বাঙালির স্টেটাস সিম্বল
বাঙালি। বিশ্বের আধাখ্যামটা জাতিগুলোর মধ্যে একটা। চিরটাকাল ভণ্ডামো যাঁদের রক্তে। সে বাঙালি সেক্স নিয়ে আদিখ্যেতা করবে না, তা কি হয়?
বাঙালির মুখে লাজ পেটে খিদে। পেটে সেক্সিয় খিদে প্রচুর। কিন্তু মুখে হরিনাম সংকীর্তন। অথচ সেই কবে কালিদাস, কুমারসম্ভবে রগরগে কাম দেখিয়ে দিয়েছেন। জয়দেব গোঁসাই শ্রীকৃষ্ণ আর রাধার একেবারে বাঁশবনচিত প্রেমরস লিখে গীতগোবিন্দকে ফেমাস করিয়ে নিয়েছেন। পরে তো এলেন বিদ্যাপতি আর বড়ু চণ্ডীদাস। যাইহোক, বাঙালি বরাবরই একটু সোনামনা গোছের। তাই রাতে খাটে বউটিকে আদর করতেও তাঁদের কুণ্ঠাবোধ ছিল প্রবল। ফলতঃ স্বাভাবিক ভাবেই শরীরে-মনে অশান্তি। রোগভোগ। পরনিন্দা। কামচর্চা। চর্চাই ছিল। প্রয়োগ আর হয়ে ওঠেনি।
হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, বাঙালির যৌনজীবনে কলাও নাই, বিজ্ঞানও নাই। রয়েছে পাশবিকতা। বাঙালির যৌনক্ষেত্রে পুরুষ সক্রিয় কর্মী, নারী নিষ্ক্রিয় শয্যামাত্র।সেই কারণেই আগেকার দিনে এক একটা বাঙালির ঘরে আট দশটা বাচ্চা। মেয়েরা স্রেফ বাচ্চা বিয়োনোর কল। বাঙালির যৌনতা ছিল স্রেফ স্বভাঁওতাবাজির কল। সে কল একেবারে নড়ে গেল নবজাগরণে। বঙ্গ নবজাগরণে অনেক কিছুই জেগেছিল। একইসঙ্গে বাঙালির ‘ওই’টিও জেগেছিল পাশ্চাত্য রেনেসাঁর বাঙালিয়ানায়। বেশ্যাগমন হয়ে উঠেছিল নেশা এবং স্টেটাস সিম্বল। বাবু কালচারের অন্যতম অঙ্গই ছিল মদ ও ‘মেয়েছেলে’। বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের লেখাটি মনে আছে তো?
“যিনি নিজ গৃহে জল খান, বন্ধু গৃহে মদ খান, বেশ্যা গৃহে গালি খান এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু..”
তাছাড়া পরস্ত্রীতে নজর, সেও এক ভারী কেতার ব্যাপার। প্যারিমোহন সেনের লেখা,
“পর স্ত্রী পর ধন, সদা করিবে হরণ।
মিথ্যা কথা প্রতারণার আশ্রয় নাও,
সুখ পাবে বিধিমত, বেশ্যাসক্ত হও”।
সেই সময় থেকেই বেশ নামডাক সোনাগাজীর। (অধুনা সোনাগাছি)
কীরকম ছিল সে বেশ্যাপাড়া?
“কী আশ্চর্য সোনাগাজী রমনীয় স্থান
গেলে পরে সুশীতল হয় মন প্রাণ
আনন্দের সীমা নাই প্রতি ঘরে ঘরে,
সুখ ভয়ে দুঃখ যেতে নাহি পায় ডরে…”
শিবনাথ শাস্ত্রীর রামতনু লাহিড়ী ও তত্কালীন বঙ্গ সমাজ বইটি পড়ে দেখতে পারেন। সেখানে লেখা, বাবুরা “গড়দহের মেলা ও মহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিয়া যাইত”। এসব ছাড়িয়ে আরও মারাত্মক কথা লিখেছেন, “লোকে পূজার রাত্রিতে যেমন প্রতিমা দর্শন করিয়া বেড়াইতেন, বিজয়ার রাত্রিতে তেমনি বেশ্যা দেখিয়া বেড়াইতেন।”
যে কেউ কালিপ্রসন্ন সিংহর হুতোম প্যাঁচার নকশা বইটি উল্টেপাল্টে দেখলেই পারেন।বাঙালিদের ‘বেশ্যাবাজি’র হরেক কিস্সা সেখানে।শুধু শোয়াশুয়িই নয়। বাঁধা বেশ্যা থাকত বাবুদের। এমনকি অনেককে বাড়ি ঘরদোর করে দেওয়াটাও ছিল একটা বেশ রকম ব্যাপার।আসলে রেনেসাঁর ঝড়ে বাঙালির মন মস্তিস্ক সমস্তটাই ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। সো কল্ড ভক্তিবাদ আর বিশ্বাসবাদ হয়ে গিয়েছিল নড়বড়ে। সবই যখন যুক্তির আতসকাঁচের তলায় রাখা হল, দেখা গেল এতো সবই মায়া। তখন চলে আসা সংস্কারে আচারে লাগলো দোলা। যে যৌনতাকে আজীবন বাঙালি রেখেঢেকে এসেছিল, সে রাখঢাক গেল মুছে। আদিম প্রবৃত্তি উথলিয়েই থাকে মানুষের। নবজাগরণের বাঙালি, সেই উথলানো দুধ নেড়ে বা ফুঁ দিয়ে শান্ত করলো না। বরং তাপ আরও বাড়িয়ে দিল। আর সে উথলানো দুধ, হাঁড়ি উপচিয়ে আগুনে পুড়ে একেবারে হইচই কাণ্ড বাঁধিয়ে দিলো। সে পোড়া দুধ কে খায়নি বলুন তো?নাম শুনলে চমকে যাবেন।
