Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Secularism_in_Bangladesh

ইরাবতীর ফিচার: ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে । আনিসুজ্জামান

Reading Time: 6 minutes

১৯৪৯ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের সংবিধান-সংক্রান্ত যা উত্থাপন করেন, তাতে প্রথমেই রাস্ট্রের শুধু রাষ্ট্রের নয়, সমগ্র বিশ্বজগতের সার্বভৌমত্ব বলা হয়েছে আল্লাহর এবং রাষ্ট্রকে যদিও স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, তবু এই রাষ্ট্রের মুসলিম অধিবাসীরা যাতে কুরআন শরীফ ও সুন্নায় বর্ণিত ইসলামের শিক্ষা ও আবশ্যকতা-অনুযায়ী বক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনযাপন করতে পারেন, তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ১৯৫০ সালের মূলনীতি কমিটির রিপোর্টেও এর প্রতিধ্বনি করা হয় এবং সেই সঙ্গে যোগ করা হয় যে, রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলিম। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা নির্বাচনী অঙ্গীকারের শীর্ষদেশেও লেখা হয়েছিল :

নীতি :কোরান ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।

১৯৫৫ সারে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। মওলানা ভাসানীর

সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় এই নামান্তরের প্রস্তাব করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী [১৮৯৩-১৯৬৩]। সভায় মওলানা ভাসানী বলেন যে,এই প্রস্তাব অনেকদিন ধরেই তাদের বিবেচনাধীন ছিল। তবে ভাষা আন্দোলনের সময়ে মুসলিম লীগ যে রকম মিথ্যে প্রচার করে, তা স্মরণ করেই সংগঠন যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় না কা পর্যন্ত তারা নাম বদলাবার ঝুকি নিতে চাননি। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে এই নীতির সংযোজন অনুরূপ বিবেচনাপ্রসূত কি না তা বলা যায় না। তবে মওলানা ভাসানী পরেও কুরআন ও সুন্নার সঙ্গে সংগতির কথা বলেছেন।

১৯৫৬ সালে যখন পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়, তখন দেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের অনেকে দেশের এই নামকরণের বিরোধিতা করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় স্বতন্ত্র নির্বাচন পুথার পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপিত হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৯২০-১৯৭৫] যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃতিযোগ্য :

আমার এক বন্ধু বলেছেন যে তারা মাইনরিটিদের সমানভাবে দেখবেন। আমি জিজ্ঞসা করি, কিভাবে সমানভাবে দেখবেন_ ইসলামিক রিপাবলিক নাম চেঞ্জ করে দিয়ে? ইসলামিক রিপাবলিক না হয়ে পাকিস্তান রিপাবলিক হোক, আমরা একথা নিয়ে ফাইট করেছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম, রাজনীতিতে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব সমান হবে_ সত্য এবংসাম্যের নীতির উপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।… স্যার, আমরা হেড অফ দি স্টেট মুসলমান করে দিলাম। ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তান নাম করলাম। এইভাবে দুই জাতি তো করেই দিলাম তার উপরেও যদি সেপারেট ইলেকশন হয় তাহলে কি হয়? দুই জাতির ভিত্তিতে আমাদের পাকিস্তান হয়েছে। এরপরও যদি আজকে আলোচনা করা হয় যে, পাকিস্তানে আমরা দুই জাতি, একটা হিন্দু আর একটা মুসলমান, তাহলে একটা প্রোভোকেশন দেয়া হয়। আজ যদি পূর্ব বাংলার এক কোটি হিন্দু বলে যে, আমাদের আলাদা জায়গা অর্থাৎ একটা হিন্দু স্টেট দিতে হবে, তাহলে কি হবে? পাকিস্তানের খাতিরে, পাকিস্তানের ইনসাফের খাতিরে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের খাতির আমি আমার বন্ধুদের অনুরোধ করব তারা যেন এই সেপারেট ইলেকটরেটের প্রস্তাব উইথড্র করেন।

