চাওয়াতে। মার্কস বৃথাই বলেননি; The ruling ideas of a period are the ideas of the ruling class.”।

তবে ব্যাপারটি সব সময় সহজ হয় না। তাই শাসক শ্রেণীর বৈষয়িক কারণেই প্রয়োজন পড়ে এমন একটা ভাবাবেগের জোয়ার সৃষ্টি করা যা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এবং যে ভাবাবেগ কখনো কখনো পৌঁছে যায় একটা বিকারের পর্যায়ে, যেমন ’৪৬-৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতা পৌঁছেছিল বাংলা ও পাঞ্জাবে। আর পাকিস্তান সৃষ্টিতে এ জোয়ার সৃষ্টি করা হয়েছিল ইসলামী তহযিব-তমুদ্দুনের আশ্বাসে, মুসলমানদের  জন্যে এক পাকভূমির মরীচিকা-প্রলোভনে। আর এভাবেই মুষ্টিমেয় মুসলমান উচ্চ ও মধ্যবিত্তের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল দরিদ্র মুসলমান জনগণের বিশাল অংশকে তাদের পিছনে গাধাবোটের মত টেনে নিয়ে যেতে পারা। অবশ্য জিনিষের নাম কতখানি হিন্দুয়ানি বা মুসলমানী হো’ল তা’ নিয়ে জয়গুনের মাথাব্যাথা ছিল না কখনো, তার আগ্রহ ছিল মূলত: জিনিষের দাম নিয়ে। আর তাই রেল-কামরায় সীটে-বসা পরিষ্কার কাপড়-জামা-পরা যাত্রীরা যখন আলোচনা করে যে পাকিস্তান হ’লে চালের দাম কমবে, তখন মেঝেতে বসা জয়গুন তা আগ্রহ নিয়ে শোনে, আর একটু এগিয়ে বসে, তার সহানুভূতির কাঁটা ঝুঁকে ঝুঁকে পাকিস্তানের পক্ষে স্থির হয়। পাকিস্তান হলে জিনিসপত্রের দাম কমবে এ কথা জয়গুন বিশ্বাস করেছিল আন্তরিকভাবেই। সরলা গ্রাম্য নারী কি করে বুুঝবে ধনবাদী অর্থনীতির মারপ্যাঁচ, বোম্বের ব্যবসায়ী আদমজী-ইস্পাহানীর লগ্নিপুঁজির স্বার্থ, জিন্নাহ্র কুটবুদ্ধি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বা মার্কিনী নয়া-উপনিবেশবাদের সাতনলা কৌশল ও মুদ্রাস্ফীতির গূঢ় রহস্য।

এক ন্যাড়া গাছে হাসু ওড়ায় পাকিস্তনী পতাকা। স্লোগান দেয়; “বল্ পাকিস্তান-জিন্দাবাদ!” শিশু সফী ও মায়মুন সে স্লোগান মেলাতে পারে না। ভুল স্লোগানের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের, ওদের জীবনে তাই পাকিস্তানী স্লোগান আজীবন বেমিলই থেকে যায়! পাশাপাশি দু’টি গাছ। একটি পাতাবিহীন ন্যাড়া গাছ আর একটি ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’-র বহু ঘটনার সাক্ষী সেই প্রতীকী তালগাছটি। খুব প্রতীকীভাবেই ন্যাড়া গাছে ওড়ানো হয়েছিল পাকিস্তানী পতাকা; পাকিস্তান বন্ধ্যা, ওদের ভাগ্যের পরিবর্তনে পাকিস্তান কোনো স্বর্ণডিম্বই প্রসব করতে পারেনি। আর তাইতেই জয়গুনের কণ্ঠে শুনি অনেক বাস্তববাদী নির্দেশ; “এবার পাকিস্তান থুইয়া গাছ থেকে নাইম্যা কাম-কাজ কর।”

               

