ভালোবাসার জন্য আমরা জীবন বাজি রেখেছিলাম।
এমন কঠিন, এমন নির্দয়,
এমন স্বার্থপর তুমিতো কখনও ছিলে না?
কেমন করে পারলে? বল? কেমন করে?
নির্বিকার, নিস্প্রাণ গলায় যখন গুডবাই বললে, তখন তোমার কণ্ঠস্বর একবারও কাঁপতে শুনি নি।
মৃত মাছের মত বোধহীন, ঠান্ডা, তোমার চোখদুটো দেখে মনে হচ্ছিল,
ঐ-চোখদুটোতে বহুকাল আলো পড়েনি।
ভাবলেশহীন, অভিব্যক্তিহীন লম্বাটে ঐমুখ,
চেয়ারে বসা শরীরের কাঠামোতে, অনঢ় কঠিন মাংশপেশী,
যেন বলে দিচ্ছিল, এখানে জীবনের কোন আলোরণ নেই। ভালোবাসার কোন উত্তাপ নেই।
চেয়ে দেখলাম, তোমার শুকনো, পাংশুটে ঠোঁট।
কে বলবে, ঐঠোঁট একদিন কতটা রক্তিম ছিল,
একদিন কতটা উষ্ণতা ছিল ঐ পেলব ত্বকে।
কেমন জোড়াল চুমু খেতে ঐ পুরুষ্ঠ অধরে।
একদিন, মাইলের পর মাইল আমরা হেঁটেছি সমানতালে,
সেই বলিষ্ঠ পদযুগলে আজ রাজ্যের আরষ্ঠতা,
হয়তো আরষ্ট সময়ের মত, তোমার মনেও শ্যাওলার আস্তরণ জমেছে আজ।
তাইতো, স্বার্থপরের মত কেবল নিজেকে বাঁচাতে চাইলে,
বলে দিতে পারলে, আমি তোমায় ভালোবাসি না,
আর কখনও যোগাযোগ কোর না আমায়!
ব্রেকআপটা এভাবে না করলেও পারতে…
অন্যভাবেও বিদায় বলা যায়।
সম্পর্ক না রাখলেও সংযোগ রাখা যায়।
সংযোগ রাখার কোন রাস্তাই তুমি রাখলে না।
ভাল–মন্দে, অসুখে–বিসুখে আমাদের আর দেখা হবে না,
এমনকি মৃত্যুতেও হবে না শেষ–দেখা ।
একটি মাত্র ‘সরি’ মিথ্যে করে দিল গত কুড়িটি বছর,
একটা মাত্র ‘গুডবাই’ দুটো পথ আলাদা করে দিল,
তোমার নিরবতা জানিয়ে দিল, এরপর আর কোন কথা থাকতে নেই।
আমাদের প্রেমে কোন গন্তব্য ছিল না,
পাওয়া–না পাওয়ার কোন দ্বন্দ্ব ছিল না,
কেবল শিরায়–শিরায় ঘণঘোর আবেগ ছিল
ছিল, বুক ভর্তি শর্তহীন ভালোবাসা!
কত হাজার কোটি বার বলেছিলে, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’?
অথচ ‘ভালোবাসি না’ কথাটা যে এতটা শক্তিশালী আমি জানতাম না।
অব্যর্থ তীরের মত, এর একটা আঘাতেই তাসের ঘরের মত হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল কুড়ি বছরের ভালোবাসা।
অথচ এই ভালোবাসার জন্য আমরা জীবন বাজি রেখেছিলাম।
ক্রমশ আমরা অপরিচিতদের ভীড়ে হারিয়ে যাবো—
ব্রেকআপের পর বুঝতে পারলাম,
তুমি কতটা আমার ছিলে!
তোমাকে আর পাব না জানার পর থেকেই বুঝতে পারলাম,
কতটা তোমাকে চাই!
আজ থেকে আমাদের সত্যিকারের ‘বিচ্ছেদ’ শুরু হল।
জানি, ‘হ্যালো বিউটিফুল’ বলে আর কখনও তুমি আমায় সম্বোধন করবে না।
আমরা আর–কেউ কখনও বলবো না, ‘সি ইউ সুন’
আর কখনও কেউ কারও খোঁজ নিয়ে বলবো না, ‘হাউ আর ইউ?’