এই বক্তৃতায় যে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তা বিকশিত হচ্ছিল অনেকদিন ধরে। বিশেষ করে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর থেকে পূর্ব বাংলার রাজনীতিক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ভাষা-আন্দোলনের আগে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ছিল দেশের একমাত্র সংগঠন যার দ্বার সকল সম্প্রদায়ের নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ভাষা আন্দোলনের পরে আমরা দেখি অসাম্প্রদায়িক ছাত্রসংগঠনরূপে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা, অসম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্রী দলের আত্মপ্রকাশ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে পরিণতি এবং দেশের এই অংমের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী মুসলিম লীগের আওয়ামী লীগে রূপান্তর। ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় যুক্ত নির্বাচন প্রথার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ এই ক্রমবর্ধমান অসাম্প্রদায়িক চেবতনারই বহিঃপ্রকাশ।

পাকিস্তানে পরবর্তী পনেরো বছরে অন্যান্য বিষয়ে বিরোধের মতো রাস্ট্রজীবনে ধর্মীয় অনুষঙ্গ এবং অসাম্প্রদায়িকতার কোন কোনো ক্ষেত্রে বলা যায় ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইহজাগতিকতার বিরোধ তীব্র হয়েছে। ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে ১৯৬২ সালে দেশের দ্বিতীয় সংবিধান প্রবর্তিত হয়। রাষ্ট্রের নাম ফিরে আসে পাকিস্তান রাষ্ট্রে অর্থাৎ নাম থেকে ইসলামি কথাটা বাদ যায়। তবে রাষ্ট্রের মূলনীতিতে কুরআন ও সুন্নাহ এবং ইসলামি জীবনধারার কথা বলা হয় এবং তার জন্য ইসলামি আদর্শ বিষয়ক একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের বিধান রাখা হয়। ১৯৬২ সালের সংবিধান রদ হয়ে যায় ১৯৬৯ সালে।

জেনারেল আইউব খান ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মতো সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধান সংবিধানের ইসলামি চরিত্র রাখতে আন্তরিকভাবে আগ্রহী ছিলেন, এ কথা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে, ক্ষমতায় থাকার জন্য, সাধারণ মানুষকে ভোলবার জন্য, তাদের প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের যোগ ঘটানোর।

০২.

অনেক স্বেদ, অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র যে ধর্মীয় হবে না, তার প্রথম আভাস পাওয়া যায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। এতে বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হবে, সে কথা মুক্তিযুদ্ধের কালে নেতারা বহুবার বলেছিলেন। শুধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান এবং এমন কি, পররাষ্ট্র মন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক আহমদের বক্তৃতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় তিন নীতি_ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা একাধিকবার ঘোষিত হয়েছিল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন রেককোর্সের জকনসভায় বক্তৃতাদানকালে তিনি বলেছিলেন :

সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রতম ও ভারত তৃতীয় বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেস কোন ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

পরে তিনি আরো একটি নীতি যোগ করেন_ জাতীয়তাবাদ। সেই চারটি মূলনীতিকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়।

আগে বলেছি, ধর্মনিরপেক্ষতার ভাব শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তার একটা কারণ ছিল এই যে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উপেক্ষা করে যারা উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তারা ধুয়া তুলেছিলেন ধর্মের। পাকিস্তান মুসলমানের রাষ্ট্র, উর্দু মুসলমানের ভাষা; তাই উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে। বাংলা হিন্দুর ভাষা, ওতে ইসলাম সম্পর্কে যথেষ্ট লেখা হয়নি; তাই বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে পারবে না।

ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার বিপদ সম্পর্কে পাকিস্তানের দিনগুলোতেই আমরা ক্রমশ অবহিত হয়েছি। তারপর ১৯৭১-এ এর মারাত্মক রূপ দেখলাম। ইসলাম রক্ষার নামে, মুসলিম রাষ্ট্রের নামে কী অমানুষিক অত্যাচারই না হলো দেশের মানুষের ওপর! পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশি দোসররা ধর্মের নামে সকল বর্বরতার প্রতি সমর্থন জানালেন। ইসলাম ও পাকিস্তানকে অভিন্ন বলে দাবি করে তারা ঘোষণা করলেন যে, পাকিস্তানের বিরোধিতা মানেই ইসলামের বিরোধিতা। যেন পাকিস্তান-সৃষ্টির আগে ইসলামের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা কলেন যে, আল-বদর বাহিনী গঠন করা হয়েছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য। যখন সেই সামরিক বাহিনীর ভরাডুবি হলো তখন তাদের যোগসাজশে ক্রোধে উন্মত্ত আল-বদরেরা দেশের সেরা সন্তানদের হত্যা করে নিজেদের আদর্শবাদের পরিচয় রেখে গেল।