পাকিস্তান সৃষ্টির পর একদিকে দেখি পর্ণকুটিরে এক বালক তার দরিদ্র মাকে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলছে; “দেশ স্বাধীন হইছে মা, দেখ এবার চালের দাম কমবে।” অন্য দিকে দেখি জোতদার গদু প্রধান, খলিল মাতবর বা ফুড কমিটির সেক্রেটারি খুরশীদ মোল্লার পোয়াবারো, দালান উঠছে পাটের দালাল নব্যধনী হোসেন মিয়ার। বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ শাকের-নিয়ামতের। ছোট ছোট কিছু বাক্যের মাধ্যমে এবং পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগানরত ট্রাক থেকে পথচারীর মুখে কাদা ছিটে যাওয়া, কলকাতা ফেরত মিঞার হাতে হাসুর চড় খাওয়া, রেলকামরায় হাতে ‘আজাদ’ নিয়ে তরুণ মৌলবীর বিতর্ক, এরকম সূক্ষ্ম কিছু মন্তাজ শটের মাধ্যমে সেই জটিল ঐতিহাসিক যুগটাকে তুলে আনতে, তথা পাকিস্তান সৃষ্টির গোটা ব্যাপারটায় ডিটেল্সের ক্ষেত্রে পরিচালকেরা অনবদ্য দক্ষতার ছাপ রেখেছেন

               

ÒAll artistic appreciations depend upon one’s political outlook” কথাটি বলেছিলেন ব্রেশট। “সূর্য দীঘল বাড়ি” ছবিটিও একজন দর্শকের ভালো লাগা-না-লাগার অনেকখানিই নির্ভর করবে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কি ? সাম্প্রদায়িকতা ও পাকিস্তানী রাজনীতিতে তার লাভ হয়েছে কতখানি ? পাকিস্তান নামক আশ্চর্য প্রদীপটির কল্যাণে যাদের ভাগ্য পাল্টেছে রাতারাতি, ছবিটি তাদের অনেকেরই ভাল নাও লাগতে পারে।       

  

বস্তুত দেশভাগের এই মহাকাব্যিক ট্রাজেডিতে লাভ হোল কার? সতীনাথ ভাদুড়ী ঠিকই দেখিয়েছিলেন; লাভ হয় মুনীমজীদের, যারা একই সঙ্গে মুসলমানের কাছে বেচে পাকিস্তানের পতাকা আর হিন্দুর কাছে বেচে ভারতের। লাভ হয় ব্যবসায়ীর। শেষ পর্যন্ত জয়গুনেরও হয় সেই একই উপলব্ধি; “লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায় … … গরীবের শান্তি নাই।”

বাইশ রকম কৃমি সারানোর কথা ছিল ‘পাকিস্তান বড়ি’-র। তা পারেনি তা। বরং পাকিস্তান আমাদের সমাজজীবনে সৃষ্টি করে রেখে গেছে আরো অসংখ্য অগুণতি কৃমি যারা আজো প্রতিদিন সমাজের স্বাস্থ্য খুঁটে খাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক দিন খাবে। “কান মে বিড়ি মু মে পান/ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” আওয়াজ দিয়ে পাকিস্তান নামক যে ফিলিস্টাইন বর্বরতার একদিন শুরু হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লক্ষ জীবন, রায়ের বাজারের ইঁটের পাঁজায় এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লাশের নৈবেদ্য সাজিয়েও সে বর্বরতা থেকে আমরা আজো মুক্তি পাইনি। পাকিস্তানী চেতনা কলুষিত করে গেছে আমাদের গোটা এক প্রজন্মের হাড়ের ভিতর পর্যন্ত। সে কারণে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের, ভবিষ্যতেও হবে। আমাদের ভাবজগত থেকে পাকিস্তানী বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলার জন্যেই তাই প্রয়োজন পাকিস্তানী শিকড়ের গোড়াটা খুঁজে বের করা এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে এই সাহসী কাজটি করার চেষ্টা করে শাকের-নিয়ামত গভীর সামাজিক কমিটমেন্টের প্রমাণ দিয়েছেন।