তোমার নম্বর থেকে আর কখনও ‘গুডমর্নিং’ কিংবা ‘গুডনাইট’ টেক্সট আসবে না।
তোমার চোখের তারায় আর কখনও আমার জন্য ভালোবাসা ঘণিয়ে উঠবে না।
গভীর আকুতি জানিয়ে, আর কোনদিন, তুমি বলবে না,
“এভরি মর্নিং আই ওয়ান্ট টু ওকআপ নেক্সট টু ইউ”
ঠিক কতটা সময় লাগবে তোমায় ভুলতে?
বুকের ভেতরে, হৃৎপিণ্ডকে ঘিরে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে
তাকে অবজ্ঞা করেই, আমায় হয়তো হাসতে হবে প্রতিদিন।
ঠিক কতদিন, তোমায় হারানোর শোক আমায় তাড়িয়ে বেড়াবে, আমি সত্যি জানি না।
এখন আমাদের আর কোন ভবিষ্য পরিকল্পনা নেই।
এই সামারে সাগরে মাছ ধরতে যাবো কিনা,
কিংবা আগামি হপ্তায় যে নতুন মুভি আসছে, সেটা দেখতে চাই কিনা,
তুমি আর কখনও জানতেও চাইবে না।
সিটির ফ্রেন্চ রেস্টুরেন্ট কিংবা দামি স্টেকহাউসগুলোতে গ্রুপনের অনেক অফার আসবে।
ব্রান্চে, লান্চে বা ডিনারে তোমার সাথে তোমার জীবনসঙ্গীনীকে দেখা যাবে।
বেকড স্যামন, কিংবা ফ্রাই কালামারি অর্ডার করতে গেলে,
আমার কথা হয়তো তোমার তখন মনে পড়বে।
এখন থেকে আমাদের মাঝে যোজন–যোজন দূরত্ব বাড়বে।
তারপর…একে–অপরকে বহুকাল না দেখতে দেখতে,
ক্রমশ আমরা অপরিচিতদের ভীড়ে হারিয়ে যাবো…
শেষ দেখা রবিবারে—
আমাদের প্রথম দেখার দিন–ক্ষণ আমি কোথাও লিখে রাখিনি।
তখনও ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টুইটার আবিস্কার হয়নি,
এমনকি, ঘটা করে ডাইরিতেও লিপিবদ্ধ করিনি তারিখটা।
কারন দিনটা ছিল বড় সাধারণ। বিশেষত্বহীন!
আমাদের প্রেম জন্ম নিয়েছিল ধীর–লয়ে,
উত্তম–সুচিত্রার আচানক মুখোমুখি ধাক্কা নয়,
চার চোখের প্রথম মিলনেও নয়,
প্রেম জন্ম নিয়েছিল, নিরবে, নিভৃতে।
সবার অন্তরালে!
কতশত মাইল পাড়ি দিয়ে,
নদী, মহাসাগর, পাহাড়, অরণ্য ডিঙ্গিয়ে সেই রবিবারে, তোমার কাছে পৌঁছেছিলাম।
শেষ–দেখাটা দেখবো বলে।
বুকের খাঁচার ভেতরে প্রাণ–ভোমরাটা খুব ছটফট করছিল।
দেখলাম, আমার কান্না তোমাকে আর বিচলিত করছে না।
আমাকে হারানোর ভয় তোমাকে আগের মত অস্থির করছে না।
তখনই বুঝতে পেরেছিলাম,
তুমি বড় নিরুপায়! বড় অসহায়!
বোধিবৃক্ষে সম্পর্কের সুতোটা তুমিই বেঁধে ছিলে,
সুতোর গেড়োটা নির্মম হাতে ছিঁড়তে হল তোমাকেই।
তুমি গণ্ডি এঁকেছিলে,
খড়িমাটির দাগটুকু আমাকেই চোখের জলে মুছতে হল।
একদিন আমাদের বাসর হয়েছিল আফ্রোদিতিকে সাক্ষী করে।
ভালোবাসার বাণী পড়ে, গলায় মঙ্গলসূত্র, অনামিকায় প্রমিস রিং পরিয়েছিলে তুমি।
আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম, নিষিদ্ধ প্রেমে অভিশাপ থাকে!