এই অভিজ্ঞতা ১৯৭২ সালে আমাদের মনে তাজা ছিল। তাই যে সংবিধান আমরা তখন রচনা করেছিলাম, তাতে একদিকে যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা একটি মূল রাষ্ট্রীয় নীতি বলে গৃহীত হয়, অন্যদিকে তেমনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ লোপ করে দেওয়া হয় সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে। তাতে বলা হয়, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার এবং কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ করা হবে।

ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বলে স্বীকৃত হলেও এর তাৎপর্য আমাদের সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি_ এমনকি, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সকলের কাছেও নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে সেকুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে। অনেকে মনে করেন, ইহজাগতিকতা বললে কথাটা স্পষ্ট হতো। তা হয়তো হতো, ধর্মনিরপেক্ষতা বলায়ও ভুল হয় না। নিরপেক্ষ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অপেক্ষারহিত_ ওতে কর্মসম্পর্কহীন, প্রয়োজনরহিত বা উদাসীন বোঝায়। আমরা যখন জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বা দলনিরপক্ষ ব্যক্তির কথা বলি তখন নিরপেক্ষ শব্দের সেই দ্যোতনাই ধরা পড়ে। কোনো জোটের সঙ্গে যে-দেশের যোগ নেই, তা জোটনিরপেক্ষ দেশ; কোনো দলের সঙ্গে যে-ব্যক্তির সংস্রব নেই, তিনি দলনিরপেক্ষ লোক। তেমনি ধর্মের সঙ্গে যে-রাষ্ট্রের সম্পর্ক নেই, তা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তাই বোঝায় রাষ্ট্রীয় উদযোগের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়ের সংযোগহীনতা, ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংশ্রবশূন্যতা, পারলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন ইহজাগতিকতা। ধর্ম থাকবে নাগরিকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয় হয়ে। রাষ্ট্র সকলকে নিজস্ব ধর্মপালনের স্বাধীনতা ও অধিকার দেবে, কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না।

তবে নিরপেক্ষতা শব্দের ব্যাপকতর প্রচলিত অর্থ পক্ষপাতহীনতা। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে অনেকেই ধরে নেন রাষ্ট্রে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্ম ও সেসব ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পক্ষপাতহীনতা। সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের স্পষ্ট বিধান সত্ত্বেও ১৯৭২ সাল থেকে আমাদের প্রবণতা দেখা দিল রাষ্ট্র কর্তৃক সকল ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদানের। তাই বেতারে, টেলিভিশনে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে_ সর্বত্র কুরআন শরীফ, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপটক পাঠ হতে থাকল একসঙ্গে। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় এ নয়। এ হতে পারে সকল ধর্মের সমান মর্যাদা লাভ। আমরা কথায় কথায় আরও ঘোষণা করতে লাগলাম, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। আর তা প্রমাণ করার জন্যই যেন বঙ্গভবনে বা গণভবনে মিলাদ পড়ানোও হলো।

ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যা-ই বোঝাক না কেন, আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোকের কাছে তা একবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের ধারায় আস্থাবান, মুসলমান ও অমুসলমানকে ভিন্ন ভিন্ন জাতিরূপে দেখতে অভ্যস্ত, সকল ধর্মের গ্রন্থ ও অনুসারীর সমান মর্যাদা লাভ তাদের কাছে খুবই শোচনীয় ব্যাপার। ১৯৭৫ সালের পরে তাদের সুযোগ এলো। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান [১৯৩৬-৮১] মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ক্ষমতার অংশ দিলেন এবং সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন আনলেন। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশবলে সংবিধানের প্রস্তাবনার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ যুক্ত হলো। ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় এলো ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের উচ্ছেদ হয়ে গেল। ১২ অনুচ্ছেদের উচ্ছেদের ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নতুন করে আমদানি হলো এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশকে বৈধ রূপ দেওয়া হলো।