মুখের ছুরত যার পুরুষে দেখিবে

বিছা, বিছু, জোঁকে তারে বেড়িয়া ধরিবে।।

যে চুল দেখিবে তার পুরুষ অচিন

সাপ হইয়া দংশিবে হাশরের দিন।।

যে নারী দেখিবে পর-পুরুষের মুখ

শকুনি-গিরধীনি খাবে ঠোকরাইয়া চোখ।।

বেপর্দা আওরতের জন্যে এই হচ্ছে গ্রামীণ পুঁথিতে লেখা দোজখের ব্যবস্থাপত্র। ‘আল্লাহ বেপর্দা আওরতের গোরে আজাব মাপ করেন না’ পুঁথি-কিতাব-শরীয়তের এই পরিবেশেই গড়ে উঠেছে জয়গুনের মুল্যবোধ। মায়মুনের হাঁস ডিম পাড়লে বুভুক্ষু পুত্রকন্যাদের বঞ্চিত করে চারটে ডিমই সে জুম্মাঘরে পাঠিয়েছিল। অনেক শ্রদ্ধার, অনেক ভক্তির সেই অর্ঘ্য যখন প্রত্যাখ্যাত হোল তখনও কিন্তু জয়গুনের শরীয়ত-বিশ্বাস টোল খায়নি। গাঁয়ের বাইরে ধান ভানার কলে কাজ করার লালুর মার লোভনীয় প্রস্তাব যে নাকচ করেই দিয়েছিল। কন্যার মঙ্গল-কামনায় সে তওবাও করেছিল, কিন্তু পুত্রকন্যার জীবনরক্ষার আরো মহত্তর তাগিদেই তাকে ভাঙ্গতে হয়েছিল সে তওবা। “আল্লায় হাত-পা দিছে কাম কইর‌্যা খাওয়ার লাগি, তওবা কইর‌্যা ঘরে বইস্যা থাকলে লাভ কি”- লালুর মা’র জবানীতে এ যেন জয়গুনের আত্মোপলব্ধি।

               

পুরুষশাসিত আমাদের সমাজে নারীর অবস্থানটা আসলে কি ? তা সে গ্রাম বাংলার ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক মুসলমান সমাজই হোক বা প্যারীর ‘মুক্ত’ আধুনিকাই হোক, পুরুষশাসিত সমাজে ভোগ্যপণ্য ছাড়া নারীর অন্য কোনো ভূমিকা কি খুব বেশি স্বীকৃত? যৌবন কি একমাত্র সম্পদ নয় যা থেকে পুরুষেরা দেখে-শুনে-ছেনে নেবে, বেছে নেবে। গদারের “নিউমরো দ্যু”-র স্ত্রীটি যখন বলে স্বামী পুরুষটি দুর্ব্যবহার করলে, তাকে ছেড়ে চলে যেতে পার, কিন্তু কি করা; “When the whole state rapes you!” তখন তার মধ্যে পাই পুরুষশাসিত সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীর বিশ্বজনীন আকৃতি। জয়গুনের অবস্থা আরো করুণ! গদু প্রধান থেকে জোবেদালী ফকির পর্যন্ত সবার নজর তার পেলব শরীরটার দিকে, কিন্তু চলে যাওয়ার মত কোনো জায়গা তার নেই।

               