তাইতো, দেবী আফ্রোদিতিও শেষতক আমাদের বাঁচাতে পারলেন না।
আগামীতে আমাদের জীবনে এমন হাজার–কোটি রবিবার আসবে, যাবে…
হাজারো প্রেমিক–প্রেমিকা মিলিত হবে এইসব রবিবারে।
কেবল, আমাদের জীবনের শেষ রবিবারটা
অভিশপ্ত হয়ে থাকলো প্রেমের ইতিহাসে!
এই শহর জানে, আমরা কী তুমুল প্রেমে পড়েছিলাম!
সেইসব দিনের কথা কী চাইলেই ভোলা যায়, বল?
দু’দুটো দশক একে–অপরকে কেমন যাপটে–জড়িয়ে বেঁচে ছিলাম আমরা।
আমাদের প্রেমে পড়ার কোন যুক্তি ছিল না।
কিন্তু সেই অযৌক্তিক ঘটনাটাই অবশেষে ঘটে গেলো।
দেখা হলে, তুমি কাজ–অকাজের নানাবিধ বিষয় নিয়ে গল্প জুড়তে।
খুঁজে–খুঁজে, নামকরা লেখকদের বই এনে আমায় পড়তে দিতে।
একসময় তোমার সাথে কথা বলা, আমার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেলো।
এক শীতের শুরুতে, আমার জন্মদিনে, তোমার পাঠানো ফুল এলো,
একদিন, আমার দরজায় তুমি নিজে এসে দাঁড়ালে।
প্রথম অভিসারে, রেস্টুরেন্টের নিরালা–কোনে, তুমি আলগোছে আমার হাত দুটো ছুঁয়েছিলে।
বার’কয়েক তোমার দ্বিধান্বিত ঠোঁট ছুঁয়ে ছিল আমার হাত।
রোমান্সের উত্তেজনায়, পার্ক করা গাড়ির হদিশ দু’জনেই ভুলে গিয়েছিলাম।
রাতের আলো–আঁধারিতে, ডাউনটাউনের কানাগলিতে, গাড়িটি আমাদের অপেক্ষায় নিশ্চুপ বসেছিল।
গাড়ি খুঁজে পাওয়ার আনন্দে, তুমি টুপ করে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়েছিলে,
সেই প্রথম!
তারপর কত হাজার কোটি বছর কেটে গেছে,
আমাদের মনে নেই।
গ্রীষ্ম শেষ হয়ে হেমন্তের পাতাঝরার দিন এসেছে,
বর্ষার ঝরঝর বৃষ্টি, বরফঝরা তীব্র শীতেও আমরা প্রেমের উষ্ণতা অটুট রেখেছি।
প্রতিবার, নতুন জীবনের উন্মাদনা নিয়ে, বসন্ত ফিরে এসেছে আমাদের শহরে।
আমরা বুঁদ হয়েছিলাম নিজেদের মাঝে!
কত তপ্ত দুপুরে তোমার তপ্ত ঠোঁটের চুমুতে আমার ঠোঁট পুড়েছে,
কত হাজার বার তুমি আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছো আমার মাঝে,
তার কী কোন হিসেব আছে, তুমি বল?
আমরা বড্ড বেহিসেবী প্রেম করেছি।
বড় বেপরওয়া ঘুরে বেরিয়েছি।
সাগরে, সৈকতে, হাটে, মাঠে, রাস্তায়, পার্কে, গাড়িতে, কোথায়–কোথায় না চুমু খেয়েছি আমরা!
এই শহর জানে সেইসব ইতিহাস।
এই শহর জানে, আমরা কী তুমুল প্রেমে পড়েছিলাম!
পূর্বপুরুষদের আদিবাসস্থান বিক্রমপুর। জন্ম পুরানো ঢাকায়।
ইন্টারমিডিয়েট ঢাকা ইডেন কলেজ। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশনার বিবরণ:
প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচটি। প্রকাশিত উপন্যাস তিনটি।
১।আমি কাদম্বরী
২।এক মোহনার জীবন
৩।বুকের গহীনে কীর্তনখোলা
প্রকাশিত গল্পসংকলন দু’টি।
১।চিলেকোঠার চড়ই পাখী
২।আবর্তন
২০২০সালে প্রকাশিত গল্পসংকলন আবর্তন “সমরেশ বসু সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করে।
লেখক দীর্ঘদিন ধরে নিউইয়র্কে সপরিবারে বসবাস করছেন।