জিয়াউর রহমান যেমন আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জন করেন; মনে হয়, জেনারেল এরশাদ তেমনি পূর্বগামীর কীর্তি কিংবা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। সংশোধনীতে বলা হয় :’প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ ইসলামের সঙ্গে অন্য ধর্মের কী বিপুল পার্থক্য করা হলো, সংশোধনীর ভাষা থেকেও তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবে সংবিধানে সকল নাগরিককে যে-সমান অধিকার দেওয়া হয়েছিল এবং আইনের দৃষ্টিতে যে সমতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা লঙ্ঘন করা হলো। কোনো অমুসলমানের পক্ষে সংবিধান-রক্ষার এবং এর প্রতি অনুগত থাকার শপথ নেওয়ার অর্থ হয়ে দাঁড়াল বিসমিল্লাহর প্রতি তার আনুগত্য-ঘোষণা।

বিশেষ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষপাতের ফলে যে নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়, এ কথা অনেকে মানতে চান না। তারা যুক্তরাজ্যের দৃষ্টান্ত টানেন। স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের পরে ইউরোপে ক্রমে ধর্ম ও রাষ্ট্রের_ চার্চ ও স্টেটের_ পৃথককরণ ঘটে এবং সকল নাগরিকের ইহলৌকিক কল্যাণসাধন রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে স্বীকৃত হয়। তা সত্ত্বেও ইউরোপের সব দেশে রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজা বা রানী চার্চ অব ইংল্যান্ডের রক্ষাকর্তা_ এই অর্থে অ্যাংলিকান চার্চের ধর্মই যুক্তরাজ্যের সরকারি ধর্ম। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার একাধিক দেশ বা আয়ারল্যান্ড, ইতালি ও স্পেনেও রাষ্ট্র বিশেষ বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। অন্যদিকে ক্যাথলিক ধর্মের অসাধারণ প্রাধান্য সত্ত্বেও ফ্রান্স ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, প্রোটেস্টান্টদের গরিষ্ঠতা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ দেশ_ সরকারি কর্মে নিয়োগের ক্ষেত্রে ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করা বা কর্মক্ষেত্রে ঈশ্বরের নামে শপথ নিতে বলা কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে বাইবেল পাঠ বা প্রার্থনা করাও সংবিধানবিরোধী বলে সে দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্থির করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র সংস্থার [ওআইসি] অর্ধেক সদস্যরাষ্ট্রেই রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু নেই। ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা সিরিয়ার মতো দেশ রাষ্ট্রধর্ম স্বীকার করে না। তুরস্ক কেবল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়, তার সংবিধানের যে ক’টি ধারা কোনোভাবে সংশোধনযোগ্য নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা তার একটি; সেদেশের সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও নারীর স্বাধীনতা-বিষয়ে ধর্মনিরপেক্ষ আইন প্রচলিত। সুতরাং কেবল উদাহরণ দিয়ে কোনো লাভ নেই। স্বদেশের অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতির ভিত্তিতেই এ বিষয়ে করণীয় নির্ণয় করা আবশ্যক। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ফ্রান্সকে ধর্মনিরপেক্ষ থাকার প্রেরণ জুগিয়েছে; আদি বসতি স্থাপনকারীদের ধর্মীয়ভাবে নিপীড়িত হওয়ার অভিজ্ঞতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ কোনো ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হতে দেয়নি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে কুফল আমরা ভোগ করেছি, ধর্মের নামে যে শোষণ ও নিপীড়ন এখানে চলেছে এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মিলিত সংগ্রামের যে-ইতিহাস আমরা রচনা করেছি, তার ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণই আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক ও সঙ্গত।

লেখক

শিক্ষাবিদ

প্রাবন্ধিক

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>