শুধু নারী-পুরুষ নয়, অর্থনির্ভর সমাজব্যবস্থায় জনক-জননী ও সন্তানের পবিত্র সম্পর্কই বা কি দাঁড়ায়? জয়গুন কাসুকে চায় মাতৃস্নেহে। কিন্তু করীম বক্স তার মোটা চোখ দিয়েই দেখে সব কিছু। কাসু সম্পর্কে জয়গুনের প্রতি তার আক্রোশ; “চাও তৈয়ার আন্ডায় উম দিতে ?” বৃদ্ধ বয়সে কাসু হবে তার অর্থনৈতিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি। তাই “তৈয়ার আন্ডা” কাসুকে সে হাতছাড়া করতে প্রস্তুত নয়। ক্রোধ, অধিকারবোধ আর অহম নিয়ে করীম বক্স একজন খাঁটি male chauvinist, জয়গুনকে দ্বিতীয়বার ভালো-লাগা শুরু হতেই যে নিকাহ্র প্রস্তাব দিতে পারে। এটাও যোগ করে যে; “তুই যদি সতীন লইয়া ঘর করতে না চাস্ তো ক’, আমি ওরে (বর্তমান স্ত্রীকে) ছাইড়া দি।” আবার স্বামীর ভিটেয় ফিরতে পারা বা পুত্র কাসুকে লাভ করার এই লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়েই আমরা বুঝতে পারি যে, চারপাশের পুরুষ বামনদের মাঝে সংবেদনশীলতায় ও আত্মমর্যাদাবোধে জয়গুন কত উঁচু। আসলেই জয়গুনের কাহিনী হচ্ছে চরম প্রতিকুল প্রতিবেশে এক নারীর আত্নসম্মান নিয়ে বাঁচার সংগ্রামের কাহিনী। অর্থ-নির্ভর সমাজে নিজের উপার্জন হচ্ছে আত্মমর্যাদার গ্যারান্টি। জয়গুন তাই নিজের উপার্জনেই দাঁড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু গদু প্রধানের দল তার উপার্জনের পথটা রুদ্ধ করল। কিন্তু তবুও তার আত্মমর্যাদাবোধকে তারা কিনতে পারেনি।

                করীম বক্স নিহত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে দেখি ফ্রেম জুড়ে জয়গুনের ভীত সন্ত্রস্ত মুখ। ফেড আউট/ ফেড ইন/ করীম বক্সের মৃত মুখ। জয়গুন জানত প্রকৃত ঘটনা। কিন্তু প্রতিবাদে সোচ্চার হয়নি সে। কেন ? এই মূক প্রতিবাদহীনতা বুঝতে হলে শতাব্দী ধরে শোষিত অসহায় গ্রাম্য নারীর ইতিহাসটাকে বুঝতে হবে।

তবে অন্তত এক জায়গায় জয়গুন সম্্রাজ্ঞী। সে মা। হাসু কারখানায় কাজ করার অনুমতি চায় তার কাছে। মায়মুন করে ছোটখাটো আবদার। আর কাসুর কাছে সে তো সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। একটা পরিবারের সম্রাজ্ঞী সে। ওই মিড শট্টার কথাই ধরা যাক। মায়মুনকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। খবর পেয়ে জয়গুন ফিরছে করীম বক্সের বাড়ি থেকে। ধাপে ধাপে নিজের উঁচু ভিটের উপর উঠছে সে। সামনে মুখ নীচু করে কাঁচুমাচু দাঁড়ানো মায়মুন। ধাপে ধাপে ওঠার সময় জয়গুন প্রশ্ন করে চলেছে মায়মুনকে। এই ধাপে ধাপে উপরে ওঠা, ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য চলচ্চিত্রে একটা বহুল-ব্যবহৃত প্রথাগত শট্। ‘অক্টোবর’ ও ‘আইভান দ্য টেরিবল’ -য়ে আইজেনস্টাইন এর চমৎকার ব্যবহার দেখিয়েছেন। এ যুগে রাজা-বাদশা নিয়ে যারা ছবি করেন, তাদের ছবিগুলোতেও হামেশা দেখা যায় এই শট্। কিন্তু ভাঙা এক ভিটের দারিদ্র্যক্লিষ্টা এক নারীর এই গর্বিত আত্মমর্যাদাপূর্ণ উত্তরণ, চরিত্র ও দৃশ্যটিকে, এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে।