সর্বপ্রথম আমার তো মনে পড়ে রবি ঠাকুরের দাদুর কথা। দ্বারকানাথ ঠাকুর। থুড়ি, প্রিন্স দ্বারকানাথ টেগোর। বাঈজি নাচে ছিল তাঁর প্রবল আসক্তি। বেশ্যাসঙ্গ তো বিস্তর। আমার সঠিক জানা নেই, তবে শুনেছি, সে সময়ে ঠাকুর বাড়ির নাকি বেশ কয়েকটা বেশ্যাখানা ছিল। শোনা যায় সোনাগাছি নাকি দ্বারকানাথের জমির ওপরেই গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ এ জোয়ারে গা ভাসাননি। কিন্তু প্রভাব তো পড়েছিল। কারণ দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লুচ্চামির কারণেই আত্মহত্যা করতে হয়েছিল কাদম্বরী দেবীকে। সে যন্ত্রণা কবি বয়ে বেড়িয়েছিলেন আজীবন। শোনা যায় রেনেসাঁর প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায়ের বেশ কয়েকজন বাঁধা রক্ষিতা ছিল। সম্ভবত, সেরকম কোনও রক্ষিতার গর্ভে জন্মেছিলেন তাঁর এক ছেলেও। আর গিরীশ ঘোষের কথা তো সবারই জানা। সে কালের নটী বিনোদিনীর কথাও কিংবদন্তী। আর এঁদের সঙ্গেই ছিল মিঞারা। মানে বাঙালি মুসলিমরা। তাঁরাও বাবুদের সঙ্গ দিতেন ভালোমতনই।
রাজনারায়ণ বসুই বলে গিয়েছিলেন, “যেমন পানদোষ বৃদ্ধি পাইতেছে, তেমনি বেশ্যাগমনও বৃদ্ধি পাইতেছে”। ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হরিদাসের গুপ্তকথায় রয়েছে, গরানহাটা থেকে কলুটোলার রাস্তার দুধারে কীভাবে ‘সারি সারি রকমারি মেয়েমানুষ’ থাকতেন। এমনকি ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের আশেপাশেও বেশ্যা!! বোঝাই যাচ্ছে, যুক্তিবাদের তাড়নায় অবাধ প্রশ্রয় পেয়েছিল যৌনতা। তাবড় ব্যক্তিত্ব, যাঁদের আমরা মণীষী বলে জানি, তাঁরাই ছিলেন এর ধারক ও বাহক। যাই হোক, এই সব পতিতাদের কিন্তু বাংলার সাহিত্যে সংস্কৃতিতে বেশ ভালরকম অবদান ছিল। কারণ থিয়েটারে তাঁদেরই তো তখন রমরমা। নটী বিনোদিনী, সুকুমারী দত্ত, গওহরজান, ইন্দুবালা, তালিকা বেশ লম্বা। মান্না দে-র কাকা অন্ধকবি কৃষ্ণচন্দ্র দে থাকতেন তারকাবালা নামে একজনকে নিয়ে। ছেলেও হয়েছিল নাকি তাদের। কাননবালার ঘরে নাকি নজরুল যেতেন। তথ্য ঠিক কী ভুল আমার জানা নেই। পড়েছি, এই মাত্র। তেমনই পড়েছি শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে পতিতাদের ভূমিকা নিয়ে।
যাইহোক, লেখা লম্বা করে লাভ নেই। সমাজের একটা শ্রেণির কাছে এই অবাধ বেশ্যাপ্রীতি অবশ্যই এবং অবশ্যই ধাক্কা খেয়েছে রামকৃষ্ণের কাছে এসে। যেখানে ঠাকুর, বাঙালিকে ভোগের থেকে ত্যাগের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বেশ সুন্দরভাগে। অবাধ নয়, বাঁধাছাঁদা ত্যাগেই মোক্ষের পথ বাতলেছিলেন। বিবেকানন্দ যুক্তির সঙ্গে বিশ্বাসের মিশেলে সংসারী হয়েও ভোগবাদ থেকে কিছুটা দূরে আনতে পেরেছিলেন বাঙালি সমাজকে। তবে বেশ্যাগমন তো আটকানো যায়নি। যাবেও না। সে কারণে এখন সোনাগাছি ছাড়িয়ে শহরের ইতিউতি বেশ্যা পকেট। ম্যাসাজ পার্লারের ফোন নম্বর পাড়ায় পাড়ায়। ইউনিসেক্স সেলুনও শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাঙালি ভোগবাদি হয়েছে আরও। বাবু কালচারকেও তিন দাঁও মারছি আমরা। রাখঢাক কমছে। ভাবনা একটাই, খাও খাও খাও… ! কিন্তু ওই, বাঙালি মোরালিটি এখনও কাছা ধরে টানে।
সাধে কী পেটপাতলা বাঙালির পেটের ব্যামো এখনও ঘুচলো না!
কৃতজ্ঞতা: আড্ডাজোন