                প্রতিবাদে কখনোই সোচ্চার হয়নি জয়গুন, নীরবে পালন করে গেছে তার কর্তব্য। আর শেষ পর্যন্তও বজায় রাখা এই নীরবতার মধ্য দিয়েই সে অপরাধী করে রেখে গেছে দর্শককে, এই সমাজব্যবস্থাকে।

পুত্র সে হাতের লাঠি বংশের চেরাগ

কন্যা সে মাথার বোঝা কূলে দেয় দাগ”।।

                মুসলমান গ্রাম্য-সমাজে নারীর অবস্থান যে কোথায় তা’ শুধু মা জয়গুন নয়, বালিকা মেয়ে মায়মুনের মাধ্যমেও প্রতিফলিত। শ্বশুরালয়ে নারী একটা বাড়তি শ্রম, নিজের বাড়ি একটা বাড়তি মুখ। হাসু ছেলে। তাই কিছুটা বেশি ভাত চাইলে পায় সে। কিন্তু বাড়তি ভাতের জন্য মায়মুনের আবদার পূরণ করা হয় ফ্যান দিয়ে। তাড়াতাড়ি মায়মুনের বিয়ে দেয়ার একটা বড় কারণ যে তাতে “একটা খাওনের মুখ কমবে।”  বালিকা-বিবাহ একটা প্রচলিত প্রথা বটে, কিন্তু কত ছোটই না ছিল সে! মায়মুনের বিয়ের ‘পরস্তাব’-য়ের পরপরই সাউন্ডট্রাকে শোনা যায়; “ভাই, টান দাও” বলে মায়মুনের শিশুসুলভ কণ্ঠস্বর। চোখের সামনে মরা চড়–ই ধরে যে বালিকাটি ভয় পাওয়াতে চায় মামীকে, তার আর যাই হোক, বিয়ের বয়স হয়নি। আর এই গৌরীদানের ফলশ্রুতিও মঙ্গলজনক হয় না কারো জন্যেই। শ্বশুর সোলেমান খাঁ ফেরত পাঠায় মায়মুনকে। তার জোয়ান ছেলে ওসমানের জন্য অতটুকু মেয়ে পোষাবে না। “আগে কাম-কাজ শিইখ্যা ল, তারপর আসিস” ‘কাম-কাজ’ অর্থ গেরস্থালীর কাজ-কর্ম বোঝালেও যৌনকর্মের ইঙ্গিতটা থাকে উহ্য কিন্তু গুরুত্ববহ।

               

মায়মুন স্বপ্ন দেখেছিল হাঁসের ডিম ফোটাবে সে। হাঁস হবে তার পুকুরভরা- অগুণতি। হয়নি। অনেক সখই মেটেনি তার। জীবনের কাছে এই বঞ্চনায় মায়মুনের মধ্যে পাই দুর্গার ছাপ। হ্যাঁ, নিশ্চিন্দিপুরের সেই ফললোভী কিশোরী দুর্গা, জীবনে যারও অনেক সখ মেটেনি, কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রে ও সাহিত্যে চিরকাল যে মিটিয়ে যাবে করুণরসের স্বাদ।

                উপন্যাসের উচিত-কথা-বলা সরল লেদু চরিত্রটি, যে ‘বরকত’-য়ের সমস্যা সমাধান করে স্রেফ জল মিশিয়ে, বাস্তবজ্ঞান ও প্রয়োগবাদিতার সংমিশ্রণে চলচ্চিত্রকাররা তাকেও একটা নতুন মাত্রা দিয়েছেন। চালের লাইনে স্বভাব-রসিক ভঙ্গীতেই সে হয়ে উঠে প্রতিবাদী; “এই কইর‌্যাই তো গরীবরে মারলেন।” হত্যাকারী যে জ্বীন নয়- মানুষ, এটা তার অজ্ঞাত থাকে না। এছাড়া জীবনযুদ্ধে পোড়খাওয়া লালুর মা, সংবেদনশীল ভাউজ, কৈশোর-চঞ্চল শফী বা কিছুটা অপুর আদলে গড়া কাসু বা ছবিটির অন্য যে সব চরিত্র, যারাই ফ্রেমে বন্দী হয়েছে বা উকিঝুঁকি দিয়ে গেছে, তাদের সবাইকেই মনে হয়েছে স্টুডিওর সাজানো ফ্লোরে নয়, তারা দাঁড়িয়ে আছে মাটির উপর- স্বদেশে, স্বকালে।

               

আজ যখন ‘সিনেমা দ্যু পাপা’ অর্থাৎ কেবল গল্প বলার মধ্য দিয়ে ছবি করার ধরণটি প্রাচীনপন্থী হয়ে পড়েছে, তখন কেন এই দুই পরিচালক রোসি, ক্রুফো বা গদারের আবির্ভাবের এতদিন পরেও এই মাধ্যমে তাদের ছবিটা করলেন? কেন ডি সিকা, জাভেত্তিনি বা রেঁনোয়ার পরে প্রায় পরিত্যক্ত নিওরিয়ালিজম, যাকে সত্যজিৎ কিছুটা নবজীবন দিয়েছিলেন মাত্র তাও সেই পঞ্চাশের দশকে, এরকম একটা প্রকাশভঙ্গিকে বেছে নিলেন এই ১৯৮০ সালে? বিশেষ করে নিও রিয়ালিজমের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ আছে যে তা’ জোলা-সুলভ ন্যাচারালিজমই দেখাতে পারে মাত্র, প্রকৃত বাস্তবতা নয়। আর যে বাস্তবতা দেখায়, তা’ও শাসকশ্রেণীর সৃষ্ট বাস্তবতা, দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা নয়। শোষিত শ্রেণীর পক্ষেই বা এই আঙ্গিক কতখানি উপযোগী, বিশেষ করে যখন হাতের কাছেই রয়েছে ‘সিনেমা ডিরেক্ট’ বা ‘সিনেমা ভ্যারিতে’-র মত লোভনীয় সব বৈপ্লবিক চলচ্চিত্র মাধ্যম! ভয় হচ্ছে ‘ফর্ম’ ও ‘কনটেন্ট’ নিয়ে সেই কুটকচালে তর্কে হয়তো জড়িয়ে পড়ছি। তবে লুকাচ, কডওয়েল বা র‌্যালফ ফক্স পেরিয়ে এসে সমাজসচেতন নন্দনতত্ত্বে এটা এখন আর কোনো বিতর্ক নয়। কি বলা হচ্ছে সেটাই মুখ্য, কী ভাবে বলা হচ্ছে সেটা আসছে তার বাহন হিসেবে মাত্র। শিল্পীর কর্তব্য জীবনের “elemental force” -গুলিকে ব্যক্ত করা। আর চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের পূর্ববঙ্গের নিস্তরঙ্গ জীবনের elemental force-গুলিকে ব্যক্ত করার জন্যে নিওরিয়ালিজমই হয়তো সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম। গ্রামবাংলার যে একটা একঘেঁয়ে নিস্তরঙ্গ বৈচিত্র্যহীন অচলায়তনতা রয়েছে সেখানে অন্য চলচ্চিত্র আঙ্গিকগুলোই বা কতখানি উপযোগী? “কলকাতা ’৭১” বা “আকালের সন্ধানে”-তে আঙ্গিকের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর “একদিন প্রতিদিন” ছবিতেই কি মৃণাল সেন সবচে সার্থক নন ? কারা যেন ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র প্রথম সেটটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। এরকমই হয় ! প্রগতিশীলেরা সব সময় বন্ধু চিনে উঠতে পারে না। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলেরা শত্রু চিনে নিতে পারে এক পলক দেখা মাত্রই।

               

ছবিটিতে দেশজ সঙ্গীতের ব্যবহারে পরিমিতিবোধ রয়েছে। সম্পাদনায় সাইদুল আনাম টুটুল রেখেছেন দক্ষতার ছাপ। আর ক্যামেরার কাজ- অনবদ্য। ‘নদী ও নারী-র পরে আর কোনো ছবিতে পূর্ববঙ্গের জলজ প্রকৃতি এত মূর্ত হয়ে ফুটে ওঠেনি আমাদের সেলুলয়েডে। কোথায় যেন একটা দুঃখবোধ আছে আনোয়ারের ক্যামেরায়। আমাদের জীবনেও দুঃখবোধ মিশে আছে ওতপ্রোত। দুঃখের সঙ্গে আমাদের এই নিত্য সহবাস দেখেই হয়তো কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, আমাদের গার্হস্থ্যজীবনে, বাক্সে, তোরঙ্গে, বিছানায় “দুঃখ তার লেখে নাম।” দুঃখ তার নাম লেখে, সর্বত্রই- ক্যামেরার লেন্সেও। তবে এ দুঃখবোধ জীবন সম্পর্কে নিরাশ করে না, বরং সব শিল্পের যা গোড়ার কথা, মানুষের প্রতি সেই সহমর্মিতাকেই তুলে ধরে। এ দুঃখবোধ মনুষ্যত্বের নিদান। গোটা ছবিতে আনোয়ারের চমৎকার সাদাকালো চিত্রায়ন সেই কাজটাই করেছে। করেছে গভীর সংবেদনশীলতার সঙ্গে।

               

যারা প্রতিবাদী চলচ্চিত্র বলতে শেষ দৃশ্যে একটা জোতদার খুন, কিছু রক্ত, একটা বক্তৃতা বা সাবটাইটেলে “ওরা আসছে” জাতীয় একটা ঘোষণা দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে চান, সেসব ‘বিপ্লবীরা’ এ ছবি দেখলে খুশী নাও হতে পারেন। এগুলো না থাকার সহজ কারণ হচ্ছে যে উপন্যাসে তা’ নেই, আর গভীর কারণ হচ্ছে স্লোগানসর্বস্বতার অনেক গভীরেই অন্তঃশীল থাকে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের সূক্ষ্ন রাজনীতি। শাকের-নিয়ামত সেটাই দেখিয়েছেন। সোনালী প্রভাত জাতীয় একটা জোলো ক্লিশে আশাবাদ না দেখিয়ে বরং সমাজবাস্তবতর প্রতি ওঁদের অঙ্গীকারের দৃঢ়তারই স্বাক্ষর রেখেছেন। আসলেই, শেষ দৃশ্যে একটা প্রতিবাদী শট্ নেই বা একটা পরাজয়বাদিতা রয়ে গেছে বলে ক্ষুব্ধ হওয়ার কোনো কারণ আছে কি? কারণ চল্লিশ দশকের গ্রামবাংলার বাস্তবতা ওরকমই ছিল। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী শিল্পী বাস্তবতাকে, তা’ যতই ব্যর্থতায় ভরা বা বেদনাদায়ক হোক না কেন, দেখাতে দ্বিধা করেন না। কারণ বাস্তবতাতেই মিশে আছে দ্বন্দ্ব। বাস্তবতাকে নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরলে শ্রেণীদ্বন্দ্বটাও আপনা থেকেই ফুটে উঠবে। এটাই মার্কসের “আপাতবৈপরীত্য তত্ত্ব” যার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে দ্বিধাহীন এঙ্গেলস স্বাচ্ছন্দ্যে প্রশংসা করে গেছেন রাজপন্থী বালজাককে। লেনিনও বলতে পারেন; “মায়কোভস্কি ভাল, কিন্তু পুশকিন আরো ভাল।” সেই একই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আমরাও বলি, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ একটি মানবিক চলচ্চিত্র এবং একটি সমাজবাস্তবতার চলচ্চিত্র।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>